আমাদের স্বাধীনতা
প্রচ্ছদ রচনা ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ মার্চ ২০২৪
স্বাধীনতা। আহ্! আমাদের প্রাণের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা চায় না এমন কেইবা আছে? সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটিও স্বাধীনতা চায়। তার স্বাধীনতায় বাধা আসলেই কেঁদে ওঠে। জানিয়ে দেয়- আমার স্বাধীনতা চাই। আস্তে আস্তে একটু একটু করে বুঝতে শেখে। স্বাধীনভাবে নিজের অধিকার চায়। একা একা হাঁটতে চায়। সবকিছু ধরতে চায়। বড়ো কিছু করতে চায়।
কৈশোরে পা দিলেই নিজেকে সেরা মানুষ ভাবতে ভালো লাগে। সবকিছু ইচ্ছে মতো করতে মন চায়। নিজের বুঝটাকেই সেরা মনে হয়। সেই ভাবনায় বাধা এলেই স্বাধীনতা সংকটে ভোগে। তারুণ্য এবং যৌবনে পা দিলে তো আর কোনো কথাই নেই। সবকিছু জানা এবং বোঝার সক্ষমতা প্রমাণ করতে ইচ্ছে করে। পাখির মতো উড়তে ইচ্ছে করে। সমাজের সকলের চেয়ে ভিন্নভাবে ঘুরতে ইচ্ছে করে। পরম মমতায় আব্বা-মা তার পাশে থাকে। অথচ কোনো কাজে বারণ করলেই মনে হয়- আমার স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। ভালোভাবে কোনো বিষয়ে নিষেধ করলেও কষ্ট লাগে। মনে হয় আমার কোনো স্বাধীনতাই নেই।
মূলত শিশু থেকে শুরু করে কিশোর, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ সকলেই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে। স্বাধীনতার সংকট হলে সকলেই বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মানুষ মাত্রই স্বাধীনতার দাবিতে অনড় থাকে। কবি রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় তাঁর ‘স্বাধীনতা’ কবিতায় সুস্পষ্টভাবে বলেছেন,
স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায়।
শুধু মানুষ নয়। পশু-পাখিরাও স্বাধীনতা চায়। খাঁচাবন্দি জীবনকে পছন্দ করে না তারাও। মুক্ত আকাশে উড়তে চায়। ইচ্ছে মতো ঘুরতে চায়। পৃথিবীর এই সমীকরণে স্বাধীনতার চাওয়াটাই বাস্তবসম্মত বিষয়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা কী? ইচ্ছে মতো সবকিছু করার নামই কি স্বাধীনতা? স্বাধীনতা মানে কি নিজেকে সীমার বাইরে নিয়ে যাওয়া? না। তা নয়।
তাহলে স্বাধীনতা কাকে বলে? অন্যের কাজে বাধা সৃষ্টি করে নয়, মূলত নির্ধারিত নিয়মের ভেতরে নিজের মৌলিক অধিকার সহজভাবে পাওয়ার নামই স্বাধীনতা। অধ্যাপক ল্যাক্সি মনে করেন, ‘স্বাধীনতা হলো সেই পরিবেশের সযত্ন সংরক্ষণ, যে পরিবেশে মানুষ তার ব্যক্তিসত্তাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে।’ তাই তো স্বাধীনতার বিপরীত দিকটাই হচ্ছে পরাধীনতা।
আমরা স্বাধীনচেতা মানুষ। এই বাংলার মানুষ স্বাধীনতা নিয়েই বাঁচতে চেয়েছে সবসময়। হাজার বছরের ইতিহাসে আমরা বারবার বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি, তবুও ভেঙে পড়িনি। স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ লড়াই করেছি। ইংরেজদের হাত থেকে নিজেদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্যও অনেক লড়াই সংগ্রাম করেছি। মীর নিসার আলী তিতুমীর স্বাধীনতার জন্য বাঁশের কেল্লা গড়েছিলেন। ইংরেজদের হাতে শহীদ হয়েও প্রমাণ করেছেন জীবনের চেয়ে স্বাধীনতার মূল্য অনেক বেশি। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীসহ অসংখ্য উলামা শহীদ হয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজী। তাঁর পুত্র মোহসীনউদ্দিন আহমদ দুদু মিয়াও স্বাধীনতার জন্য সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন। অবশেষে ব্রিটিশ বিদায় নিয়েছে ১৯৪৭ সালে। সৃষ্টি হয়েছে পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আমরা স্বাধীন হয়েও নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছি। বাংলাভাষা চর্চা নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। তাই তো ভাষা আন্দোলন হয়েছে ১৯৫২ সালে। শুরু হলো অধিকার আদায়ের ধারাবাহিক আন্দোলন। সেই ধারাবাহিকতায় এসেছে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণা আসে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাকিস্তানিদের পরাজিত করে স্বাধীন পতাকা অর্জন করেছি। দীর্ঘ নয়মাস মরণপণ যুদ্ধ করতে হয়েছে এই স্বাধীনতার জন্য। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমরা বিজয় অর্জন করেছি।
