ফেরা
গল্প মাহমুদ শরীফ জুন ২০২৪
রাত বারোটা। হাত ঘড়িটা তারিখ ও সময় পাল্টানোর সংকেত দিলো। নতুন তারিখ ও বারকে স্বাগত জানালো সে।
রাস্তায় জনমানব আর যানবাহনের চলাচল নেই বললেই চলে। বিভাগীয় শহরের এখনও কেউ কেউ জেগে আছে। গ্রামে অবশ্য এখন গভীর রাত। কোথাও সাড়া-শব্দ পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের দক্ষিণের বিভাগীয় শহর খুলনা। চারিদিকে আলোর ঝলকানি। রাস্তায় রাস্তায় সোডিয়াম লাইট জ¦লছে। সারা দিন মহাব্যস্ততার পর একটু নিঝুমতা নেমে এসেছে শহরময়। সবাই যার যার কুঠিরে মাথা গুঁজেছে।
আশিক চলছে তো চলছেই। আপন মনে একাগ্রচিত্তে হেঁটে চলেছে সে। কোথায় কার কাছে, কোন গন্তব্যে ছুটে চলেছে তা জানা নেই আশিকের। শুধু হাঁটছে আর হাঁটছে, বিরামহীনভাবে।
হঠাৎ কারো ডাকে সম্বিৎ ফিরে আসে কিশোর আশিকের।
- এই ছেলে কোথায় যাচ্ছো? কী নাম তোমার?
আশিক দেখে মধ্য বয়সী শরীরে পুলিশের মতো পোশাক পরা জনৈক ব্যক্তি তার পাশে দাঁড়িয়ে। হাতে বাঁশি ও একটা বড়োসড়ো লাঠি। সহজেই বোঝা যায় লোকটি এই এলাকার রাতের পাহারাদার।
আশিক নিজের পরিচয় খুলে বলে পাহারাদার শফি মিয়ার কাছে। পাশে বসিয়ে আশিকের মাথায় হাত বুলায় শফি মিয়া। সব কথা শুনে পাহারাদার বললো, তুমি বড্ড ভুল করেছো বাবা; এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করতে পারোনি, তাই বলে কী বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হবে? এ বছর পাশ না করলেও আগামী বছর তো আছে! যদি ঠিকমতো লেখাপড়া করো তাহলে অবশ্যই আগামী বছর পাশ ধরা দেবেই দেবে। শোনো! সঠিক পথে সাধনা করলে মহান আল্লাহ সেই সাধনার ফল অবশ্যই দেন।
আশিক শফি মিয়ার কথা শুনে হা করে চেয়ে থাকে। তাকে এভাবে কেউ কোনোদিন আপন করে কাছে বসিয়ে বুঝ দেয়নি। লোকটি বলেই চলেছে।
- আমি জানি, পরীক্ষায় ফেল করা লজ্জার ব্যাপার। সবাই শুধু ধিক্কারই দেয়। সহপাঠীদের কাছে ছোটো মনে হয় নিজেকে। মাথা নিচু হয়ে আসে সবখানে। তাই বলে ভেঙ্গে পড়লে তো আর চলবে না! একবার না পারিলে দেখ শত বার!
আশিক মাথা নিচু করে শুনছে লোকটির কথা। নিজে কিছু বলার ভাষা যেন খুঁজে পাচ্ছে না। বাক্য ভাণ্ডার যেন শূন্য হয়ে গেছে ওর। পাহারাদার শফি মিয়া জানতে চাইলেন- তোমার আব্বা কী করেন?
আশিক উত্তর দেয়- আব্বা বেঁচে নেই। শুধু মা আছে; আমিই মায়ের একমাত্র সন্তান।
লোকটি আশ্চর্য হয়ে বললো- সর্বনাশ! তুমি কীভাবে এমন কাজ করতে পারলে? ছি-ছি-ছি! এমন কাজ করা তোমার মোটেও ঠিক হয়নি। তোমার হতভাগী মায়ের তুমিই একমাত্র অন্ধের যষ্টি। তোমাকে নিয়েই তোমার মায়ের হাজারো স্বপ্ন। তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর থেকে হয় তো তোমার মা পাগলীনি হয়ে গেছে।
এবার আশিক একটু প্রতিবাদের ভাষায় জবাব দেয়- বুঝলাম, তাহলে কেন আমার ওপর এত রাগ দেখায়? কেন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে বারবার?
