চলে গেলেন স্বপ্ন জাগানিয়া কবি আসাদ বিন হাফিজ
স্মরণ ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ আগস্ট ২০২৪
আশির দশকের একজন তুখোড় কবি। জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক। চিন্তাশীল তারুণ্যের পছন্দের থ্রিলার রাইটার। কিশোরদের প্রিয় কণ্ঠস্বর। বিশ্বাসী জনমানসে একজন সুপরিচিত গীতিকার। সাংস্কৃতিক কর্মীদের সামনের সারিতে থাকা একজন অন্যতম সিপাহসালার। সব মিলিয়ে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর কবি আসাদ বিন হাফিজ। তাঁর জীবন-সাহিত্য পাঠ করলে অগ্রজ কবি ফররুখ আহমদের কথা স্মরণে আসে।
জীবনের পুরোটা সময় ঢাকা শহরেই কাটিয়ে দিয়েছেন কবি আসাদ বিন হাফিজ। স্থানীয় মানুষের মতোই ঢাকা শহরের অলিগলি পথঘাট চেনা হয়েছে তাঁর। আর হবেই বা না কেন, জন্মই তো বৃহত্তর ঢাকায়। বর্তমান গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার অন্তর্গত বড়গাও গ্রামে। মুহাম্মদ হাফিজউদ্দীন মুন্সী এবং মাতা জুলেখা বেগমের কোল জুড়ে তিনি পৃথিবীর বুকে চোখ মেলেন ১ জানুয়ারি ১৯৫৮ সালে। ঢাকা কাছাকাছি হলেও জায়গাটি ছিল এক্কেবারে অজোপাড়া-গাঁ। চারিপাশে ঝোপঝাড়-জঙ্গল, পুকুর মাঠ সবই ছিল। সেই পরিবেশেই বেড়ে ওঠেন কবি। আরবি শেখা শুরু করেন বাড়ির পাশের মক্তবে। কবির বড়ো ভাই মুহাম্মদ ইউনুস ছিলেন পবিত্র কুরআনের হাফেজ। তিনি বিক্রমপুরে মোস্তফাগঞ্জ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করতেন। কবি আসাদ বিন হাফিজ ভাইয়ের সাথে সেখানে গিয়ে সহীহ কুরআন তেলাওয়াত শেখেন। সেইসাথে নিজ গ্রাম বড়গাঁও প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষাজীন শেষ করেন কবি।
কবির সবচেয়ে বড়ো ভাই অধ্যাপক ইউসুফ আলী। তিনি নরসিংদী কলেজে অধ্যাপনা করতেন। কবি সেখানে গিয়ে ব্রাহ্মনদী কলেজিয়েট হাইস্কুলে ভর্তি হন। কিছুদিন পরেই দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। তিনি বড়ো ভাইয়ের সাথে ঢাকায় চলে আসেন এবং তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলে ভর্তি হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ফরিদাবাদ হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৭৪ সালে সেখান থেকেই তিনি মানবিক বিভাগে এসএসসি পাশ করেন।
আসাদ বিন হাফিজ প্রথমে টাঙ্গাইল কালিহাতির ভন্ডেশ্বরে আলাউদ্দিন সিদ্দিকী কলেজে ভর্তি হন। এরপর ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাশ করেন। বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স শেষ করেন স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
শিক্ষকতা পেশার প্রতি খানিকটা ঝোঁক ছিল তাঁর। কবিতা প্রেমের কারণে বাংলায় উচ্চাতর ডিগ্রি নিয়েছেন। শিক্ষকতা পেশায় থেকে লেখালিখিতে তারুণ্যমন ধরে রাখার স্বপ্নেই তিনি শিক্ষকতা পেশাকে পছন্দের তালিকায় রাখেন। তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায় কিছুদিন বাংলা পড়ান। পরে মানারাত স্কুল এন্ড কলেজে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষতা করেন।
পেশাগত দিক থেকে শিক্ষক হলেও মনে মননে তিনি সাহিত্যকর্মী। ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্যপাগল। লেখালেখি, সম্পাদনা আর প্রকাশনার নেশায় মত্ত থাকতেন কবি আসাদ বিন হাফিজ। ‘মাসিক পৃথিবী’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে বেশ কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্র জীবনে ‘বিপরীত উচ্চারণ’ ও ‘সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী’র মতো সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ‘বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ এবং ‘সাহিত্য-সংস্কৃতিকেন্দ্রেও’ দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘ সময়। শিল্প-সাহিত্য বিকাশে তিনি নিজ দায়িত্বে প্রীতি প্রকাশন নামে একটি বড়ো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