আমরা স্বাধীনতা এনেছি। স্বাধীনতা এনেছি আমাদের ব্যক্তিত্ব ও জীবনকে পূর্ণভাবে বিকশিত করার জন্য। জীবন ধারণের মতো মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য। সকল মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের জন্য। ব্যক্তি স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য। আইনের শাসন জনগণের স্বাধীনতার অন্যতম রক্ষাকবচ। আইনের শাসন বলতে আমরা বুঝি আইনের প্রাধান্য। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে আইন সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। বিনা বিচারের কাউকে আটক রাখা যাবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা আইনের শাসনের অন্যতম শর্ত। যে সমাজে আইনের শাসন কার্যকরী থাকে, স্বাধীনতা সেখানে পূর্ণমাত্রায় বিরাজ করে। আইন সবার জন্য সমান। প্রত্যেক নাগরিক আইনের চোখে সমান অধিকার পাবে। এখানে কোনো পক্ষপাতিত্ব থাকবে না। আইনের মারপ্যাঁচে কেউ নাকাল হবে না। সেই আইনের শাসনের জন্য আমাদের স্বাধীনতা।
মানুষ স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করবে। সেই মতামত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি। সভা-সমিতির মাধ্যমে একজন নাগরিক নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে। মতামত প্রকাশ করতে পারে মিডিয়ার মাধ্যমে। নির্ভিকভাবে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করার মধ্যদিয়ে সংবাদ পত্রের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত হয়। আমরা স্বাধীনতা এনেছি সেই অধিকার নিশ্চিত করার জন্য।
আমার সম্পদ আমি ন্যায়সঙ্গত উপায়ে স্বাধীনভাবে উপভোগ করতে চাই। স্বাধীনভাবে নিজের সম্পত্তি বিক্রয় এবং অন্যের সম্পত্তি ক্রয় করতে চাই। সেই অধিকার সঠিকভাবে নিশ্চিত করার জন্য আমরা স্বাধীনতা এনেছি। প্রত্যেক নাগরিক স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকার চায়। শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় কার্যকলাপ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনে কোনো বাধা-বিঘœ থাকবে না। স্বাধীনভাবে নিরাপদে ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছি।
পরিবার হচ্ছে সমাজের মূল ভিত্তি। পরিবার নিয়ে পাড়া, পাড়া নিয়েই গ্রাম বা মহল্লা। সেই গ্রাম বা মহল্লা নিয়েই ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড। ওয়ার্ড নিয়ে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশন। ইউনিয়ন নিয়ে উপজেলা। উপজেলা নিয়ে জেলা, জেলা নিয়ে বিভাগ এবং বিভাগ নিয়ে একটি দেশ। দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট হচ্ছে পরিবার। প্রত্যেক নাগরিকের পরিবার গঠনে ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রয়োজন। সেই অধিকার নিশ্চিত করতেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। প্রত্যেক মানুষকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অপরিহার্য। চিকিৎসা এবং শিক্ষা প্রতিটি মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। এই শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের প্রতি রাষ্ট্রের তীক্ষè দৃষ্টি পাওয়ার জন্য আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
