পাখিটা মরে গেছে
গল্প তমসুর হোসেন অক্টোবর ২০২৪
শীত জেঁকে বসেছে ডিসেম্বরে।
সকালে জেগে বারান্দায় পায়চারি করছি। সাতটা বেজে গেছে। এখনও গাছের পাতায় কুয়াশা জমে আছে। বাসায় আমি একা। রান্না ও পরিচ্ছন্নতার ঝামেলা নিজেই সামলে নিচ্ছি। সময় না পাওয়ায় ভেতর আঙিনার পেয়ারাতলে অনেক পাতা জমে গেছে। একজোড়া ঘুঘু বাড়ির নির্জনতার সুযোগে পেয়ারার ঝাঁকড়া শাখায় বাসা তৈরি করেছে। পালা করে ডিমে তা দিচ্ছে ওরা। এখন ওদের বিরক্ত করার কেউ নেই। তাই ওরা ডিম তা দেওয়ার ফাঁকে মধুর সুরে গান গায়। ঘুঘুর নরম ধাঁচের সুর শ্রবণে মধু ঢালে। কী সুমধুর সতেজ ও ছন্দময় সে সুর। শৈশবে একটা সাদা খেলনা ঘুঘু ছিল আমার। ঘুঘুটা হারিয়ে অনেক কেঁদেছি আমি। সকালের পায়চারিতে বৈষয়িক চিন্তায় বেশ মগ্ন ছিলাম। ঘুঘুর কোমল সুর আমাকে শৈশবের ফেলে আসা দিনে টেনে নিয়েছিল। এর মধ্যে পেয়ারা গাছ থেকে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দে আমি সচকিত হলাম। মাঝারি উচ্চতার গাছের সব শাখাপ্রশাখাই সজীব ও প্রাণবন্ত। ওখান থেকে কোনোকিছু খসে পড়ার বিষয় নেই। আমার মনে একটা কৌতূহল সৃষ্টি হলো। সকালে পায়চারি করা আমার বহুদিনের অভ্যাস। এমন শব্দ কোনোদিন কানে আসেনি। গাছের নিচে যেয়ে কঞ্চি দিয়ে জমে থাকা পাতায় মৃদু নাড়া দিলাম। নাড়া পেয়ে একটা বুলবুলি পাখা ঝাপটিয়ে ছুটে যেতে লাগলো। ওর একটা ডানা বেশ দুর্বল। আমি ওকে ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বুলবুলিটা ভীত হয়ে আমার নাগালের বাইরে চলে গেল। আমি ভাবলাম এ অবস্থায় ধরতে গেলে ও আরও অসুস্থ হতে পারে। কোনো কারণে হোক অসুস্থ হয়েছে পাখিটা। এই মুহূর্তে ওর পেছনে ছোটা ঠিক হবে না। আর ওকে ধরতে না পারলে সমস্যা জানা যাবে কী করে?
সকালে অনেক কাজ। এখনও নাস্তা হয়নি। নাস্তার আগে শোবার রুম আর চেম্বার গোছগাছ করতে হবে। রাতে হোটেল থেকে পরোটা এনেছি। ওই পরোটা গরম করে ডিম দিয়ে খেতে হবে। চটজলদি চালও সেদ্ধ করতে হবে দুপুরের জন্য। দুটো আলু গুঁজে দিলে সহজেই দুপুরের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। শীতের অবকাশে গিন্নি বাচ্চাদের নিয়ে পিতৃগৃহে বেড়াতে গেছে। নটায় চেম্বারে ভিড় লাগবে। দুটো তক ব্যস্ত থাকতে হবে। কখন বুলবুলির খোঁজ নেবো। বেশ ঝামেলা হলো একটা।
কাজ সেরে বুলবুলিকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু ওর কোনো সন্ধান মিলছে না। ভেতর আঙিনায় চোখ লাগিয়ে খুঁজছি। গেলটা কোথায়। অবশেষে কিছু পাতার আড়ালে ওকে পেলাম। গা খুব গরম পাখিটার। ও থরথর করে কাঁপছে। এখন আর ছুটতে পারছে না। বসেও থাকতে পারছে না। ওর চোখের দৃষ্টি বড়ো অসহায়। দৃষ্টির ভাষা দিয়ে আমাকে কষ্টের কথা বোঝাতে চায়। এই সুন্দর ধরণির শ্যামল সবুজে ও বাঁচতে চায়। আমি তো পাখি চিকিৎসক নই। ওর রোগ শনাক্ত করতে আমি অপারগ। ওর দেহে কোনো জখম নেই। আঘাত পেয়েছে বলে মনে হয় না। দেশে এখনও করোনার প্রকোপ চলছে। ভাবলাম ওর করোনা হয়েছে নাকি? পাখিরও কি করোনা হয়? এই মুহূর্তে ওর কী সেবা দেবো। অনেক ভেবে এক মিলি মক্সিন খাইয়ে দিলাম ওকে। একটা গামলায় তুলো বিছিয়ে শুইয়ে দিলাম। আঙিনায় কোমল রোদ পড়েছে। আয়নার মতো ঝলমলে পরিচ্ছন্ন রোদ। গামলাটা সেই রোদে রাখলাম যাতে বুলবুলি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
