তিন দুরন্ত মিশন জঙ্গলবাড়ি
রহস্যভেদ রবিউল ইসলাম জানুয়ারি ২০২৫
(গত সংখ্যার পর)
নয়.
শাইকের কয়েক হাত সামনে বিরাট সাপ। ওর দিকে ফণা তুলে আছে। ও মনে মনে দোয়া ইউনুস পাঠ করতে থাকে। সাপটা ওর দিকে এগিয়ে আসছে। শাইক বুঝতে পারছে না এখন কী করবে? এই সময় সাব্বির ও রাকিব থাকলে নিশ্চয়ই ওকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতো। ও বুঝতে পারছে কিছু একটা করা দরকার। একদমই সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। সাপ খুব ভয়ংকর। মুহূর্তে ছোবল মেরে বসতে পারে! আর একবার ছোবল মারলে, এই বনের মধ্যে অন্তত কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। শাইক ডান হাতটা পেছনে দিলো। তারপর একটি গাছের ডাল ধরলো। ডালটা বেশ সরু ও নরম ছিল। একটু মোচড় দিতেই ডালটা ভেঙে গেল। তারপর ডালটা হাতে নিয়ে এক মুহূর্ত দেরি করে না শাইক। গায়ের সব শক্তি দিয়ে সাপের মাথায় আঘাত করে। ডালের আঘাতে সাপটা টাল সামলাতে না পেরে একদিকে পড়ে যায়।
শাইক আর কোনো সময় নষ্ট করলো না। সুযোগ বুঝে দিলো ছুট। ও ছুটছে তো ছুটছে... মাঝে মাঝে লতায় পা আটকে যাচ্ছে। কিন্তু তাতেও থামছে না শাইক। ও শুনেছে সাপ নাকি অনেক দ্রুত দৌড়াতে পারে। কী জানি এই সাপ আবার ওর পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে কি না। এ রকম নানা ভাবনা ওর মাথার ভেতরে আসছে। কিন্তু ও থামছে না। এভাবে আর কত দৌড়ানো যায়! একসময় ক্লান্ত হয়ে যায় শাইক। এবার থামা দরকার, একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার। শাইক দাঁড়ালো একটি ঝোপের পাশে। ও হাঁফাচ্ছে, দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। একটু পানি খেতে পারলে ভালো হতো। এই জঙ্গলের মধ্যে কোথায় বা পানি পাবে। শাইকের শরীর যেন আর পারছে না। একটি গাছের গায়ে হেলান দিলো। তারপর চোখ দুটো বুজে আসে।
তিন বন্ধু মিলে স্কুলের মাঠে বসে আছে। কয়েকদিন পর ইন্টারস্কুল ফুটবল ম্যাচ। সেই ম্যাচের ক্যাপ্টেন শাইক। কত কিছু করতে হবে। সাব্বির ও রাকিবের সঙ্গে সেসব পরিকল্পনা করছে। কাকে কাকে দলে রাখা যায়। গোলকিপার হিসেবে কে ভালো করবে। ওদের সঙ্গে এসব নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করছে শাইক। এবার যেভাবেই হোক চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। গতবার পাশের গ্রামের স্কুলের কাছে ফাইনালে হারতে হয়েছে। অল্পের জন্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারল না ওরা। তাই এবার চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। পুরো উপজেলায় স্কুলের নাম উজ্জ্বল করতে হবে। তিনজন একসঙ্গে বলে উঠলো, ‘এবার আমরা চ্যাম্পিয়ন হবো ইনশাআল্লাহ।’
তখন মসজিদ থেকে আসরের আজান ভেসে আসে। রফিক স্যার এগিয়ে আসেন ওদের দিকে। স্যার বললেন, ‘চলো নামাজ আদায় করে আসি।’
