নজরুল-কাব্যে শিশু-কিশোর ভুবন

নজরুল-কাব্যে শিশু-কিশোর ভুবন

স্মরণ জয়নুল আবেদীন আজাদ আগস্ট ২০২৪

ভুবন মোহন হাসির কথা আমরা শুনেছি। সবাই কি আর সেভাবে হাসতে পারে? তবে শিশু-কিশোররা পারে। জীবনে কান্নাও আছে। আসলে হাসি-কান্না নিয়েই মানুষের জীবন। শিশু-কিশোররাও এর বাইরে নয়। তবে মাত্রায় তারতম্য থাকতে পারে। আমাদের প্রিয় যে পৃথিবী- তার একটা মানচিত্র আছে, পরিচয় আছে। মজার বিষয় হলো; ধনী-গরিব, শিশু-প্রবীণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের আলাদা এবং নিজস্ব ভুবন আছে। সেই ভুবনে আমরা সবাই রাজা। তবে সবার ভুবন একরকম নয়। কারও ভুবন ছোটো, কারোটা আবার বেশ বড়ো। কারো ভুবন সাদামাটা, অন্যটা আবার বেশ রঙিন। মানুষের শিক্ষা-দীক্ষা, ভাবনা-কল্পনা ও সামর্থ্যরে তারতম্যের কারণে ব্যক্তির ভুবনে পার্থক্য ঘটে যায়।

শিশুরা ইঙ্গিতে কথা বলে বেশি, তাই ওদের ভুবনটা বেশ রহস্যময়। কিশোররা প্রশ্ন করে বেশি, ফলে ওদের ভুবনের পরিচয়টা সহজেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা একসাথে শিশু ও কিশোরদের নিয়ে কথা বললেও ওদের ভুবন একরকম নয়। কবি-সাহিত্যিকরা শিশু-কিশোরদের অবলোকন করেছেন, ওদের ভুবন নিয়ে চর্চা করেছেন। কবিরা কাব্যকথায় তা তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। শিশু-কিশোরদের নিজস্ব যে ভুবন, সেখানে জমা হয়ে আছে অনেক কথা, অনেক রং। ওদের না বলা কথাগুলো একান্ত বন্ধুর মতো কাব্যভাষায় সুন্দর করে প্রকাশ করেছেন কবিরা। যেমন-

আমি সাগর পাড়ি দেবো, আমি সওদাগর।

সাত সাগরে ভাসবে আমার সপ্ত মধুকর।

আমার ঘাটের সওদা নিয়ে যাব সবার ঘাটে,

চলবে আমার বেচাকেনা বিশ^জোড়া হাটে।

ময়ূরপঙ্খী বজরা আমার “লাল বাওটা” তুলে

ঢেউ-এর দোলায় মরাল সম চলবে দুলে দুলে।

সিন্ধু আমার বন্ধু হয়ে রতন মানিক তার

আমার তরী বোঝাই করে দেবে উপহার।

...............................................

এখানে বলার মতো একটি বিষয় হলো, শিশু-কিশোরদের নিয়ে কবিদেরও কিন্তু আবেগময় একটি আপন-ভুবন আছে। সেই ভুবনের কথাও তাঁরা প্রকাশ করেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে নানা শব্দে ও ছন্দে।

