পিঠাপুলির বাংলাদেশ

পিঠাপুলির বাংলাদেশ

ফিচার রুমান হাফিজ জানুয়ারি ২০২৫

গ্রামের মেঠোপথ, ঘোমটা পরা কুয়াশা, খেজুরের রস, সূর্যের উঁকি দেওয়া সকালের কোমল মিষ্টি রোদ, আর মায়ের হাতের পিঠা মনে পড়লে কার না গ্রামে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। তাইতো পিঠাকে ঘিরে ‘পল্লী মায়ের কোল’ কবিতায় বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশীতে বিষম খেয়ে/আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’ 

গ্রাম-বাংলার শীতের আলাদা ঐতিহ্য রয়েছে। আর সেই ঐতিহ্যের বড়ো অংশ জুড়ে আছে পিঠাপুলি। শীত এলেই পিঠাপুলির ধুম পড়ে যায়।

বিভিন্ন এলাকার পিঠার তারতম্য থাকায় আমাদের গ্রাম-বাংলায় ভিন্ন ভিন্ন পিঠাভিত্তিক সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছে। আর শীতের আনাগোনায় পিঠার আধিক্য যেন আরো বেড়ে যায়। সেজন্য শীতকালকে পিঠার মৌসুমও বলা হয়ে থাকে। এ সময় হেমন্তে নতুন ধান ঘরে ওঠে। ধান মাড়াই, সিদ্ধসহ প্রক্রিয়াজাত করা শেষ হতে না হতেই শীত এসে হাজির হয়। নতুন ধানের নতুন চালে হরেকরকম পিঠা তৈরি হয় গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর কিংবা সন্ধ্যায় গাঁয়ের বধূরা চুলার পাশে বসে ব্যস্ত সময় কাটায় পিঠা তৈরিতে। অতিথি বিশেষ করে জামাইদের দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানো হয়। এ সময় খেজুরের রস থেকে গুড়, পায়েসসহ নানারকম মিষ্টান্ন তৈরি হয়। খেজুরের রসের মোহনীয় গন্ধে তৈরি পিঠা-পায়েস আরও বেশি মধুময় হয়ে ওঠে। 

সেই আদিকাল থেকেই বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে সারা বছরই কোনো না কোনো ধরনের পিঠাপুলি খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। তবে শীতকালই হলো হরেক রকম পিঠাপুলির আসল মৌসুম। মূলত মাঘ-ফাল্গুন এ দুমাসই জমিয়ে পিঠা খাওয়া হয়। একসময় এ দেশে যেমন শত শত নামের ধান ছিল, তেমনি সেসব ধানের পিঠারও অন্ত ছিল না। কত কী বিচিত্র নামের পিঠা! আর সেসব পিঠার নামের বাহার যেন পিঠা খাওয়ার আকাক্সক্ষা আরো বাড়িয়ে দেয়। এসব পিঠার মধ্যে বেশ পরিচিত কিছু পিঠা- চিতই, ভাপা, নকশি, ছিট পিঠা, দুধকুলি, ক্ষীরকুলি, তিলকুলি, পাটিসাপটা, ফুলঝুড়ি, ধুপি পিঠা, নকশি পিঠা, মালাই পিঠা, মালপোয়া, পাকন পিঠা, ঝাল পিঠা, বিউটি পাপড়ি, পুলিপিঠা ছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে হরেক নামের বাহারি সব পিঠা দেখা যায়। 

ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি আমাদের দেশের সংস্কৃতির এক বিরাট অংশ। আবহমানকাল থেকে চলে আসা পিঠাপুলির উৎসব এবং শতাধিক রকমের পিঠা তৈরির মধ্য দিয়ে এ দেশের নারীদের শিল্পী সত্তার পরিচয় মেলে। পিঠা তৈরি ছিল আবহমান বাংলার মেয়েদের ঐতিহ্য। এ দেশের নারীরা কত যে গুণের অধিকারী, ধৈর্যশীলা ও কঠোর পরিশ্রমী তার পরিচয় পাওয়া যায় তাদের তৈরি পিঠার নকশা, রকমারি ডিজাইন ও বানানোর পদ্ধতি দেখলে। 

পৌষের হিমেল হাওয়া ছাড়া যেমন শীতকে কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনি পিঠা ছাড়াও বাঙালির ঐতিহ্য ভাবা যায় না। তবে অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন পিঠা যেমন দেখা যায়, তেমনি একেকটি পিঠার বিভিন্ন নামও লক্ষ করা যায়। যেমন-

ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পিঠার মধ্যে আছে গুজা পিঠা, ডালরুটি, ছানার মালপোয়া, বিবিখানা পিঠা, কলাপিঠা, মুখশলা পিঠা, চাপড়ি পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, মুঠি পিঠা, খেজুর পিঠা, ডিমের ঝাল পুয়া, তিল পুলি, সাবুর পিঠা।

নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পিঠার মধ্যে রয়েছে- ডিমের পানতোয়া, খোলাজা পিঠা, নারকেল পুলি পিঠা, নারকেলের চিড়া। 

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী কিছু পিঠা হলো- আতিক্কা পিঠা, বিন্নি পুলি পিঠা। সিলেটের গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কিছু পিঠার মধ্যে অন্যতম হলো চুঙ্গাপুড়া পিঠা, নোনতা বা নুনগড়া পিঠা। ময়মনসিংহে কলসি পিঠা নামে একধরনের আঞ্চলিক পিঠার প্রচলন আছে।

বাগেরহাট-খুলনা অঞ্চলের আঞ্চলিক পিঠার নাম বললে শুরুতে আসবে সেমাই পিঠা। একটা সময় কাঠের কাঠামোয় তৈরি কল চেপে এই পিঠা তৈরি করা হতো। এখন কাঠের কলের বদলে ইস্পাতের কল এসেছে। হাতল ঘোরালেই মুখ দিয়ে চিকন সেমাই পিঠা বের হয়। এরপর এই সেমাই ভাপে সেদ্ধ করতে হয়। নতুন আলু আর দেশি মুরগির ঝোল দিয়ে করা হয় গরম-গরম পরিবেশন। এ ছাড়া চুই-মাংস দিয়েও পিঠাটি খাওয়া হয়। শীতকালে বাড়িতে বড়ো কুটুম এলেই সাধারণত এই পিঠা তৈরি করা হয়ে থাকে।

আরও কিছু আঞ্চলিক পিঠার নাম বলে যাই। ছাঁচ পিঠা, দোল পিঠা, চাপড়ি পিঠা, মুঠি পিঠা, ছিট পিঠা, সরভাজা পিঠা, মালপোয়া পিঠা, ঝালপোয়া পিঠা, তেলপোয়া পিঠা, ঝিলমিল পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, মালাই পিঠা, চুটকি পিঠা, গোকুল পিঠা, আন্দশা পিঠা, রসফুল পিঠা, গোকুল পিঠা, ঝিনুক পিঠা, কুশলি পিঠা, নারকেল নাড়ু পিঠা এবং কাউনের মোয়া পিঠা।


নগরেও পিঠাপুলি

শীতকালে শুধু গ্রাম-বাংলায়ই নয়, শহর এলাকায়ও পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। শহরের ব্যস্ততার পরও সবারই মন চায় জননীর কিংবা প্রিয়জনের হাতের পিঠা খেতে। কিন্তু শহুরে জীবনে এই আকুলতা দূর করতে অনেকেই ছুটে যায় বিভিন্ন পিঠা উৎসবে। তবে কজনই বা পিঠা উৎসবে যাওয়ার সময় পায় বা সামর্থ্য রাখে। তাই নগরে বাসিন্দাদের পিঠার চাহিদা মেটাতে রাস্তার মোড়ে, অলিগলিতে, বাসস্ট্যান্ডে বসে ছোট ছোট পিঠার দোকান। দোকানগুলোতে মিলে নানান রকম শীতের পিঠা, যেখানে বেশি চোখে পড়ে চিতই আর ভাপা। নানা পেশার লোকজনের ভিড়ও লেগে থাকে দোকানগুলো ঘিরে। 

তাছাড়া, সময় স্বল্পতার কারণেও বাসায় পিঠা বানানো অনেকের জন্য সম্ভব হয়ে উঠে না। এসব কারণেই এখন অনেকেই অনেক শপ, গ্রুপ বা ওয়েবসাইট-এ অনলাইনে অর্ডার দিয়েও পিঠার স্বাদ গ্রহণ করেন। শীতের পিঠার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ভাপা, চিতই ও রসের পিঠা। শীতে সব জায়গাতেই ভাপা ও চিতই পিঠার আধিক্য থাকলেও রসের পিঠা গ্রামেই বেশি দেখা যায়। খেজুরের রসের সঙ্গে দুধ আর নারকেল দিয়ে, রসের পিঠার যে স্বাদ, তা বর্ণনাতে কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না।

তবে কিছুটা দুঃখ রয়েই যায়। সাম্প্রতিক সময়ে পিঠার দোকানের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় বাড়িতে বাড়িতে পিঠা বানানোর ঐতিহ্য কিছুটা ম্লান হয়েছে। নতুন প্রজন্ম তাদের মায়ের হাতের হরেকরকম পিঠাপুলি খেতে পারে সেদিকে আরেকটু খেয়াল রাখা যেতে পারে। দেশ-বিদেশে পিঠাশিল্পের বাণিজ্যিকীকরণও দরকার। পিঠা সে তো আমাদেরই ঐতিহ্য, আমাদেরই সংস্কৃতি। তাই এই ঐতিহ্য বাঁচিয়েও রাখতে হবে আমাদেরই।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