ছাত্র জীবনেই সাহিত্যকর্মে নিজেকে পুরোপুরি ডুবিয়ে ফেলেন। এমনকি ডাকসু নির্বাচনে তিনি সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছেন। জীবনযাপনে তিনি যেমন ছিলেন সহজ-সরল তেমনি খুব সহজ ভাষায় লিখতে পছন্দ করতেন কবি আসাদ বিন হাফিজ। তিনি বলতেন, যা পাঠক সহজে বুঝতে পারবে না, সে সাহিত্য করে কী লাভ? শিল্প তো জীবনের জন্য। শিল্প তো মানবিক উৎকর্ষতার জন্য। তাই শিল্পবোধকে সহজীকরণের মধ্যেই সার্থকতা। তাঁর ছড়া-কবিতা কিংবা গানের মধ্যে দুর্বোধ্যতার তেমন কোনো মিশ্রণ চোখে পড়ে না। জীবনবোধের কথাগুলো তিনি সহজে শিল্পময় করে উপস্থাপন করতে পছন্দ করতেন।
‘কি দেখো দাঁড়িয়ে একা সুহাসিনী ভোর’ কাব্যগ্রন্থটি ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই আমি সংগ্রহ করেছিলাম ঢাকা থেকে। কবি আসাদ বিন হাফিজের প্রীতি প্রকাশনে নিয়মিত বসতাম। আড্ডা দিতাম। তখনই সংগ্রহ করেছিলাম তাঁর এই কবিতার বইটি। ছোটো-বড়ো মিলিয়ে তেষট্টিটি কবিতা স্থান পেয়েছে। সবগুলো কবিতা পড়েছিলাম একটানা। মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল দারুণভাবে। তখন থেকেই আমি তাঁকে ‘সুহাসিনী ভোরের’ কবি বলে সম্বোধন করতাম। ১৯৯৬ সালে ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পরে অন্যরকম এক আসাদ বিন হাফিজকে আবিষ্কার করলো বাংলাদেশের সাহিত্যমোদী মানুষেরা। এই গ্রন্থের ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ শিরোনাম কবিতাটি তাঁকে উন্নততর আসনে উচ্চকিত করে। সুহাসিনী ভোরের কবি থেকে তিনি হয়ে গেলেন ‘অনিবার্য বিপ্লবের কবি’। তিনি যে সমাজের স্বপ্ন দেখেন তার অসাধারণ এক কাব্যিক রূপ দিয়েছেন এই কবিতায়। কবিতার কয়েকটি চরণ-
আমি আমার জনগণকে
আসন্ন সেই বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
যেখানে অন্ধকার
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে ক্লেদাক্ত পাপ ও পঙ্কিলতার সয়লাব
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে নগ্নতা ও বেহায়াপনার যুগল উল্লাস
সেখানেই বিপ্লব
যেখানে মিথ্যার ফানুস
সেখানেই বিপ্লব
বিপ্লব সকল জুলুম, অত্যাচার আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে
বিপ্লব অন্তরের প্রতিটি কুচিন্তা আর কুকর্মের বিরুদ্ধে।
শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। অথচ শিশুতোষ ও কিশোর-সাহিত্যে আসাদ বিন হাফিজের রয়েছে বিশাল ভাণ্ডার। ছড়া, রম্যগল্প, থ্রিলার, প্রবন্ধ সব শাখাতেই সমানতালে বিচরণ করেছেন কবি আসাদ বিন হাফিজ। ‘হরফ নিয়ে ছড়া’ গ্রন্থটি প্রকাশ হয় ১৯৮৯ সালে। ১৯৯০ সালে প্রকাশ হয় ‘আলোর হাসি ফুলের গান’ নামের ছড়ার বই। ‘কুক কুরু কু’ প্রকাশ হয় ১৯৯২ সালে। এরপর ২০০১ সালে ‘আল্লাহ মহান’, ২০০১ সালে ‘কারবালা কাহিনী’, ‘মজার ছড়া বাংলা পড়া’, ‘মজার ছড়া আরবী পড়া’, ‘মজার পড়া অ. ই. ঈ. উ’ এবং ২০২১ সালে ‘টাপুর টুপুর বৃষ্টি’ তাঁর মজার মজার ছড়ার বই আমাদের শিশু-কিশোর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