শিশু-কিশোর ভুবন নিয়ে বাংলা ভাষার বহু কবি লিখেছেন। সবার সৃজন নিয়ে কথা বলতে গেলে বড়ো একটা গ্রন্থ রচনা করতে হবে। সেই কাজটা এখন আমি করছি না। ছোট্ট এই নিবন্ধে আজ একজন কবির সৃজন নিয়েই কথা বলবো। তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এখানে বলে রাখা ভালো যে, এই লেখায় আমি প্রিয় কবির কাব্য-বিশ্লেষণ করবো না, তাঁর কালজয়ী লেখার কিছু অংশ শুধু তুলে ধরবো। শিশু ভুবনের এত বিষয় নিয়ে তিনি কী করে লিখলেন? কিশোর মনের অভিযাত্রার খবর কবি রাখতেন। ফুল, পাখি, প্রকৃতিও শিশু-কিশোরদের প্রিয় বিষয়। বড়োদের মতো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চায় কিশোরও। তাই তো নজরুলের গানে ও কবিতায় যুক্ত হয়েছে বিদ্রোহের সুর। বড়োদের মতো কিশোর মনেও ধর্ম ভাবনা একটি পবিত্র ও সুন্দর বিষয়। নজরুলের গানে তা বেশ ভালোভাবেই ফুটে উঠেছে। আর কথা নয়, নজরুলের কবিতা ও গানের ভুবনে এখন প্রবেশ করতে চাই। নজরুল শিশু-কিশোরদের জাগাতে চেয়েছেন সময়ের সাথে, যেন প্রকৃতি থেকে পিছিয়ে না পড়ে। কবির ‘প্রভাতী’ কবিতায় সেই পরিচয় পাওয়া যায়-

ভোর হলো

দোর খোলো

খুকুমনি ওঠ রে!

ঐ ডাকে

জুঁই-শাখে

ফুল-খুকি ছোট রে!

খুকুমনি ওঠ রে!

সাত ভাই চম্পার কাহিনী ছোটো-বড়ো সবারই প্রিয়। ‘সাত ভাই চম্পা’ কবিতায় নজরুল চার ভাইয়ের বক্তব্য নিজের মতো করে তুলে ধরেছেন। প্রথম ভাই বলেছে-

আমি হব সকাল বেলার পাখি।

সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি।

সূয্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে,

‘হয়নি সকাল, ঘুমো এখন’- মা বলবেন রেগে!

বলব আমি, ‘আলসে মেয়ে! ঘুমিয়ে তুমি থাক,

হয়নি সকাল-তাই বলে কি সকাল হবে নাক!’

আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?

তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!

........................................................

ছোটোবেলায় আমরা নজরুলের ‘সংকল্প’ কবিতাটি পড়েছি। তোমাদেরও পড়ার কথা। কবিতাটি এই বৃদ্ধ বয়সেও আমাদের আন্দোলিত করে-

থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,

কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।

দেশ হতে দেশ দেশান্তরে

ছুটছে তারা কেমন করে,

কিসের নেশায় কেমন করে মরছে যে বীর লাখে লাখে,

কিসের আশায় করছে তারা বরণ মরণ- যন্ত্রণাকে॥

..........................................................

কিশোর শুধু জাগার কথা বলে না, জগৎ দেখার কথা বলে না, মায়ের মমতার কথাও বলে। ‘মা’ কবিতায় নজরুল লিখেছেন-

যেখানেতে দেখি যাহা

মা-এর মতন আহা

একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,

মায়ের মতন এত

আদর সোহাগ সে তো

আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই।

হেরিলে মায়ের মুখ

দূরে যায় সব দুখ,

মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,

মায়ের শীতল কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,

মায়ের শীতল কোলে

সকল যাতনা ভোলে

কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।

.........................................

মায়ের মমতায় শিশুর পরান জুড়ায়, আবার শিশুর কোমল ও নির্মল রূপে মা হন বিমুগ্ধ। ‘শিশু যাদুকর’ কবিতায় সে কথাই তুলে ধরেছেন কবি-

পার হয়ে কত নদী কত সে সাগর

এই পারে এলি তুই শিশু যাদুকর।

কোন্ রূপ-লোকে ছিলি রূপকথা তুই,

রূপ ধরে এলি এই মমতার ভুঁই।

.....................................

ফুল-পাখি শিশু-কিশোরদের প্রিয় বিষয়। প্রিয় কবির কাছেও। নজরুল লিখেছেন ‘ঝিঙেফুল’ কবিতা-

ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!

সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-ফুল

ঝিঙে ফুল।

গুল্মে পর্ণে

লতিকার কর্ণে

ঢল ঢল স্বর্ণে

ঝলমল দোলে দুল-

ঝিঙে ফুল।

পাতার দেশের পাখী বাঁধা হিয়া বোঁটাতে,

গান তব শুনি সাঁঝে তব ফুটে ওঠাতে।

............................................

পাখির ভুবন বিচিত্র। কত পাখি, কত রূপ, কত রং। পাখির ভুবনে হারিয়ে যায় কিশোর, হারিয়ে যায় কবিও। নজরুলের ‘সারস পাখি’ কবিতায় সেই পরিচয় পাওয়া যায়-

সারস পাখি! সারস পাখি!

আকাশ-গাঙের শ্বেত কমল!

পুষ্প-পাখি! বায়ুর ঢেউ-এ

যাস্ ভেসে তুই কোন্ মহল?

তোরে ময়ূর-পঙ্খী করি

পরীস্থানের কোন্ কিশোরী

হালকা পাখার দাঁড় টেনে যায়?

নি¤েœ কাঁপে সায়র-জল

গগন-কূলে ঘুম ভেঙে চায়

মেঘের ফেনা অচঞ্চল!

..........................

প্রজাপতিতে মুগ্ধ হয়নি, প্রজাপতি নিয়ে খেলেনি- এমন কোনো শিশু-কিশোর আছে কি? বিষয়টি কবি ভালো করেই জানেন। তাই তো লিখেছেন ‘প্রজাপতি’ কবিতাটি-

প্রজাপতি! প্রজাপতি! কোথায় পেলে ভাই!

এমন রঙিন পাখা!

টুকটুকে লাল নীল ঝিলিমিলি আঁকাবাঁকা

কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা!

............................................

তুমি হাওয়ায় নেচে নেচে যাও,

তোমার মতো মোরে আনন্দ দাও;

এই জামা ভালো লাগে না,

দাও জামা ছবি-আঁকা।

কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা।

............................................

মানব সমাজ সবসময় মানবিক হয় না। ন্যায় ও ভালোবাসার অভাবে মানুষ মজলুম হয়। এমন সমাজে মানুষের দুঃখ বাড়ে। বঞ্চনার সমাজে মৈত্রীর বদলে দেখা দেয় ভেদাভেদ ও ঘৃণা। এমন সমাজ শিশু-কিশোরদের পছন্দ নয়, পছন্দ নয় নজরুলেরও। তাই তো কবি লিখেছেন ‘চাষী’ কবিতাটি-

চাষীকে কেউ চাষা বলে

করিও না ঘৃণা,

বাঁচতাম না আমরা কেহ

ঐ সে কৃষাণ বিনা।

রৌদ্রে পুড়ে, বৃষ্টিতে সে

ভিজে দিবারাতি,

মোদের ক্ষুধার অন্ন জোগায়

চায় না সে যশ-খ্যাতি।

ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা তো জানো মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দ আছে। তোমাদের মধ্যেও তো কিছু দুষ্ট ও ডানপিটে বালক আছে। তাদের নিয়ে কি করা যায়? তাড়িয়ে দেওয়া যায়, আবার কাছে টেনে ভালোও করা যায়। আসলে কেউ একটা ভুল বা অন্যায় করলেই একেবারে নষ্ট হয়ে যায় না। সংশোধনের মাধ্যমে মন্দকে ভালো করা যায়। তবে এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুভব ও উপলব্ধি। নজরুলের ‘লিচু-চোর’ কবিতায় তেমন একটি চিত্র লক্ষ্য করা যায়-

বাবুদের তাল-পুকুরে ছোট এক ডাল ধরেছি,

হাবুদের ডাল-কুকুরে পড়েছি সড়াৎ জোরে!

সে কি বাস্ করলে তাড়া, চুরিতে আর যদি যাই!

বলি থাম্, একটু দাঁড়া। তবে মোর নামই মিছা!

