বাংলাদেশের দুর্লভ পাখি
প্রচ্ছদ রচনা ফরিদী নুমান নভেম্বর ২০২৪
গ্রামের বাড়ির উঠোনের পাশের ঝোপের মধ্যে ছোট্ট পাখি টুনটুনি ঠিক ফজরের আজানের সাথে সাথেই ডেকে ওঠে। এর সাথে সাথেই আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েলের তীব্র শিস শুনেই আমাদের ভোর হয়। আর কাক যদি হাঁক-ডাক না ছাড়ে তাহলে তো সূর্য মামারও ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যেত। এমন পাখি-ডাকা ভোর হওয়ার দেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। চৈত্রের উদাস দুপুরে দক্ষিণের আম বাগানের ছায়ায় ঘুঘু পাখির গুরু-গম্ভীর গান কিংবা বসন্ত বাউরি পাখির কোরাস আমাদের প্রায় সবারই পরিচিত। পাখি আমাদেরকে যেমন ঘুম ভাঙানির কাজ করে তেমনি সন্ধ্যায় তাদের নীড়ে ফেরা দেখে আমাদেরও বাড়ি ফিরতে হয়। এ তো গেল দিনের বেলার কথা। শিশুকালে রাতে কোয়াক পাখি, হুতুম প্যাঁচা কিংবা রাতচরা পাখির ভুতুড়ে ডাক শুনে ভয়ে মায়ের কোলের মধ্যে সেধিয়ে যাওয়ার স্মৃতি হয়তো অনেকেরই মনে আছে।
কিন্তু আমাদের সেইসব স্মৃতি জাগানিয়া পাখিদের অনেকেই প্রকৃতি থেকে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে কিংবা কেউ কেউ ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে। নির্বিচার বন বা বৃক্ষ নিধন, পাখির আবাস ধ্বংস, ফসলি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক বা বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের অবিমৃশ্য আচরণই প্রকৃতির এসব বন্ধুদের হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশের পাখির তালিকায় স্থানীয় ও পরিযায়ী মিলে প্রায় সাত শতাধিক পাখি আছে। নানান বর্ণ, নানান আকার, বৈচিত্র্যময় আচার-আচরণের পাখিরা দেশের আকাশ, বন, বিল, হাওর-বাওড়, নদী, সমুদ্রের নিসর্গকে প্রাণবন্ত করে রাখে। আজ আমরা বাংলাদেশের কয়েকটি দুর্লভ, বিরল ও বিপন্ন পাখি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো। এই পাখিগুলো এমন যে- অনেকের কাছেই প্রায় অদেখা কিংবা দেখেছে, হয়তো চিনতে পারেনি। বিজ্ঞানীরা যেসব কারণে পাখিদের সুলভ-দুর্লভ বা অন্য অভিধায় তালিকাভুক্ত করেন তা মোটামুটি এ রকম-
আবাবিল
৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর জন্মের মাত্র দু’মাস আগের ঘটনা। ইয়েমেনের দাম্ভিক রাজা আবরাহা ১৩টি বিশালাকায় হস্তীসহ (মতান্তরে ৯টি) বিপুল সৈন্য-সামন্ত নিয়ে পবিত্র কাবা ধ্বংস করতে এলো। আবরাহার বিপুল বাহিনীকে মোকাবিলা করার মতো সামরিক সক্ষমতা আরব কুরাইশদের ছিল না। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে হাজার হাজার ক্ষুদ্র পাখি কঙ্কর নিক্ষেপ করে আবরাহার পুরো বাহিনীকে বিধ্বস্ত ও ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহর নির্দেশে আসা ক্ষুদ্র পাখিকে আমরা ‘আবাবিল’ নামে চিনি। পবিত্র কুরআনের ১০৫ নম্বর সূরা ফিলে ‘তাইরান আবাবিল’ শব্দটি এসেছে। বাংলাদেশে আবাবিল গোত্রে অন্তত ১০ প্রজাতির পাখি রয়েছে।
Common | দুর্লভ | সঠিক স্থান ও মৌসুমে যে-পাখি নিয়মিত দেখা যায় | ||
