দেশে দেশে টুপি সংস্কৃতি
গল্প সীমান্ত আকরাম মার্চ ২০২৫
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ও সভ্যতায় টুপির নিদর্শন রয়েছে। একেক দেশের টুপির সংস্কৃতি একেক রকম। প্রাচীনকাল থেকেই টুপি ব্যবহারের প্রচলন ছিল। গোড়ার দিকে মানুষ মাথা ঢাকার জন্য পাতা, পশুর চামড়া, পাখির পালক ইত্যাদি ব্যবহার করতো। একসময় এটি সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। রাজা, বাদশা ও যোদ্ধারা মাথায় মুকুট আর শিরোস্ত্রাণ পরিধান করতে থাকে। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের টুপির প্রচলন দেখা যায়। ধর্মীয় অঙ্গনের বাইরে বা বিশেষ ঘরানায় আলাদা আলাদা টুপি ব্যবহারের রীতি চালু আছে। এগুলোর ব্যবহার ও ধরন হিসেবে বিভিন্ন নামও আছে। যেমন- গোল টুপি, লম্বা টুপি বা কিস্তি টুপি, পাঁচকল্লি টুপি, চারকল্লি টুপি, জিন্নাহ টুপি, গান্ধী টুপি, নেহরু টুপি, নেপালি টুপি, মালয়েশিয়ান টুপি, শামি টুপি, তুর্কি টুপি, রুমি টুপি, পাকিস্তানি টুপি, সৌদি টুপি, আরবি টুপি, জালি টুপি, তালি টুপি, বেতের টুপি, খানকা টুপি, দরবারি টুপি, পিরালি টুপি, মুরিদি টুপি, কংগ্রেসি টুপি, বিয়ের টুপি ও ঈদের টুপি ইত্যাদি।
টুপি মুসলিম উম্মাহর জাতীয় নিদর্শন
টুপি মুসলিম উম্মাহর জাতীয় নিদর্শন। টুপি নবী করিম (সা) নিজে পরেছেন, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেইন তাবেতাবেইন ও পরবর্তী সময়ে সব যুগে মুসলিমগণের টুপি পরিধানের ব্যাপক আমলের ধারাবাহিকতা চলে আসছে।
রাসূলুল্লাহ (সা), সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবেতাবেইন, আইম্মায়ে মুজতাহিদগণসহ সব যুগে টুপি পরিধান করার প্রচলন মুসলিম সমাজে ছিল, এখনো আছে।
মুসলমানদের জাতীয় পোশাকের মধ্যে অন্যতম। এটি শুধু নামাজ বা সভা-সমাবেশের সঙ্গে নির্দিষ্ট নয়; বরং রাসূল (সা) এবং সাহাবায়ে কেরাম (রা) সবসময় পাগড়ি-টুপি পরিধান করতেন।
হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে শামে (সিরিয়ার) তৈরি সাদা টুপি পরিহিত অবস্থায় দেখেছি’। হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, ‘সফরে নবী করিম (সা) এমন টুপি পরিধান করতেন, যা দ্বারা কান ঢাকা যায় এবং বাড়িতে অবস্থানকালে শামে তৈরি (সাধারণ) টুপি পরিধান করতেন’। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা)-এর তিন রকম টুপি ছিল। এক. সাদা তুলার আস্তরণবিশিষ্ট টুপি, দুই. ডোরাদার ইয়ামানি চাদর দ্বারা নির্মিত টুপি এবং তিন. কান ঢাকা যায় এমন টুপি। এটি তিনি সফরকালে পরতেন এবং কখনো কখনো নামাজ আদায়ের সময় রসটি সামনে রেখে দিতেন।
মুসলিম সংস্কৃতিতে টুপি
পৃথিবীতে অনেক ধর্ম-বর্ণের মানুষের বসবাস। সবারই একেকটি প্রতীক থাকে। টুপি একজন মুসলমানের সংস্কৃতির অংশ। ইসলামে পোশাকের সৌন্দর্যের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নামাজের সময় তোমাদের সর্বোৎকৃষ্ট পোশাক পরিধান করো’ (সূরা আরাফ : ৩১)। আর ইসলামের শিয়ার বা প্রতীক টুপি অবশ্যই সুন্দর পোশাক। হযরত যুহাইর (রহ) বলেন, আমি প্রখ্যাত তাবেয়ি আবু ইসহাক সাবিয়িকে দেখেছি, তিনি আমাদের নিয়ে নামাজ পড়ছেন। তিনি মাটি থেকে টুপি উঠিয়ে মাথায় পরছেন। টুপি মুসলিমদের ব্যক্তিত্বে আভিজাত্য প্রকাশ পায় টুপির মাধ্যমে। মুসলিম সংস্কৃতির অন্যতম একটি পোশাক এই টুপি। তাই টুপি পরিধানে মুসলিমদের গুরুত্ব অপরিসীম।
বিভিন্ন দেশ ও সভ্যতায় টুপির ব্যবহার