পুকুরের ঐ কাছে না কুকুরের চামড়া খিঁচা!

লিচুর এক গাছ আছে না সে কি ভাই যায় রে ভুলা-

হোথা না আস্তে গিয়ে মালীর ঐ পিটনিগুলা!

য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে কি বলিস? ফের হপ্তা?

গাছে গ্যে যেই চড়েছি তৌবা-নাক খপ্তা।

মানব সমাজের বাইরে আরও একটি সমাজ আছে। পশু-পাখিদের সেই সমাজের কথা আমরা কতটা জানি? বাঘ আর হরিণ কি এক রকম? একটি হিং¯্র, অপরটি শান্ত। কাক ও কোকিল কি এক রকম? একটির আওয়াজ কর্কশ, অপরটির সুরেলা। প্রাণিজগতে বিড়াল আছে, আছে আবার কাঠবেড়ালিও। বিড়ালের চাইতে কাঠবেড়ালি দেখতে সুন্দর, মজারও বটে। গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়ায়, আর মজা করে খায় নানা স্বাদের ফল। তোমাদের মধ্যে যেমন দুষ্টু ছেলে আছে, তেমনি ওদের মধ্যেও আছে ডানপিটে কাঠবেড়ালি। এ কারণেই হয়তো কাজী নজরুল লিখেছেন ‘খুকি ও কাঠবেড়ালি’ কবিতাটি-

কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও?

গুড়-মুড়ি খাও? দুধভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?

বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?

ডাইনি তুমি হোঁতকা পেটুক,

খাও একা পাও যেথায় যেটুক!

বাতাবি নেবু সকলগুলো

একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো

তবে যে ভারী লেজ উঁঠিয়ে পুটুস্ পাটুস্ চাও?

ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!

.....................................................

খুকি কত করে একটি পেয়ারা চাইলো কাঠবেড়ালির কাছে, কিন্তু দুষ্টু কাঠবেড়ালি দিলো না। বরং ছুটে পালালো। তাই তো খুকি রেগে গিয়ে বললো-

দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ যে ছুট? অ’মা দেখে যাও!

কাঠবেড়ালি! তুমি মর! তুমি কচু খাও!

স্বার্থপরতার কারণে দুষ্টু কাঠবেড়ালি খুকির বন্ধু হতে পারলো না। ফলে ওকে আড়ি দিলো খুকি। মানব সমাজেও অমন স্বার্থপর চরিত্র আছে। এমন চরিত্র কি কারো প্রিয় হতে পারে?

শিশু-কিশোররা মাকে ভালোবাসে, ভালোবাসে মাতৃভূমিকেও। মাতৃভূমির আলো-বাতাসে শিশুরা বেড়ে ওঠে। দেশের মাটিতে পা ফেলে শিশুরা হাঁটতে শেখে। দেশের ফলমূল ও শস্যদানা পুষ্টি জোগায়। দেশের সাথে জড়িয়ে আছে কত মধুর স্মৃতি। এভাবেই শিশু-কিশোর মনে দৃঢ় হয় দেশপ্রেম। দেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ওরা। ওদের এমন মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে নজরুলের ‘আমার দেশের মাটি’ কবিতায়-

আমার দেশের মাটি

ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি॥

এই দেশেরই মাটি জলে

এই দেশেরই ফুলে ফলে

তৃষ্ণা মিটাই মিটাই ক্ষুধা

পিয়ে এরি দুধের বাটি॥

কবি নজরুলের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা আমরা জানি। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় এবং অগ্নিঝরা লেখার জন্য কবিকে জেলে যেতে হয়। তবে নজরুলের লেখায় স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয় কিশোর এবং যুবকসহ সব দেশপ্রেমিক নাগরিক। কবির বিদ্রোহের বার্তা স্পষ্ট হয়েছে ‘ভাঙার গান’ লেখাটিতে-

কারার ঐ লৌহ- কপাট নাচে ঐ কাল-বোশেখী,

ভেঙে ফেল র্ক রে লোপাট কাটাবি কাল বসে কি?

