ইমি ও তার মেঘের চারা

ইমি ও তার মেঘের চারা

গল্প খায়রুল আলম রাজু নভেম্বর ২০২৪

ইমিদের সুন্দর দোতলা বাড়ি। শহরের বড়ো সড়কের পাশে সবুজের বুক চিরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ইমিদের বাড়িতে নীতু এক সপ্তাহ হলো এসেছে। সবুজ ছোট্ট এক গ্রাম থেকে। ইমির বয়স ছয় বছর। সারাক্ষণ এ-ঘর-ওঘরে  ছোটাছুটি করে। ছাদে যায়, নিচের বাগানে যায়, বাড়ির পেছনের পুকুরে যায়।


ভীষণ দস্যি এক মেয়ে! ইমির মা থাকেন ঘরের কাজে ব্যস্ত। ইমিকে চোখে চোখে রাখতে হয়। নীতুকে তাই আনা হলো ইমির দেখাশোনা ও তার সাথে খেলাধুলা করার জন্য। যদিও নীতু এত বড়ো না, দশ বছরের মেয়ে কিন্তু খুব দায়িত্বশীলা। 


আজ খুব সকালে  দোতলা বারান্দার এককোণে নীতু দেখলো, রঙিন নতুন চারটি ফুলের টব। একটা চকচকে হলুদ, একটা গাঢ় সবুজ, একটা হালকা খয়েরি এবং একটা কুচকুচে কালো রঙের। টবগুলো  ইমির বাবা অফিস থেকে ফেরার সময় এনেছেন। নীতু টবগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে বড়ো সড়কের দিকে তাকালো। খানিকক্ষণ পর চোখ রাখলো, বাড়ির ছাদ ঘেঁষে বিস্তীর্ণ বড়ো একটা বাগান বিলাস গাছটায়। গাছটা কী সুন্দর বেয়ে উঠেছে মাটি থেকে ছাদ অবধি! পাতার ভিড়ে রঙিন ফুলগুলোও চমৎকার! বাড়ির মাঝখানে সরুপথ। দু’পাশে বাগান। তারপর গেইট। গেইটটা খুললেই বড়ো রাস্তাটা। কত-শত গাড়ির আসা-যাওয়া।


‘নীতুপা, ও নীতুপা, আজ গল্প শোনবে না?’ ইমি নীতুকে নীতু আপা বলার বদলে নীতুপা ডাকে। ইমির ডাকে নীতু গল্প শুনবো বলে ইমিকে নিয়ে ছাদে গেল। ছাদের দোলনায় বসে ইমি শুরু করলো, ডানাঅলা এক মাছের গল্প। সোনা রঙের সেই মাছটির পরীর মতো দুইটা ডানা। সাদা বকপাখির মতো সেই মাছটি উড়তে পারে। বর্ষার দিনে ডানাঅলা মাছটি মেঘের দেশে ঘুরে, আকাশে ভেসে থাকা মেঘ খায়। রাত্রি হলে জোছনার আলো খেতো মাছটা। আরও কত কী অদ্ভুত মজার কাণ্ড করতো।


ডানাঅলা মাছের পর শোনালো, জোছনার জিলাপির গল্প। যে জিলাপি বানানো হয় চাঁদের ধবধবে সাদা জোছনার আলো দিয়ে। চাঁদের কুঁজো বুড়ি মা সেই জিলাপি পরীদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন। ইমি বোকা তারার গল্প, একহালি চাঁদের গল্প, কলার সমান মানুষের গল্প, অদ্ভুত কত রকমারি রূপকথার গল্প জানে। ওসব ইমির দাদুর মুখে শোনে শোনে মুখস্থ করেছে। গল্প বলতে বলতে ইমি থেমে গেল। সে বললো, ‘নীতুপা, তুমিও একটা গল্প শোনাও।’


