ঝিলকন্যা
গল্প এনায়েত রসুল জুলাই ২০২৪
রিমঝিম আপুর বিয়ে। তাই দুর্গাপুর এসেছি। দুর্গাপুরকে ঘিরে রেখেছে অসংখ্য পাহাড় আর পাহাড়ি গ্রাম। গ্রামের প্রান্ত ছুঁয়ে বয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা ঝরনাধারা। রয়েছে খানাখন্দ, পুকুর আর ঝিল। তেমনি এক জল থইথই ঝিলের পাড়ে একাকী বসে আমি আকাশ দেখছি, পাখি দেখছি, বিস্ময় ভরা চোখে পাহাড় আর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সবুজের সৌন্দর্য দেখছি। সে সময় পেছন থেকে রিনিঝিনি কণ্ঠে কে যেন বলে উঠলো, ভাইয়া! তোমার নাম? তোমাকে কি নামে ডাকবো?
কণ্ঠটা চেনা নয়। তাই অমন একটি প্রশ্ন শুনে আমি ঘুরে তাকালাম। এবার আমার চোখ পড়লো একটি ছোট্ট মেয়ের ওপর। মেয়েটি যেন মানুষ নয়, সদ্যফোটা কোনো সুন্দর ফুল! আর সেই ফুলটি ফুটে আছে আমার গা ছুঁয়ে। এত সুন্দর, এত নির্মল আর মিষ্টি দেখতে যে, অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে ওর তুলনা হয় না। আমাকে কি নামে ডাকবে, তা জানতে চাইছে সে।
মাত্র এক সেকেন্ড আগে আমি পেছনে তাকিয়েছিলাম। তখন কাউকে চোখে পড়েনি। আমি ছিলাম একেবারেই একা। হঠাৎ এ মেয়েটি এলো কোথা থেকে?
আমি সেই প্রশ্নটি করতে যাবো, তার আগেই আমাকে চমকে দিয়ে মেয়েটি দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া! বললে না, কী নামে ডাকবো তোমাকে?
মেয়েটির প্রশ্ন করার ধরন আমার কাছে গায়েপড়া ধরনের মনে হলো। তাই কণ্ঠে বিরক্তি নিয়ে বললাম, আমার নাম আনন। আমার বোনের নাম অধরা। আমার খালাতো বোন রিমঝিম আপুর বিয়ে। তাই ঢাকা থেকে দুর্গাপুর এসেছি। আমার কথা তো বললাম। এবার তোমার কথা বলো।
: আমার কথা বলবো না। শোনার দরকার নেই।
: কেন?
আমি বিরক্তি নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালাম। মেয়েটি বললো, কারণ, আমার কথা বলে কোনো লাভ নেই। সে কথা তোমার বিশ্বাস হবে না। মাঝ থেকে তুমি বিরক্ত হয়ে হাজারটা প্রশ্ন করবে।
কথাগুলো বলার সময় মেয়েটির কণ্ঠ ভারী হয়ে এসেছিল। মনে হচ্ছিল কান্না দমিয়ে রেখে সে কথাগুলো বলছে। তাই এবার একটু নরম সুরে বললাম, কথা দিচ্ছি, আমি বিরক্ত হবো না। আর তোমার সব কথা বিশ্বাস করবো। এবার বলো তুমি কে?
মেয়েটি বললো, আমি ঝিলের মেয়ে। আমার নাম ঝিলকন্যা।
মেয়েটির নাম শুনে অবাক হলাম না, ভালোও লাগলো। তাই বললাম, কী মিষ্টি নাম তোমার- ঝিলকন্যা! তো ঝিলকন্যা, তোমার বাড়ি কোথায়? কোন গ্রামের মেয়ে তুমি?
ঝিলকন্যা বললো, আমি কোনো গ্রামের মেয়ে নই। ঝিলের নিচে এক শহর আছে- ঝিলশহর। আমি সেই ঝিলশহরের মেয়ে।
ঝিলকন্যার সব কথা বিশ্বাস করবো বললেও এ কথাটা বিশ্বাস হলো না। তাই নিজের অজান্তেই আমার কণ্ঠে অবিশ্বাস ঝরে পড়লো- কী বললে? কোন শহরের মেয়ে? আবার বলো তো প্লিজ।
ঝিলকন্যা খিলখিল করে হেসে উঠলো আমার প্রশ্ন শুনে। হাসতে হাসতে বললো, কী মজা! তোমার চোখ দুটো গোল হয়ে গেছে! আমি জানতাম আমার কথা শুনে তোমার চোখ গোল হয়ে যাবে- একেবারে বলের মতো! কেন, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
বললাম, আমার সঙ্গে যে মেয়েটি কথা বলছে সে ঝিলের নিচ থেকে উঠে এসেছে, কেমন করে আমি তা বিশ্বাস করবো? এ কি বিশ্বাস করার মতো কথা, বলো?
