গাছি মামার গল্প
গল্প রফিক মুহাম্মদ জানুয়ারি ২০২৫
অগ্রহায়ণ প্রায় শেষ। প্রকৃতিতে এ সময় শীতের পরশ থাকার কথা। বাতাসের মৃদু হিমেল ছোঁয়া, ভোরে ঘাসের ডগায় শিশিরের ঝিকিমিকি এসবের কিছুই এখনো দেখা যাচ্ছে না। অথচ আজ থেকে দশ বারো বছর আগেও কার্তিকের শেষেই শিউলি গাছের পাতায় থেকে শেষ রাতে শিশিরের টুপটাপ ঝরে পড়ার শব্দ শোনা যেত। তখন রমজান আলীর কত কাজ ছিল। এই রসুলপুরের নাম করা গাছি সে। কার্তিকের শেষ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত নাওয়া-খাওয়ার সময় ছিল না তার। দুই থেকে আড়াইশো খেজুর গাছ ছিল তার অধীনে। কার্তিক মাসের শুরু থেকেই চলতো তার প্রস্তুতি। মাটির ভাঁড়, চোঙ, দড়াগাছা এসব ঠিকঠাক করতো। লাল রঙের বড়ো দানার কড়কড়ে বালু দিয়ে ঘষে গাছ কাটার দাওটাকে ভালো করে ধার দিতো রমজান গাছি। এ কাজেও তার ছিল মুনশিয়ানা। দু-তিন দিন ধরে ক্রমাগত সে তার দাওয়ে ধার দিতো। এলাকার সবাই বলতো রমজানের দাও ধারণীর ভাবটাই আলাদা। তার দাও দিয়ে আগুন পানি পর্যন্ত কাটা যায়। খেজুর গাছ কাটায় এ অঞ্চলে তার মতো পারদর্শী আর কেউ নেই। তাইতো সবাই তাকে রমজান গাছি এমনকি শুধু গাছি বলেই ডাকে। এতে করে তার রমজান নামটা প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। যেমন বিলুপ্ত হতে চলেছে এ এলাকার খেজুর গাছ। আগে এ অঞ্চলের তিন চারটি গ্রামে পাঁচ ছয়শো খেজুর গাছ ছিল। এখন তা কমতে কমতে পঞ্চাশ-ষাটটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আর কয়েক বছর পর হয়তো খেজুর গাছ খুঁজেই পাওয়া যাবে না।
এলাকায় যে কয়টা গাছ আছে এগুলো থেকেই রমজান গাছি এখনো রস সংগ্রহ করে। তাই কার্তিকের শেষ সময়ে অভ্যাসবশত দাওয়ায় বসে গাছ কাটার দাওয়ে ধার দিচ্ছে সে। আদনান এক বছর পর মায়ের সাথে নানা বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। গত বছর যখন এসেছিল তখন ডিসেম্বর মাস ছিল। শীতের দিনে সকালে গাছ থেকে খেজুর রসের হাঁড়ি নামিয়ে গাছি মামা তাকে খেতে দিয়েছিল। মাটির একটি কাপে করে খাওয়া সে রসের স্বাদ আজও যেন তার জিবে লেগে আছে। সেবার আদনানের বাবার অফিসের জরুরি কাজের জন্য নানু বাড়িতে একদিন থেকেই চলে যেতে হয়েছিল। তাইতো গাছি মামার সাথে পরিচয় হলেও তার সাথে কথা বলতে পারেনি। গাছি মামা তাকে অনেক গল্প বলবে বলেছিল। কিন্তু আদনানের আর সেগুলো শোনা হলো না। তবে এবার সে বাবাকে রেখেই মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে। কয়েকদিন থাকবে।
সকাল সকাল নাস্তা সেরেই আদনান গাছি মামার বাড়িতে এসে হাজির। রমজান আলীর ছনের ছাওয়া ছোট্ট এই ঘরটি আদনানের নানার বাড়ির পাশেই। গত বছর সে যখন এসেছিল তখন নানাজানই তার সাথে গাছি মামার পরিচয় করিয়েছিলেন। নানাজান তাকে বলেছিলেন, ‘নানু ভাই এই হলো তোমার গাছি মামা। সে খেজুর গাছ কেটে তার থেকে রস বের করে। এরপর সে রস থেকে গুড় তৈরি করে। খেজুরের রস খুবই মজা। কাল সকালেই তোমার গাছি মামা তোমাকে খেজুরের রস খাওয়াবে। কিরে আমার নানু ভাইকে খাওয়াবে তো?’ নানাজানের প্রশ্নে গাছি মামা বলেছিল, ‘চাচা যে কি কইন। আমার ভাগিনা বাবাজি রস খাইবো আর আমি দিতাম না। এইডা কি কইন। কাইল ভোরে মামা তুমি চইল্লা আইয়ো গাছ থাইক্ক্যা পাইরা টাটকা রস খওয়াইয়ামনে।’
রমজান গাছি ঘরের বারান্দায় বসে মাটির হাঁড়িতে দড়ি বাঁধতে ব্যস্ত। আদনান তার কাছে গিয়ে সালাম দেয়, ‘আসসালামু আলাইকুম গাছি মামা।’ আদনানের সালাম শোনে ঘাড় তোলে তাকায় রমজান। আদনানকে তার সামনে উঠানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রমজান আনন্দিত হয়ে সালামের উত্তর দিয়ে বলে, ‘আরে আমার আদনান বাবাজি যে। তা কোন সময় আইল্য মামা? আসো আসো এইহানে বসো।’ ঘরের বারান্দায় একটা জলচৌকিতে আদনানকে বসতে দেয়।
আদনান বসতে বসতে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছেন মামা?’
