নতুন ভাই
গল্প কামাল হোসাইন মার্চ ২০২৫
এক বিকেলের কথা। বাড়ির পুকুরপাড়ে খেলছিল ওরা। লালু হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লো। হঠাৎ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে।
লাবণীর প্রায় কাছাকাছি বয়সের লালু। লাবণীর একটা ভাই। সে লালু। একসঙ্গে স্কুলে যায়। এক ক্লাসে পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ওরা।
ওদের ক’জন বন্ধু আছে। কাছেই থাকে। তমাল আর ঈষিকা ওদের প্রিয়বন্ধু।
বন্ধুদের সঙ্গে সারাদিন ওরা কতরকম খেলা খেলে। পুতুল খেলে। বউচি খেলে। চিঁ বুড়ি খেলে। গোল্লাছুট খেলে।
লালু সবসময় হইচই করতে পছন্দ করে। আনন্দে থাকে। কিন্তু আজ হঠাৎ ওর কী যে হলো! ওর কান্না দেখে লাবণী আকুল হয়ে যায়। ভাবে, আহারে বেচারা! কী যে হলো ওর! ও কাছে গিয়ে জানতে চায়,‘ কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?’
কিন্তু লালু কিছুই বলছে না। কেবল কেঁদেই চলেছে।
লালুকে এবার শক্ত করে ধরে। বলে, ‘বল কী হয়েছে? আমাকে বলতেই হবে।’
লালু এবার কিছুটা শান্ত হয়। বলে, ‘আজ আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে। মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। মন চাইছে মাকে দেখতে। কিন্তু কোথায় পাই তাকে?’ বলে আবার হু হু করে কাঁদতে লাগলো লালু।
লাবণী এবার যেন আকাশ থেকে পড়লো। বলে কী ছেলেটা! বলে, ‘এই তুই কী বলছিস! মানে কী এসবের? মাকে দেখতে চাস, তাকে কোথায় পাবি! কী বলতে চাস তুই? মা এখন রান্নাঘরে। আর তুই বলছিস, তাকে কোথায় পাবি! যা, দেখে আয়। তা না এখানে উনি কাঁদতে বসেছেন! যত্তসব!’
লালু নিজেকে সামলে নেয়। ও ছোট হলেও বোঝে ব্যাপারটা। কিন্তু লাবণী তেমন বোঝে না। জানে না বলেই হয়তো।
কেউ না জানুক। লালু তো জানে। এসবই ভাবছিল লালু। লাবণী কণ্ঠ চড়িয়ে বলে, ‘কী রে বল। কিছু বলছিস না কেন?’
তখনো লালুর চোখ ছলছল। এ সময় লাবণী ওর মাথায় হাত রাখে। এতে লালুর কান্না যেন আরো বেড়ে যায়। আবার কান্না শুরু করে। লাবণীর মনে বিস্ময় জাগে। ও কিছুতেই বুঝতে পারছে না। কী হলো এই লালুটার!
লাবণী বললো, ‘আমি তাহলে মাকে ডেকে আনি...।’
লাবণী একথা বলে মাকে ডাকতে যায়, ‘মা...’
লালু ওর মুখে হাত দিয়ে থামায়। বলে, ‘ডাকিস না বোন। আমি একটা কথা বলবো, বিশ্বাস করবি?’
লাবণী ড্যাবড্যাব করে তাকায়। লালু এমন করে কথা বলছে কেন? কিছু না বলে ঘাড় কাত করে। বোঝায় সে বিশ্বাস করবে।
লালুর কথাটা বলতে দ্বিধা হয়। তবু না বলে উপায় নেই। লালু মুখ খোলে। বলে, ‘যদি বলি আমি তোর ভাই না। তাহলে বিশ্বাস করবি? যদি বলি তোর মা আমার মা না, তাহলে?’
লাবণী হকচকিয়ে যায়। লালুর কি মাথা খারাপ হলো? পাগলের মতো কী বলছে এসব!
লাবণীর মুখ দেখে লালু থতমত খায়। বুঝতে পারে, লাবণী বিশ্বাস করছে না। লালু আবার বলার চেষ্টা করে।
‘সত্যি বলছি বোন। বিশ্বাস কর। আমি তোকে খুব ভালোবাসি। মাকেও অসম্ভব ভালোবাসি। বাবাকেও। ভালোবাসি এই বাড়ির সবকিছু। কিন্তু যা সত্যি, তা তো বলতে হবে। তাই না? আমি আসলেই তোর আপন ভাই না। আমি তোর সৎভাই। আর...’
লালুর কথা শেষ হয় না। পেছনে ওদের মা এসে হাজির। এসেছেন বাবাও।
মা বললেন, ‘লালু, কী হচ্ছে এসব? আমরা না তোকে নিষেধ করেছি। এসব কেন বলছিস বাবা?’
লাবণী মায়ের কাছে ছুটে যায়। বলে, ‘মা, দোখো না, লালু কেমন আবোলতাবোল কথা বলছে!’
লালু বসে ছিল। বাবা তাকে ওঠালেন। বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলেন। মাথায় হাত বোলাতে থাকলেন। বললেন, ‘মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে বুঝি? পাগল ছেলে কোথাকার। তাহলে ওটা কে? আমি কে?’
লালু আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে। এবার মা এসে ওকে বুকে নিয়ে আদর করতে থাকেন। বললেন, ‘কক্ষনো আর এ কথা বলবি না। বললে এবার মার খাবি কিন্তু। জানি তোর নিজের মা-বাবা নেই। ছোটবেলায় মারা গিয়েছে। তারা নেই বলে কি তোর বেঁচে থাকার অধিকার নেই? খুব আছে। তারপর তো আমরাই তোকে এনেছি। লাবণী যেমন আমাদের সন্তান। তুইও আমাদের আরেকটা সন্তান। সমান যত্ন নিয়ে বড়ো করে তুলছি। আর তুই কিনা...’
মায়ের কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে এলো। লালু বুঝলো বড়ো ভুল হয়ে গেছে। বললো, ‘মা, আমি আর কক্ষনো বলবো না এ কথা। এই কান ধরছি। আমরা আর পর কেউ না। আমরা এখন আপন দুই ভাইবোন।’
এ কথা বলে ছোট্ট হাতে লালু যেন সবাইকে জড়িয়ে ধরলো।
লাবণীও সব জেনে খুশি হলো। লালুকে যেন সে আজ নতুন করে পেল। আপন ভাই হিসেবে পেল। ‘হুররে’ বলে লাবণীও সবাইকে জড়িয়ে ধরলো।
আরও পড়ুন...