রক্ত-জমাট দেরে দেখি

শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী! ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!

ওরে ও তরুণ ঈশান! লাথি র্মা, ভাঙ্রে তালা!

বাজা তোর প্রলয়-বিষাণ যত সব বন্দী-শালায়-

ধ্বংস-নিশান আগুন জ্বালা,

উড়–ক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি। আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি!

নজরুলের জীবনে স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি তরুণদের যুক্ত করতে চেয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামে। কবির চল্ চল্ চল্ কবিতাটি তার বড়ো প্রমাণ-

চল্ চল্ চল্

ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল,

নিম্নোক্ত উতলা ধরণী-তল,

অরুণ প্রাতের তরুণ দল

চল্রে চল্রে চল্ ।

চল্ চল্ চল॥

ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত

আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,

আমরা টুটাব তিমির রাত,

বাধার বিন্ধ্যাচল।

আমরা আগল ভাঙার কথা শুনেছি, জোর কদমে চলার বার্তা পেয়েছি। তবে জীবনে কখনও একটু থামতে হয়, বিশ্রাম নিতে হয়, নতুন করে আবার চলার জন্যই এই বিশ্রাম। আর বিশ্রামের সাথে জড়িয়ে থাকে ঘুম। তবে দুষ্টু ছেলেদের ঘুম পাড়ানোর কাজটা খুব সহজ নয়। কারণ দৌড়-ঝাপেই ওদের আনন্দ বেশি। তাই ওদের বশ করতে নজরুল লিখেছেন ‘ঘুম-পাড়ানী গান’-

ঘুম-পাড়ানী মাসিপিসি ঘুম দিয়ে যেয়ো

বাটা ভরে পান দেবো গাল ভরে খেয়ো

ঘুম আয় রে, ঘুম আয় ঘুম॥

ঘুম আয়রে, দুষ্টু খোকায় ছুঁয়ে যা,

চোখের পাতা লজ্জাবতী লতার মত নুয়ে যা

ঘুম আয়রে, ঘুম আয় ঘুম॥

মেঘের মশারিতে রাতের চাঁদ পড়ল ঘুমিয়ে,

খোকার চোখের পাপড়ি পড়–ক ঘুমে ঝিমিয়ে।

ঘুম আয়রে, ঘুম আয় ঘুম॥

ঘুম-পাড়ানী গানে না হয় ঘুমিয়ে গেল দুষ্টু ছেলের দল। কিন্তু এই ঘুম কতক্ষণ? কর্মচঞ্চল কিশোররা তো বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার পাত্র নয়। আর ওদের জাগিয়ে তোলার মন্ত্র জানা আছে নজরুলের। সেই মন্ত্র হলো ছন্দের-ঢেউ। শুকনো পাতায়ও খেলে যায় ছন্দের ঢেউ। ‘শুক্নো পাতার’ গানটিতে সেই রহস্যের খোঁজ পাওয়া যায়-

শুক্নো পাতার নূপুর পায়ে

নাচিছে ঘূর্ণিবায়।

জল-তরঙ্গে ঝিল্মিল ঝিল্মিল

ঢেউ তুলে সে যায়॥

দিঘির বুকের শতদল দলি,

ঝরায়ে বকুল চাঁপার কলি,

চঞ্চল র্ঝনার জল ছলছলি

মাঠের পথে সে ধায়॥

আমরা প্রভাতে জাগলাম, প্রকৃতির সাথে কথা বললাম। শিশুর আগমনে মা মুগ্ধ হলেন। মায়ের মমতায় শিশু বেড়ে উঠলো। কিশোর জগতকে দেখার সংকল্প করলো। এর আগে ফুল-পাখির সাথেও কথা হলো। শিশু-কিশোরের চোখে তো স্বপ্নের অভাব নেই। নজরুল ওদের স্বাধীনতার স্বপ্নও দেখালেন। শোনালেন আগল ভাঙার গান। জানালেন জোর কদমে চলার আহ্বান। এরপর ক্ষণিকের বিশ্রাম, আবার ছন্দের ঢেউ এবং জাগরণ।

