প্রিয় কবি সৈয়দ আলী আহসান
বিবিধ শরীফ আবদুল গোফরান জানুয়ারি ২০২৪
বৃক্ষের পরিচয় যেমন ফলে, একজন কবির পরিচয় তেমনি তার কবিতায়। তাঁর ভাবে, বিষয়ে, বিন্যাসে।
তোমাদেরকে যে মানুষটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই তাঁর পরিচয়ও তাঁর কবিতায়। যেমন একটি কবিতায়-
তোমার যখন হাঁটি হাঁটি
একটু একটু পায়ের চলা
তোমার যখন ভাঙ্গা ভাঙ্গা
একটি দুটি শব্দ বলা।তোমার যখন প্রথম হাসি
মেঘ সরিয়ে আলোক জলে
তোমার নতুন চেয়ে দেখায়
ফুলগুলো সব কথাই বলে।এখন সবাই আনন্দিত
বলে সবাই চাঁদ নেমেছে
আকাশ থেকে মাটির বুকে
রাতের বেলা দীপ হেসেছে।আমি এখন তোমার দিকে
হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসি
তুমি আমার নয়ন তারা
খুশির গাঙ্গে বান ডেকেছে।ওপরের কবিতাংশ থেকেই আমরা তাকে চিনে নিতে পারি। তাঁর মনোজগৎ তার দৃষ্টিকোণ তার প্রকাশ ভঙ্গিতে সবকিছুর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মুখের হাসি আর বুকের ভালোবাসাকে মনের রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার প্রয়াসী তিনি। যে প্রিয় মানুষটির কথা তোমাদেরকে বলতে চাচ্ছি তিনি হলেন আমাদের প্রিয় মানুষ প্রিয়, কবি সৈয়দ আলী আহসান।
সৈয়দ আলী আহসান একজন বড় কবি, বড় মানুষ। তাঁর অজস্র লেখা। তিনি বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, তেমনি ছোটদের জন্যও তাঁর সাহিত্যের ভাণ্ডার কম নয়। তাঁর কথা বাচনভঙ্গিই আলাদা। তিনি যখন কথা বলতেন, তখন মনে হতো যেন প্রতিটি কথাই কবিতার পঙক্তিমালা। যেন ছন্দে ছন্দে দুলতে থাকত তাঁর কথার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লাইন। তার প্রবন্ধগুলো পড়লে মনে হয় যেন প্রতিটি লাইনই কবিতার লাইন। তাঁর লেখার মধ্যে যেমন ছিল রোমান্টিকতা, তেমনি সারা বিশ্বের ইতিহাস, ঐতিহ্য সংস্কৃতিও ফুটে উঠতো। তাঁর লেখার মধ্যে বিশ্বের কোনো না কোনো দেশের কথা আসতোই। কারণ তাঁর অনেক জানা। সারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন তিনি।
এই বড় মানুষটির সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। কী বলো, তাই না? হ্যাঁ বলছি, শোনো।
১৯২২ সালের ২৬ শে মার্চ। যশোর জেলার আলোকদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সৈয়দ আলী আহসান। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আলী হামেদ, আর মাতার নাম সৈয়দা কামরুন্নেগার খাতুন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাড়িতে গৃহ শিক্ষকের কাছে তাঁর হাতে খড়ি। ১৯২৬ সালে ধামরাই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু।
তারপর ১৯৪১ সালে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে আরমানিটোলা স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩৮ সালে তিনি কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর ঢাকা কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবনে সৈয়দ আলী আহসান ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, হুগলি ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, অল ইন্ডিয়া রেডিও, বাংলাদেশ বেতার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৮২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে যোগদান করেন।
তাঁর প্রথম লেখা কোথায় ছাপা হয় জানো? ১৯৩৭ সালে স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রথম একটি ইংরেজি কবিতা ছাপা হয়। ১৯৪০-৪৪ সালের মধ্যে তিনি গল্প, উপন্যাস লেখা আরম্ভ করেন। তখনকার গল্পগুলোর শিরোনাম হলো-বুদ্বুদ, তারা তিনজন, রহিমা, জন্মদিন ইত্যাদি। এসব লেখা তৎকালীন মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাতে ছাপা হয়। তাঁর লেখা প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১০৫টি।
সৈয়দ আলী আহসান পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করেন। আমার মনে হয় সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো তিনিই একমাত্র কবি।
তিনি দেশ-বিদেশ থেকে অগণিত পুরস্কার লাভ করেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্বাধীনতা স্বর্ণপদক, একুশে পদক, নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক ও মাইকেল মধুসূদন সাহিত্য পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।
কবি সৈয়দ আলী আহসান নীল রং পছন্দ করতেন। তবে সাদা রঙের কাপড় তিনি বেশি ব্যবহার করতেন।
সব ধরনের খাবারে তার প্রিয়। তবে বিশেষ পছন্দ ছিল বিরিয়ানি, পরোটা, কাবাব, পাঙ্গাশ মাছ, শোল মাছ ও বড় কৈ মাছ।
সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন একজন ভাবুক মানুষ। অন্ধকার রাতে মাঠে বেরিয়ে এসে শীতল বাতাসের প্রশ্রয়ে নক্ষত্র খচিত নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে স্রষ্টার সাথে কথা বলতেন। তার ভাষায়- ‘হে প্রভু, অসহায় আমি/তোমার সৃষ্টির বিপুল বিস্তার দেখে আনন্দে আপ্লুত এবং তোমার অস্তিত্বের কাছে আমি আমার নিজকে সমর্পণ করছি।’ ২০০২ সালের ২৫ শে জুলাই বাংলার সবুজ মাটির মায়া ত্যাগ করে মহান স্রষ্টার কাছে নিজেকে চিরদিনের জন্য সমর্পণ করেন তিনি।
আরও পড়ুন...