Uncommon | দুর্লভ | সঠিক স্থান ও মৌসুমে গেলে হঠাৎ দেখা যেতে পারে | ||
Rare | বিরল | সঠিক স্থান ও মৌসুমে বারবার গেলে দেখা যেতেও পারে | ||
Migratory | পরিযায়ী | যে-পাখি এক দেশ থেকে অন্যদেশে পরিযান করে | ||
Passage migrant | পান্থ-পরিযায়ী | পরিযানের পথে যে-পাখি স্বল্প সময়ের জন্য মধ্যবর্তী কোনো স্থানে দেখা যায় | ||
Vagrant | অনিয়মিত | সারাদেশে ১০ বছরের মধ্যে যে-পাখি কালেভদ্রে দেখা গেছে | ||
Vulnerable | সংকটাপন্ন | ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে | ||
Endangered | বিপন্ন | অদূর-ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হওয়ার বেশ সম্ভাবনা রয়েছে | ||
Critically-endangered | মহাবিপন্ন | অচিরে বিলুপ্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে | ||
Near-threatened | প্রায়-বিপদগ্রস্ত | টিকে থাকার পথে গুরুতর কিছু অন্তরায় রয়েছে | ||
Threatened | বিপদগ্রস্ত | সংকটাপন্ন, বিপন্ন অথবা মহাবিপন্ন অবস্থায় থাকা পাখি | ||
Not-threatened | বিপদমুক্ত | টিকে থাকার পথে বড়ো কোনো অন্তরায় গোচরে আসেনি | ||
Resident bird | আবাসিক পাখি | যে-পাখি এক দেশে থাকে, নিয়মিত দেশান্তরে যায় না | ||
Mud-bird | কাদাচরা পাখি | খাবারের জন্য যে-পাখি অধিকাংশ সময় কাদায় বিচরণ করে | ||
Aerial bird | খেচর পাখি | দিনের বেশিরভাগ সময় যে-পাখি আকাশে উড়ে বেড়ায় | ||
Waterfowl | জলচর পাখি | যে-পাখি অধিকাংশ খাবার পানি থেকে সংগ্রহ করে | ||
Grass-bird | তৃণচারী পাখি | দিনের বেশিরভাগ সময় যে-পাখি ঘাসে বিচরণ করে | ||
Arboreal bird | বৃক্ষচারী পাখি | দিনরাত্রির অধিকাংশ সময় যে-পাখি গাছে থাকে | ||
Terrestrial bird | ভূচর পাখি | দিনের অধিকাংশ সময় যে-পাখি মাটিতে থাকে |
৮ নং পৃষ্ঠার নিচের ছবিটি একটি পাতি আবাবিলের। ইংরেজিতে বলা হয় Barn Swallow এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Hirundo rustica. বাংলাদেশের বিরল আবাসিক ও সুলভ পরিযায়ী পাখি। ভীষণ ব্যস্ত পাখি আবাবিল, একদণ্ড বসার সময় নেই তার। সারাক্ষণ তিড়িং-বিড়িং করে উড়ে চলে। কদাচিৎ পাখিটিকে বসা অবস্থায় পাওয়া যায়। সারাদেশের গ্রামাঞ্চলে, কৃষিজমি কিংবা বনের খোলা জায়গায় এরা সাধারণত ঝাঁকে বিচরণ করে। উড়ন্ত পোকামাকড় বিশেষত মশা-মাছি এদের খাবার। এজন্য শস্যখেত কিংবা পানির ওপর উড়ে উড়ে শিকার ধরে খায়। মার্চ থেকে জুলাই তাদের ডিম ফোটানোর মৌসুম। এ সময় এরা দালানের ফাঁক-ফোকরে বা ছাদের নিচে কাদা দিয়ে ঘাস, খড়কুটা ও পালক গেঁথে বাসা বানায়।
হুদহুদ
মানুষ হুদহুদ পাখিকে চেনে প্রাচীনকাল থেকে। মানব সভ্যতার বিভিন্ন যুগের সংস্কৃতিতে একে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায়। প্রাচীন মিসরে একে পবিত্র জ্ঞান করা হতো। বাইবেল ও কুরআনে এই পাখির উল্লেখ আছে। কুরআনের সূরা নামলের ২০ নং আয়াতে এর কথা বলা হয়েছে।