‘আলহামদুলিল্লাহ। ভালোই আছি বাবাজি।’
‘গাছি মামা এইবার এখনো খেজুর রস হয় নাই?’
‘বাবাজি অহনো তো শীত আইয়ে নাই। উত্তরের হিম বাতাস আইবো। কুয়াশা পড়বো তখন তো খেজুর গাছে রস অইবো। এ আল্লার এক অপূর্ব কুদরত বাবাজি। কি খটখটা শক্ত শইল খেজুর গাছের। এই খটখটা শইলের থাইক্ক্যা মিষ্টি রস কেমনে বাইর অয়। এইডা আল্লার এক মহান কুদরত বাবাজি।’
সত্যি এই বিষয়টা তো কখনই ভাবেনি আদনান। খেজুর গাছের শরীর থেকে কেমনে এত মিষ্টি রস বের হয়? আদনানের ভাবনার মধ্যেই রমজান গাছি বলতে থাকে, ‘এই খেজুর গাছের খটখটা শইল থাইক্যা রস বাইর করার অনেক কায়দা কানুন আছে বাবাজি। গাছের আগায় খুব যতেœ, কায়দা করে দফায় দফায় ছাল চেঁছে দিতে হয়। এই ছাল চাঁছাটা ঠিক মতো না হলে ভালো রস পাওয়া যায় না। তাইতো গাছ কাটায় দক্ষ গাছি লাগে। এটা খুব মেহনতের কাজ। গাছ চেঁছে সন্ধ্যার আগে গাছে নালি লাগিয়ে হাঁড়ি বাঁধা হয়। সারারাত টুপটাপ করে গাছের শইল থাইক্যা হাঁড়িতে রস ঝরে পড়ে। সুবেহ সাদিকের সময় গাছিরা রসের হাঁড়ি নামায়। বেলা বাড়লে রসের স্বাদ কমে যায়।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ বাবাজি। রোদ ওঠার আগেই গাছ থেকে রসের হাঁড়ি নামাতে হয়। আর একটি বিষয় সপ্তাহে তিন দিন গাছ কাটা হয়। প্রথম দিনের রস ‘জিরান কাটা’ রস। দ্বিতীয় দিনের রস দো কাটা রস এবং শেষ দিনেরটা ঝরা রস। জিরান কাটা রসের স্বাদই আলাদা। এখন তো হাঁড়ির চারপাশে জালের বেড়া দিয়ে রাখতে হয় বাদুড়ের কবল থেকে রক্ষার লাইগ্যা। রসে যদি বাদুড় মুখ দেয় তাইলে তো সব্বনাশ। নিপা ভাইরাসের ভয়।’
‘হ্যাঁ এইডাতো ভয়ানক ভাইরাস মামা।’
‘এই লাইগ্যাতো অহন গাছে গাছে জাল দিয়া বেড়া দিতে অয়। শোন বাবাজি খেজুর গাছ কাটায় যেমন কায়দা কানুন আছে, তেমনি আগুনে রস জাল দেওয়ার মধ্যেও অনেক মুনশিয়ানা আছে। রসের নিচে যখন বলক আসে তখন তার সুবাসে পুরো এলাকা মোহিত হয়ে যায়। আর বলক আসার পর রসের সুবাসেই বুঝতে হবে গুড়টা হয়েছে কি না। কখন জাল বন্ধ করতে হবে এসব রসের সুবাসেই বুঝতে হবে তা না হলে গুড়ের স্বাদও ভালো হবে না।’
ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়–য়া বালক আদনান রমজান গাছির মুখে খেজুরের রস ও গুড় তৈরির কাহিনী মুগ্ধ হয়ে শুনে। রূপকথার গল্পের মতোই এসব শোনার কৌতূহল তার বাড়তে থাকে।
‘বাবাজি আমাদের এই রসুলপুরে কত রকম স্বাদের গুড় অয় তা কি জানো?’