কিশোর চোখে একটা স্বপ্নময় পৃথিবীর কল্পচিত্র এঁকে দেবার জন্য তিনি ১৯৯২ সালে প্রকাশ করেন ‘নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন’। সহজ ভাষার এ প্রবন্ধগ্রন্থটি পাঠকসমাজে সমাদৃত হয়। কবি ফররুখ আহমদকে সহজ সরল ভাষায় কিশোর উপযোগী করে তুলে ধরেছেন কবি আসাদ বিন হাফিজ। ১৯৯৭ সালে ‘নাম তাঁর ফররুখ’ প্রকাশিত হলে কিশোর তরুণ মহলে কবি ফররুখ আহমদ নতুনভাবে আন্দোলিত হন। উত্তাল মাদকতার ঢেউ থেকে সুস্থ জীবনের সন্ধান দিতে তিনি ১৯৯৯ সালে প্রকাশ করেন ‘আলোর পথে এসো’। কিশোর-তরুণের চোখে বিশুদ্ধ স্বপ্ন এঁকে দিতে বইগুলো ব্যাপক সফলতা অর্জন করে।
শিশু-কিশোর গল্পেও নতুন সম্ভাবনার গান শুনিয়েছেন কবি আসাদ বিন হাফিজ। ১৯৯৪ সালে ‘ইয়াগো মিয়াগো’ প্রকাশের মধ্যদিয়ে শিশু-কিশোর সাহিত্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তিনি। ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় ‘ভীন গ্রহের বন্ধু’। ‘ছোটদের মজার গল্প’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘জ্বিনের সঙ্গে বসবাস’।
ঐতিহাসিক দুঃসাহসিক অভিযান সিরিজের মধ্যদিয়ে কিশোর-তরুণদের স্বপ্নের নায়ক হয়ে ওঠেন কবি আসাদ বিন হাফিজ। ১৯৯৭ সালে ‘গাজী সালাউদ্দীনের দুঃসাহসিক অভিযান’ প্রকাশিত হবার পর থেকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সালাউদ্দীনের কমান্ডো অভিযান, সুবাক দূর্গে আক্রমণ, ভয়ংকর শিরযন্ত্র, ভয়াল রজনী, আবারো সংগ্রাম, দূর্গ পতন, ফেরাউনের গুপ্তধন, উপকূলে সংঘর্ষ, সর্প কেল্লার খুনী, চারিদিকে চক্রান্ত, গোপন বিদ্রোহ, পাপের ফল, তুমুল লড়াই, উম্রু দরবেশ, টার্গেট ফিলিস্তিন, গাদ্দার, বিষাক্ত ছোবল, খুনী চক্রের আস্তানায়, পাল্টা ধাওয়া, ধাপ্পাবাজ, হেমস এসর যোদ্ধা, ইহুদী কন্যা, সামনে বৈরুত, দুর্গম পাহাড়, রক্তাক্ত মরুভূমি, ছোট বেগম, রক্তস্রোত, যাযাবর কন্যা, মহাসমর’ এর মতো চৌত্রিশটি সিরিজ তরুণ পাঠককে ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করে। মোবাইল সংস্কৃতির ভয়াল ছোবলের এ যুগেও তারুণ্যেও উচ্ছ্বাসে বইগুলো দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনখণ্ডে সমাপ্ত ক্রুসেড সমগ্র কিশোর-তারুণ্যের যৌবনদীপ্ত অনুপ্রেরণায় উচ্ছ্বল ঢেউ তুলে চলেছে।
নসীম হিজাযীর অনুবাদ সম্পাদনা করে আসাদ বিন হাফিজ বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে অন্যরকম এক সুবাতাস ছড়িয়ে দেন পাঠক মহলে। সীমান্ত ঈগল, আঁধার রাতের মুসাফির, হেজাযের কাফেলা, ইরান তুরান কাবার পথে, কায়সার ও কিসরা, শেষ বিকালের কান্না, কিং সায়মনের রাজত্ব, ইউসুফ বিন তাসফিন, আলোর কুসুম, মহাবীর সুলতান মাহমুদ প্রভৃতি গ্রন্থগুলো বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
কবি আসাদ বিন হাফিজ তাঁর বর্ণাঢ্য সাহিত্যকর্মের অন্যতম সহযাত্রী কিশোরকণ্ঠ। কিশোরকণ্ঠের সাথে ছিল তাঁর আত্মিক সম্পর্ক, স্বপ্নময় প্রেম। তিনি নিয়মিত লিখতেন কিশোরকণ্ঠে। কিশোরকণ্ঠের লেখক-পাঠকদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল জান্নাতি স্বপ্নের সুবাসিত পরশমাখা। ২০০৪ সালে কিশোরকণ্ঠ ফাউন্ডেশন তাঁকে ‘কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করে অনুপ্রাণিত করে এবং নিজেরাও সম্মানিত হয়।
দুনিয়ার ব্যস্ততম সফর শেষ করে চলে গেলেন আসাদ বিন হাফিজ। মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন ২০২৪ সালের ১ জুলাই দিবাগত রাত্রি ১২.৫৫ মিনিটে। এটাকে আমরা ২ জুলাই রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরও বলতে পারি।
যিনি যেভাবেই বলুন না কেন, তিনি চলে গেছেন পরপারে এটাই সত্য কথা। তবে তিনি বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন। বেঁচে থাকবেন তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্মের মধ্যে। তিনি বেঁচে থাকবেন বিশ^াসী তারুণ্যের উদ্দীপ্ত চেতনায়। বিশ^াসী মানুষের কোমল ভালোবাসায়।
আরও পড়ুন...