ধৈর্যের পরিণাম

ধৈর্যের পরিণাম

প্রবন্ধ নিবন্ধ ড. মোজাফফর হোসেন সেপ্টেম্বর ২০২৪

ধৈর্য শব্দের প্রতিশব্দ আছে, যেমন- সংযত, ধীর, স্থির, অবিচল, সহ্য, অপেক্ষা, সহিষ্ণু, নিস্পৃহ প্রভৃতি। ধৈর্য বলতে এসব শব্দের ভাবার্থকেই বোঝায়। ধৈর্যের আরবি প্রতিশব্দও আছে, তা হলো- সবর। আর আরবি সাবের অর্থ হলো ধৈর্যশীল। সঙ্কুল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার পরও অপ্রত্যাশিত কোনো অপ্রীতিকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে অপেক্ষা করার অর্থই হলো ধৈর্যধারণ। রাগ বা উত্তেজনার সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সংক্ষুব্ধ হওয়ার পরও অচিবল থাকাই হচ্ছে ধৈর্য। ধৈর্য মনুষ্যত্বের বড়ো গুণ; মানুষ হয়ে ওঠার সিঁড়ি। মানুষের আত্মসম্মানবোধ ও ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠতে পারে ধৈর্যধারণের মাধ্যমে। ওজনও ধৈর্যের প্রতিশব্দ। ওজনসম্পন্ন মানুষ মানেই ব্যক্তিত্বেপূর্ণ ধৈর্যশীল মানুষ। আবার ওজনসম্পন্ন মানুষ মানে মান-সম্মানবোধসম্পন্ন মানুষ। সম্মানবোধও সৃষ্টি হতে পারে ধৈর্য ধরার মধ্যে দিয়ে। ধৈর্যের বিপরীত শব্দ হলো অধীর, ধৈর্যহীন, চঞ্চল, অসহিষ্ণু, বিচলিত, কাতর, ব্যাকুল, উৎকণ্ঠিত। অবনতও হতে পারে ধৈর্যের বিপরীত শব্দ। আর অবনত হতে না পারলে নিজেকে আকাশের মতো উঁচু মনে হতে পারে।

যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে কিংবা কোনো একটা বিষয়ে তিক্ত-বিরক্ত হতে হতে মানুষ একসময় বলে ফেলে, আর কত সহ্য করা যায়! ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে। অথবা রগরগা রাগে লাল হতে হতে রাগকে বশে আনতে মানুষ ধৈর্যধারণের চিন্তা করে; আর তখনই বলে, ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে। আদতেই কি ধৈর্য-সহ্যের সীমা আছে? যদি ধৈর্যের সীমা থাকে; তাহলে সেই সীমা কী  হতে পারে বা কত রকম হতে পারে! সীমা অতিক্রম করলে কী ঘটে? সীমানা পেরিয়ে মানুষ কী করতে চায়? কী করে? কিংবা কী করা সমীচীন? তা নিয়ে দু-এক কথা বলার অবকাশ আছে।

ধৈর্য মানুষের ব্যক্তিজীবনের সাথে ঘনিষ্ঠ। ব্যক্তির ব্যক্তিজীবনে আঘাত লাগলে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। তবে ধৈর্য ব্যক্তিজীবনেই ধারণ করতে হয় সবচেয়ে বেশি। জীবননাশ কিংবা অঙ্গহানির মতো আঘাত না আসলে সেখানে ধৈর্যধারণ করা জরুরি হতে পারে। ধৈর্যধারণ করা জরুরি হতে পারে অসুখ-বিসুখ, রোগশোকে; বিপদে-আপদে, অর্থসম্পদ বা টাকাপয়সা হারিয়ে গেলে, অথবা অর্থের ক্ষতিসাধন হলে; ফল-ফুল, ফসল বিনষ্ট হলে। ধৈর্যশীল হওয়ার প্রয়োজন পড়ে দাম্পত্যজীবনের নৈমিত্তিক আচরণে। সন্তান-সন্ততি উৎপাদনে ব্যর্থ হলেও ধৈর্য ধরতে হয় সন্তুষ্ট চিত্তে। ধৈর্যের ফল সুমধুর। বেশির ভাগ মানুষ ব্যক্তি জীবনে ধৈর্যধারণ করতে পারে না। অল্প বিপদে, সামান্য ক্ষতিতে, কিংবা দাম্পত্য কলহে বিচলিত হতে থাকে। অস্থির হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে। ক্ষতির পরিমাণ আন্দাজ করতে না পেরে রাগে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। সংঘটিত ঘটনায় ধৈর্য ধরার কারণে যে পরিমাণ ক্ষতি সম্পন্ন হতে পারে, দেখা যায় ধৈর্যহারা হওয়ার কারণে বা অস্থির বিচলিত হয়ে ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে তার দ্বিগুণ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তড়িৎ গতিতে ধৈর্য অবলম্বন করতে না পারলে যে ক্ষতি হয় তার মাশুল দিতে হতে পারে জীবনভর। ব্যক্তিজীবনে ধৈর্য ধরার জোর তাগিদ থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষতিতে কিংবা প্রতিষ্ঠানের সমূহ বিপদে ধৈর্য ধরার ফল আরো  বিপদের অথবা ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন বহিঃশত্রুর আক্রমণে রাষ্ট্রপ্রধান যদি ধৈর্যধারণ ফরমুলায় অভ্যস্ত হতে থাকে, তাহলে সেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সার্বভৌমত্ব ও অস্তিত্ব বিলীন হতে পারে। এভাবে সামাজিক কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর বিপদ কিংবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিসাধিত হতে থাকে আর সেই প্রতিষ্ঠান প্রধান যদি আসন্ন ক্ষতি থেকে উত্তরণের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করে ধৈর্যধারণ করে, তবে সেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ক্ষতির কবল থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন হতে পারে। প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে ব্যক্তি ধৈর্যধারণ না করলেও ব্যক্তিগত বিপদে-আপদে ধৈর্যধারণের ফলে ব্যক্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