নীতু হাসলো। শব্দ বিহীন সেই হাসিটা ভীষণ চমৎকার! সাতদিনে এই প্রথমবার হাসল নীতু। এতদিন মুখে দুঃখী দুঃখী একটা ছাপ নিয়ে কী সব যেন ভাবতো মেয়েটা। মনে হয় হাসির খুশিতে সেই ছাপটা মুছে গেছে আজ। নীতু বললো, ‘ইমি, আমি তোমার মতো এতসব মজার গল্প জানি নে বোন! তবে আমার ছবির মতো সুন্দর সবুজ গাঁয়ের গল্প জানি। যেখানে হীরের মতো বৃষ্টি হয়। কলকলিয়ে নদী বয়। নদীর বুকে ছোট-বড়ো ঢেউ ওঠে। শরতের দিনে ধবধবে সাদা কাশফুলে ভরে যায় নদীর দুই পাড়। নবান্ন উৎসব, বৈশাখী মেলা, বর্ষার জলধারায় কেমন সবুজে সেজেগুজে ওঠে আমার গ্রাম।’


ইমি বলে, ‘নীতুপা, তোমার গ্রামের নাম কী?’


‘রানী গাঁও, পথে পথে সারি সারি উঁচু-নিচু গাছ। পায়ের নিচে ঘাস, সবুজ আর ঘন। সবুজ ফসলি ধানক্ষেত, সবজি ক্ষেত, তাল-সুপারির গাছ, আছে আধপাকা ঘরবাড়ি, একটা-দুটো কুঁড়েঘর কত কী! দিনের শুরুতে কুসুমরাঙা সূর্য উঠলে জেগে ওঠে পাখিরা, পাখিদের সাথে জেগে ওঠে পুরো গ্রাম; আর তাতে ঘুম ভাঙে গ্রামের মানুষদের। লাঙল, কাস্তে, কোদাল, কুড়াল হাতে সবাই আপন আপন কাজে ব্যস্ত রয়। পশ্চিম আকাশে সূর্য যখন সমস্ত আলোর বাতি নিভিয়ে সন্ধ্যাকে স্বাগত জানায়, ঠিক তখন পিদিম হয়ে আকাশ পাড়ে ফুটতে থাকে একটা-দুটো তারা।  নিবুনিবু তারার ভিড়ে রাত্রিভর জোছনা বিলায় ডাবের মতো চাঁদ।’


ইমি অদ্ভুতভাবে নীতুর দিকে চাইলো, ‘নীতুপা, রূপের গুণে তোমার গ্রাম ঠিক রূপকথার গল্পের মতো। এজন্যই বুঝি তোমার গ্রামের নাম রানী গাঁও?’


নীতুও হাসলো, নামকরণের গল্পটা সে নিজেও জানে না, হয়তো নাম নিয়েও মজার কোনো গল্প থাকবে। শহুরে জীবনে এসব সোনালি দিন ইমির নেই। পাখি ডাকা ভোর নেই, শিশির ভেজা ঘাস নেই, ঘুড়ি উড়ানোর বিকেল নেই; একদুপুর নদীর জলে সাঁতরে কিংবা পুকুরে ডুবে গোসল করে কাটায়নি কোনো দিন। বন-বাদাড়ে পাখির খোঁজে সকালকে গড়ায়নি দুপুরের কাঁটায়। নীতুর রঙিন রঙিন এসব গল্পে ইমি রূপকথার স্বাদ পায়। মনে মনে অবাক হয়! গল্প বলতে বলতে নীতু হঠাৎ থেমে গেল। দুঃখী একটা মলিন ছাপে ঢাকা পড়লো সুন্দর হাসিটা। ইমি বলে, ‘নীতুপা, মন খারাপ?’