এর অন্য নাম কাঠকুড়ালি। ইংরেজিতে Hoopoe, আর সায়েন্টিফিক নাম Upupa epops. পাতি হুদহুদ বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। দেশের সব বিভাগের গ্রামের খোলা মাঠ-প্রান্তর, বনপ্রান্ত, উদ্যান, নদী-তীর, আবাদি-জমিতে একা বা জোড়ায় বা বিচ্ছিন্ন পাখির দলে বিচরণ করে। মাটিতে লম্বা ঠোঁট ঢুকিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। খাদ্যতালিকায় আছে পোকামাকড়, পিউপা, ঝিঁঝি পোকা, পঙ্গপাল, ফড়িং ও শুঁয়োপোকা। এপ্রিল থেকে জুন মাসে ডিম পাড়ার মৌসুমে গাছের গর্ত বা দালানের ফাটলে পাতা, ঘাস, পশম, পালক ও আবর্জনা কুড়িয়ে এনে বাসা তৈরি করে।
হুদহুদ পাখি নিয়ে আল কুরআনে বর্ণিত একটি সুন্দর কাহিনী আছে। সংক্ষেপে সেটা বলি। হযরত সুলাইমান (আ) ছিলেন বাদশাহ। একজন বাদশাহকে তার রাজ্য ছাড়াও আশপাশের অনেক খবর রাখতে হয়। বাদশাহ সুলাইমানকে আল্লাহ পশু-পাখির ভাষা বোঝার ক্ষমতাও দিয়েছিলেন। গোয়েন্দা তথ্যের জন্য হযরত সুলাইমান (আ) পশুপাখিদের ব্যবহার করতেন। আর তাঁর গোয়েন্দাবাহিনীর অন্যতম সদস্য ছিল ছোট্ট মিষ্টি পাখি হুদহুদ।
একদিন হুদহুদ বললো, বাদশাহ নামদার! খোঁজ নিয়ে জানলাম, ইয়েমেন দেশটি শাসন করেন একজন নারী; কিন্তু তিনি অগ্নিপূজক। নাম তার বিলকিস বিনতে শারাহিল। সুলাইমান (আ) একটি চিঠি লিখলেন রানী বিলকিসের কাছে। তাতে লিখলেন- ‘গোমরাহির পথ ছেড়ে দাও, সত্যের পথে এসো। অগ্নিপূজা বন্ধ করো, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করো, তাঁর ইবাদত করো।’
হুদহুদ ঠোঁটে করে এই চিঠি নিয়ে পৌঁছে গেল রানী বিলকিসের প্রাসাদে। জানালা দিয়ে ফুড়–ত করে ঢুকে পড়লো রানীর ঘরে। ঘুমন্ত রানীর বিছানার পাশে চিঠিটি রেখে আবার দে ছুট। এত পাইক-পেয়াদা, সৈন্যসামন্তের কঠোর প্রহরা ভেদ করে কে রেখে গেল এই চিঠি কেউ বলতে পারলো না। রানী ভড়কে গেলেন। অনেক ভেবেচিন্তে সুলাইমানকে (আ) বাগে আনতে দামি দামি উপঢৌকন দিয়ে দূত পাঠালেন। সুলাইমান (আ) আল্লাহর নবী। তিনি অত সহজে দমবার পাত্র নন। রানীর দূতকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, ‘রানী বিলকিস কি এসব উপঢৌকন দিয়ে আমাকে খুশি করতে চায়? আমি সম্পদের কাঙাল নই। তোমাদের রানী এখনও অগ্নিপূজা ছাড়েনি, তাকে গিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলো।’
খবর পেয়ে রানী ছুটে এলেন বাদশাহ সুলাইমানের দরবারে। রানী কখন আসছেন, কীভাবে আসছেন- এসব হুদহুদ আগেই জানিয়ে দিলো সুলাইমানকে (আ)। হোক না অগ্নি-উপাসক। কিন্তু তিনিও তো একটি দেশের রানী। তারও সম্মান আছে। মর্যাদা আছে। সুলাইমান (আ) রাজ দরবারকে সুন্দরভাবে সাজালেন। বিলকিসের আসার পথে তৈরি করলেন তোরণ। রানী আসার আগেই জিনের মাধ্যমে সুলাইমান (আ) সাবা নগরী থেকে রানীর স্বর্ণখচিত ও পাথরে অলঙ্কৃত সিংহাসন নিয়ে এলেন নিজের দরবারে। রানী এলেন। এখানে নিজের সিংহাসন দেখে তিনি ভেবেই পেলেন না কেমন করে এটা সম্ভব! সুলাইমান (আ) তাকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। আল্লাহর একত্ববাদের কথা বললেন। সব দেখে-শুনে মুগ্ধ রানী। অগ্নিপূজা ছেড়ে দিয়ে শামিল হলেন চির শান্তির পতাকাতলে। পবিত্র কুরআন মাজিদে সূরা নামল-এর ২০ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতে হযরত সুলাইমানের এই ঘটনার বর্ণনা রয়েছে।
