পবিত্র ঈদুল আজহা
প্রচ্ছদ রচনা এস. এম রুহুল আমীন জুন ২০২৪
ঈদ মানে আনন্দ! ঈদ মানে খুশি!
ঈদের কথা শুনলেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। হৃদয় রাজ্যে ঢেউ খেলে যায় খুশির জোয়ার। আন্দোলিত হয় মন ও প্রাণ। আনন্দিত ও আন্দোলিত হওয়ারই কথা। আমাদের প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, “অন্যান্য ধর্মের লোকদের জন্য যেমন খুশির ও উৎসবের দিন রয়েছে। আমাদের জন্যও রয়েছে তেমন দুটো খুশির বা ঈদের দিন। এক. ঈদুল ফিতর দুই. ঈদুল আজহা।
প্রিয় বন্ধুরা, আজকে দ্বিতীয় ঈদ, ঈদুল আজহা নিয়েই বলবো। আল্লাহর দেওয়া মানুষের ওপর অর্পিত বিধি-বিধানের গুরুত্বপূর্ণ একটি হলো ঈদুল আজহা। যা এসেছে ঈমামুল আম্বিয়া মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর মাধ্যমে। আমরা সবাই জানি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যুগে যুগে পাঠিয়েছেন অসংখ্য নবী ও রাসূল। তাঁর শরয়ী বিধান বাস্তবায়নের জন্য। তাঁদেরই একজন ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ)। তাঁর জন্ম হয়েছিল বর্তমান ইরাকের তৎকালীন বাবেল শহরে। দীনের দাওয়াত প্রচারে আমাদের নবীর মতো ছাড়তে হয়েছিল দেশ। হিজরত করেছেন একে একে বর্তমানের ফিলিস্তিন ও মিসরে।
কুরবানি ও ঈদুল আজহা কী?
ঈদুল আজহাকেই বলা হয় কুরবানির ঈদ। কুরবানি শব্দটি আরবি ‘কুরবুন’ শব্দ থেকে এসেছে। যার অর্থ কাছাকাছি, নৈকট্য, সান্নিধ্য, নাগাল প্রভৃতি। ইংরেজিতে বলা হয় ঘবধৎহবংং, ঈষড়ংবহবংং, ঝধপৎরভরপব ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় কুরবানি বলতে বোঝায়, “আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য আরবি জিলহজ মাসের দশ তারিখ সুবহে সাদিক থেকে বারো তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাঁরই নামে সুস্থ-সবল গৃহপালিত পশু জবেহ করা।” আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁর পথে রাসূল (সা) প্রদর্শিত ও নির্দেশিত পন্থায় নিজের জান-মালের মাধ্যমে আত্মত্যাগকেও কুরবানি বলা হয়। সূরা আল আনআমের ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলুন, হে নবী! নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছুই মহান রাব্বুল আলামীনের জন্য।” মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা আল কাউসারেও বলেছেন, “হে নবী! নিশ্চয়ই আপনাকে অনেক নিয়ামত (কাউসার) দিয়েছি, অতএব আপনি সালাত আদায় করুন এবং আপনার রবের জন্য কুরবানি করুন। আপনার বিরোধী শক্তিই মূলত লেজকাটা বা অন্তঃসারশূন্য।”
কুরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
সূরা আল হাজ্জের ৩৪ নং আয়াতের মাধ্যমে জানা যায় কুরবানির ইতিহাস অতি প্রাচীন ও মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই এর শুরু। মহান আল্লাহ বলেন, ‘প্রত্যেক উম্মাহর জন্য আমি কুরবানির একটি নিয়মনীতি বা বিধান ঠিক করে দিয়েছি, যাতে সে উম্মাতের লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নেয় যেগুলো তিনি তাদের দিয়েছেন।’
ইতিহাস থেকে জানা যায়, যুগে যুগে প্রায় সকল নবী রাসূলের উম্মাতেরাই কুরবানি পালন করেছেন। অগ্নি পরীক্ষা দিয়ে করেছেন ত্যাগ স্বীকার, কিন্তু প্রভু প্রেম ও নিঃশর্ত আল্লাহর আনুগত্য মহান রবের কাছে বেশি পছন্দ হয়েছে হযরত ইবরাহীমের। তাই মহান আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের কাছে এ নির্দেশ পৌঁছে দিতে কুরবানির বিধান স্বচ্ছল ও সামর্থবানদের ওপর করেছেন ওয়াজিব ।
