আনল ডেকে হেমন্তকে
ফিচার রবিউল ইসলাম অক্টোবর ২০২৪
সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?
আনল ডেকে মটরশুঁটি,
খেসারি আর কলাই ফুলে
আনল ডেকে কুয়াশাকে
সাঁঝ সকালে নদীর কূলে...
হেমন্ত নিয়ে লেখা সুফিয়া কামালের বিখ্যাত কবিতা। এই কবিতার সঙ্গে মিশে আছে আমাদের শৈশব ও কৈশোরের রঙিন রঙিন স্মৃতি। প্রতিদিন ভোরে পাঠশালায় সবাই সুরে সুরে পড়তাম এই কবিতা। তখন অদ্ভুত এক ভালো লাগা আমাদের মন ছুঁয়ে যেত।
আচ্ছা, তোমরা কি জানো পাঠশালা কী? আমি বলছি, আগে ভোরবেলা ছেলেমেয়েরা মিলে গ্রাম্য মাস্টারের কাছে পড়তে যেত। সেখানে চেয়ার-টেবিল থাকতো না। সবাই মাটিতে খেজুরপাতা, তালপাতা দিয়ে বোনা পাটিতে বসে লাইন ধরে পড়তো। পাঠশালার যিনি মাস্টার থাকতেন, তিনি সবাইকে কড়া শাসনে রাখতেন। পড়া না পারলে শাস্তি দিতেন। পাঠশালার সবচেয়ে মজা ছিল সুর করে নামতা পড়া, কবিতা পড়া...।
আহা! পাঠশালার সেই দিনগুলো আর নেই। তবে হেমন্ত আছে। হেমন্ত মিশে আছে বাংলার ঋতু বৈচিত্র্যের সঙ্গে। বাংলা ক্যালেন্ডারে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ- এই দুই মাস হেমন্তকাল। মানে শরতের শুভ্রতাকে বিদায় জানাতে আসে হেমন্ত। সহজ করে বললে শরৎকালের পরে আসে হেমন্ত, শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে। এ সময় বাংলাদেশের প্রকৃতিতে প্রগাঢ় সবুজ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় শীতের মিষ্টি আমেজ। হেমন্তের প্রকৃতি থাকে মিষ্টি সোনা রোদ মাখা। আকাশ ঢেকে থাকে নীলের শামিয়ানায়। এই ঋতুর শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় যেন মুক্তার মেলা বসে।
তাইতো কবি ফররুখ আহমেদ লিখেছিলেন-
হিম শির শির হেমন্ত মাঠ
কাঠুরিয়া যায় কেটে কাঠ
রাত্রিশেষে ঝলমলে দিন
বেড়ায় মাঠে সোনার হরিণ।
হেমন্তকাল ফসলের ঋতু। কার্তিক মাস দিয়ে এই ঋতু শুরু হয় এবং অগ্রহায়ণে শেষ হয়। অগ্রহায়ণ হলো পুরোপুরি ধান কাটার মাস। তখন ফসলের মাঠ, কৃষকের বাড়ি ভরে থাকে নতুন ধানের ঘ্রাণে। বাংলার মানুষের জীবনে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে অগ্রহায়ণ মাস। সঙ্গে আনে নবান্ন উৎসব।
তোমাদের জানিয়ে রাখি, অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থ বর্ষ শুরুর মাস। একসময় বাংলা নতুন বছর শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাস দিয়ে, তাই এ মাসের এমন নামকরণ।
অগ্রহায়ণের প্রথম দিনটিই বাংলাদেশে নবান্ন যাপনের দিন হিসেবে পরিচিত। দেশের প্রাচীন উৎসবগুলোর একটি নবান্ন উৎসব। নবান্নের শব্দগত অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধানের চালের প্রথম রান্না উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন। এ সময় গ্রামের ঘরে ঘরে পিঠা, পায়েস, মুড়ি-মুড়কি ও নতুন চালের ভাতের সুগন্ধে ভরে ওঠে মন।
সাধারণত, অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব হয়। নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য। নবান্ন উপলক্ষ্যে পাড়ায় পাড়ায় ঘরের দাওয়ায়, বাড়ির উঠোনে, রাস্তার মোড়ে, স্কুলের আঙিনায় সাপখেলা, বানরখেলা, লাঠিখেলার আসর বসে। গ্রামের মেলায়, হাটে পাওয়া যায় নানা স্বাদের খাবার। ছোটদের বাড়তি আনন্দ দিতে গ্রাম্য মেলায় দেখা যায় নাগরদোলা।