ঝিলকন্যা বললো, আমি জানতাম, আমার কথা তোমার বিশ্বাস হবে না। কিন্তু আমি একটি কথাও বানিয়ে বলিনি! যা সত্য তা হলো, ঝিলের নিচে ঝিলশহর নামে একটা শহর আছে। আমি সেই শহরের মেয়ে। আমার মা আছেন বাবা আছেন। খেলার সাথী আছে। কিন্তু কোনো ভাই নেই। তাই ভাইয়ের খোঁজে এসেছি। আনন, তুমি আমার ভাই হবে?
বললাম, ভাই? ভাই হতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে একটি শর্ত আছে।
ঝিলকন্যা বললো, শর্ত? ভাই হবে, এ নিশ্চয়তা দিলে যে-কোনো শর্ত মেনে নেবো। বলো, কী শর্ত?
ঝিলকন্যা দুষ্টু দুষ্টু চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম, শর্ত হলো, আমার কাছে তোমাকে সত্য কথা বলতে হবে। তুমি কে, কোন গাঁয়ের মেয়ে, সে সব বলতে হবে আমাকে।
ঝিলকন্যা বললো, কী মুশকিল! সে কথা তো বলেছি। কিন্তু তুমি তা বিশ^াস করতে পারছো না। বিশ^াস করো, আমি ঝিলশহরের মেয়ে। আমার নাম ঝিলকন্যা।
আমি বললাম, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুমি মানুষের মেয়ে। হাত-পা-চোখ-মুখ সব মানুষের মতো। কথা বলছো মানুষের ভাষায়। অথচ তুমি বলছ তুমি ঝিলশহরের মেয়ে! ঝিলদের কখনো মেয়ে হয়? আচ্ছা, তুমি যে ঝিলশহরের মেয়ে, তার কোনো প্রমাণ আছে?
: প্রমাণ তো আছে। কিন্তু কেমন করে আমি তোমাকে সেই প্রমাণ দেখাবো? প্রমাণ দেখাতে হলে তোমাকে ঝিলশহরে নিয়ে যেতে হয়। মানুষদের তো ঝিলশহরে নিয়ে যাবার উপায় নেই।
অসহায় কণ্ঠে ঝিলকন্যা বললো। তার জবাবে আমি বললাম, উপায় থাকলে কী করতে? আমাকে ঝিলশহরে নিয়ে যেতে?
: অবশ্যই নিয়ে যেতাম। আর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শহরটা দেখাতাম। সেই শহরে তুমি যখন পানুষদের দেখতে পেতে, তখন আর আমাকে অবিশ্বাস করতে পারতে না।
: কে বললো পারতাম না? অবিশ্বাস করার সুযোগ তো তুমিই করে দিচ্ছো।
: আমি করে দিচ্ছি? কেমন করে?
উল্টো আমাকে প্রশ্ন করলো ঝিলকন্যা। আমি বললাম, আগে তুমি ঝিলশহরের কথা বলেছো। সেই কথাটা বিশ্বাস করবো কি করবো না সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না, নতুন করে আবার বললে পানুষদের কথা। পানুষ নামে কিছু আছে না কি?
ঝিলকন্যা বললো, আছে ভাই আছে। পানুষদের মা-বাবা ভাই-বোনও আছে। পানুষ হলো এক ধরনের জলজ প্রাণী।
: পানুষ জলজ প্রাণী? মজার কথা শোনালে! পানুষ নামে কোনো জলজ প্রাণী আছে, আমার তা জানা ছিল না। তোমার কাছ থেকে জেনে জ্ঞান বাড়লো। তো তুমি কোন প্রজাতির প্রাণী- মানুষ, না পানুষ?