পারস্য : উষ্ণীষের বয়স প্রায় ছয় হাজার বছর। অনেকে বলেন, পারস্যেই এর যাত্রা শুরু।
গ্রিস ও রোম : গ্রিসে উষ্ণীষের ব্যবহার দেখা যায় পাঁচ হাজার বছর আগে মিনোয়ান সমাজে। মিনোয়ান নারী-পুরুষ সবাই বড়ো চুল রাখতো আর পাতা বা ধাতু দিয়ে মুকুট বানিয়ে নিতো। তবে শাসক ও ধর্মগুরুরা কাপড়ের উষ্ণীষ ব্যবহার করতেন। আফগানদের পাকল নামের টুপি আর গ্রিকদের কাউসিয়া প্রায় একই রকম দেখতে। ধারণা করা হয়, গ্রিকরা এটি আফগানিস্তানের নুরিস্তানে নিয়ে আসে। গ্রিকরা পশ্চিম এশিয়ার (কুর্দিস্তান, সিরিয়া প্রভৃতি) দেশেও টুপির প্রসার ঘটিয়েছে।
চীন : খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের আগে থেকে চীনের রাজারা সিল্কের উষ্ণীষ ব্যবহার করতেন। তাদের টুপিতেই প্রথম রোদ থেকে বাঁচার জন্য বাড়তি অংশের ব্যবহার দেখা যায়। সাধারণ লোকজনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠদের টুপি পরার অধিকার ছিল।
ইহুদি টুপি : টুপি ব্যবহারে ইহুদি ধর্মগুরুরা বেশ যত্নবান ছিলেন। মিসরে ফারাওরা মাথা-ঢাকনি ব্যবহার করতেন। রানি নেফারতিতির মুকুট দেখা যায় চোঙা আকৃতির। ইহুদিদের টুপি অন্য সব টুপির চেয়ে ছোট। অনেক ক্ষেত্রে মাথার তালুর সঙ্গে চুলের ক্লিপ দিয়ে আটকানো থাকে।
খ্রিস্টধর্ম : খ্রিস্টধর্মে টুপির ব্যবহার তেমন একটা দেখা যায় না। তবে পোপকে বিশেষ এক ধরনের টুপি ব্যবহার করতে দেখা যায়।
আফ্রিকা : আফ্রিকায় মুকুট বা উষ্ণীষের চল বহু পুরোনো। তবে কাপড়ের টুপির ব্যবহার তুলনামূলকভাবে নতুন। ইসলাম প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকায় কাপড়ের টুপির ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। আরবরা টুপি ও পাগড়ি ইসলাম আসার আগে থেকেই ব্যবহার করতো। শীতপ্রধান অঞ্চলে পশুর চামড়া বা পশমের টুপি দেখা যায় বেশি, বিশেষত উত্তর এশিয়ায়।
বাংলাদেশে টুপির রকমফের
বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে টুপি ব্যবহারের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে ঘরানাভেদে টুপি ব্যবহারের বৈচিত্র্য রয়েছে। বাংলাদেশের মুসলমানরা পরিধান করে থাকেন এমন কয়েক ধরনের টুপির বৃত্তান্ত তুলে ধরা হলো।
পাঁচকল্লি : বাংলাদেশের অনেক কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী পাঁচকল্লি টুপি পরেন। পাঁচকল্লি টুপির মধ্যে আরেক প্রকারের টুপি আছে, যেগুলোতে এমব্রয়ডারি বা সাদা সুতার নকশা থাকে না। ইসলামের মূল স্তম্ভ পাঁচটি। তাই এসব দিকে চিন্তা করে অনেকে পাঁচকল্লি টুপি ব্যবহার করেন।
কিশতি টুপি : নৌকার মতো লম্বা এক ধরনের টুপিকে বলা হয় কিশতি টুপি।
কুশিকাটার টুপি : কুশিকাটা বা ক্রুশকাঠির মাধ্যমে হাতে বোনা টুপি। প্রায় ৬ ইঞ্চি লম্বা স্টিলের একটি চিকন কাঠির মুখে সুতা পেঁচিয়ে ধরার জন্য সামান্য বাঁকানো, এরই নাম হলো কুশিকাটা। মুসল্লির মাথায় নামাজের সময় কুশিকাটা দিয়ে তেরি টুপি দেখা যায়। টুপিটি শুধু সুতা দ্বারা তৈরি এবং হালকা-পাতলা হওয়ায় নামাজ শেষে আবার সুন্দরভাবে পকেটে রেখে দেওয়া যায়। বগুড়ার ধুনট এবং শেরপুরের একাধিক এলাকায় কয়েক বছর ধরে এই টুপি তৈরি হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তো যাচ্ছেই, বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে এই টুপি।