মত প্রকাশের ভালো মাধ্যম ভোট দেওয়া। রাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক নাগরিকের ভোটাধিকার রয়েছে। সঠিকভাবে নিরাপদে নির্বিঘেœ ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ তৈরির জন্য আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন। রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের যোগ্যতা অনুযায়ী যে-কোনো পদে প্রার্থী হবার ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের নাগরিকগণ তাদের যে-কোনো অভাব-অভিযোগের কথা সরকারের নিকট পেশ করতে পারবে। বিদেশে গেলেও নিরাপত্তার জন্য নিজের রাষ্ট্রের সাহায্য দাবি করতে পারে। প্রত্যেক নাগরিকের নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী রাষ্ট্রের অধীনে সরকারি চাকুরি লাভের অধিকার রয়েছে। প্রত্যেক নাগরিক দেশের যে-কোনো স্থানে নিজ ইচ্ছানুযায়ী বসবাস করতে পারে। এই সকল অধিকার নিশ্চিত করার জন্যই ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ; আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
কাজ করে খাওয়া সকল নাগরিকের অধিকার। যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাওয়া ও কাজ করার ক্ষমতাকে কর্মের অধিকার বলে। এ অধিকার বলবৎ থাকার কারণে সরকারের ওপর বেকার ভাতা দেবার কর্তব্য বর্তায়। কর্মের অধিকার তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন ন্যায্য মজুরি দেওয়া হয়। মজুরি এমনভাবে দিতে হবে যেন তা কাজের মান, দায়িত্ব ও পরিমাণের সাথে সংগতিপূর্ণ হয়। কাজের সময়সীমা নির্ধারণ এবং কাজের শেষে অবকাশ-বিনোদনের ব্যবস্থা করাকে অবকাশ লাভের অধিকার বলে। এ সকল অধিকারে কালো হাতের থাবা বসেছিল বলেই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া।
শ্রমিকরা দেশের উন্নয়নের প্রাণশক্তি। শ্রমিকের হাত দেশের অর্থনীতির আশির্বাদ। সেই শ্রমিকেরা শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হয়। মালিকের হাতে শ্রমিক নির্যাতিত হয়। শ্রমিক অধিকার বঞ্চিত হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছেও। অথচ শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত না হলে দেশের উন্নয়নই সম্ভব নয়। তাই শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতেই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সেই হিসেবে আত্মবিকাশের জন্য মানুষের প্রয়োজন স্বাধীনতা। প্রয়োজন নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা। সাধারণভাবে এ সকল সুযোগ-সুবিধাকে অধিকার বলা হয়। মানুষ সমাজে কতটুকু অধিকার পায়, কতটুকু পাওয়া উচিত প্রভৃতির ওপরই সমাজের পরিবর্তন ও উন্নয়ন নির্ভর করে। অধিকার ভোগ ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই নাগরিক জীবন সুন্দর ও সার্থক হয়ে ওঠে। সেই সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা পূরণের জন্যই রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এনেছি।
বাংলাদেশ আমাদের স্বপ্নভূমি। দেশ ও জাতির কর্ণধার তরুণ ও যুবশক্তি। কিশোর সমাজে নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয় মানেই দেশ ও জাতি নিমজ্জিত হবে অধঃপতনের অতল তলে। এ দেশের সত্যিকারের স্বাধীনতার জন্য তাই আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
মাদকের ভয়াবহ ছোঁবল থেকে মুক্ত হয়ে ক্যারিয়ার গঠনে মনোযোগী হতে হবে। বিশ্বায়নের চোখ ঝলসানো চমক ও অপসংস্কৃতির মায়াজাল ছিন্ন করে নৈতিক-চরিত্র গঠনে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পূর্ণবাস্তবায়নে নিজেদেরকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। আল্লাহভীতি সৃষ্টি করতে হবে। পরকালীন মুক্তিচেতনা তরান্বিত করতে হবে। সুস্থ সংস্কৃতি ও বিনোদন চর্চায় এগিয়ে আসতে হবে।
সর্বোপরি ভালো বন্ধু নির্বাচন করে পথ চলতে হবে। বন্ধু নির্বাচন সম্পর্কে মহানবী (সা) বলেন, ‘সৎ সঙ্গ ও অসৎ সঙ্গের উপমা হচ্ছে সুগন্ধি বিক্রেতা ও কামারের হাপরে ফুঁক দানকারীর মতো। সুগন্ধি বিক্রেতা হয়তো এমনিতেই তোমাকে কিছু সুগন্ধি দিয়ে দেবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে কিনে নেবে কিংবা যদি নাও দেয়, তুমি তার কাছ থেকে সুঘ্রাণ অবশ্যই পাবে। আর কামারের হাপরের ফুলকি তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পুড়িয়ে দেবে অথবা তুমি তার নিকট থেকে দুর্গন্ধ অবশ্যই পাবে।’
আমাদের প্রাণের স্বাধীনতা রক্ষায় আমরাই হবো নতুন প্রজন্মের স্বাধীনতা সংগ্রামী।
‘বুকের ভেতর স্বপ্নবাগান ফুল-ফসলের চাষ
স্বাধীন স্বদেশ গড়তে করি চেষ্টা বারো মাস।’
আরও পড়ুন...