চোখ খোলার মধ্যে একটি জাগরণ আছে, অন্তর ও আত্মার বিকাশের মধ্যে আছে ভিন্ন জাগরণ। বিদ্যুতের আলোয় আমরা পথ চলি। আকাশও আমাদের আলো দেয়। বিদ্যুতের আলো আমরা উৎপাদন করি, এর পেছনে রয়েছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অবদান। তবে আকাশের আলো আমরা উৎপাদন করি না। বিনে পয়সার এ আলো ¯্রষ্টার দান। চন্দ্র-সূর্য ¯্রষ্টার সৃষ্টি। ¯্রষ্টার আলো আমরা ভোগ করছি কিন্তু মর্মার্থ তেমন উপলব্ধি করছি না। মহান ¯্রষ্টা শুধু দিনকে প্রস্ফুটিত করার আলো দিয়েই ক্ষান্ত হননি। অন্তরকে আলোকিত করার জন্য দিয়েছেন আসমানি কিতাব। উভয় আলোই এসেছে আসমান থেকে, ¯্রষ্টার কাছ থেকে। বিষয়টি নজরুলের উপলব্ধিতে ছিল। তাই তিনি ¯্রষ্টার প্রশস্তি করেছেন, নবী প্রেমের গান গেয়েছেন। এই অঙ্গনে বড়োদের পাশাপাশি ছোটোদের জন্যও তিনি লিখেছেন বহু গান। এখানে কবির জনপ্রিয় কিছু গানের কথা উল্লেখ করা যায়-

এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি

(খোদা) তোমার মেহেরবানী।

শস্য শ্যামল ফসল-ভরা মাটির ডালিখানি

(খোদা) তোমার মেহেরবানী।

তুমি কতই দিলে রতন

ভাই বেরাদর পুত্র স্বজন,

ক্ষুধা পেলেই অন্ন জোগাও

মানি চাই না মানি

(খোদা) তোমার মেহেরবানী॥


খোদা! তোমার হুকুম তরক করি আমি প্রতি পায়,

তবু আলো দিয়ে বাতাস দিয়ে বাঁচাও এ বান্দায়।

শ্রেষ্ঠ নবী দিলে মোরে

তরিয়ে নিতে রোজ-হাশরে,

পথ না ভুলি তাই তো দিলে

পাক কোরআনের বাণী

(খোদা) তোমার মেহেরবানী॥

আমরা মহান আল্লাহর বান্দা। এই পৃথিবীকে তিনি মানব-বান্ধব করে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের চারিদিকে অসংখ্য নিয়ামত। আমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করি, সাহায্য চাই তাঁরই কাছে। আত্মসমর্পণ তাঁরই কাছে, দোয়া-মুনাজাতও তাঁরই দরবারে। বান্দার এমন আকুতি ফুটে উঠেছে নজরুলের একটি গানে-

শোনো শোনো য়্যা এলাহি

আমার মুনাজাত

তোমারি নাম জপে যেন

হৃদয় দিবস-রাত॥

যেন শুনি কানে সদা

তোমারি কালাম, হে খোদা,

চোখে শুধু দেখি যেন

কোরআনের আয়াত॥


মুখে যেন জপি আমি

কল্মা তোমার দিবস-যামী,

(তোমার) মসজিদেরই ঝাড়–-বর্দার

হোক আমার এ হাত॥


সুখে তুমি, দুখে তুমি,

চোখে তুমি, বুকে তুমি

এ পিয়াসী প্রাণের খোদা

তুমিই আবহায়াত॥

গভীরতর উপলব্ধি ও শব্দ সুধায় নজরুল আল্লাহর প্রশস্তি করেছেন। সেসব এখানে তুলে ধরার সুযোগ নেই, কিছু নমুনা পেশ করলাম মাত্র। গানে গানে নবী প্রেমের অনেক কথা বলেছেন নজরুল। সেখান থেকে কিছু উদাহরণ তুলে ধরবো এখন-

