অদ্ভুত গাছ বাওবাব
চিত্র-বিচিত্র মঈন উদ্দিন জুলাই ২০২৪
বাওবাব নামের এক ধরনের গাছ রয়েছে, যা কাণ্ডে কয়েক লক্ষ লিটার পানি ধারন করে রাখতে পারে। তালগাছের মতোই খাড়া লম্বা এই গাছ উচ্চতায় ৫ থেকে ৩০ মিটার। দেখে মনে হবে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাওবাব গাছটির বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাডানসোনিয়া ডিজিটাটা। আঞ্চলিক ভাষায় এটি বব, বোবোয়া, বোতল গাছ এবং উল্টানো গাছ হিসেবেও পরিচিত। আরবিতে গাছটি বু-হিবাব নামে পরিচিত, যার অর্থ অনেক বীজযুক্ত গাছ।
এই ধরনের গাছ সাধারণত আফ্রিকার শুষ্ক অঞ্চলে দেখা যায়। গাছটি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় মেসিনা নামক অঞ্চলে। তাই মেসিনাকে বলা হয় দ্য বাওবাব টাউন। আফ্রিকা মহাদেশের মাদাগাস্কার দেশের এফেট্টি শহরে বহু শতাব্দী প্রাচীন এই গাছ রয়েছে, যে গাছের নাম দেওয়া হয়েছে ‘টি-পট বাওবাব’। কারণ কাণ্ডের সাথে চায়ের কাপের অদ্ভুত মিল রয়েছে। গাছটির বয়স আনুমানিক ১,২০০ বছর। অস্ট্রেলিয়ায় একে বলে দ্য প্রিজন ট্রি। মানে জেলখানা গাছ!
নয়টি প্রজাতির গাছের মধ্যে ৬টি প্রজাতিকে দেখা যায় মাদাগাস্কায়। দুটি গাছের দেখা মেলে আফ্রিকা আর আরবে। বাকি একটি অস্ট্রেলিয়ায়।
সব গাছের আকার এক রকম হয় না। এদের আকার নির্ভর করে এলাকা ও প্রজাতির ওপরে। সবচেয়ে বড়ো গাছটি রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার লিনপোপো প্রদেশের একটি খামারে। উচ্চতা ৪৭ মিটার আর ব্যাস ২২ মিটার। এর নাম সানল্যান্ড বিগ বাওবাব।
মাদাগাস্কারে এই গাছের ৬ রকমের প্রজাতি রয়েছে। এদের কাণ্ডের রং ধূসর-বাদামি থেকে লাল পর্যন্ত হয়ে থাকে। গাছগুলোর ডালপালা ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত বোতাম বা নলাকার শঙ্কুর আকারে থাকে।
বাওবাব গাছটিকে দেখলে মনে হবে এর কাণ্ড নিচে আর শিকড় ওপরে। গাছটিতে বছরে মাত্র ৬ মাস পাতা থাকে। এই গাছে ৫টি পাপড়ি বিশিষ্ট ফুলও ধরে। ফুলের রং বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে যেমন- লাল-হলুদ-সাদা।
খুব রুক্ষ মাটিতেও এই গাছ জন্মায়, বাড়ে এবং ফল-ফুল ধরে। এরা দীর্ঘজীবী। এক একটি গাছের বয়স প্রায় ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার বছর। এই গাছের গুঁড়ি এতটাই লম্বা যে এতে প্রায় ৩২ হাজার গ্যালন পানি ধরে। সেই কারণেই এরা রুক্ষ মাটিতে খুবই সতেজ থাকে এবং দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে।
মাদাগাস্কারের বাওবাব গাছের কোটরে একসময় সেখানকার আদিবাসীরা বসবাস করতো। আর অস্ট্রেলিয়ার বাওবাবগুলো ব্যবহার হতো আরো বৈচিত্র্যময় কাজে। সেখানকার অধিবাসীরা কারাগার হিসেবে ব্যবহার করতো বাওবাবের প্রকাণ্ড খোঁড়ল। কোনো কোনো কোটরে ২০-২৫ জন বন্দিও ধরে যেত! এজন্য এদের নাম বাওবাব প্রিজন ট্রি!
বাওবাব গাছটি খুবই উপকারী। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাওবাব গাছটি কাণ্ডের মধ্যে ১,১৭৩৪৮ লিটার পানি ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে। আফ্রিকার স্থানীয় মানুষ এই প্রজাতির গাছগুলো ব্যবহার করে থাকে।
এই গাছগুলোর পাতা ভোজ্য হয়। গাছের পাতা সবুজ এবং চকচকে। এতে প্রোটিন, খনিজ এবং ভিটামিন এ আর সি প্রচুর পরিমাণে থাকে। ফলে, মসলা এবং ঔষধ হিসাবে এই গাছের পাতা ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
গাছের ফলগুলো বড়ো আকারের হয়। একেকটির ওজন প্রায় দেড় কেজি। এদের ফল ১৮ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হয়। দেখতে অনেকটা নারকেলের মতো। ফল থেকে পাওয়া যায় পর্যাপ্ত শাঁস, যা বেশ সুস্বাদু খাবার। টক-মিষ্টি স্বাদের বাওয়াব ফল দুগ্ধজাত খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এই ফল বানরের খুব পছন্দের তাই এই ফলের আরেক নাম monkey bread। গাছের ফল থেকে এক ধরনের সতেজ পানীয় তৈরি করা হয়, যা ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
গাছের ছাল থেকে ফাইবার পাওয়া যায়। গাছের ছাল নরম, তন্তুযুক্ত এবং আগুন প্রতিরোধী হওয়ায় এই বাকল দিয়ে কাপড় এবং দড়ি, বাদ্যযন্ত্রের তার, জলনিরোধী ব্যাগ, এমনকি ছাতাও তৈরি হয়। আবার আফ্রিকার অনেক দেশে গাছগুলোর ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে।
গ্রীষ্মের শুরুর দিকে গাছে খুব বড়ো, সাদা ফুল দেখা দেয়। এগুলো বিকেলে পাপড়ি মেলে। সারা রাত ফুটে থাকার পর সকালে এরা ঘুমিয়ে পড়ে মাটির বুকে। সেই সময় মিষ্টি গন্ধ বের হয়।
প্রাণিকুলের হাত থেকে যথেষ্ট সুরক্ষিত এই গাছ। একমাত্র হাতিই পারে এদের ক্ষতি করতে। এক জাতের ছত্রাক রয়েছে এদের জন্য প্রাণঘাতী।
গত কয়েক দশক ধরে জলবায়ুর পরিবর্তন গাছগুলোর ওপর প্রভাব ফেলেছে। ২০০৫ সাল থেকে আফ্রিকার ১৩টি প্রাচীনতম গাছগুলোর ৯টি ধ্বংস হয়ে গেছে। এর সাথে আফ্রিকায় এই প্রজাতির যে ৬টি বৃহত্তম গাছ ছিল তার মধ্যে ৫টি ধ্বংস হয়ে গেছে।
আরও পড়ুন...