চেম্বারে দুটো বেজে গেল। হঠাৎ বুলবুলির কথা মনে পড়লো। ওকে কিছুই খাওয়ানো হয়নি। তরল খাবার গিলতে পারবে মনে হয়। একটু চিনির শরবত দিলে মন্দ হবে না। ওর কাছে গিয়ে দেখি রোদ সরে গেছে। ছায়ায় থেকে দেহটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। পাখা ছড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে আছে পাখিটা। ওর গায়ে একটু নাড়া দিলাম। একটুও সাড়া দিলো না পাখিটা। ওর দেহে একটুও শক্তি নেই। সেদিন এক নবজাতক এসেছিল চেম্বারে। সেপটিসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিন দিন ছিল জেলা হাসপাতালে। মৃত্যুর আলামত প্রকাশ পেয়েছিল ওর শরীরে। আমি ওকে রক্সিম আর ভিটামিন ড্রপ দিয়েছি। তাতেই শিশুটি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছে। পাখিটার মধ্যে রোগের কোনো চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না। ড্রপারে শরবত দিলাম ওর ঠোঁটে। শরবত গিলতে পারলো কি না বুঝতে পারলাম না। ওকে ঔষধ গেলানোর চেষ্টা করলাম। ফল একই হলো। ও গিলতে অপারগ হলো। ওর দেহে গরম কাপড় জড়িয়ে বারান্দার কোণে রেখে দিলাম। বিকেল হতেই কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। আমার মন চায় ওর পাশে বসে থাকি। প্রতি মুহূর্তে ওর শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করি। কিন্তু জরুরি কাজ থাকায় সন্ধ্যার দিকে বাইরে পা বাড়াতেই হলো।
বাসায় ফিরতে রাত হয়ে গেল। মার্কেটে জরুরি কাজ সেরে যেতে হয়েছে গ্রামের দিকে। ওখানে একজন পশুচিকিৎসকের সাথে দেখা হলো। তাকে প্রশ্ন করলে বললো, শীতের প্রকোপে ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে অনেক পাখি মারা যায়। তাছাড়া পাখির উপদ্রব থেকে ফসল রক্ষা করতে জনগণ জমিতে বিষ প্রয়োগ করে। এতে অসংখ্য পাখির জীবন বিনাশ হয়। এ পাখিটাও সেরকম কোনো সমস্যায় পড়তে পারে। পশুচিকিৎসকের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। তাহলে পাখিটা বাঁচবে না। ওর প্রতি বেশ মায়া জন্মেছে আমার। এই অবোধ পাখিরা কণ্ঠের কলকাকলিতে প্রকৃতিকে প্রাণবন্ত করে রাখে। অথচ ওদের প্রতি মানুষের কোনো মমতা নেই। পাখিনিধনের অনেক নিষ্ঠুর কাহিনী পত্রিকায় দেখেছি। ফাঁদ পেতে পাখি ধরে অনেকে বাজারে বিক্রি করে। পাখির কণ্ঠ নকল করে অথবা তার রেকর্ড বাজিয়ে পাখিকে বিভ্রান্ত করে ফাঁদে ফেলে অনেক শিকারি। এসব কথা ভেবে রাতের খাবার হোটেলে খেয়ে চিন্তিত মনে বাসায় চলে এলাম।
জনহীন বাসাটা কুয়াশার আলখাল্লা পরে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গেইটের সিকিউরিটি লাইট অনুজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে বিভ্রান্ত করছে নীড়হারা পতঙ্গকে। গেইটের তালা খুলে রুমে ঢুকে মন বেদনার্ত হয়ে উঠলো। সবাই বাসায় থাকলে মন এমন হতো না। আমার অনুপস্থিতিতে ওরা পাখিটার যত্ন করতে পারতো। অসহায় পাখির মৃত্যুদৃশ্য একাকী প্রত্যক্ষ করতে হবে আমাকে। একরাশ বিষণœতা নিয়ে শরীর থেকে শীতের পোশাক খুলে ফেললাম। একটা ফুলহাতা গেঞ্জি পরে গেলাম পাখিটার কাছে। বারান্দার বাতিটা বড়োই নিষ্প্রভ মনে হচ্ছে। মনে হয় এখানে কত শোক জমা হয়ে আছে। ঠাণ্ডাও পড়ছে দারুণ। হিমাচ্ছন্ন বারান্দায় মৃত্যুর করুণ আবহ টের পাচ্ছি আমি। ভীতিকর অচেনা অনুভূতি আমার হাত-পা অবশ করে দিচ্ছে। বারান্দায় আর একটা বেশি ভোল্টের উজ্জ্বল বাল্ব আছে। ওটা জ্বালিয়ে পরিবেশটা একটু হালকা করলাম। তারপর পাখিটাকে অবলোকন করলাম গামলার আবরণ খুলে। ভালো করে দেখলাম ওর মধ্যে জীবনের কোনো অস্তিত্ব নেই। নিশ্চল ডানা ছড়িয়ে ঝরাপাতার মতো নেতিয়ে পড়ে আছে। তা দেখে চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগলো। মৃত্যুর সময় প্রতিটি প্রাণী মনে হয় কারো সঙ্গ কামনা করে। আমি যদি নিরীহ পাখিটাকে অন্তিম সময়ে একটু সঙ্গ দিতে পারতাম। তাহলে কতই না ভালো কাজ হতো।
আরও পড়ুন...