তোরা দেখে যা, আমিনা মায়ের কোলে

মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে॥

যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে॥

কুল-মাখ্লুকে আজি ধ্বনি ওঠে, কে এলো ঐ,

কলেমা শাহাদাতের বাণী ঠোঁটে, কে এলো ঐ,

খোদার জ্যোতি পেশানিতে ফোটে, কে এলো ঐ,

আকাশ গ্রহ তারা পড়ে লুটে, -কে এলো ঐ,

পড়ে দরুদ ফেরেশ্তা, বেহেশতে সব দুয়ার খোলে॥

মানুষে মানুষের অধিকার দিলো যে জন,

“এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই” কহিল যে জন,

মানুষের লাগি চির-দীন বেশ নিলো যে জন,

বাদশা ফকিরে এক শামিল করিল যে জন,

এলো ধরায় ধরা দিতে সেই সে নবী,

ব্যথিত মানবের ধ্যানের ছবি,

আজি মাতিল বিশ্ব নিখিল মুক্তি-কলরোলে॥

নবীপ্রেমের এই গানে ইসলাম ধর্মের অনেক মৌলিক বিষয় উঠে এসেছে। সুরের লহরিতে তা আমাদের হৃদয় গহনে পৌঁছে গেছে।

নবীকে ভালোবেসে নজরুল আরও লিখেছেন-

মোহাম্মদ নাম যতই জপি, ততই মধুর লাগে

নামে এত মধু থাকে, কে জানিত আগে॥

ঐ নামেরই মধু চাহি,

মন-ভোমরা বেড়ায় গাহি,

আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা নাহি

ঐ নামের অনুরাগে॥

প্রত্যেক জাতিরই উৎসব থাকে, ঈদ থাকে। উৎসবের গানও থাকে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের ঈদের তেমন ভালো কোনো গান ছিল না, যা ছোটো-বড়ো সবার মুখে মুখে থাকবে। সেই অভাবটা পূরণ করে দিলেন নজরুল। পুরো গানটা এখানে তুলে ধরা হলো-

ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে

এলো খুশির ঈদ,

তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে,

শোন আসমানী তাকিদ॥

তোর সোনা-দানা, বালাখানা

সব রাহে লিল্লাহ

দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ

ভাঙাইতে নিদ॥

তুই পড়বি ঈদের নামাজ রে মন

সেই সে ঈদগাহে,

যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম

হয়েছে শহীদ॥

আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত-দুশমন,

হাত মেলাও হাতে,

তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল

ইসলামে মুরিদ॥

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য-ভাণ্ডার নানা ভাবসমৃদ্ধ ও বিচিত্র রসে সমৃদ্ধ। শুধু বড়োদের জন্য নয়, শিশু-কিশোরদের জন্যও তিনি লিখেছেন অনেক। এই নিবন্ধে তাঁর কিছুটা পরিচয় পাওয়া যাবে। কলেবরের কথা চিন্তা করে তাঁর সব লেখার কথা এখানে তুলে ধরা যায়নি। এটা আমাদের সীমাবদ্ধতা। তবে শিশু-কিশোরদের সামনে তো অনেক পথ, সময়ও আছে। একটু কষ্ট করে জাতীয় কবির সব লেখা পড়ার চেষ্টা করবে। সম্মানিত অভিভাবকরা এ ব্যাপারে শিশু-কিশোরদের সাহায্য করতে পারেন। আমার লেখাটি নজরুল পাঠে শিশু-কিশোরদের উৎসাহিত করতে সমর্থ হলে খুশি হবো। মহান ¯্রষ্টা আমাদের সহায় হোন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