আমার প্রশ্ন শুনে একটুও দমে না গিয়ে ঝিলকন্যা বললো, আমি পানুষ প্রজাতির মেয়ে পানুষ।
এত উল্টোপাল্টা কথা বলতে পারে মেয়েটা! ওর রহস্যময় কথাগুলো আমাকে বিরক্তির শেষপ্রান্তে পৌঁছে দিলো। তবু ধৈর্য ধরে বললাম, মেয়ে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ওই যে পানুষ বললে, সেই পানুষের ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দেখে ঝিলকন্যা যেন আকাশ থেকে পড়লো। ঝট করে মাথায় হাত দিয়ে বললো, হায় আল্লাহ! একটা সহজ কথা বুঝতে পারছ না! আচ্ছা, বুঝিয়ে বলছি। তোমাদের শরীর মাটি দিয়ে তৈরি- তাই তোমাদের নাম মানুষ। আর আমাদের শরীর পানি দিয়ে তৈরি- তাই আমাদের নাম পানুষ। তার মানে- মাটি থেকে মানুষ আর পানি থেকে পানুষ। সহজ কথা।
: আর কোনো সহজ কথা আছে?
জিজ্ঞেস করলাম আমি। ঝিলকন্যা বললো, হ্যাঁ, আছে। তোমাদের এই মাটির শরীর একদিন গলে-পচে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। আর আমাদের পানির শরীর অণু-পরমাণুর মতো পানির বিন্দু হয়ে পানির সঙ্গে মিশে যাবে। মাটির ওপর মানুষদের বসবাস আর পানির নিচে পানুষদের। একেবারে সহজ কথা।
খুব অল্প কথায় মানুষ আর পানুষদের সম্পর্কে বোঝাতে চেষ্টা করলো ঝিলকন্যা। কিন্তু আমি তার এক বিন্দুও বুঝলাম না। তাই বললাম, ব্যাপারটা তোমার কাছে সহজ মনে হলেও আমার কাছে তা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমি এক রূপকথার দেশে এসে পড়েছি। সেই দেশে ঝিলের নিচে শহর রয়েছে, সেই শহরে পানুষরা বাস করে, তুমি ঝিল থেকে উঠে আসা ঝিলের মেয়ে। এসব শুনে ভীষণ অদ্ভুত লাগছে। আমি শুধু একটা কথাই বলবো, বড়ো হয়ে তুমি গল্প লিখিয়ে হবে।
আমার কথা শুনে ঝিলকন্যার কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়লো- ছাই হবো। বুঝতে পেরেছি, আমার কথা তোমার বিশ্বাস হয়নি। মানুষদের নিয়ে এ এক সমস্যা- নিজের চোখে দেখেও তারা অনেক কিছু বিশ^াস করে না। কিন্তু বিশ্বাস করাবো কেমন করে! তোমাকে তো ঝিলশহরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তুমি যদি সাপ বা ব্যাঙের মতো উভচর প্রাণী হতে, তাহলে তোমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যেত। তবে হ্যাঁ, আমি অন্য একটা প্রমাণ দেখাতে পারি।
: কী প্রমাণ?
বিপুল কৌতূহল নিয়ে আমি ঝিলকন্যার দিকে তাকালাম। ঝিলকন্যা বললো, পানুষদের শরীর যে পানি দিয়ে তৈরি- সেই প্রমাণ। যদি দেখতে চাও তো বলো। চোখের পলকে গুঁড়ো গুঁড়ো পানি হয়ে প্রমাণ দেখিয়ে দিই। দেখাবো প্রমাণ?
ঝিলকন্যা আবার আমাকে একটা অদ্ভুত কথা শোনালো- চোখের পলকে পানির গুঁড়ো হয়ে গিয়ে সে আমাকে প্রমাণ দেখাবে! তা যদি পারে তো দেখাক। তাতে আমি আপত্তি করবো কেন?
এ কথা ভেবে আমি বললাম, আচ্ছা, প্রমাণ দেখাও।
: দেখবেই প্রমাণ? তাহলে যে তোমার কাছে আমার থাকা হবে না। আমি তো তোমার কাছে থাকতে চাই, ভাইয়া।
কেমন একটা আকুতি ঝরে পড়লো ঝিলকন্যার কণ্ঠে। কিন্তু আমাকে তা প্রভাবিত করতে পারলো না। বরং আমি বিরক্তির সঙ্গে বললাম, থাকতে চাও তো প্রমাণ দেখাও। তোমার থাকা না থাকার চেয়ে প্রমাণ পাওয়াটা জরুরি আমার কাছে।
আমার এ কথার জবাবে ঝিলকন্যা কিছু বললো না। শুধুু ম্লান হেসে ঝিলের দিকে তাকালো। সেভাবে কেটে গেল কয়েকটি সেকেন্ড। তারপর অবাক বিস্ময়ে আমি দেখলাম, ঝিলকন্যার শরীরটা টলটল টলমল করে উঠছে। সেই শরীর ডানে-বামে হেলেদুলে পড়ছে- যেন রক্তমাংসে নয়, সত্যি সত্যিই পানি দিয়ে তৈরি ওর শরীর!