ফুলের সঙ্গে হেমন্ত ঋতুর মধুর সম্পর্ক আছে। এ সময় গাছের ডালে ডালে নানারকম ফুল ফোটে। হেমন্তের ফুলের কথা বলতে গেলে শিউলির কথা বলতে হয়। যদিও শিউলি শরতেও ফোটে। কিন্তু হেমন্তকেও রাঙিয়ে তোলে শিউলি ফুল। এই ফুলের কলিরা মূলত সন্ধ্যায় জগে ওঠে। তাই হেমন্তের রাত থাকে শিউলির ঘ্রাণে ভরপুর। শিউলির আবার আয়ু কম, ভোরেই ঝরে পড়ে।
হেমন্তের ফুলের কথা বললে এর পরেই আসে ছাতিমের কথা। ছাতিমকে হেমন্তের দূত বললে ভুল হবে না। উঠানের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছাতিম যেন শীতকে অভ্যর্থনা জানায়। হালকা সবুজাভ সাদা রঙের ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে।
দেবকাঞ্চন ও হিমঝুরি এই ঋতুর অন্যতম ফুল। যদিও হিমঝুরির দেখা পাওয়া বেশ কঠিন। এছাড়া গন্ধরাজ, মল্লিকা, রাজ-অশোক, বকফুল, কামিনী- এই ফুলগুলোও হেমন্তে দেখা যায়।
একটা প্রশ্ন করি তোমাদের- তোমরা বরই গাছ দেখেছ? কেন এই প্রশ্ন করলাম জানতে চাও? কারণ বরইগাছে ফুল আসে হেমন্তের শুরুতে। তখন সেই ফুলে বসে মৌমাছির মেলা। সারাদিন শোনা যায় গুনগুনানি গান। বরইয়ের ফুলের কিন্তু এক প্রকার গন্ধ আছে। বেশ মিষ্টি সেই গন্ধ! তোমরা যারা গ্রামে থাকো, তারা নিশ্চয়ই এটা খুব ভালোভাবেই জানো।
কাজী নজরুল ইসলামকে তো তোমরা চেনোই? আমাদের জাতীয় কবি তিনি। হেমন্ত নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
উত্তরীয় লুটায় আমার
ধানের খেতে হিমেল হাওয়ায়
আমার চাওয়া জড়িয়ে আছে
নীল আকাশের সুনীল চাওয়ায়
ভাটির শীর্ণা নদীর কূলে
আমার রবি-ফসল দুলে
নবান্নেরই সুঘ্রাণে মোর
চাষির মুখে টপ্পা গাওয়ায়।
কবি মোশাররফ হোসেন খান বলেন-
হেমন্তের হাওয়া-
সেতো আমার বোনের নোলাক
নতুন চালের ভাতের বোলাক
আপন করে পাওয়া।
ফলের দিক দিয়ে হেমন্ত ঋতু বেশ কৃপণ। এ ঋতুর বিশেষ কিছু ফল হলো- কামরাঙা, চালতা, আমলকী ও ডালিম।
আগেই বলেছি, হেমন্ত ছিল আমাদের শৈশব ও কৈশোরের রঙিন ঋতু। এখনো আছে হেমন্ত। কিন্তু তোমরা যে হেমন্তকে উপভোগ করো তার সঙ্গে আগের হেমন্তের কিছুটা তফাত আছে। তোমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, কেন এই তফাত? এই প্রশ্নের উত্তর হলো- প্রকৃতি সবসময় বইয়ের পাতার মতো হয় না। জলবায়ু পরিবর্তনে পালটে গেছে ঋতু পরিবর্তনের আবহমানকালের পাণ্ডুলিপি।
এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, তোমরা যারা ঢাকা কিংবা কোনো বিভাগীয় শহরে বাস করো, তারা শুরুতে হেমন্তের কোনো ছোঁয়া পাও না। কিন্তু দেশের উত্তরের জেলাগুলোতে হেমন্ত আসতে না আসতেই যেন শীত নামে। শুধু কি শীত নামে? না, বরং রাতে টিপটিপ করে বৃষ্টির মতো কুয়াশা ঝরে। ভোর পর্যন্ত কুয়াশায় ছেয়ে থাকে উত্তরবঙ্গের নানা জেলা। ভিজে যায় পিচঢালা পথ। গাছের পাতা, ধানের খেত আর ঘাস চকচক করে রাতের ঝরা শিশিরবিন্দুতে। এটাই হলো হেমন্তের চিরাচরিত সৌন্দর্য।
মহান আল্লাহ তায়ালা এই পৃথিবীকে আমাদের জন্য সাজিয়েছেন। প্রকৃতিতে দান করেছেন অসংখ্য নিয়ামত। তেমনই একটি নিয়ামত এই হেমন্ত ঋতু। কিন্তু আমরা কী করছি? সেই প্রকৃতিকে ধ্বংস করে ফেলছি! গাছ কেটে বন উজাড় করছি! এতে কী হচ্ছে? বদলে যাচ্ছে আমাদের প্রকৃতি। ধেয়ে আসছে নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ! অথচ আমরা আল্লাহর নিয়ামত ধ্বংস করলেও বিপদে তিনিই আমাদের রক্ষা করছেন।
তাই আমাদের দায়িত্ব হলো এই প্রকৃতিকে রক্ষা করা। এসো সবাই মিলে প্রকৃতির পাশে দাঁড়াই। অন্তত একটি গাছ রোপণ করি। এই হোক নতুন দিনে আমাদের নতুন অঙ্গীকার। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তায়ালা এজন্য আমাদের উত্তম প্রতিদান দেবেন।
আরও পড়ুন...