ঈদের কবিতা
কবিতা শাহাদাৎ সরকার মার্চ ২০২৫
বিশ্ব মুসলিমের অন্যতম উৎসব ঈদ। আর ঈদকে ঘিরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানারকম আয়োজন হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ও এর ব্যতিক্রম নন। তাই ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের আয়োজন হয়ে থাকে আমাদের দেশে। অন্যান্য দেশীয়ও উৎসব থেকে ঈদ ব্যতিক্রম তার আধ্যাত্মচেতনার কারণে। এই আধ্যাত্মিক অনুভব কবিদের মনে তৈরি করে কাব্যরস। আর কবি সৃষ্টি করেন কবিতা। বাংলা কবিতায়ও এর উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
বাংলা ভাষায় প্রথম ঈদের কবিতা সৃজন করেন বিখ্যাত ‘নবনূর’ পত্রিকার সম্পাদক ও ‘ডালি’ কাব্যের কবি সৈয়দ এমদাদ আলী (১৮৭৫-১৯৫৬)। ১৯০৩ সালের নবনূর ডিসেম্বর সংখ্যায় কবি সৈয়দ এমদাদ আলী ‘ঈদ’ নামে একটি কবিতা প্রকাশ করেন। এটি বাংলা ভাষার প্রথম ঈদের কবিতা।
কুহেলি তিমির সরায়ে দূরে / তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে
রাঙিয়া প্রতি তরুর শিরে / আজ কি হর্ষ ভরে!
আজি প্রভাতের মৃদুল বায় / রঙে নাচিয়ে যেন কয়ে যায়
‘মুসলিম জাহান আজি একতায় / দেখ কত বল ধরে।’
প্রথম কবিতা সৃজনের কৃতিত্ব যেমন সৈয়দ এমদাদ আলীর; তেমনি ঈদসংখ্যা প্রকাশের সূচনাও তাঁর হাতে। আজ যে ঢাউস সাইজের ঈদম্যাগাজিন বের হয় ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে, যা হাতে না নিলে যেন রুচিশীল সাহিত্যামোদী বাঙালির ঈদই উদযাপন করা হয় না, এর পথনির্মাতা কবি সৈয়দ এমদাদ আলী। বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান এই কবি, যিনি ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা, ব্রিটিশ সরকার যাঁকে ভূষিত করেছিল ‘খানসাহেব’ উপাধিতে, সর্বপ্রথম ঈদসংখ্যা প্রকাশ করেন। ১৯০৩, ১৯০৪ ও ১৯০৫-পরপর এ তিন বছর নবনূর ঈদসংখ্যা বের হয়, যেখানে ঈদবিষয়ক লেখা লেখেন সৈয়দ এমদাদ আলী, মহাকবি কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১) ও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২)। কায়কোবাদ ‘ঈদ আবাহন’-এই একই শিরোনামে দুটি ঈদের কবিতা লেখেন, যার একটি প্রকাশিত হয় ‘অশ্রুমালা’ কাব্যগন্থে, অন্যটি ‘অমিয়ধারা’য়।
আজি এ ঈদের দিনে হয়ে সব এক মন প্রাণ,
জাগায় মোস্লেম সবে গাহ আজি মিলনের গান।
ডুবিবে না তবে আর ঈদের এ জ্যোতিষ্মান রবি,
জীবন সার্থক হবে, ধন্য হবে এ দরিদ্র কবি।
এরপর থেকে বাংলা ভাষায় ঈদের কবিতা লেখেননি এমন মুসলমান কবি খুঁজে বের করাটাই কষ্টকর। শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩) ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩২৭ সংখ্যায় লেখেন ‘ঈদ’ শিরোনামে একটি কবিতা।
মুসলেমের আজ ঈদ শুভময়, আজ মিলনের দিন,
গলায় গলায় মাখামাখি, আমির ফকির হীন।
আজ সবারি হস্ত পূত, ধোওয়া স্বর্গ নীরে
তাই যে চুমোর ভিড় লেগেছে, নম্র নত শিরে।
শেখ ফজলল করিম (১৮৮২-১৯৩৬) ও ‘ঈদ’ শিরোনামে একটি কবিতা লেখেন, যেখানে কবি মুসলিম জাতির জাগরণের গান গেয়েছেন খুবই বেদনাকাতর কণ্ঠে :
অলস অধম মোরা এখনো কি অবহেলে যাব রসাতলে?
অদৃষ্টের উপহাস এখনো কি আনিবে না চেতনা ফিরিয়া?
এখনো লাঞ্ছিত মোরা বুঝিব না হিতাহিত, রহিব ঘুমিয়া?
জীবনপ্রভাত আজি বিস্ময়ে দেখিতে চাহি মহাজাগরণ
সাহসে বাঁধিয়া বাকি পথে হয়ে অগ্রসর নতুবা মরণ!!