ঝিলকন্যার শরীর ভেদ করে আমার দৃষ্টি ঝিলের ওপারে চলে গেল। ওর স্বচ্ছ শরীরের ভেতর দিয়ে আমি পাহাড়, বন আর আকাশ দেখতে পেলাম- কাচের ভেতর দিয়ে যেমন দেখা যায়। এ কি করে সম্ভব? আমি কি স্বপ্ন দেখছি!
আমাকে বিচলিত অবস্থায় দেখে ঝিলকন্যার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে সে বললো, আমি জানি, তোমার মনে আর কোনো সন্দেহ নেই। এবার তুমি মেনে নেবে আমি এক ঝিলের মেয়ে। আমার এ শরীর পানি দিয়ে তৈরি। বলো, বিশ্বাস হচ্ছে আমার কথা?
ঝিলকন্যার এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো। একবুক আশা নিয়ে মেয়েটি একটি অনুকূল জবাবের অপেক্ষায় রয়েছে। অথচ আমার চোখ যা দেখতে পাচ্ছে, মন তা মেনে নিতে পারছে না। এত কিছুর পর কেমন করে আমি এই সত্য প্রকাশ করবো?
আমি যখন অসহায়ের মতো ওর প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছি, সে সময় ঝিলকন্যা বললো, ভাইয়া! বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা?
বললাম, এই যে তোমার শরীর টলমল করছে, সেই শরীরের ভেতর দিয়ে আমি আকাশ-পাহাড় দেখতে পাচ্ছি- সব তো চোখের সামনেই ঘটছে। তবুও সবকিছু অবিশ^াস্য মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এক বিভ্রান্তির ভেতর বিচরণ করছি! তাই তোমার কথা বিশ্বাস করবো কি করবো না, বুঝে উঠতে পারছি না। আচ্ছা, তুমি যে পানুষদের কথা বললে, ওরাও কি তোমার মতো ডাঙায় উঠে আসে?
ঝিলকন্যা বললো, না, একেবারেই না। কারণ পানুষরা ডাঙায় উঠে এলে বেঁচে থাকতে পারে না। তাদের নিঃশ্বাস থেমে যায়।
: তোমারও কি নিঃশ্বাস থেমে যায়? কষ্ট হয়?
: খু-উ-ব কষ্ট হয়। এখন যে কত কষ্ট হচ্ছে, বোঝাতে পারবো না। কিন্তু উপায় নেই, আমাকে তো উঠে আসতেই হবে।
: কেন?
আমার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে এক মুহূর্ত আকাশের দিকে তাকালো ঝিলকন্যা। তারপর বললো, আমার যদি একটা ভাই থাকতো, তাহলে আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাঙায় উঠে আসতাম না। আমি আসি শুধুুু ভাইয়ের খোঁজে। একটি ভাইয়ের জন্য আমার মন যখন হাহাকার করে ওঠে, তখন মৃত্যুভয়ের পরোয়া না করে আমি ডাঙায় উঠে আসি। যেমন আজ এসেছি। আনন, আবার জিজ্ঞেস করছি- তুমি আমার ভাই হবে?
আমার পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বললো ঝিলকন্যা। কিন্তু মনে হলো পাশে নয়- সাত সমুদ্রের ওপার থেকে ওর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে! সেই কণ্ঠস্বরে রয়েছে শুধুু একটিই আকুতি- আনন, তুমি আমার ভাই হবে?
ঝিলকন্যার আকুতির মাঝে কোন শক্তি লুকিয়ে ছিল কে জানে, সেই আকুতি আমাকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ওপারে পৌঁছে দিলো। সত্য না মিথ্যা, স্বপ্ন না বাস্তব- সব প্রশ্ন মন থেকে মুছে দিয়ে আমার হƒদয় নিংড়ে বেরিয়ে এলো শুধু একটি প্রতিশ্রুতি- হ্যাঁ ঝিলকন্যা, আমি তোমার ভাই হবো। তুমি হবে আমার ঝিলবোন।
: ঝিলবোন? আহ্, কি যে ভালো লাগছে শব্দটা শুনে- ঝি-ল-বো-ন! আমি একটি ভাইয়ের বোন হয়ে গেলাম! আহ্... কি যে আনন্দ...
