দুঃখ তাড়ানোর ঔষধ
গল্প আবরার সাঈদ জানুয়ারি ২০২৫
রাত দুইটা। চোখে ঘুম নেই। ইদানীং চিন্তার ডালপালা বেড়েছে খুব। দুঃখরা লজ্জায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে ঘরের এক কোণে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে। কারণ আমি চিন্তা করছি রাত গভীর হলে কী করে দুঃখদের তাড়ানো যাবে?
ছোটবেলায় একটি শুভ্র স্বপ্নের সাথে বসবাস ছিল আমার। স্বপ্ন দেখতাম আর আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্বপ্নের দু’গাল জুড়ে চুমু খেতে খেতে বলতাম- হে স্বপ্ন তুমি সত্যি হবে তো?
আমার সেই স্বপ্নের কথা একটি ইংরেজি রচনায় খুব লিখতাম। আই ওয়ান্ট টু বি এ ডক্টর। আজ থেকে চার-পাঁচ বছর আগে আমি সত্যি ছোট ছিলাম। আমার স্বপ্নের সমান ছিল মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার টপিকগুলো। আর আমি সেই বই আর টপিকগুলোতে নিয়ম করে চুমু খেতে খেতে বলতাম- হে স্বপ্ন তুমি সত্যি হবে তো?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। স্বপ্ন একদিন সত্যি হবে। কিন্তু বাস্তবতা যে স্বপ্নের থেকেও বড়ো সেটা তখনও জানা ছিল না। দুই দুই বার চেষ্টার পরও স্বপ্ন থেকে গেল অধরা। তাই পড়লাম মুষড়ে। আল্লাহ কেন আমার স্বপ্ন পূরণ করলেন না?
মা শুনলেন কথাগুলো। আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আস্তাগফিরুল্লাহ! আতাহার! এসব বলতে নেই। আল্লাহ আছেন বলেই তো তুই বেঁচে আছিস। আসতে পেরেছিস এত দূর। তোর রিজিক দেন কে? চলার শক্তি-সামর্থ্যের জোগান দেন কে? এই যে পথে ঘাটে এত বিপদ। হঠাৎ শুনি মানুষ নাই হয়ে যাচ্ছে। তোকে না আল্লাহ এসব বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। শোন! স্রষ্টা আমাদের কল্যাণ চান বলেই অনেক কিছু খোঁজার পরও দেন না। কারণ তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ জানেন। আমরা কেবল অতীত আর বর্তমান জানি। ভবিষ্যৎ জানি না।’
মা আমাকে টেনে তোলার সব ব্যবস্থা করলেন। বললেন, ‘আতাহার! আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, একদিন আল্লাহ তোমাকে এত বেশি দেবেন যে তুমি খুশি হয়ে যাবে। বুঝছিস। এত খারাপ লাগা কীসের। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখ।’
মায়ের চেয়ে আমি ইসলাম একটু বেশি বুঝি কিন্তু বিশ্বাসের বিচারে আমি মায়ের কাছে বারবার হেরে যাই। স্বপ্ন যেদিন ভঙ্গ হয়েছিল সেদিনও হেরে গেলাম।
আজ বিশ্বাসে পাকাপোক্ত হয়েছি ঠিকই কিন্তু রাত গভীর হলে দুঃখ তাড়ানোর জন্য চিন্তা করতে হয়। কেন করতে হয় জানি না। রাত দশটা-এগারোটার পর পরই দিনের বেলায় নাক ডেকে ঘুমানো দুঃখরা এসে জড়ো হতে শুরু করে রাত জাগা ঘুমহীন মানুষের কাছে। মস্তিষ্কে এসে গিজগিজ করতে থাকে। আবার সেই মস্তিষ্ক বিশিষ্ট মানুষের কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ! আমারও হয়েছে তাই!