‘না... কৌতূহল ভরা কণ্ঠে জবাব দেয় আদনান।’
‘শোনো বাবাজি, গুড়ের মধ্যে কম বেশি জাল দিয়া তৈরি করা হয় বিভিন্ন ধরনের গুড়। এর মধ্যে আছে পাটালি, নলেন, ঝোলা, দানা, চিটা, ভেলি এসব নানা জাতের গুড়। এই রসুলপুরের পাটালি ও নলেন গুড়ের সুনাম দেশ ছাইড়া বিদেশেও ছড়াইয়া গেছে। তোমার নানুজানের হাতের কালি জিরা চাল আর নলেন গুড়ের পায়েস যে কি মজা তা যে না খাইছে সে বুঝবো না। তোমার বাবার তো এই নলেন গুড়ের পায়েস খুব পছন্দের। আর পাটালি গুড় দিয়া ভাপা, পুলি আরও কত জাতের পিঠা হয়। তয় বাবাজি অহন আর আগের মতো দিন নাই। আট দশ বছর আগেও দেড় দুইশো গাছ থাইক্ক্যা দশ-বারো জন কামলা দিয়া প্রতিদিন রস নামাইছি। আর অহন সব মিলাইয়া পঞ্চাশ ষাইট্টা গাছ আছে। আর আশপাশের কয়েক গাঁওয়ে গাছি আছি চাইর জন। আমাদের রসুলপুরেতো খেজুর গাছ অহন আট দশটার মতো আছে। তাই এই কাম কইরা অহন আর ভাত জোটে না বাবাজি। কিন্তু কি করুম এইডা যে নেশার মতো। প্রতি বছরই কার্তিক-অগ্রাণ মাস আইলেই খেজুর গাছ কাটার আয়োজন করতে থাকি। আহারে.. কী দিন গেল, আর কি দিন আইলো..!
কথাগুলো বলতে বলতে রমজান গাছির বুক ছিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। আদনানের মনে তার ছায়া ফেলে। সে বলে, ‘মামা, খেজুর গাছ কমে যাচ্ছে কেন?’
‘তা কেমনে কইয়াম বাবাজি। তয় আমার যেডা মনে অয়, যে বার থাইক্ক্যা ওই গাঙের পাড় ঘেইষ্যা পর পর তিনডা ইটের খলা অইলো হের পরের বছর থাইক্ক্যা খেজুর গাছ মরা শুরু করলো। ইট খলার আশপাশে অহন আর খুব গাছপালা নাই। অহন আমরার এই এলাকায় আম গাছে আগের মতন বোল ধরে না। জাম গাছে জাম অয় না, কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল অয় না। এই যে শীতকাল আইতাছে অহন ইট খলার ধুঁমায় পুরা এলাকা অন্ধাইর অইয়া যায়।’
আদনান এবার বিষয়টা বুঝতে পারে। সে পরিবেশ পরিচিতি বইয়ে পড়েছে, অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটা নির্মাণের ফলে ব্যাপক বায়ুদূষণ হয়। এর ফলে গাছপালাসহ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আদনান ভাবে এ বিষয়টি তার নানাজানকে বলতে হবে। এই রকম পরিবেশ দূষণকারী ইটভাটা থাকলে এ এলাকার গাছপালা সব নষ্ট হয়ে যাবে। জমিতে ফসল ফলবে না। পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। তাই এসব ইটভাটাকে পরিবেশবান্ধব করে নির্মাণ করতে হবে। নানাজানতো এই এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। তারও তো এই এলাকার পরিবেশ রক্ষার, মানুষের জীবন জীবিকা রক্ষার দায়িত্ব আছে।
এসব ভাবতে ভাবতে কিছুটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রমজান গাছির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে আদনান। বেলা তখন প্রায় দ্বিপ্রহর। এই কার্তিক মাসেও সূর্যের তেজ অনেক। আদনান গাঁয়ের ছোট্ট মাটির সড়ক ধরে হাঁটছে। দূরে দু’টি খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছগুলো যেন আদনানকে ইশারা করে ডাকছে। আদনানের তখন মনে পড়ে যায় রসের কথা, কি যে স্বাদ। গাছি মামা বলেছে, জিরান কাটা রসের স্বাদই অন্যরকম। পাটালিগুড়ের ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা...। আদনানের জিভে পানি এসে যায়। দূরের খেজুর গাছের দিকে তাকিয়ে সে হাঁটতে থাকে। মনে মনে ভাবে এই রাস্তার দু-পাশ জুড়ে অনেক খেজুর গাছ লাগাবে। ইটভাটাগুলো পরিবেশবান্ধব করে তৈরি করবে। এর পর এই রসুলপুর গ্রাম জুড়ে সারি সারি খেজুর গাছ দেখা যাবে। খেজুর গাছের আগায় ঝুলবে রসের হাঁড়ি। রস নামানো আর গুড় তৈরির ব্যস্ততায় কাটবে গাছি মামার দিন। পাটালি গুড়, নলেন গুড়...। গুড়ের সুবাসে আবার ভরে যাবে চারদিক।
আরও পড়ুন...