হাত দুটো দু দিকে ছড়িয়ে প্রজাপতির মতো ঘুরে ঘুরে নেচে চলছিল ঝিলকন্যার টলমলে দেহ। কিন্তু হঠাৎ ওকে থমকে যেতে হলো। ওর পা টলে গেল। শরীর এঁকেবেঁকে ভেঙে যেতে চাইলো। পড়ে যেতে যেতে দ্রুত আমার কাঁধে হাত রেখে নিজেকে সামলে নিলো ঝিলকন্যা।
আমি বললাম, সাবধান বোন, সাবধান। পড়ে যাবে তো!
চোখেমুখে কষ্টের ছায়া ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ছায়াটাকে সরিয়ে মিষ্টি করে হাসলো ঝিলকন্যা। তারপর বললো, সাবধানে ছিলাম বলেই তো পড়ে যাইনি। ভাই থাকার কী সুবিধা, দেখেছ? পড়ে যেতে যেতেও বোনেরা ভাইদের কাঁধে হাত রেখে নিজেকে রক্ষা করতে পারে- যেমন আমি রক্ষা করলাম নিজেকে। কিন্তু ভাইটির সঙ্গে তো বেশিক্ষণ থাকা হবে না।
: কেন?
বুক ভেঙে প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো। ঝিলকন্যা বললো, আমাকে বাবা-মায়ের কাছে যেতে হবে। ভাই, মনে রেখো আমাকে। ঝিল থেকে উঠে আসা এ বোনটিকে ভুলে যেয়ো না।
কোনো দিনও ভুলে যাবো না- সে কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। কণ্ঠ বুজে এলো। তা বুঝতে পেরে ঝিলকন্যা বললো, হলো কি তোমার? মন খারাপ লাগছে? ঠিক আছে, মন ভালো করে দিই।
আমার কাঁধ ছেড়ে দিয়ে ঝিলের দিকে হাত বাড়ালো ঝিলকন্যা, অমনি সেই হাতে একটি নীলপদ্ম উঠে এলো। সেই পদ্মটি আমার হাতে তুলে দিয়ে ঝিলকন্যা বললো, ভাইয়ের জন্য বোনের উপহার। হায় আল্লাহ! এখনও তুমি হাসছো না যে?
আমি কোনো জবাব দিলাম না। ঘোর লাগা চোখে নীলপদ্মটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে অবসরে আরো কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল। তারপর শুনতে পেলাম ঝিলকন্যার কষ্টে ভেজা কণ্ঠস্বর- উহ্ আল্লাহ! আমি আর পারছি না। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া।
: খুবই কি কষ্ট হচ্ছে?
: খু-উ-ব। আমাকে চলে যেতে হবে। নইলে আমি চিরদিনের মতো পানিতে মিশে যাবো।
: এখনই চলে যাবে?
: হ্যাঁ ভাইয়া, এক্ষনি। সময় শেষ হয়ে আসছে। বিদায় রে ভাই, বিদায়... মানুষ বোনটির সঙ্গে এই পানুষ বোনটিকেও মনে রেখো।
বুক ভেঙে আমার কান্না আসছিল। তবু ওকে আশ^স্ত করে বললাম, মনে রাখবো বোন, চিরদিন মনে রাখবো।
আমার এই আশ্বাস ঝিলকন্যা শুনতে পেয়েছে কি পায়নি বোঝা গেল না। নীল দুটি চোখ তুলে সে ঝিলের দিকে তাকালো। তারপর ভেসে এলো ওর যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠস্বর- আহ্! কী যে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার দেহ-মনে?
: কী অনুভূতি হচ্ছে ঝিলবোন?
: মনে আনন্দ হচ্ছে ভাই পেয়েছি বলে আর দেহে কষ্ট হচ্ছে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পানিতে মিশে যেতে হচ্ছে বলে। খু-উ-ব কষ্ট... আমি যাচ্ছি ভাইয়া, যাচ্ছি। তুমি ভালো থেকো- ভালো থেকো ভা-ই...
আমি বলতে চেয়েছিলাম তুমিও ভালো থেকো, কিন্তু তা আর বলা হলো না। তার আগেই ঝিলকন্যার টলোমলো শরীরটা কুয়াশার মতো ফিকে হতে হতে বাতাসে ভেসে ভেসে ঝিলের বুকে মিশে গেল! আমার হাতে রইলো শুধু ঝিল থেকে উঠে আসা নীলপদ্ম।
আরও পড়ুন...