কম্পা নদীর স্রােত
গল্প তমসুর হোসেন জুলাই ২০২৪
নদীর ধারে একটি গ্রাম। সেই গ্রামে বাস করতো এক চাষী। তার নাম নাথান। নাথানের বড়ো ভাইয়ের নাম ডেভিড। নাথান ছিল সহজ প্রকৃতির মানুষ। বড়ো ভাই ডেভিডের কথার বাইরে সে কোনো কাজ করতো না। ডেভিড নানা রকমের লোকের সাথে মেলামেশা করতো। নানান কাজে যুক্ত হয়ে অহেতুক ব্যস্ততায় দিন কাটাতো। ওদের সংসার মোটেই স্বচ্ছল ছিল না। নদীর স্রােতে ওদের অনেক জমি নষ্ট হয়ে গেছে। সামান্য জমি চাষ করে ওদের বছরের পাঁচ মাসের খাবারও জোটে না। নাথান অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ফসল ফলায়। ডেভিডের তিনটি ছেলেমেয়ে। ওদের খরচের বিষয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। ওদের খাবার, পোশাক এবং চিকিৎসার খরচ নাথানকে বহন করতে হয়। আর্থিক অনটনে ওদের কষ্টের অন্ত ছিল না। সংসারে সময় না দিলেও কর্তৃত্ব ছিল ডেভিডের হাতে। যার ফলে হতাশার কালোমেঘে ভরে গিয়েছিল নাথানের চারপাশ।
এই সীমাহীন দারিদ্রের মধ্যে নাথানের একটি ছেলে জন্ম নিলো। ছেলেটি একটু বড়ো হলে ওর মা অপুষ্টিতে ভুগে মৃত্যুবরণ করলো। মা হারা ছেলেটিকে নিয়ে নাথান চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলো। কী করবে এখন নাথান! স্ত্রীর মৃত্যু নাথানের অন্তরকে হতাশায় ভরে দিলো। সংসারের সব কষ্ট সয়ে স্বামী আর সন্তানের দিকে খেয়াল রাখতো ইলিয়ানা। মা হারা থিয়োডোরের দিকে দেখলে নাথানের কলিজা শুকিয়ে যায়। সারাদিন নাথান মাঠের কাজে ব্যস্ত থাকে। আর এদিকে তার ছেলে ক্ষুধায় কাতর হয়ে কান্না করতে থাকে। তার বড়ো মা তার দিকে কোনো খেয়াল রাখে না। থিয়োডোর কার কাছে পাবে একরত্তি আদর। তার মলিন চোখের দিকে তাকানো যায় না। এই শিশুটির সমস্যা দূর করা নাথানের পক্ষে মোটেই সম্ভব হয় না। সে থিয়োডোরের মুখে একমুঠো ভাত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কেউ ওর যত্ন নেয় না। সারাদিন সে মায়ের কবরের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। একদিন নাথান বাড়ি ফিরে দেখে ইলিয়ানার কবরের পাশে ঘুমিয়ে আছে থিয়েডোর। এ দৃশ্য দেখে সে অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকে।
ওর দেহের ধূলো ঝেড়ে আদর করতে থাকে নাথান। থিয়োডোরকে ঘুম পাড়ানোর জন্য ব্যথিত কণ্ঠে ছড়া শোনায় সে। কিন্তু থিয়োডোর মোটেই ঘুমাতে চায় না। সে তার বাবাকে দেহের কিছু জখম আর মারের দাগ দেখায়। একটা মার তার ডান চোখেও লেগেছে। চোখটায় রক্ত জমে আছে। এসব দেখে গ্রামে বাস করার কথা মন থেকে মুছে ফেলে নাথান। সে বলে, “সোনাবাপ, চলো আমরা অন্য কোথাও যাই। এখানে আমাদের একদিনও থাকা চলবে না। ওরা তোমাকে না খাইয়ে মেরে মেরে শেষ করে দেবে।” বাবার কথা শুনে থিয়োডোর শুকনো কণ্ঠে বলে, “বাবা, তুমি মাঠে চলে গেলে বড়ো মা আর জন আমাকে কাঠ দিয়ে মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। আমি তখন কোথায় যাবো। অনেক কান্না করে মায়ের পাশে শুয়ে থাকি। জন ওখানে এসে আমার কান টেনে ধরে। মাকে কত বলি। মা আমার কথা একটুও শুনতে পায় না।”