কুরবানির উদ্দেশ্য
কুরবানির আসল উদ্দেশ্য তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন। পশু কুরবানির আড়ালে মূলত মনের পশুত্বকে কুরবানি করার কথাই এখানে বলা হয়েছে। সূরা আল হাজ্জের ৩৭ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তাদের কুরবানির গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে যায় শুধু মাত্র তাদের তাকওয়া। তিনি তাদের তোমাদের জন্য এমনভাবে অনুগত করে দিয়েছেন যাতে তাঁর দেওয়া পথনির্দেশনার ভিত্তিতে তোমরা তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। আর হে নবী! সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দিয়ে দিন।’’
সুতরাং বান্দার আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন, আনুগত্য ও শুকরিয়া প্রকাশের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভই আসলে ইবাদাত। আর সুন্নাতে ইবরাহীম বা কুরবানি তেমনই একটি ইবাদাত।
মুসলিমগণ তাদের জীবন, ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসে তার প্রিয় রব আল্লাহকে। তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য বিলিয়ে দেয় সবকিছু। পিছপা হয় না জীবনটাকেও কুরবানি করতে। যার ইতিহাস রচিত হচ্ছে অতীতের মতো বর্তমানেও। আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম বাহন এ কুরবানি অন্তরের শুধু পাশবিকতা দূরিকরণই করে না পাশাপাশি করে সমাজের অভাবগ্রস্ত আত্মীয়-স্বজনের প্রতি দায়িত্বপালনের নির্দেশও।
পরীক্ষায় পাস করে ও কুরবানি দিয়ে জাতির নেতা হলেন হযরত
ইবরাহীম (আ)
হযরত ইবরাহীম (আ) ছিলেন খলিলুল্লাহ বা আল্লাহর বন্ধু। আর বন্ধু হওয়ার জন্য তাঁকে দিতে হয়েছে অনেক পরীক্ষা। মুখোমুখি হয়েছেন হাজারো মুসিবতের। করতে হয়েছে অনেক ত্যাগ স্বীকার। তাঁকে পাস করতে হয়েছে সকল পরীক্ষায় গোল্ডেন পেয়ে। সফলতা লাভ করে আস্থা অর্জন করেছেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মহান রবের। আর এসব কারণেই তাঁকে করা হয়েছে বিশ্ববাসীর ঈমাম বা নেতা। যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে সূরা বাকারার ১২৪ নং আয়াতে। আল্লাহ বলেন, “যখন ইবরাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতপর তিনি তাতে উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ বললেন, আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা করবো। তিনি বললেন, হে আমার রব! আমার বংশধর থেকেও কি এই ওয়াদা? আল্লাহ বললেন, আমার অঙ্গীকার জালিমদের পর্যন্ত পৌঁছবে না।”
আমরা জেনে নিই হযরত ইবরাহীমকে করা আল্লাহ তায়ালার কয়েকটি পরীক্ষার কথা। ক. দীনি দাওয়াত প্রচারের কারণে দেশ ত্যাগ। খ. শিশুপুত্র ইসমাঈল ও প্রিয়তমা স্ত্রী হাজেরাকে নির্জনে নির্বাসনের পরীক্ষা। গ. নিজ পিতা কর্তৃক সংসার থেকে বহিষ্কার আদেশ। ঘ. নিজের ভাতিজা ও স্ত্রী ছাড়া কেউ দাওয়াত কবুল না করা। ঙ. রাজ দরবারে স¤্রাটের সাথে তর্কযুদ্ধ ও বিনিময়ে জ¦লন্ত আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পরীক্ষা। চ. সর্বশেষ বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার বয়সে জন্ম নেওয়া রক্তের বাঁধন, কৈশোরে পা দেওয়া প্রাণের চেয়েও প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানি করার পরীক্ষা।
হযরত ইসমাঈলের কুরবানি ও পিতা পুত্রের ধৈর্য
হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহর নবী। আল্লাহ স্বপ্নে বললেন, “তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কুরবানি করো। এ স্বপ্ন দেখলেন একাধারে পরপর তিন দিন। প্রতিদিন জবেহ করলেন একশত করে উট। তিন দিনে জবেহ করলেন তিনশোটি। পুনরায় স্বপ্নাদেশ হলো, “হে ইবরাহীম তোমার প্রিয় বস্তু কুরবানি করো।”
আল্লাহর হাবিব ইবরাহীম (আ) বুঝতে পারলেন তাকে কোন বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। কাল বিলম্ব না করে তিনি স্বীয় পুত্র ইসমাঈলকে তাঁর স্বপ্নাদেশ ও ইচ্ছার কথা জানালেন অকপটে। যেমন পিতা তেমন পুত্র। এ জন্যই কথায় বলে ‘বাপকা বেটা’। এ সম্পর্কে সূরা আস সাফফাতের ২নং আয়াতে আল্লাহ বলেন,“সে পুত্র ইসমাঈল যখন তাঁর সাথে কাজকর্ম করার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহীম একদিন তাঁকে বললো, হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি জবেহ করছি, এখন তুমিই বলো তুমি কি মনে করো এবং আমি কি করতে পারি? পুত্র ইসমাঈল বললো, হে আমার শ্রদ্ধেয় পিতা! আপনাকে যে হুকুম দেওয়া হয়েছে আপনি তাই করুন। অবশ্যই আল্লাহ যদি চান এ কাজে আপনি আমাকে সবরকারী হিসেবেই পাবেন।”
আরবের মিনা প্রান্তরে উপস্থিত হলেন হযরত ইবরাহীম (আ) প্রাণের পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে। উপুড় করে শুয়ে দিলেন জবেহ করার জন্য হযরত ইসমাঈলকে। হযরত ইবরাহীম নিজের চোখ বেঁধে পুত্রের ঘাড়ে চালালেন ধারালো ছুরি। আল্লাহর হুকুমে ও ব্যবস্থাপনায় ইসমাঈলের পরিবর্তে জবেহ হলো জান্নাতের দুম্বা। এ প্রসঙ্গে সূরা আস সফফাতের ১০৪-১০৯নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “শেষ পর্যন্ত যখন এরা দু’জন আনুগত্যের শির নত করে দিলো এবং ইবরাহীম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলো তখন আমি আওয়াজ দিলাম, হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছো। আমি সৎকর্মকারীদের এভাবেই পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চিতভাবেই এটি ছিল একটি প্রকাশ্য পরীক্ষা। একটি বড়ো কুরবানির বিনিময়ে আমি এ শিশুটিকে ছাড়িয়ে নিলাম এবং বংশধরদের মধ্যে চিরকালের জন্য তাঁর প্রশংসা রেখে দিলাম। সালাম বা শান্তি বর্ষিত হোক ইবরাহীমের ওপর।”
আত্মত্যাগের এত বড়ো অনুপম উপমা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর ঘটেনি বলেই আমরা জানি। বিষয়টি আল্লাহর কাছে এতই প্রিয় হলো যে, মহান আল্লাহ তায়ালা কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য কুরবানির বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে দেন। নির্দিষ্ট করেন অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে।
প্রিয় বন্ধুরা, আমরা সবাই জানি ত্যাগ ও কুরবানি মুসলিম উম্মাহর নিত্য সঙ্গী। ছিল অতীতে, আছে এখনও।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের শহীদি ঈদ নামক কবিতাটি স্মরণ করা যাক। কবি বলেছেন-
শহীদের ঈদ এসেছে আজ
শিরোপরি খুন- লোহিত তাজ
চাহি না ক’ গাভী দুম্বা উট
কতটুকু দান? ও দান ঝুট।
চাই কুরবানি, চাই না দান।
রাখিতে ইজ্জত ইসলামের
শির চাই তোর, তোর ছেলের,
দেবে কি? কে আছ মুসলমান?
তাই এসো বন্ধুরা, আমরা আবার শপথ নিই। উজ্জীবিত হই হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের কুরবানির চেতনায়। জাতীয় কবির শহীদি ঈদের আহ্বানে জেগে উঠি। আবার বিশ্বকে গড়ে তুলি। নব উৎসাহ আর উদ্দীপনায় নিজেকে বিলিয়ে দেই আল্লাহর রাহে। জীবন চলার পথ হোক ভোগ নয়, ত্যাগ ও কুরবানির মহিমায়।
আরও পড়ুন...