কবি শাহাদাৎ হোসেন (১৮৯৩-১৯৫৩) ও কবি গোলাম মোস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪) কয়েকটি কবিতা লেখেন ঈদকে নিয়ে। গোলাম মোস্তফা রচিত নিচের কবিতায় ফুটে উঠেছে ঈদের চাঁদকে নিয়ে কবির আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কথা। তিনি ঈদের চাঁদের তুলনা করেছেন নবীর মুখের হাসির সাথে।
আজ নূতন ঈদের চাঁদ উঠেছে, নীল আকাশের গায়।
তোরা দেখবি কারা ভাই- বোনেরা আয়রে ছুটে আয়।
আহা কতই মধুর খুবসুরাৎ ঐ ঈদের চাঁদের মুখ
ও ভাই তারও চেয়ে মধুর যে ওর স্নিগ্ধ হাসিটুকু
যেন নবীর মুখের হাসি দেখি ওই হাসির আভায়।
তবে ঈদ নিয়ে যত কবিতাই লেখা হোক, ঈদের কবিতা প্রকৃত সাহিত্যিক মূল্য পেয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের হাতে। নজরুল ছিলেন সত্যিকার অর্থে বাঙালির জাতীয় কবি। শক্তিমান এ কবির হাতে বাঙালি-মুসলমানের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি একটি পরিশুদ্ধ শিল্পের আকার প্রাপ্ত হয়ে দুচোখ ধাঁধিয়ে দেয় সকলের। কি তাঁর ছন্দ, কি তাঁর মানবিক আবেদন!
ঈদ বারবার ফিরে এসেছে নজরুলের গানে ও কবিতায়। বাঙালির ঈদের সাথে নজরুলসত্তা এত নিবিড়িভাবে মিশে আছে যে, একটা থেকে আরেকটাকে পৃথক করা যায় না। বাঙালির তো ঈদুল ফিতরই হয় না নজরুলের এই গান ছাড়া :
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
যেমন এর সুর, তেমনি এর ভাব-ব্যঞ্জনা, যা বাঙালি-মুসলমান শুধু নয়, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে যে-কোনো বাংলাভাষীকে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তবে এ গানের মধ্য দিয়ে কবি স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন মুসলিম জাতির অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন :
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ।
আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে,
যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।
ইসলাম যে তরবারি দিয়ে নয়, ভালোবাসা ও সাম্যবাদ দিয়ে সারা পৃথিবী জয় করেছিল একদিন, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবি বলেন :
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলা ও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পর খুশির বার্তা নিয়ে আসে ঈদ, মুসলমানদের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। কিন্তু সর্বজনীন শান্তির এই ঈদ অর্জন করার জন্য মুসলিম জাতিকে কত রক্তাক্ত রাস্তাই না পাড়ি দিতে হয়েছে, স্বীকার করতে হয়েছে কত ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কুরবানি। শাশ্বত সেই ঈদকে স্বাগত জানিয়ে কবি বলেন :
শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো,
কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো,
বরষের পরে আসিলে ঈদ!
ভুখারির দ্বারে সওগাত বয়ে রিজওয়ানের,
কণ্টক-বনে আশ্বাস এনে গুল-বাগের,
সাকিরে “জা’মের” দিলে তাগিদ।
ঈদ অর্থ আনন্দ। তবে নজরুল ঈদের এই আভিধানিক অর্থ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেননি তাঁর ঈদবিষয়ক কবিতাসমূহে, বরং তিনি এর মধ্যে তালাশ করেছেন এর হাকিকি অর্থ, যা-ই মূলত ধারণ করে আছে ঈদের আসল সৌন্দর্য। ঈদের প্রসঙ্গ এলেই কবি দুঃখী-মানুষদের নিয়ে হাজির হয়েছেন জাতির সামনে। যে জাতির কাজই ছিল একসময় ভুখানাঙা মানুষদের মুখে সুখের হাসি ফোটানো, সে-জাতি কী করে গরিব-দুঃখীদের উপেক্ষা করে আত্মসুখে বিভোর হয়ে থাকতে পারে, সে কথা তিনি তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে ছাড়েন না। কৃষকপ্রজার দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন কবি তার ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায়।
ঈদুল ফিতর উদযাপনের অধিকার তো তাদেরই বেশি, যারা এক মাস ধরে সিয়াম পালন করে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। সিয়াম সাধনা বা রোজা রাখার অর্থই হলো উপবাস থাকা। কিন্তু জালিম-শাসকের অধীনে অসহায় প্রজাসাধারণ তো উপবাস থেকেছে সারা বছরই। কবি তাই শ্লেষের সাথে বলেন :
প্রজারাই রোজ রোজা রাখিয়াছে, আজীবন উপবাসী,
তাহাদেরই তরে এই রহমত, ঈদের চাঁদের হাসি।
নজরুল-উত্তরকালে আর যাঁরা ঈদের কবিতা লিখে প্রসিদ্ধ হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ফররুখ আহমদ, আ ন ম বজলুর রশীদ, সিকান্দার আবু জাফর, আবুল হোসেন, তালিম হোসেন, আহসান হাবীব, সৈয়দ আলী আহসান, সানাউল হক, সুফিয়া কামাল, আজিজুর রহমান, আশরাফ সিদ্দিকী, আল মাহমুদ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। আধুনিককালে তো ঈদের কবিতা লেখা একটা ‘রীতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর নতুন নতুন ঈদের কবিতা নিয়ে হাজির হচ্ছেন এ কালের কবিরা। এসব কবিতায় যেমন আছে বিচিত্র শিল্পের আনন্দ, তেমনি মানবিক আবেদনের সমাহার।
ফররুখ আহমদ তাঁর ‘ঈদের স্বপ্ন’ কবিতায় আমাদের নিয়ে যান স্বপ্নের রাজ্যে-
আকাশের বাঁক ঘুরে চাঁদ এলো ছবির মতন,
নতুন কিশতি বুঝি এলো ঘুরে অজানা সাগর
নাবিকের শ্রান্ত মনে পৃথিবী কি পাঠালো খবর
আজ এ স্বপ্নের মাঠে রাঙা মেঘ হল ঘন বন!