স্যারের সঙ্গে মসজিদে গেল তিন বন্ধু। তারপর জামায়াতে আসরের নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষ করে আবার মাঠে এলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে দমকা বাতাস আসে। বনের গাছগুলো সব যেন নড়ে ওঠে। শুকনো পাতাগুলো বনের মধ্যে ঝরে পড়ছে। পত পত করে ঝরাপাতার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বনের মধ্যে বাতাসের শনশন আওয়াজ হচ্ছে। পাতার সঙ্গে পাতার ধাক্কা লাগছে। মনে হচ্ছে বনের মধ্যে ঝড় উঠেছে।
অবাক হয় শাইক! ও একটি গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে ওই এত সময় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল। শাইকের মন খারাপ হয়ে যায় রাকিব ও সাব্বিরে জন্য। ওরা দু’জন কি এখনো স্কুলের মাঠে বসে আছে? ওর জন্য কি ওরা এখনো অপেক্ষা করছে? নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে।
একটু আগে তো সাপের কাছে প্রাণটাই হারাতে যাচ্ছিল। আল্লাহর রহমত ছিল বলেই কোনোভাবে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার হয়েছে। শাইক ভিতর থেকে বলে ওঠে, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
শাইক একটু একটু করে সামনের দিকে পা ফেলতে থাকে। কিছু দূর আসার পর একটু ফাঁকা জায়গা পেল। এখানে জঙ্গল কিছুটা কম। মাটিতে ঘাসগুলো বিছানার মতো হয়ে আছে। শাইক সেখানে বসলো। অনেকক্ষণ ভাবলো, কিন্তু কোনো সমাধান খুঁজে পেল না। ও জঙ্গলের মধ্যে গোলকধাঁধায় পড়ে গেছে! কোনোভাবে বের হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। বারবার বিপদ এসে তাড়া করছে। রাত তো কম হলো না। আর কত সময় এভাবে চলতে থাকবে?
দুই দুইবার বিপদ থেকে উদ্ধার হয়েছে। তাই দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে চাইলো শাইক। যেই ভাবনা সেই কাজ। উঠে দাঁড়ালো নামাজে। তারপর দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করলো। তারপর দুই হাত তুলে দোয়া করলো।
এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে দোয়া করছিল শাইক। এখন ওর একটু ভালো লাগছে। ভয় কমে গেছে। চারপাশে জোনাক জ্বলছে। জোনাকগুলো যেন ওকে ঘিরে রেখেছে। তখন বনের মধ্যে হালকা বৃষ্টি নামলো। দুই হাত মুঠো করে শাইক বৃষ্টির পানি পান করলো। খুব বেশিক্ষণ বৃষ্টি হলো না। মিনিট পাঁচেকের মতো। বৃষ্টি শেষে আকাশ আবার পরিষ্কার হলো। মেঘ ভেদ করে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে বনের মধ্যে। সেই আলোতে বৃষ্টি ভেজা গাছের পাতাগুলো ঝলমল করছে। বনের মধ্যে আলোর মেলা বসেছে। এই বনটাকে এই মুহূর্তে খুব আপন মনে হচ্ছে শাইকের। নিজের ভেজা শরীরে কোনো ক্লান্তি নেই। সব ক্লান্তি যেন বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে।
উঠে দাঁড়ালো শাইক। আর কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নয়। যেদিকে মন চাইবে সেদিকে হাঁটতে থাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ওকে সাহায্য করবেন। শাইক ডান দিকে হাঁটতে শুরু করে। বেশ কিছু দূর হাঁটার পর মনে হলো সেই জামার কথা। সাপের তাড়া খেয়ে ওতো জামার কথাই ভুলে গেছে। ওর মনের মধ্যে আবার প্রশ্ন জমা হয়, তাহলে জামাটা কার? এ বনের মধ্যে জামা এলো কীভাবে? নিশ্চয়ই আর কেউ আছে এই বনের মধ্যে। সে অবশ্যই বিপদে পড়েছে, তাই তার জামাটা বনের মধ্যে পড়ে আছে। যদি বিপদে না পড়তো তাহলে বনের মধ্যে কারো জামা পড়ে থাকার কথা নয়।
এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল শাইক। কারো যেন আর্তনাদ শুনতে পায় ও। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর খুব ভালো করে শোনার চেষ্টা করে কোনদিক থেকে শব্দ আসছে। সামনের দিক থেকে আসছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন গোঙাচ্ছে। তবে খুব জোরে শব্দ হচ্ছে না। শাইক বুঝতে পারছে না সামনের দিকে যাওয়া ঠিক হবে কি না। ওর ভয় হচ্ছে, যদি ভয়ংকর কিছু হয়! আবার এটাও মনে হচ্ছে যদি কেউ বিপদে পড়ে, তাহলে তো তাকে সাহায্য করা দরকার। ও সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আর মনে মনে বলতে থাকে, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমাকে সাহায্য করুন।’
এক পা দু’ পা এগোতে এগোতে শাইক সামনে যেতে থাকে। গোঙানোর শব্দ ওর খুব কাছে চলে এসেছে। ও দূর থেকে দেখার চেষ্টা করে, মনে হলো একজন মাটিতে পড়ে আছে। ও খুব দ্রুত সেখানে যায়। সত্যি সেখানে একজন পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে অনেক অসুস্থ। চাঁদের আলোতে বোঝা যাচ্ছে লোকটার মুখে রক্ত লেগে আছে। হাত দুটো পেছন দিকে বাঁধা। শাইক দ্রুত লোকটার হাতের বাঁধন খুলে দিলো। তারপর বললো, ‘আপনি কে? এই বনের মধ্যে কী করছেন?’
লোকটা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। কেবল গোঙাচ্ছেন।
শাইক আবার বললো, ‘আপনার এই অবস্থা কীভাবে হলো?’
এবার লোকটা খুব আস্তে বলেন, ‘চেয়ারম্যান ও তার লোক। তুমি এখান থেকে চলে যাও। এটা খুব ভয়ংকর জায়গা। ওরা তোমাকে দেখলে মেরে ফেলবে।’
‘চেয়ারম্যানের লোক এখানে কীভাবে আসবে? ওরা কেন আপনাকে মারবে?’
‘আমার হাতে সময় খুব কম। তোমাকে বিস্তারিত বলা সম্ভব না। এই বনে চেয়ারম্যানের অপরাধের রাজত্ব চলে। চেয়ারম্যান যাদের শত্রু মনে করে তাদের এই বনে এনে মেরে ফেলে। তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাও। তোমাকে দেখলে জীবিত ছাড়বে না। ওরা খুব ভয়ংকর মানুষ।’
শাইক আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই লোকটা ওর হাতে একটা চাবি তুলে দিলেন। আর বলে দিলেন, ‘আরেকটু সামনে একটা নদী আছে। নদীর ওপারে চেয়ারম্যানের গোপন আস্তানা আছে, চেয়ারম্যানের জঙ্গলবাড়ি। ওরা ওখানে থাকে। ওখানে সবাইকে বন্দি করে রাখে।’
লোকটা একটু দম নিলেন। তার কথা বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমতা আমতা করে বললেন, ‘যদি কখনো পারো আমার একটু উপকার করবে। ওই জঙ্গলবাড়িতে একটি ছোটো সিন্দুক আছে, ওটা আমার। ওই সিন্দুকের চাবি এটা। ওর মধ্যে আমার সারা জীবনের সম্পদ গচ্ছিত আছে। যদি উদ্ধার করতে পারো আমার পরিবারের কাছে দিও বাবা। ওরা এই চাবি খুঁজছে। এজন্য আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে। আমার সিন্দুক নিয়ে এসেছে। কিন্তু খুলতে পারছে না। তুমি এখান থেকে চলে যাও। যে-কোনো মুহূর্তে ওরা এখানে চলে আসবে।’