নীলকান মাছরাঙা
মাছরাঙা পাখি কে না চেনে! আমাদের আশপাশের পুকুর-খাল-ডোবা-নদীতে হরহামেশাই পাখিটিকে দেখা যায়। সারাক্ষণ মাছ ধরা ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নেই। কিন্তু মজার কথা হলো বাংলাদেশে প্রায় ১২ প্রজাতির মাছরাঙা আছে। প্রথমেই যে মাছরাঙাটির কথা বলছি এটিকে দেখতে সাধারণ বা পাতি মাছরাঙার সাথে মিল থাকলেও এর প্রধান পার্থক্য হলো এদের কানের চারপাশে পাতি মাছরাঙার মতো বাদামি রঙের দাগ থাকে না। শরীরের নীল রঙেও কিছুটা ব্যতিক্রম আছে; পাতি মাছরাঙার শরীরের রং সবুজাভ নীল আর নীলকানের শরীরের রং গাঢ় নীল। আকার তুলনা করলে পাতি মাছরাঙার লেজ ও শরীর কিছুটা লম্বাটে আর নীলকান মাছরাঙার শরীর একটু গোলাকার। বাংলাদেশে এটি বিরল দুর্লভ আবাসিক পাখি। পাখিটিকে ইংরেজিতে বলা হয় Blue-eared Kingfisher এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Alcedo meninting.
সুন্দরবনসহ দেশের চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশালের নদী, বন, জোয়ারভাটায় সিক্ত খাড়ি, জলজ বন কিংবা বাদাবনে বিচরণ করে। সাধারণত একা বা জোড়ায় দেখা যায়। যেখানে এদের দেখা যাবে, সেখানেই সামান্য আশপাশেই সে ঘুরেফিরে বেড়াবে। পানির ওপর ঝুলন্ত ডালে এরা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকে এবং সুযোগ বুঝে শিকার ধরার জন্য পানিতে ঝাঁপ দেয়। খাদ্য-তালিকায় আছে ছোট মাছ আর জলজ-পোকামাকড়। মার্চ থেকে জুন মাসে নদী-তীরে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
লাল মাছরাঙা
প্রথম দেখায় মনে হবে পাখিটি এইমাত্র আলতার ডিব্বায় ডুব দিয়ে এসেছে। এর পুরো শরীর, ঠোঁট, এমনকি পা দু’টিও লাল। বাংলাদেশের পাখিবিশারদরা এর নাম দিয়েছেন লাল মাছরাঙা।
এর ইংরেজি নাম Ruddy Kingfisher, আর বিজ্ঞানীদের দেওয়া নাম Halcyon coromanda. লাল মাছরাঙা বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। পাখিটিকে শুধু সুন্দরবনেই দেখা যায়। সাধারণত একা বা জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। পানির ওপরে কিংবা কাদায় শিকার খোঁজে। নামে মাছরাঙা হলেও এর প্রিয় ও প্রধান খাবার কাঁকড়া। তবে মাছ, গুবরে পোকা, ফড়িং, খুদে প্রাণী ইত্যাদিতেও অরুচি নেই। বাচ্চা ফোটানোর সময় মার্চ থেকে এপ্রিল। ডিম পাড়ে পাঁচ থেকে ছয়টি। বাসা বাঁধে গাছের প্রাকৃতিক কোটরে অথবা মাটির খাড়া দেওয়ালের গর্তে। মাটির গর্ত নিজেরাই খোঁড়ে।
খয়রাপাখ পাপিয়া, খয়েরি-ডানা পাপিয়া
বাংলাদেশে ১২ প্রজাতির পাপিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো খয়রাপাখ পাপিয়া। গ্রীষ্মকালে ঢাকা, খুলনা ও সিলেটের বনবাদাড়ে দেখতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের দুর্লভ দর্শন পরিযায়ী পাখিটিকে। ইংরেজিতে বলা হয় Chestnut-winged Cuckoo এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Clamator coromandus.