ছেলের কথা শুনে ঘুম আসে না নাথানের। কাজের চাপে সে ছেলের দিকে একটুও খেয়াল রাখতে পারেনি। আজ ওর দিকে তাকিয়ে হৃদয় খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়। কেমন হয়ে গেছে ওর চেহারা। অনাহারে চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে। মায়ের কবরের কাছে বসে থাকা ছাড়া ওর কোনো সান্ত¡না ছিল না। থিয়োডোরকে নিয়ে কোথায় যাবে নাথান। কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। এমন কোনো স্বজন তো তার নেই। ভেবে ভেবে নাথানের মাথা ঘুরতে লাগলো। ¯œায়ুর চাপে ওর গা ঘামতে লাগলো। হঠাৎ তার খেয়াল হলো একজন লোকের কথা। এখান থেকে মাইল দশেক উত্তরে কলারাডো নদীর কাছে তার বাড়ি। কী যেন নাম লোকটার। ওর বাড়িতে গিয়ে থাকতে বলেছে লোকটা। ফলের বাগানে কাজ করতে হবে। থাকা খাওয়ার সমস্যা হবে না। মাইনেও দেবে পছন্দ মতো। এ কথা মনে হতেই নাথানের মন গভীর শান্তিতে ভরে গেল। ওখানে গেলে তারা তিনবেলা পেট পুরে খেতে পারবে। বাগানের ফল আর শাকপাতা খেয়ে ওদের ভালোই দিন চলবে। বেতনের টাকা জমিয়ে রাখলে দরকার মতো খরচ করা যাবে। মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নিলো সূর্য উঠার আগেই ছেলেকে নিয়ে লোকটার বাড়ির দিকে রওনা দেবে। এখানের বাতাস বড়ো বিষাক্ত হয়ে গেছে। এখানে থাকলে বাপবেটা দু’জনকেই না খেয়ে মরতে হবে। থিয়োডোরকে ঘাড়ে করে নিয়ে পাকা সড়কে এসে একট পাবলিক বাসে উঠে পড়ে সে। বাসের হেলপার তাকে কোথায় যাবে প্রশ্ন করলো। সে কিছুই বলতে পারলো না। কী যেন বাজারটার নাম। তার পাশেই লোকটার বাড়ি। নাথান ভাবলো কিছুটা পথ যেয়ে তারা বাস থেকে নেমে পড়বে। কোনো বাজার চোখে পড়লে তার আশেপাশে খুঁজলে অবশ্যই ওই লোকটার সন্ধান পাওয়া যাবে। রাতে একটুও ঘুম হয়নি। বাসের মৃদু ঝাঁকুনি আর শীতল হাওয়ায় নাথানের চোখে গভীর ঘুম এসে যায়। বাসটা যখন শেষ স্টপেজে থামে তখন চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে। হেলপার ছেলেটা ওর গায়ে ধাক্কা দিয়ে চোখের ঘুম ছুটিয়ে দেয়। এখানে কোন জায়গায় এসেছে সে অগ্র-পশ্চাৎ কিছুই বুঝতে পারে না। ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে বোকার মতো রাস্তার চলন্ত গাড়ির দিকে চেয়ে থাকে। সাথে একটা কচি বাচ্চা। গাড়ির হেলপার ছেলেটাকে সে বলে, “ভাই এটা কোন জাগা?”
“এটা পুরতুক। লাস্ট স্টপেজ।”
ছেলেটা নাথানের অবস্থা ভালো করে বুঝতে পেরেছে। গাড়িতে নাক ডেকে ঘুমিয়ে যে যাত্রী লাস্ট স্টপেজে হা করে দাঁড়িয়ে থাকে তারা এভাবেই জায়গার নাম জিজ্ঞেস করে। এই ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে রাতের বেলা লোকটা যাবে কোথায়? ছেলেটা চিৎকার দিয়ে ড্রাইভারকে বলে, “ওস্তাদ। এই লোকটা জায়গার নাম জিজ্ঞেস করে।”
পরিবহণ ব্যবসার এই একটা সমস্যা। “খালের থন বাইর হইয়া লাফ দিয়া উঠবো বাসে। পকেটে টাকা নাই। আর কইবো এটা কোন জায়গা?”