সত্যি সত্যি কারো পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। কারা যেন এদিকে আসছে। লোকটা শাইককে পালাতে বলেন। ও দৌড়ে গিয়ে একটু আড়ালে দাঁড়ায়। দু’জন লোক এসে তার সঙ্গে চিৎকার করতে থাকে। লোকটা গোঙাচ্ছেন। ওরা বারবার চাবির কথা বলছিল। কিন্তু কিছুতেই লোকটা উত্তর দিচ্ছিলেন না। খানিকক্ষণ পর দুটো গুলির আওয়াজ শোনা যায়। তারপর লোক দুটো চলে যায়।
শাইক সেখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল ও নিজেও জানে না। এই প্রথম সামনে থেকে গুলির শব্দ শুনলো। ভয়ে ওর হাত ও পা কাঁপছে। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। শাইক স্তম্ভিত হয়ে গেছে। ওর স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো। তারপর ও আস্তে আস্তে লোকটার দিকে এগিয়ে যায়। কয়েকবার ডাকলো চাচা চাচা বলে। কিন্তু কোনো উত্তর এলো না।
শাইকের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। ও চাবিটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে। তারপর প্যান্টের পকেটে রেখে দিলো। সেখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না শাইক। লতা ও গাছ মাড়িয়ে দৌড়াতে থাকে। ও টানা দৌড়াচ্ছে। কোথায় থামবে, নিজেও জানে না। তখনই একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে যায় শাইক।
দশ.
সাব্বির পানিতে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরেই কুমির। কুমিরের লেজটা সাব্বিরের পায়ের দিকে। মাথাটা উলটো দিকে। এই বনে এসে শেষ পর্যন্ত কুমিরের পেটে যেতে হবে নাকি? ভয়ে পুরো শরীর শিউরে ওঠে! ও দাঁড়িয়ে আছে, কোনো নড়াচড়া করছে না। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বিপজ্জনক। কুমির এদিকে ঘুরলে আর রক্ষে নেই। মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে থাকে সাব্বির। তারপর নিঃশব্দে এক পা পেছনে নিলো। তারপর আরেক পা। এভাবে কয়েক পা পিছিয়ে আসে। ঠিক তখনই কুমিরটা নড়ে ওঠে। সাব্বিরও দ্রুত ডাঙায় উঠে যায়। কুমির ওর দিকে তেড়ে আসে। ও পাড়ে উঠেই দৌড়।
কিছুদূর দৌড়ে দাঁড়াল। বিরাট বাঁচা বেঁচে গেছে। আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাল সাব্বির, আলহামদুলিল্লাহ। এই বনটা যে এত ভয়ংকর বাইরে থেকে কোনোদিন ধারণা করতে পারেনি। অথচ ওদের স্কুলের পাশে এই বন।
এই মুহূর্তে সাব্বিরের মনে পড়ছে রাকিব ও শাইকের কথা। ওরা তিন বন্ধু। স্কুলে অনেক সুনাম, সবাই বলে তিন দুরন্ত। পড়ালেখা, খেলাধুলা সবকিছুতে সেরা। অথচ আজ রাতে ওরা তিনজনই এই বনের মধ্যে হারিয়ে গেছে। কে কোন অবস্থায় আছে তা বোঝা মুশকিল।