এদের বিচরণের জন্য চিরসবুজ বন, আর্দ্র পাতাঝরা বন, বনভূমি ও ক্ষুদ্র ঝোপঝাড় আদর্শ। সাধারণত একা কিংবা ৩-৪ জনের বিচ্ছিন্ন দলে ঘুরে বেড়ায়। ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে ঘন পাতার আড়ালে খাবার খায়। পছন্দের খাবার শুঁয়োপোকা। বাংলাদেশে এরা আসলে প্রজনন-পরিযায়ী হয়ে আসে। মে-আগস্টে ডিম পাড়ার সময়ই এদের দেখা মেলে। অন্যসব পাপিয়াদের মতো খয়রাপাখ পাপিয়াও বাসা করতে জানে না এবং অন্যের বাসায় ডিম পাড়ে। খয়রাপাখ পাপিয়ার মেয়েপাখি পেঙ্গা পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। ডিম-ফোটানো, ছানা লালনপালন করে পেঙ্গা মা।
চাতক, পাকরা পাপিয়া
গ্রীষ্মের অসহ্য দাবদাহের অবসানে মৌসুমি বাতাসের আগে আগে উড়ে এসে বৃষ্টির পূর্বাভাসের সুখবর দেয় চাতক। বিশ্ব-সাহিত্য কিংবা গান আর বিশ্বাসের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা এই পাখিটিকে প্রাকৃতিক আবহাওয়াবিদও বলা যায়।
চাতক বাংলাদেশের দুর্লভ গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী পাখি। এর ইংরেজি নাম Jacobin Cuckoo বা Pied Cuckoo, আর বিজ্ঞানীদের দেওয়া নাম Clamator jacobinus. পরিযানকালে সাধারণত একই জায়গায় একই সময়ে বছরের পর বছর ফিরে আসে। সব বিভাগের গ্রামাঞ্চলের আবাদি জমি, গাছপালা-পরিপূর্ণ এলাকা, বাগান, খামার ও ঝোপে বিচরণ করে। সাধারণত একা বা জোড়ায় কিংবা ছোট দলে ঘুরে বেড়ায়। খাবারের তালিকায় আছে- শুঁয়োপোকা, উই, পিঁপড়া, ছারপোকা। জুন থেকে আগস্ট তার ডিম পাড়ার মৌসুম। বাসা-তৈরি, ডিমে তা দেওয়া কিংবা ছানা লালনপালন এরা করে না। মেয়েপাখি ছাতার পাখির বাসায় একটি ডিম দিয়ে পালিয়ে যায়। ডিম-ফোটানো, ছানা লালনপালন ছাতারই করে।
হীরামন
উপমহাদেশের সাহিত্য-কবিতা-রূপকথা কিসসা-কাহিনী জুড়ে ছিল শুক-শারী বা হীরামন পাখি। সেসব কাহিনীতে অভিজাত বণিক সওদাগররা জাহাজ নিয়ে বাণিজ্যে যাওয়ার সময় আদুরে কন্যার বায়না থাকতো একটি হীরামন পাখির। রাজরানী বা রাজকন্যাদেরও অন্যতম বায়না থাকতো হীরামন পাখির। হীরামন বা শুক-শারী পাখি নাকি মানুষের মতো কথা বলতে পারতো বা ভাগ্যলিপি বলে দিতে পারতো। বাস্তবে সত্য না হলেও মানুষ ভালোবেসে এখনো হীরামন টিয়া খাঁচায় পোষে।
হীরামন বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। ইংরেজিতে বলা হয় Blossom-headed Parakeet এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Psittacula roseata. এরা বৃক্ষবহুল এলাকা, হালকা বন কিংবা বনের কাছের আবাদি-জমিতে বিচরণ করে। সাধারণত ৫ থেকে ১০টির ছোট দলে দেখা যায়। ফলের বাগান কিংবা জমির ফসল কাটার সময় বড়ো দল বেঁধে খাবার খায়। খাবারের তালিকায় শস্যদানা, ফল, ফুলের পাপড়ি, কুঁড়ি ও ফুলের মিষ্টি রস রয়েছে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস এদের ডিম পাড়ার মৌসুম। গাছের কাণ্ডের গহ্বরে কিংবা কাঠঠোকরা ও বসন্ত পাখির পুরোনো বাসা সংস্কার করে, কাঠের কুঁচির গদি বিছিয়ে এরা ডিম পাড়ে। এমনিতেই পাখিটি হিংস্র স্বভাবের।
হুতুম প্যাঁচা
সন্ধ্যা-রাতে তার পিলে চমকানো গম্ভীর ডাক শুনে ভয় পেতে হয়। হুতুম প্যাঁচা দেখতে ভয়ানক কিসিমের হলেও আদতে এটি একটি নিরীহ পাখি। অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের প্যাঁচাটি দিনের বেলায় পাতাঅলা বড়ো গাছের আড়ালে কিংবা কোটরে লুকিয়ে থাকে। আর এ কারণে বাংলাদেশের এই সুলভ দর্শন নিশাচর পাখিটি সহজে নজরে পড়ে না। এর ইংরেজি নাম Brown Fish Owl, আর বিজ্ঞানীদের দেওয়া নাম Ketupa zeylonensis.