কাউন্টারের পাশে একটা খালি রুম আছে। এসব যাত্রী ওখানেই রাখা হয়। থিয়োডোরকে দেখে ড্রাইভারের মায়া হয়। হোটেলে নিয়ে পেট পুরে খাওয়ায় দুই বাপবেটাকে। তারপর ওদের সাথে আলাপ করে সবকিছুই জানতে পারে ড্রাইভার। ড্রাইভারের কোনো সন্তান নেই। একটি সন্তান দত্তক নেওয়ার কথা অনেকদিন ধরে ভাবছে সে। অনেক চিকিৎসা করা হলো তার স্ত্রী জুলির। সবশেষে একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ জানিয়ে দিলো জুলির কোনো সন্তান হবে না। নাথানের ছেলেটি তার খুব ভালো লেগেছে। নাথানকে যদি গ্যারেজে কাজ দেওয়া যায় তাহলে ছেলেটিকে জুলি কাছে রাখতে পারবে।
নাথানও ছেলের দেখাশুনা করে মন লাগিয়ে কাজ করতে পারবে। সকালে ওদেরকে নিয়ে বাসায় চলে যায় ড্রাইভার। জুলিকে ডেকে তার মনের কথা বলে। শুনে জুলি আনন্দে অধির হয়ে যায়। থিয়োডোরকে কোলে নিয়ে চুমু খায়। সকালে নাস্তা তৈরি করেছে সে। সেই নাস্তা খাওয়ায় সে থিয়োডোরকে অনেক আদর করে। এ দৃশ্য দেথে নাথান খুশির আতিশয্যে কাঁদতে থাকে। এমন আদর কতদিন থেকে পায় না থিয়োডোর। সারাদিন নাথান ড্রাইভারের সাথে তার নতুন কাজের জায়গায় কাজ করে। এখানের কাজ তার কাছে অপরিচিত হলেও মন্দ লাগছে না। কিছুদিন কাজ করলে সে সবকিছু আয়ত্ত করে নিতে পারবে।
থিয়োডোরকে পেয়ে জুলি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। ওর হাসিতে জুলির ঘর-দরজা আলোয় ঝলমল করছে। একটি অবোধ শিশুর হাসি ওর সবকিছুকে যেন নতুন রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে। ওকে জড়িয়ে নিয়ে সে ঘুমের অতলে হারিয়ে যায়। ওকে কোলে নিয়ে জুলি বুঝতে পারে কী যেন ফুলের সুবাসে ওর অন্তরের বাতায়ন মউমউ করছে। থিয়োডোর তো ওর গর্ভজাত সন্তান নয়। তবু ওর দিকে তাকিয়ে তার চোখ ভরে যায় হৃদয় পরিতৃপ্ত হয়। জুলি অবাক হয়ে যায় থিয়োডোরকে ওর বুকের দুধ পান করতে দেখে। পরম পরিতৃপ্তি সহকারে সে জুলির দুধ পান করে। জুলি স্বামীকে অতি গোপনে এ কথা বলে। শুনে তার স্বামী আল্লাহকে ধন্যবাদ জানায়। নাথানকে ড্রাইভার কোনোদিন মুখ ফুটে বলেনি সে থিয়োডোরকে দত্তক নিতে চায়। কিন্তু ওর প্রতি জুলির মমতা দেখে একদিন নাথানই বলে, “একটা কথা বলি। মনে কিছু করবেন না।”
“আরে কি কথা। বলো বলো। মনে করার কি আছে।” প্রফুল্ল মনে বললেন ড্রাইভার।
“বলছিলাম কি। ওর তো মা বেঁচে নেই। আমারও তো বিয়ে করার ইচ্ছে নেই।”
“ও। তুমি থিয়োডোরের কথা বলছো? তা কি করতে চাও ওকে?” রক্তিম অধরে এক চিলতে হাসির সুরভি মিশিয়ে বলে জুলি।
“এখন থেকে আপনারাই ওর বাবা-মা। ওর দেখাশুনা আপনারাই করবেন।”
“মন্দ বলোনি তুমি। আমাদের সন্তান নেই। ওকে আমরা নিজের সন্তানের মতো মানুষ করবো। এ বিষয়ে একটুও চিন্তা করবে না। শুধু থিয়োডোর কেন। তুমিও এখন থেকে এই পরিবারের একজন হলে। পাশের কামরাটায় তুমি থাকবে।” খুব আন্তরিকভাবে বলে ড্রাইভার।
অনেক সুখে দিন কাটে থিয়োডোরের। জুলির যত্ন ও তদারকিতে সে অনেক লেখাপড়া করে। একটা দায়িত্বপূর্ণ পদে সে নিয়োগ পায়। ড্রাইভার দম্পতি ও নাথান ওকে নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। সে তার নাম রাখে থিয়োডোর এন্থনি নাথান। এন্থনি তার ধর্মপিতা ড্রাইভারের নাম।
আরও পড়ুন...