ওদের তিন বন্ধুর মধ্যে সাব্বিরের গায়ে একটু শক্তি বেশি। খেলার মাঠেও ওর সঙ্গে দৌড়ে কেউ পারে না। ওকে সবাই বলে ধুলিয়াপুরের রোনালদো। বন্ধুদের জন্য সব করতে পারে সাব্বির। কিন্তু আজ যেন কোনো কিছুই কাজ করছে না। রাকিব ও শাইককে ও কোনোভাবে খুঁজে পাচ্ছে না। তাই বলে হাল ছেড়ে দিলে হবে না। চেষ্টা করে যেতে হবে। কারণ সাব্বির জানে, আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন, যারা নিজে চেষ্টা করে।
তাই চেষ্টা করতে হবে। তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো না কোনো পথ ঠিকই বের করে দেবেন। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। বরং কাজে লেগে পড়তে হবে। কিন্তু মুশকিল হলো, ও এখন বনের কোন দিকে যাবে? বাইরে থেকে ছোটো মনে হলেও এই বনটা অনেক বড়ো। আর ভেতরে ঘন জঙ্গল। সাব্বির হাঁটতে থাকে। এদিক ওদিক তাকায় আর সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। খুব সাবধানে হাঁটছে ও। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়। কিংবা সন্দেহজনক কিছু সামনে পড়ে।
আকাশে চাঁদের লুকোচুরি খেলা চলছে। কখনো কখনো কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে চাঁদ। তখন পুরো বনে ঘন অন্ধকার নেমে আসছে। আবার মেঘ সরে গেলে চাঁদের আলোয় বনটাও আলোকিত হচ্ছে। চারদিকে নানারকম গাছ, লতা।
হঠাৎ সাব্বির খেয়াল করলো ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে গাছ নেই। অনেকটা অংশ ফাঁকা। শুধু গাছের গুঁড়ি আছে। তার মানে এখান থেকে কেউ গাছ কেটে নিয়ে গেছে। কিন্তু এটা তো সরকারি বন, এখানকার গাছ তো কারো কাটার কথা নয়। তখনই ওর মাথায় আসে চেয়ারম্যানের কথা। ও শুনেছে চেয়ারম্যান নাকি বনের গাছ কেটে কাঠ পাচার করে। আবার এই বনের মধ্যে চেয়ারম্যানের ছেলে বল্টুকে দেখেছে ও। বল্টুর সঙ্গে লোকও ছিল। তাহলে এটা নিশ্চিত এই বনে চেয়ারম্যানের লোকের যাতায়াত আছে। এবার অজানা আশঙ্কা ভর করে সাব্বিরের মনে! চেয়ারম্যানের লোকেরা রাকিব ও শাইকের কোনো ক্ষতি করলো না তো? এই চিন্তায় ওর কপাল ঘামতে শুরু করে। কানের পাশ দিয়ে শিরশির অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে।
সাব্বির সেখানে বসে পড়ে। কয়েকবার কী সব ভাবলো। তারপর বললো, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমার বন্ধুদের রক্ষা করুন। ওরা যদি কোনো বিপদে পড়ে আমাকে ওদের কাছে পৌঁছে দিন। আর আমাকে শক্তি দিন আমি যেন ওদের উদ্ধার করতে পারি।’
সাব্বির আবার হাঁটতে শুরু করে। কখনো আস্তে হাঁটছে, আবার কখনো জোরে জোরে পা ফেলছে। আর মাথার মধ্যে যত্ত সব চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। তখনই একটি পাখি উড়ে যায় ওর মাথার ওপর দিয়ে। ও চেয়ে চেয়ে পাখিটিকে দেখার চেষ্টা করলো। ও ঘুরে দাঁড়ালো, কী যেন ভাবলো। তারপর পাখিটি যেদিকে উড়ে গেছে ও সেদিকে হাঁটতে শুরু করলো। ফাঁকা বন শেষ। মানে এখান থেকে আবার ঘন বন। এদিকে গাছ কাটা হয়নি। ও ঘন বনের মধ্যে ঢোকে। লতার সঙ্গে ওর মাথাটা আটকে যায়। কয়েকবার চেষ্টা করে নিজেকে সেখান থেকে মুক্ত করলো। তারপর আবার হাঁটতে থাকে।
নিজের জুতো দুটো খুব ভারী মনে হচ্ছে সাব্বিরের। একবার ভাবলো জুতো জোড়া খুলে হাঁটবে। কিন্তু আবার ভাবলো এই বনের মধ্যে নানারকম কাঁটা থাকতে পারে। খালি পায়ে হাঁটলে সেই কাঁটা পায়ে ফুটবে। তাই কষ্ট হলেও জুতো জোড়া পায়ে দিয়ে হাঁটতে হবে।
অনেক পথ হাঁটা হলো। বন তবুও শেষ হচ্ছে না। রাকিব কিংবা শাইকের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। হঠাৎ সাব্বির কারো পায়ের আওয়াজ পেল। ও দাঁড়িয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজও বন্ধ হয়ে যায়। সাব্বির আবার হাঁটতে শুরু করে। আবার ওর কানে পায়ের আওয়াজ আসে। ও বুঝতে পারে, কেউ না কেউ ওকে অনুসরণ করছে। কিন্তু এই বনের মধ্যে ওকে কে অনুসরণ করবে? আর কেনই বা অনুসরণ করবে? একমাত্র চেয়ারম্যানের লোক এই কাজ করতে পারে। এতসময় ও যা বুঝেছে, তাতে এই বনে চেয়ারম্যান ছাড়া অন্য কারো যাতায়াত নেই।
এসব যখন ভাবছিল তখনই সাব্বিরের ঘাড়ে কেউ ঘুষি মারলো। ও নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়। তারপর মুখ তুলে তাকায়। ওর সামনে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা লম্বা গোঁফ তার। সাব্বির লোকটাকে চিনতে পেরেছে। যখন বল্টু ওদের তাড়া করলো তখন এই লোকটা ওদের পেছনে ছিল। এটা চেয়ারম্যানের লোক। লোকটা সাব্বিরকে জোরে লাথি মারার চেষ্টা করে। কিন্তু ও বুঝতে পেরে সরে যায়। তাতে লোকটার লাথি সরাসরি একটি গাছে লাগে। আর সে ব্যথায় কাতরে ওঠে, পায়ে ভালোই ব্যথা পেয়েছে। এই সুযোগ। সাব্বির উঠে দাঁড়ায়। তারপর পালটা আক্রমণ করে। লোকটার পিঠ বরাবর এমন একটা ঘুষি মারলো তাতে সে আঁতকে উঠলো। তারপর মুখ থুবড়ে বনের মধ্যে পড়ে গেল। ও দ্রুত লোকটার কাছে গিয়ে দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরে। তারপর পেছনে দিকে মুচড়ে রাখে। সে অনেক চেষ্টা করে কিন্তু সাব্বিরের কাছ থেকে কোনোভাবে নিজেকে ছাড়াতে পারে না।
লোকটার মাথায় একটা গামছা পেঁচানো ছিল। সাব্বির সেই গামছা দিয়ে লোকটার দুই হাত শক্ত করে পেছন দিকে বেঁধে দিলো। সে খুব চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর, কিন্তু আর পারছে না।
তখন লোকটা সাব্বিরের কাছে অনুনয় করলো, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না।’
‘আপনাকে ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু বলতে হবে, আমার বন্ধুরা কোথায়?’
‘তোমার সঙ্গে যে ছেলেটা ছিল তাকে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু আর কাউকে তো দেখিনি।’
‘ওকে ধরে নিয়ে কোথায় রেখেছে? কারা ধরে নিয়ে গেছে?’
‘চেয়ারম্যান ধরে নিয়ে গেছে। এই বনে যারা আসে তাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যায়।’
‘কোথায় নিয়ে গেছে?’
‘এ কথা আমি বলতে পারবো না। তাহলে চেয়ারম্যান আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে।’
‘আমাকে এটা জানতেই হবে। আপনি না বললে আমি আপনাকে ছাড়বো না।’
‘তুমি জানলেও কিছু করতে পারবে না। ওরা অনেক ভয়ানক মানুষ।’
‘ঠিক আছে আপনি তাহলে এখানে থাকুন। আমিই খুুঁজে নেবো।’ সাব্বির সামনের দিকে হাঁটা শুরু করে।
(চলবে)
আরও পড়ুন...