ব্যক্তিগত বিপদে আপদে ধৈর্যধারণের কোনো সীমানা নেই। হতে পারে অনন্তকাল ধৈর্যধারণ করতে হবে। বিপদ কখন কেটে যেতে পারে বলা অসম্ভব। যে পর্যন্ত না কেটে যাবে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। বিপদ-আপদের আশঙ্কা যতদিন বহাল থাকবে, ততদিনই ধৈর্যধারণ করতে হতে পারে। ধৈর্যধারণের ব্যাপারে বিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পরামর্শ রয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ১৫৩ থেকে ১৫৭ নম্বর আয়াতে ধৈর্যধারণ বিষয়ে আল্লাহ বিশ্বাসী ব্যক্তিকে পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেছেন- ‘ঈমানদারগণ তোমরা  আশ্রয় প্রার্থনা করো, ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে; ধৈর্যধারণকারীদের সঙ্গে আল্লাহ আছেন।’ এর পরের বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর রাস্তায় যারা জীবন দিয়েছে তাদেরকে তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত কিন্তু তোমরা বুঝতে পারো না।’

প্রথম আয়াতে ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা হয়েছে; আর পরের আয়াতেই বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর রাস্তায় মৃত্যুবরণ করেছে তাদের সম্মানের কথা। অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে সেসব প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে ধৈর্যধারণ নয়, প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। এর পরের আয়াতে বলা হয়েছে- ‘তোমাদেরকে পরীক্ষা করা হবে ভয় দিয়ে, দুশ্চিন্তা দিয়ে, সম্পদের ক্ষতি দিয়ে, জীবনের ক্ষতি দিয়ে এবং ফলফুল ফসলের ক্ষতি দিয়ে; এতে যারা ধৈর্যধারণ করবে, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ; তারা বিপদে আপদে বলে, আমরা আল্লাহর জন্য এবং তার কাছেই ফিরে যাবো।’

বিশ্বাসী ব্যক্তিগণ কীভাবে ধৈর্যধারণ করেছিলেন তার উদাহরণ আছে। ধৈর্যের পর্বতসমান উদাহরণ হযরত আইয়ুব (আ)। আইয়ুব (আ) আল্লাহর নবী ছিলেন। তিনি এমন অসুস্থ ছিলেন যে  তার আত্মীয়স্বজনরা নিরুপায় হয়ে তাকে রাস্তার পাশে ফেলে রেখেছিল কিন্তু আইয়ুব (আ) কখনই ধৈর্যহারা হননি বরং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ ও বিশ্বাসে অবিচল থেকে অপেক্ষা করেছেন। আল্লাহ তাকে পুনরায় সুস্বাস্থ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহর নবী মুসা (আ) ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত হতে গিয়ে সমুদ্রের মুখোমুখি হয়েছেন। মুসার সামনে সমুদ্র, পেছনেই ঘাতক ফেরাউনের বাহিনী। কঠিন বিপদ। মুসা ধৈর্যধারণ করলেন এবং আল্লাহর সাহায্য চাইলেন। আর আল্লাহ তাকে উদ্ধার করলেন। শিশুপুত্র ইসমাইল (আ) এবং বিবি হাজেরাকে নিয়ে হযরত ইবরাহিম (আ) চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি স্ত্রী-পুত্রকে মক্কার জনমানব তৃণলতা শূন্য মরু উপত্যকায় রেখে  ফিরে গেলেন। এই যাওয়া সহজ ছিল না। একটি কঠিন পরীক্ষা ও ধৈর্যের মুখে পড়তে হয়েছে ইবরাহিম (আ)-কে। পুত্র সামান্য একটু বড়ো হলে সেই পুত্রকেই কুরবানি করার আদেশপ্রাপ্ত হলেন তিনি। বৃদ্ধ বয়সে পুত্রসন্তান লাভ করার পর পরম আদরের সেই পুত্রকেই কুরবানির আদেশ, ইবরাহিম (আ)-এর জন্য এই অবস্থা কম ধৈর্যের বিষয় ছিল না। তবুও ইবরাহিম (আ) ধৈর্যধারণ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত সম্মানিত হলেন। অনুসন্ধান করলে ধৈর্যধারণের এরকম দৃষ্টান্ত অপ্রতুল নয়। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, সীমাহীন ধৈর্যধারণ করতে পারা মানুষ মহিমান্বিত হতে পারে।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