দিনের বেলা লুকিয়ে থাকলেও সূর্য-ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই খাবারের খোঁজে তৎপর হয়ে ওঠে। মাছ তার সবচেয়ে পছন্দের খাবার, আর তাই রাতের বেলা জলাশয়ের আশপাশে ঘুরঘুর করে কিংবা পানির কাছাকাছি গাছের ডালে বসে শিকারের প্রতীক্ষায় থাকে। মাছ ছাড়াও গেছো-ইঁদুর কিংবা সাপ শিকারেও দক্ষ হুতুম প্যাঁচা। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল তাদের ডিম পাড়ার মৌসুম। এ সময় বাসা বাঁধে গাছের প্রাকৃতিক খোড়লে অথবা পুরোনো দালানের ফোকরে।
মেটে মেছোপ্যাঁচা
দেখতে হুবহু হুতুম প্যাঁচার মতো মনে হবে শুধু কপালের ভ্রু সাদা দেখে তাকে আলাদা করতে হয়। মেটে মেছোপ্যাঁচা বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। ইংরেজিতে বলা হয় Buffy Fish Owl এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Ketupa ketupu.
বাংলাদেশে সুন্দরবন ছাড়া আর কোথাও পাখিটিকে দেখার রেকর্ড নেই। স্বভাবে লাজুক পাখিটি অন্যসব প্যাঁচাদের মতো দিনের বেলায় গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। বাদাবনই এদের প্রিয় বিচরণস্থল। চুপচাপ কোথাও বসে থেকে এরা পানিতে বা কাদায় শিকার খোঁজে। পছন্দের খাবার মাছ হলেও পোকা, ব্যাঙ, সরীসৃপ, খুদে স্তন্যপায়ী এবং বাদুড়ও খায়। ভোর, গোধূলি ও পূর্ণিমা রাতে এরা বেশি কর্মতৎপর থাকে। ডিসেম্বর থেকে মে মাস প্রজনন-ঋতু। এ সময় এরা গাছের কাণ্ডের প্রাকৃতিক ফাটল বা ফোকরে বাসা বাঁধে।
রাম ঘুঘু
রাম ঘুঘু বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। অন্যান্য ঘুঘুদের চেয়ে আকারে একটু বড়ো পাখিটির ইংরেজি নাম Oriental Turtle Dove উড়াব এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Streptopelia orientalis.
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগের খোলা বন, বাদাবন, আবাদি-জমি ও বাগানে বিচরণ করে। সাধারণত জোড়ায় বা ছোট দলে থাকে। এরা বনের খোলা-প্রান্তে, আবাদি-জমি, পতিত-জমি কিংবা মেঠোপথে হেঁটে খাবার খুঁটে খায়। খাবারের তালিকায় ঘাসবীজ, গুল্ম, আগাছা, শস্যদানা অন্যতম। মে-জুলাই প্রজননকাল। এ সময় চারা গাছে, বাঁশবনে কিংবা ঝোপে কাঠি দিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
কমলাবুক হরিয়াল
পাখিটি একসময় প্রায় সারাদেশে সুলভ দর্শন ছিল- এখন দুর্লভ আবাসিক পাখি। চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা ও সিলেটের চিরসবুজ বনগুলোতে দেখা গেলেও কমলাবুক হরিয়ালের বৃহত্তম আবাস সুন্দরবন। পাখিটির ইংরেজি নাম Orange-breasted Green Pigeon এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Treron bicinctus.