আমার মা থাকলে এতক্ষণে কান ঝালাপালা করে ফেলতেন, তাড়াতাড়ি না ঘুমালে। আর শোনাতেন নবীজির দারুণ সব অভ্যাসের কথা। নবীজি এশার পরপরই ঘুমিয়ে যেতেন আর উঠতেন ভোর হওয়ার আগেই। সে সময়ে নাকি আসমান থেকে ফেরেশতাদের ডানায় চড়ে নেমে আসে অগণিত রিজিক। আর সেই রিজিকের ফলপ্রসূ সন্ধান পেতে তাড়াতাড়ি ঘুমানো চাই। তা না হলে কখনোই পাওয়া যাবে না আসমানি বারাকাহ!
এটা শতভাগ সত্য। মা এখন গ্রামে। মাকে খুব মিস করছি। এমন সময়ে হঠাৎ আমার মেসেঞ্জারে এক ছোট ভাই তার স্বপ্নের কথা জানালো। ছবি পাঠিয়ে বললো, ‘ভাই আমার স্বপ্ন এখন আমার ল্যাপটপের ওয়ালপেপারে। সুন্দর না?’
নাম তার তাসিফ। ছোট মানুষ। স্বপ্নও মাত্র একটি। দুইটি না, তিনটিও না। আমিও একসময় তার মতো ছিলাম। মাত্র একটি স্বপ্ন দেখেছি। অথচ পুরুষ মানুষের অন্তত চারটি স্বপ্ন দেখা উচিত। একটি স্বপ্ন দেখাতেই আমাকে ভুগতে হলো নিদারুণ কষ্টে। রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লো আমার বিশ্বাসী ক্বলব। যেখানে মানুষের ঈমান থাকে। সেই একটি স্বপ্ন ভাঙনের শব্দ কিছু সময়ের জন্য আমার ঈমানকেও তছনছ করে দিয়েছিল। তাই আমি কখনোই চাই না নিরর্থক মোটিভেশন দিতে আমার কোনো ভাইকে।
আমি তাকে বললাম, ‘শোনো তাসিফ। স্বপ্নকে উদার করো। শুধুমাত্র একটিকে শক্ত করে আঁকড়ে থেকো না। এটা ছাড়া আমার চলবে না- এমনটা ভেবো না। যদি এমন হয় তাহলে দুটো বিপদ আছে। এক. স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেলে হৃদয়ে অহংকার চলে আসার সম্ভাবনা আর দুই. স্বপ্ন পূরণ না হলে তোমার ক্বলব রোগাক্রান্ত হবার ঝুঁকি আছে। তখন না থাকবে ঈমান, না থাকবে আমল। কাজেই স্বপ্নকে মেলে ধরো আকাশের গায়। আকাশ উদার, না?’
‘জি।’
‘এক্সাক্টলি, তুমি চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখবে না কিন্তু তোমার স্বপ্নকে আকাশের মতোন উদার হওয়া চাই।’
‘জি অবশ্যই। অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। আমার জন্য দোয়া করবেন।’
‘মোস্ট ওয়েলকাম। ভালো থেকো। নিরন্তর দোয়া। রাত অনেক হয়ে গেল। পারলে তাহাজ্জুদ পড়ে খানিক ঘুমিয়ে ফজরের নামাজ পড়তে যেয়ো মসজিদে। আল্লাহ হাফেজ।’
‘তাসিফ! ওহ! এত কিছু বলে ফেললাম। আসল কথা তো বলা হয়নি এখনো। দুঃখ তাড়ানোর ঔষধ পেয়ে গেছি। বলবো? ধুর। এত ঢং আমার নিজেরও ভালো লাগে না। দুঃখ তাড়ানোর ঔষধ হচ্ছে এশার নামাজের পর খাবার খেয়ে ঘুমানো। আর তাহাজ্জুদের জায়নামাজে অশ্রু ঝরানো। কেন অশ্রু ঢালবো? সেই কথা না হয় মনের গহীনেই থাকুক।’
আরও পড়ুন...