‘না বোন, বাবা আর মা’র কথা মনে পড়লো। সে বার যখন চৈত্র মাসে তীব্র গরম আর খরায় মাটি ফেটে চৌচির হলো, তাতে আমাদের ধানক্ষেতে ভালো ফলন হয়নি। বোরো ধানের ফলন হলে আমাকে এখানে আসতে হতো না। তুমি তো ছোট তুমি জানবে না, চৈত্র মাসের পর বৈশাখে বোরো ধান ঘরে তোলা হয়। বোরো ধানের ভালো ফলনের জন্য চৈত্র মাসের শেষের দিকে বৃষ্টির দরকার। কিন্তু সেবার ছিল তীব্র খরা। খরায় মাটি ফেটে চৌচির, ধানের জমিতে বড়ো বড়ো গর্ত। মাটি হলো রসহীন। এতে ফলন হলো অল্প। জানো, বাবার না বড্ড লোকসান হলো। ধারদেনা করে চাষ করা ফসলে আমরা হলাম ঋণগ্রস্ত। ঘরের খাবারে কমতি হলো, গোয়ালঘরের বড়ো দুটো গাভী গরু বিক্রি করা হলো আর আমি আসলাম তোমাদের এখানে! নীতুর চোখ পানিতে ছলছল করে। দুফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। ইমি নীতুর অশ্রু মুছতে মুছতে বললো, ‘নীতুপা, কেঁদো না, কেঁদো না গো প্লিজ!’


নীতুর দুঃখে এত্তোটুকুন ইমির মনে দাগ কাটলো! ভেতরে ভেতরে মনে-মনে সেও কান্না করলো তার প্রিয় খেলার সাথী নীতুপার জন্য। কান্না লুকিয়ে মিছেমিছি হেসে বললো, ‘নীতুপা, এইবারও বুঝি তোমরা বোরো ধান চাষ করবে?’


‘হ্যাঁ গো বোন, আমন ধানে মোটামুটি ফলন হয়েছে। এইবারও বোরো ধান চাষ করা হবে। কী যে হয়, আল্লাহ জানেন।’


ইমি বড়োদের মতো করে সাহস ও অভয় দিয়ে বললো, ‘নীতুপা, এইবার অনেক অনেক বেশি ফলন হবে। বোরো ধানে ভরে উঠবে তোমাদের বাড়ির উঠোন, তুমি দেখে নিও আমি বললাম।’


ইমির কথায় খুশিতে ইমিকে জড়িয়ে ধরে নীতু হাসলো। সুখের হাসি। মৃদু বাতাসে যেন সেই হাসির খুশি পৌঁছে যায় দূরের রানী গাঁয়। ছাদ থেকে নামতে নামতে ইমিকে নীতু বলে, ‘তুমি যেমনটা বললে তাই যেন হয়। ঠিকঠাক সময়মতো বৃষ্টি হলেই হলো।’


রাতে ঘুমোনোর সময় ইমি তার মাকে বলে, ‘মা, মেঘ কী গো, বৃষ্টি কাকে বলে?’ 


মেঘ ও বৃষ্টির বড়ো আর বৈজ্ঞানিক কঠিনতম সংজ্ঞা তো আর ইমি বুঝতে পারবে না, তাই ইমির মা ইমির চুলে বিলি কাটতে কাটতে সহজ ভাষায় বোঝানোর জন্য বলেন, ‘আকাশে সাদা সাদা তুলোর মতো যে বস্তু ভাসতে দেখা যায় তাই মেঘ। আর আকাশে ভাসতে থাকা সেসব মেঘ যখন ফোঁটা ফোঁটা আকারে মাঠ-মাটিতে ঝরে পড়ে তাই বৃষ্টি।’ মেঘ বৃষ্টির কথা শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে ইমি।


