জ্ঞানতাপস দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ
বিবিধ অধ্যাপিকা চেমন আরা এপ্রিল ২০২৫
অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এ দেশের এবং উপমহাদেশের প্রবীণতম দার্শনিক, ইসলামিক চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, সুপণ্ডিত, জাতীয় অধ্যাপক, সমাজ ও সমাজব্যবস্থার সমালোচক এবং সুসাহিত্যিক। তিনি ছিলেন একজন মহত্তম মানুষের প্রতিকৃতি। তিনি ত্যাগী মনীষী বটে। মহান দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। তিনি ছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদদের প্রতিকৃতি ও জ্ঞান তাপস। সত্যানুসন্ধানী, মানবতাবাদী। সভা-সমিতি, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এসব শব্দ যেন একাকার হয়ে মিশে থাকতো আজরফের প্রাত্যহিকতায়। তিনি এক কথায় সমাজের অস্তিত্ব হয়ে গিয়েছিলেন। সমাজের মানসভূমিতে তিনি বিচরণ করতেন। সমাজের সকল অবস্থানের মানুষের সাথে তাঁর এক গভীর আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল। আজরফ ছিলেন এক বিশেষ অর্থে সমাজমনস্ক মানুষ। তিনি খুব সহজে ছুটে যেতেন সমাজের মানুষের কাছে। সহজ কথায় বলা যায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমাজের অস্তিত্বপুরুষ।
এই মহান সাধক ১৯০৬ সালের ২৫শে অক্টোবর সুনামগঞ্জ জেলার তেঘরিয়া গ্রামে নানা মরমী কবি, হাসন রাজার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রাণবন্ত। তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব যার সামনে বসে থাকতে ভালো লাগতো। তাঁর হৃদয়টি ছিল চিরসবুজ। তিনি ছিলেন সদা হাস্যময় ও মমতাময়। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন স্বভাবের লোক ছিলেন তিনি। ভদ্র, অমায়িক এবং অজাতশত্রু। তিনি সহজ-সরল জীবন-যাপন করতেন। শান্তিবাগের একটি টিনের ঘরে তিনি বাস করতেন।
অধ্যক্ষ আজরফ সাহেব ছিলেন একজন দ্রষ্টা। তিনি দেখতে পারতেন নিজকে, সমাজকে, সমাজের মানুষকে। এই যে দেখার এক বিরল শক্তি অর্জন করেছিলেন তিনি এই শক্তিই ধীরে ধীরে তাঁকে করে তুলেছিল দ্রষ্টা থেকে একজন দার্শনিক। তাঁর দর্শন মানুষের দর্শন। কর্মময় জীবনের আস্থায় আস্থাশীল ছিলেন তিনি। তাঁকে বলা যায় কর্মিষ্ঠ দার্শনিক পুরুষ। এ সমাজে যারা কাজের নামে কর্তাগিরি করে বেড়ায় তারা একেবারেই উদাসীন, অমনোযোগী তাদের জন্য আজরফ সাহেবের কর্মময় জীবন এক অনুসরণীয় উদাহরণ। অধ্যক্ষ আজরফ সাহেব আজীবন সত্যের রাজতোরণের সন্ধানী ছিলেন। শৈশব থেকেই তাঁর সত্য অন্বেষার সত্তাটি ক্রমাগত জাগ্রত হতে থাকে। তিনি আমাদের জাতীয় জীবনের এক নক্ষত্রপুরুষ। উদার মানবতাবাদী এ মানুষটি তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, ঋজুতায় সর্বজননন্দিত। বর্তমান মানব সমাজের মুক্তির জন্য অনবদ্য জীবন দর্শন রচনা করে গেছেন দেওয়ান আজরফ। মানুষের সভ্যতা ও প্রগতির স্বার্থে তিনি জীবনদর্শন, সাহিত্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি সমন্বিত যে গ্রন্থাবলি রচনা করে রেখে গেছেন সে থেকে এ সমাজের সচেতন মানুষ মানবিক ঐশ্বর্যময় এক আলোকিত পৃথিবীর সন্ধান পেতে পারে। মনন চর্চার সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে এক উদার ও মার্জিত, শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের মাধ্যমে তিনি সমাজের পরিবর্তন ও সমাজব্যবস্থার রূপান্তর চেয়েছেন। তাঁর সারা জীবনের সাধনাই ছিল এ জড় সমাজের অচলাবস্থা দূর করা। তিনি রেখে গেছেন তাঁর বর্ণাঢ্য ও কর্মময় জীবনের ও জ্ঞানসাধনার ইতিহাস, শিক্ষা বিস্তারে ও জ্ঞান চর্চায় এবং সাহিত্য সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান। তিনি সুপুরুষ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী অথচ অমায়িক ও হাস্যোজ্জ্বল। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের অন্তরের উদারতা আর সৌন্দর্যও ছিল হৃদয়ে দাগ কাটার মতো। জমিদার নন্দন আর অভিজাত পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও, কোনোরূপ অহমিকা বা উচ্ছমন্যতা তাঁর আচরণে ছিল না। সিলেটের সুনামগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি নামের শেষে চৌধুরী পদবি লেখা বর্জন করেছিলেন এবং তাঁর বহু রচনায় দেওয়ান অভিধাও ব্যবহার করেননি। জমিদার নন্দন হওয়া সত্ত্বেও মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থা এবং চিন্তা চেতনার বিরোধী, ইসলামের সাম্য ও মানবতাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও শোষণ বঞ্চনামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় আকাক্সক্ষী। লেখালিখির উত্তরাধিকার অর্জন করেছিলেন অনেকটা বংশগত ও পারিবারিক ঐতিহ্য সূত্রে। ১৯৪৬ সালে তিনি আসাম আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অনুরাগী ও অনুসারী ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের কাণ্ডারি সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের তিনি ছিলেন আমৃত্যু সভাপতি।
তিনি ইসলাম ধর্মের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক দিক ইসলামের ইতিহাস ও দার্শনিক তত্ত্ব, ইসলামের আদর্শ ও মানবতাবাদী শিক্ষা তুলে ধরার পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম দর্শনেও তুলনামূলক পর্যালোচনা করতেন। তিনি ছিলেন সাম্যবাদী নীতি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শের বিশ্বাসী। আল্লাহর একত্বে এবং সার্বভৌমত্বে আস্থাবান দার্শনিক আজরফ হযরত আবু জর গিফারী (রা)-এর অনুরাগী ছিলেন। ১৯৬৭ সারে বিপ্লবী সাহাবী হযরত আবু জর গিফারী (রা)-এর নামে প্রতিষ্ঠিত করেন আবু জর গিফারী নামে একটি কলেজ। তিনি ছিলেন ঐ কলেজের অধ্যক্ষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের খণ্ডকালীন অধ্যাপকও ছিলেন তিনি। তিনি একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকসহ বহু পদক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি স্বজাতি, স্বদেশ, স্ব-সমাজের উন্নয়নেও ছিলেন অভিলাষী। বিখ্যাত দার্শনিক ও কবি সাহিত্যিকদের রচনাসহ শেখ সাদী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, আল্লামা ইকবাল, নজরুল প্রমুখের কবিতা তাঁর কণ্ঠ থেকে অনায়াসে উচ্চারিত হতো। তাঁর স্মরণশক্তি অবিশ্বাস্যরকমের। অনবরত তিনি ইংরেজি, ফারসি, আরবি, উর্দু কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন।
তিনি ৯৪ বছর বয়স পেয়েছিলেন। এই পরমায়ু খুব বেশি মানুষ পায় না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনুভূতি ও মন মানসিকতার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন জীবন্ত। বিংশ শতাব্দীর উষালগ্ন ১লা নভেম্বর ১৯৯৯ সালে আমাদের এই ধূলিধূসর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে তিনি চলে গেছেন আরেক পৃথিবীর দিকে। যেখানে মানুষ মাত্রই একাকী এবং নিঃসঙ্গ, সেখানে সাথী কেবল নিঃশব্দ মৃত্তিকানিচয়। কোনো মায়ার ডাক, ইন্দ্রিয়ের আহ্বান তাঁকে স্পর্শ করবে না। অতীন্দ্রিয় এক শব্দহীন, স্পর্শহীন, আলোহীন, অন্ধকারময় এক অনন্যপূর্ব ভুবনের বাসিন্দা এখন তিনি। তাঁর বিদেহী আত্মা এখন অনন্তের শান্তি, কল্যাণ এবং মুক্তির দ্বারপ্রান্তে শায়িত। আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি তাঁর পারলৌকিক শান্তি, কল্যাণ, মঙ্গল এবং মহাপরিত্রাণের জন্য।
আরও পড়ুন...