নিবিড় সন্ধ্যার পথে সাহজাদি উতলা উন্মন,
কার প্রতীক্ষায় যেন পাঠায়েছে আলোর ইশারা;
আতরের ঘন গন্ধে মাটি চায় হাওয়ার বাঁধন।
আল মাহমুদ তাঁর ‘গৃহলতা’ কবিতায় স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন তাঁর শৈশবের ঈদের কথা স্মরণ করে।
ঈদের দিনে জিদ ধরি না আর
কানে আমার বাজে না সেই
মায়ের অলঙ্কার।
আল মাহমুদ বাংলা কবিতাকে যেমন নিয়ে গেছেন অনেক উচ্চতায় তেমনি ঈদকেও তিনি কবিতায় দান করেছেন এক নতুন মাত্রা। তাই তিনি এভাবে বলতে পারেন :
কোনো এক ভোর বেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।
আরও যে কত ঈদের কবিতা রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায় আধুনিক কালে এবং রচিত হয়ে যাচ্ছে প্রতি বছর, তার হিসাব দেওয়া অত সহজকর্ম নয়। উৎসব ছাড়া কী মানবজীবন চলে আর বাঙালির জীবন চলে ঈদ-উৎসব ছাড়া?
তাইতো ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান, কবি আবদুল হাই শিকদার, কবি মতিউর রহমান মল্লিক, কবি মোশাররফ হোসেন খানসহ এখানকার অধিকাংশ কবি বাদ থাকেননি ঈদ নিয়ে কবিতা রচনায়। তাঁদের ভেতর থেকে ঈদকেন্দ্রিক কবিতার কিছু লাইন নিম্নরূপ :
সাজজাদ হোসাইন খান রমজান শেষে ঈদের আগমনের ছবি আঁকেন এভাবে :
মাস শেষে আসে ঈদ খুশিদের রাজা/ এই খুশি গিলে গিলে হও তরতারা।
কিংবা,
বিলের ধারে নীলের বাড়ি তারপরে ভাই সাদা/ সেই সাদাতে ঘুমায় দেখো ঈদের শাহজাদা।
মস্তবড়ো হিরার পালঙ আবির মাখা জাজিম/ ঘুরে ঘুরে মেঘের হাওয়া করছে তারে তাজিম।
আবদুল হাই শিকদারের কবিতায় রমজান ও ঈদের বৈশিষ্ট্য উঠে আসে এভাবে :
খুলে প্রাণ/ রমজান/ ঈদ এলো ফিতরের,/ দূরে যায়/ শংকায়/ কষ্টরা ভিতরের।
এক মাস/ উপবাস/ পরে মহা উৎসব,/ কেউ নাই/ পর ভাই/ ভেদাভেদহীন সব।
মতিউর রহমান মল্লিকের কবিতা :
রোজার মাসে যে করেছে বন্দেগী,
যে গড়েছে রোজার আলোয় জিন্দেগী-
সেই তো জয়ী! আসলে সে ধন্য যে।
ঈদ এসেছে রোজাদারের জন্য যে।
মোশাররফ হোসেন খান ঈদকে দেখেছেন এভাবে :
ঈদ মানেতো খুশির খেলা / ফুলের মতো গন্ধে দোলা
ছন্দে ঝরা বিষ্টি ধারা / টাপুর টুপুর,
ঈদ মানেতো দেদোল দোলা / সকাল দুপুর।
এভাবেই বাঙালি মুসলিম কবিরা ঈদকে ধারণ করেছেন তাঁদের কাব্য-কবিতায়। এই ধারাবাহিকতা চলমান। চলতেই থাকবে।
আরও পড়ুন...