সাধারণত দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, আবার অন্য হরিয়ালদের ঝাঁকে একসঙ্গে বিচরণ করতে দেখা যায়। বট, পাকুড়, ডুমুর, পাকা খেজুর, বরই ও এ-জাতীয় ছোট ফল পছন্দ করে। এরা গাছেই থাকে, পানি পান ব্যতিরেকে মাটিতে নামে না খুব একটা। ডিম পাড়ার মৌসুম জুন-জুলাই। এলাকাভেদে প্রজনন-সময় আলাদা। গাছের উঁচু ডালে সরু কাঠি দিয়ে বাসা বাঁধে, ডিম পাড়ে।
সুন্দরী হাঁস, কালামুখ প্যারাপাখি, মুখোশ-পরা জলার পাখি
সুন্দরবনের জেলেরা এর নাম দিয়েছেন ‘সুন্দরী হাঁস’। দেখতে হাঁসের মতো হলেও পাখিটি হাঁস তো নয়ই, হাঁসদের নিকট-আত্মীয়দেরও কেউ না। পাখিটির ইংরেজি নাম Masked Finfoot, Asian Finfoot এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Heliopais personatus. সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগারের মতোই রহস্যময়ী এই পাখি। এই পাখি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে পর্যাপ্ত তথ্য নাই এর রহস্যময় আচরণের কারণে। ২০০৯ সালে বার্ডলাইফ ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী সারাবিশ্বে এ পাখির সংখ্যা ৬০০ থেকে ১৭০০টির বেশি নয়। তবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওরিয়েন্টাল বার্ড-ক্লাবের ২০২০ সালে প্রকাশিত Forktail জার্নালের তথ্য অনুযায়ী সারাবিশ্বে এর সংখ্যা ১০০ থেকে ৩০০-এর মতো, যা আগের তুলনায় আশঙ্কাজনক কম।
বাংলাদেশের সুন্দরবনসহ এই পাখিটির বসবাস রয়েছে পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি দেশে। বিগত কয়েক দশক ধরে এই পাখির সংখ্যা বিশ্বজুড়েই আশঙ্কাজনক হারে কমছে এবং পূর্ববর্তী কয়েকটি বিচরণস্থলে সম্ভবত এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। লাজুক স্বভাবের, রহস্যময়ী সুন্দরী হাঁস বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। সুন্দরবন বাংলাদেশ অংশের কয়েকটি খালই সম্ভবত পাখিটির সবশেষ বৃহত্তম (কমবেশি ১০০টির মতো) আবাসস্থল। ভারতীয় সুন্দরবনে পাখিটিকে দেখা যাচ্ছে না বহুদিন ধরে। সুন্দরবনের খালের পাড়ে কাদায় হেঁটে বা অগভীর পানিতে সাঁতার কেটে খাবার খায়। খাদ্যতালিকায় আছে মাডস্কিপার, ছোট মাছ, জলজ-পোকা, শামুক ও অমেরুদণ্ডী প্রাণী। জুলাই-আগস্ট এদের ডিম ফোটানোর কাল। এ সময় পানি বা ভূমি থেকে সামান্য উপরে গাছের বড়ো ডালে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
ছোট হরিয়াল, পম্পাডুর হরিয়াল
ছোট হরিয়াল বা পম্পাডুর হরিয়াল বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। একসময় দেশের চিরহরিৎ বনাঞ্চলে দেখা গেলেও এখন আর সেভাবে নজরে পড়ে না। ইংরেজিতে চড়সঢ়ধফড়ঁৎ মৎববহ ঢ়রমবড়হ, আর সায়েন্টিফিক নাম ঞৎবৎড়হ ঢ়ড়সঢ়ধফড়ৎধ.