জালি টুপি : জালের মতো বুনন করা জালি টুপির প্রচলন ব্যাপকভাবে দেখা যায় চট্টগ্রামের মাদ্রাসাগুলোতে। জালি টুপি চিটাগাঙ্গি টুপি নামেই এর পরিচিতি। সিলেটেও মোটামুটি এই টুপির প্রচলন রয়েছে। ধর্মীয় অঙ্গনে আধুনিক ও তরুণদের অনেকের কাছেই বর্তমানে জালি টুপিটাই বেশি পছন্দের। চিটাগাঙ্গি টুপি ছাড়াও জালি টুপির আরও নানা আদল আছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে তুর্কি জালি। তুর্কি জালি বর্তমানে অনেকেই পরেন।
জিন্নাহ টুপি : মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ যে টুপি পরতেন সেটাকে জিন্নাহ টুপি বলা হয়। টুপিটির মূল নাম ছিল ‘কারাকুল’ টুপি। কারাকুল অর্থ কালো পশম। এই টুপিটি কারাকুল জাতের (কালো পশমি) ভেড়ার পশম দ্বারা তৈরি করা হয়। নকশার ক্ষেত্রে টুপিটি উঁচু হয়ে থাকে এবং এর বেশ কয়েকটি ভাগ রয়েছে। টুপিটি মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম জনসংখ্যার মধ্যে এখনো বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
তালের আঁশের টুপি : তালের আঁশের টুপিকে ভাসানী টুপিও বলা হয়। তালের আঁশ ও তালপাতা সরু সরু করে নির্দিষ্ট মাপে কেটে হাতে বানানো হয় এই টুপি। একসময় এই টুপির খুব চাহিদা ছিল। গ্রাম ও মফস্বলের লোকেরা এই টুপি পরতেন। গ্রামের অনেক মসজিদে এখনো এই টুপির দেখা মিলে।
আল আজহারের টুপি : লাল রঙের টুপির ওপর সাদা কাপড় প্যাঁচানো বিশেষ এক ধরনের টুপি। মিসরে ঘোরাফেরা করলেই দেখা যাবে এমন বিশেষ ডিজাইনের টুপি পরিহিত আলেমদের। তারা আল আজহারের গ্র্যাজুয়েট। বাংলাদেশের যেসব শিক্ষার্থী মিসরের আল আজহার থেকে পড়াশোনা করে আসেন তারাও এই লাল-সাদা রঙের টুপি পরিধান করেন। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হলেও সেখানে পড়াশোনা না করেও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষ এখন এই টুপি পরেন।
কারুকাজ করা টুপি : এটি রঙিন সুতার কারুকাজ করা এক ধরনের উঁচু টুপি। অনেক আলেম এই ধরনের টুপি পরিধান করে থাকেন। আলিয়া মাদ্রাসার অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরও এই ধরনের টুপি পরিধান করতে দেখা যায়। গ্রাম, মফস্বল থেকে শুরু করে শহুরে শৌখিন লোকদের এই ধরনের টুপি পরিধান করতে দেখা যায়।
বুগিস টুপি : বর্তমানে কওমি মাদ্রাসার রুচিশীল শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গ্রাম, মফস্বল ও শহুরে শৌখিন লোকদের বুগিস টুপি পরিধান করতে দেখা যায় অহরহ। এটি এক ধরনের দামি কাপড় দ্বারা তৈরি, যা সাদা রঙের হয়ে থাকে। তুরস্ক, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবসহ একাধিক মুসলিম দেশ থেকে এই টুপি বাংলাদেশে আসে। দেশভেদে এই টুপির দাম ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
প্লাস্টিকের টুপি : প্লাস্টিকের পাতলা আবরণ দিয়ে তৈরি টুপি। আগে কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এই টুপির ব্যবহার ছিল। এখন খুব একটা দেখা যায় না। এক সময় অনেক মসজিদেও রাখা হতো এই টুপি। যেসব মুসল্লির টুপি থাকতো না, তারা এই টুপি পরিধান করে নামাজ পড়তেন।
টুপির ক্ষেত্রে শরিয়তের মূলনীতি হলো টুপি রেশম, স্বর্ণ ও রুপার তৈরি হতে পারবে না, কাফের ও নারীদের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারবে না এবং অহংকার ও দাম্ভিকতাপূর্ণ হতে পারবে না। তবে সবচেয়ে উত্তম টুপি হলো, যা পরিধান করার মাধ্যমে বিনয় প্রকাশ পায়। বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিভেদে টুপির রকমফের বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন...