পচু কাহিনী
গল্প জাফর তালুকদার সেপ্টেম্বর ২০২৪
রাতে মন্টু মামা ফোন করে বললেন, ‘হ্যাঁরে পল্টু, কী করিস?’
‘তেমন কিছু না। টিভি দেখছি।’
‘শোন, বিদেশ যাবি নাকি?’
‘কোথায় মামা?’
‘বেশি দূর নারে। শ্রীলঙ্কা। আমাদের বন্ধুদের একটা গ্রুপ যাচ্ছে। তুই আমার গেস্ট হয়ে যাবি। কী রাজি তো?’
আজকাল ইউরোপ-আমেরিকা নাকি পান্তা ভাত হয়ে গেছে! সে কুয়োর ব্যাঙ। কিছুই হয়নি দেখা চক্ষু মেলিয়া। মাদারটেক থেকে দুই পা ফেলিয়া। তাই বলে শ্রীলঙ্কা!
মামা উৎকণ্ঠার গলায় বললেন, ‘কী ভাবছিস? আরে বাবা, আমি তো সঙ্গে আছি। চিন্তা কীসের!’
‘সেটা না। সবাই বলে ওটা নাকি খুব পচু দেশ!’
‘বেশ তো ওরা পচু। আর আমরা ধচু। তাতে হয়েছে কী এমন কচু?’
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বোঁচকা নিয়ে চেপে বসলো মামার ঘাড়ে। ঢাকা বিমান বন্দরে ঢুকে চোখ জুড়িয়ে গেল। শ্রীহীন ঢেউয়ার যদি এই কেরামতি হয়, শ্রীযুক্ত লঙ্কার কী ফাটাফাটি হবে ভাবতেই বাথরুম চেপে গেল।
কলম্বো বন্দর নায়েকে এয়ারপোর্টে নেমে পল্টুর পচু হারিয়ে গেল। এর বদলে ফিরে এলো চোখ ছানাবড়া করা এক অপরূপ তরতাজা দৃশ্য।
ম্যাথুস লোকটা চমৎকার। একহারা শ্যামলা গড়ন। হাসিটি লেগে আছে মুখে। সে হলো গাইড কাম ড্রাইভার।
গাড়িটা বড়োসড়ো। সবাই হাত-পা খুলে বসতে পারলো। ঠিক হলো পাঁচদিনের রানিং ট্যুরে যা দেখার পথেই দেখা হবে। খানাপিনাও হবে যেতে যেতে। আর যেখানে নামবে রাত, সেখানেই হবে কাত। তবে এই কাত চিতকাত হোটেলে নয় মোটেই। রীতিমতো ফোর স্টারের তকমা জুড়ে আছে তাদের গলায়।
প্রথম রাতটি কাটলো কলম্বোর ম্যারিনা বিচ ফাইভ স্টার হোটেলে। হোটেলে শুয়ে সাগরের নীল পানির ঢেউ গোনার অপূর্ব সুযোগ। মন নেচে উঠলো ফুরফুরে বাতাসে। ঘুমটাও হলো দারুণ।
সকালে শুরু হলো ম্যাথুসের জিম্মায় আসল যাত্রা। গাড়ি ছুটছে। ছবির রিলের মতো হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক দৃশ্য। পল্টু ইচ্ছে করেই বেছে নেয় ড্রাইভারের পাশের আসনটি। তার একটু ভাব হয়েছে ম্যাথুসের সঙ্গে। কথার পিঠে কথা। যা দেখছে সেটা নিয়ে আলাপ জুড়ে দিচ্ছে। এই যে ক্যাণ্ডি, নুওয়ারা এলিয়া টি এস্টেট, ডেমোডারা, ন্যাশনাল পার্ক, মিরিশা, গ্যালি ফোর্ট, মাদু রিভার, টার্টল কনজারভেশন প্রোজেক্ট- যাই দেখছে চোখ আটকে যাচ্ছে অপার বিস্ময়ে।
পথেঘাটে কোথাও একটু ময়লা-আবর্জনা নেই। পরিপাটি করে সাজানো সবকিছু। যানজট নেই। ঝর্ণা আর পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে পাইনের সারি। যত্রতত্র নারকেল গাছের ছড়াছড়ি। বাড়িগুলো পুঁতিদানার মতন গেঁথে আছে একের পর এক। একতলা বাহারি রঙের। যেনবা শিল্পীর আঁকা দুর্লভ পেন্টিং। পাহাড়ের ওপর বিশাল বৌদ্ধ মূর্তি। প্যাগোডা। মানুষগুলো পরিচ্ছন্ন। শান্ত নীরব। কোলাহল নেই। যে যার মতো ছুটছে আপন ব্যস্ততায়। পল্টু বিস্ময় ধরে রাখতে না পেরে কৌতূহলী চোখে তাকায় ম্যাথুসের দিকে।
‘এটা কী করে সম্ভব?’
‘কেন সম্ভব নয়!’
‘ঠিক আছে, কারণটা শুনি।’
‘শিক্ষা আর দেশপ্রেম।’
‘পথে আমরা যে আনারস, পেঁপে, কলা, মধু, ডুরিয়ান, অ্যাভাকাডো, অ্যানোডা, ম্যাঙ্গোস্টিন ফলফলারি কিনলাম, এগুলো কী পুরোটা বিষমুক্ত! টুরিস্ট দেখে ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছে নাতো?’
‘ওইসব দুনম্বরি কাজ এখানের মানুষজন চিন্তাও করতে পারে না। এটা পর্যটন-বান্ধব দেশ। আমরা বিদেশি টুরিস্টদের সম্মান করি। তারা আমাদের উপার্জনের বড়ো মাধ্যম। এখন তো অফ সিজন। পিক টাইমে এলে হোয়াইটদের ভিড়ে পা ফেলতে পারবে না।’
‘সমুদ্র সৈকত আর পাহাড়ি রিসোর্টগুলো তো এখনই টইটম্বুর দেখছি!’
‘হ্যাঁ, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, কটেজ, রেস্তরাঁ, দোকানপাট- সব জায়গাতেই টুরিস্টদের দারুণ সমাদর। তাদের অসম্মান হলে পুরো দেশের বদনাম।’
‘এত পুরোনো আমলের লাইট হাউস, পুরাকীর্তি, প্রাচীন আমলের বাড়িঘর সবটাই দেখি সাজানো-গোছানো নতুনের মতো করে রাখা।’
‘পর্তুগিজ, ব্রিটিশ কলোনিয়াল পিরিয়ডের কিছুই নষ্ট করা হয়নি। এগুলো আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। ধর্মীয় অনুভূতিটাও হারাতে দেওয়া হয়নি।’
ম্যাথুস মানুষটি এমন। যে-কোনো আলোচনার সুইচ টিপলেই সে পুরো লঙ্কার মানচিত্রটাই তুলে ধরে চোখের সামনে। তবে সবকিছুর ওপর সে মেনে চলে তার সীমারেখা বোধ। সে সবার সঙ্গে লাঞ্চ সারলেও নিজের জন্য বেছে নেয় আলাদা টেবিল। চা-কফির বেলাতেও বিনীত প্রত্যাখ্যান। তবে পিড়াপিড়িতে একান্তই এড়াতে না পারলে সবাইকে ডাব বা আইসক্রিম খাইয়ে পুষিয়ে দেয় ষোলোআনা।
দেখতে দেখতে সময় ফুরিয়ে এলো। কলম্বো দিয়ে শুরু। এখানেই শেষ। বিদায়বেলা ম্যাথুসের বাড়ি চায়ের নেমতন্ন। শেষ চমকটি সবার জন্য রেখে দিয়েছিল পচু দেশের ড্রাইভার ম্যাথুস গুনাকর। কলম্বোর অভিজাত পাড়ায় ম্যাথুসের ডুপ্লেক্স ভিলা। বাড়ির সামনে কেয়ারি করা সুদৃশ্য বাগান। চমৎকার রং-বেরঙের বাহারি ফুল ফুটে আছে সেখানে। বাড়ির অন্দর মহলটি দেখার মতো। মূল্যবান কাঠের বাঁকানো সিঁড়ি। থরে থরে সাজানো নানা রকম দুষ্প্রাপ্য এন্টিক। নিরহংকারী ম্যাথুস সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। গৃহিণী স্কুল শিক্ষিকা। একমাত্র ছেলে কানাডা থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে ফিরে এসে ম্যানেজারিয়াল পোস্টে কাজ করছে একটি জাপানি ফার্মে।
এই হলো ম্যাথুস। অবসরে ঘরে বসে না থেকে বেছে নিয়েছে এই ভিন্ন রকম পেশা। রান্নার এক ভাত টিপলে পুরো হাড়ির খবর আন্দাজ করা যায়।
আরও পড়ুন...