আশিকের কথা শেষ না হতেই পাহারাদার শফি মিয়া আবার বলে- শোনো, তোমার মা রাগ করে চলে যেতে বললেই তুমি বাড়ি ছাড়া হবে? শোনো বাবা! সকল মা-বাবাই সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। তাদের রাগের মধ্যেও কল্যাণ রয়েছে। আর মায়ের মতো আপন কে আছে বলো? যদি কেউ মা-বাবার থেকে বেশি ভালোবাসে তাহলে সেটা স্বার্থের জন্যই হতে পারে। কিন্ত মা-বাবার ভালোবাসা আদর স্নেহ সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ। তাই বলি বাবারে! ফিরে যাও, মায়ের কাছে ফিরে যাও। নতুন করে আবার পড়ালেখা করো। তোমার মা তোমার পথের দিকে চেয়ে আছে। তার কাছে যাও, দোয়া নাও গে! সে-ই তোমার পরম শান্তির পরশ। তোমার জান্নাত! তুমি দুই দিন বাড়ি ছাড়া, মনে হয় তোমার মা...
শফি মিয়ার কথা শেষ না হতেই আশিক নিজের ভুল বুঝতে পারে। সত্যিই তো, মা যে তার সবচেয়ে আপন। মায়ের ভালোবাসার মতো নির্মল ভালোবাসা কেউ দিতে পারে না।
আশিক পাহারাদারের কথায় আবার ফিরে পায় সাহস আর উদ্যম। লেখাপড়া করার আগ্রহ-উদ্দীপনা। পাশাপাশি সকালেই বাড়ি ফেরার সংকল্প করে মনে মনে। গত দুই রাত খুলনা রেলস্টেশনে কেটেছে তার। খেয়েছে পথের ধারের হোটেলে। তাছাড়া পকেটও শূন্য প্রায়।
গভীর রাত। ঘনকালো তিমির অন্ধকারে ছেয়ে আছে রসুলপুর গ্রাম। চারপাশ নিঝুম, নিস্তব্ধ। ঝিঁঝি পোকা আর নিশাচর পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে মাঝে মধ্যে। দূর থেকে খ্যাঁকশিয়ালের হুক্কাহুয়া সুর শোনা গেল কয়েকবার। ডাহুক পাখির ডাকাডাকির শব্দও হচ্ছে ঝোপঝাড়ে। আশিকের মা রাহেলা বেগম ঘরের দরজা খোলা রেখে হারিকেন জ¦ালিয়ে বসে আছে। কান দুটো সর্বদা সজাগ। প্রতিবেশীরা সবাই ঘুমের দেশে। মায়ের চাতকী চোখের একান্ত প্রত্যাশা- ছেলে আশিক এই আসলো বুঝি!
আশিক লজ্জা আর শরমে দিনের বেলায় বাড়ি ফেরেনি। দুপুরের পর পরই উপজেলা শহর কুমারখালী এসেছে সে। এখন গভীর রাতে চুপি চুপি পায়ে হাজির বাড়িতে, মায়ের কাছে। পায়ের শব্দ শুনেই রাহেলা বেগম বলে ওঠে- কিডা? কিডা ওহানে?
- আমি মা! আ-মি-ই!
- তুই আইছিস বাজান? আয় আয়, আমার বুকে আয়! আমি না হয় একটু রাগই করেছিলাম, পরীক্ষায় ফেল না করলে কি রাগ করতাম? আয় বা-জা-ন, আয় সোনা মানিক! বলেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে দু’জনেই।
মা বলে- আমারে ছাইড়া আর কোনোদিন, কোথাও যাবি না বাপ!
- হাঁ মা, আর কোনোদিন তোমাকে ছেড়ে যাবো না, কোনোদিন না।
আশিক বলতে বলতে মা রাহেলা বেগমের চোখের পানি মুছে দেয়। মাও ছেলের মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে। মা-ছেলের মিলনের দৃশ্য দেখে জোনাকিরা আলোর জ্যোতি বাড়িয়ে দেয়। ঝিঁঝিরা সুর তুলে গেয়ে উঠে নতুন গান। আশিকের পায়রার ঘর থেকে ভেসে আসে বাকবাকুম ডাকের সুমধুর ধ্বনি।
আরও পড়ুন...