গাড়ির হর্ন আর কোলাহলে সকালে জেগে ওঠে ইমি। নিচতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠে। দোতলার বারান্দা থেকে চকচকে হলুদ টবটা নিয়ে নিচতলায় নেমে আসে। বাড়ির উঠোনে ঘরের প্রবেশ পথের পাশে বাগান বিলাস গাছটির নিচে মাটি ভর্তি নতুন টবটা রেখে নিজের ঘরে যায় ইমি। খেলনাপাতি ভরা একটা বড়ো বাক্স থেকে পানির বোতল নিয়ে টবের কাছে দৌড়ে এলো। বোতলে ভরা এই পানি বৃষ্টির পানি। বর্ষার কোনো এক বিকেলে ছাদের আধভাঙা একটা বালতি থেকে সে এই পানি জমিয়ে রেখেছিল। ধানের চারার মতো সে-ও মেঘের চারা চাষ করবে। ইমির ধারণা, টবে এই পুরো এক বোতল পানি ঢেলে দিলে মেঘের চারা হবে, আর চারা থেকে গাছ। গাছ থেকে ফোঁটা ফোঁটা আকারে বৃষ্টি পড়বে। সেই বৃষ্টি ইমি পাঠিয়ে দেবে নীতুপার রানী গাঁও। দিন যায়, রাত যায়। একে একে তৃতীয় দিন ইমি দেখলো, টবে ছোট ছোট তিনটি চারা। এই তার সেই মেঘের চারা! রাতে ঘুমোনোর আগে চারায় পানি দিতে দিতে ইমি ছড়ায় ছড়ায় বলে-


বড়ো হও, বড়ো হও মেঘেদের চারারা


দেখে রেখো আকাশের মিটিমিটি তারারা।’


আরও দিন যায়। আরও রাত ফুরায়। ইমির মেঘের চারাও খানিকটা বড়ো হলো। একেকটা চারার দুইটা করে ছোট্ট কচি পাতা গজালো। বিকেলে যখন সূর্যের তেজ কমে রোদের রং কমলা হয়, ইমি চারায় পানি দেয় আর ছড়া কেটে বলে-


পানি দেই, পানি খাও, 


খেয়ে যেয়ো, রানী গাঁও।


উজ্জ্বল চাঁদের জোছনা মাখা এক রাতে ইমি স্বপ্নে দেখলো, চারারা বড়ো হয়েছে। বাগান বিলাস গাছটা ছুঁয়ে ছাদ ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁইছুঁই অবস্থা। চারাগুলির কতগুলি ডালপালা পুরো শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিয়েছে। আর ফলের বদলে আছে ফোঁটা ফোঁটা আকারের সীমাহীন কতশত বৃষ্টির ফোঁটা। ঠিক রাতের আকাশের ঝলঝল তারার মতো দেখতে। যেন হীরার মতো বৃষ্টিরা ঝরে পড়বে তার প্রিয় নীতুপার রানী গাঁওয়ের মাঠে, ঘাটে, পথে ও প্রান্তরে। ইমি ছড়ার ছন্দে ও আনন্দে গেয়েছিল-


ওগো, মেঘ, ঝরে যা


মাটি-মাঠে পড়ে যা...


ইমির মেঘের চারাগুলো সত্যি সত্যি মেঘের চারা ছিল না। কিন্তু কোনো এক চৈত্র মাসের খরার দিনে ঠিকই রানী গাঁওয়ের মাঠ, ঘাট, পথ ও প্রান্তর ভিজেছিল ফোঁটা ফোঁটা আকারে হীরার মতো বৃষ্টির পানিতে। 


মাস-দুয়েক পর এক সকালে ইমি দেখলো, টব থেকে লতা-পাতা ছড়িয়ে কতগুলো গাছ বেয়ে বেয়ে বাগান বিলাস গাছটির সাথে মিশে গেছে। সেইসব গাছের লতাপাতার আড়ে বড়ো কয়েকটা হলুদ ফুল আর কতগুলি ফুটবলের সমান ফল। ওইগুলো আসলে  কুমড়োর ফুল ও কুমড়ো। ইমি এসবের জানবে কী! সেই টবের মাটিতে তার মা পরদিনই যে চার-ছয়টা কুমড়োর বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন। সেই কুমড়োর গাছ, ফুল ও কুমড়োকে ছোট্ট  ইমি মেঘের চারার কোনো এক অংশ ভেবে এখনো বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে। চিঠির মতো সেই মেঘের খামে হীরার মতো বৃষ্টির ফোঁটাকে সে পাঠিয়ে দেবে; তার প্রিয় খেলার সাথী নীতুপা’র রানী গাঁও!

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