ছোট হরিয়াল চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনে পাওয়া যায়। এরা দলবদ্ধ পাখি, শতাধিক পাখি একসাথে বিচরণ করতে পারে। জোড়ায় বা একাকী খুব কম দেখা যায়। লাজুক বিধায় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে পছন্দ করে। পছন্দের খাবার ডুমুর ও বট-পাকুড়ের ফল। কোনো রকম বাধা বা বিরক্তির শিকার না হলে প্রতি বছর একই গাছে ফল খেতে আসে। পানি পান করতে ও লবণাক্ত মাটি খেতে এরা ভূমিতে নেমে আসে। ডিম পাড়ার মৌসুম ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি। অঞ্চল ভেদে প্রজনন মৌসুমের হেরফের দেখা যায়। গাছের পাতার আড়ালে লতাপাতা, চিকন কাঠি দিয়ে বাসা বাঁধে।
লালবুক গুরগুরি, লালখেনি
লালবুক গুরগুরি বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। ইংরেজিতে Ruddy-breasted Crake, আর সায়েন্টিফিক নাম Zapornia fusca.
চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেট বিভাগের জলাশয়গুলোতে দেখা যায়। এরা অতি সাবধানি, চতুর, ভীতু ও অতি চঞ্চল পাখি। শীতের সকালে রোদ পোহায়। এদের মূল খাদ্য হলো ছোট চিংড়ি, জল-কাদা-শ্যাওলা এবং পচা জলজ পাতার স্তূপে জন্ম নেওয়া ল্যাদাপোকা ও জলাবনের ডানাওয়ালা ছোট পোকা। মশাও অতি প্রিয় খাদ্য এদের। জুন থেকে অক্টোবর মাসের ডিম পাড়ার মৌসুমে এরা মাটির ওপরে আখের পাতা ও অন্যান্য পাতা দিয়ে বাসা তৈরি করে। ঝোপঝাড়, ঘাসবন, এমনকি ধানখেতেও বাসা করে।
লাল নুড়িবাটান
লাল নুড়িবাটান বাংলাদেশের দুর্লভ পান্থ-পরিযায়ী পাখি। পরিযানকালে কোনো পাখি স্বল্প সময়ের জন্য মধ্যবর্তী কোনো অঞ্চলে অবস্থান করলে তাকে ‘পান্থ-পরিযায়ী’ বলা হয়। পাখিটির ইংরেজি নাম Ruddy Turnstone এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Arenaria interpres.
এদের মূল-আবাস উত্তর-আমেরিকার উত্তরমেরুর উঁচু তুন্দ্রা-অঞ্চল থেকে সাইবেরিয়া পর্যন্ত। আমাদের দেশে আসে নভেম্বরের দিকে। বিদায় নেয় মার্চের মধ্যেই। এ সময়টাতে সুন্দরবনসহ উপকূলসমূহের কাদাচর কিংবা বালুতটে বিচরণ করে। মিঠাপানির কাছে থাকার সম্ভাবনা কম। শীতের আবাসে ছোট ঝাঁকে অন্য বাটান জাতীয় অন্য পাখিদের সাথে বিচরণ করে। এরা ধীরে হেঁটে, গর্ত করে ঠোঁট ঢুকিয়ে কোনো ছোট বস্তু উলটিয়ে খাবার খায়। খাবারের-তালিকায় আছে পোকা, শামুক, চিংড়িজাতীয় প্রাণী ও কেঁচো। ডিম পাড়ার কাল মে থেকে আগস্ট। এ সময় এরা মূল আবাসের শিলাময় উপকূলের খোলা প্রান্তরে ছোট গর্ত করে লতাপাতা বিছিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
কাদা বাটান
কাদা বাটান বাংলাদেশের বিরল পান্থ-পরিযায়ী পাখি। ইংরেজি নাম Dunlin এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Calidris alpina.
শীতকালে সুন্দরবনসহ বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের উপকূল ও নদীতীরে দেখা যায়। এরা স্যাঁতসেঁতে তৃণবহুল জায়গা, কাদাচর, বালিময় সমুদ্র-সৈকত ও কাদাময় মিঠাপানির জলাশয়ে বিচরণ করে। সাধারণত অন্য পাখির ঝাঁকের সাথে মিশে থাকে। খাদ্যতালিকায় আছে- পোকা ও তাদের লার্ভা, ছোট চিংড়ি, শামুকজাতীয় প্রাণী, অমেরুদণ্ডী প্রাণী এবং কিছু বীজ ও পাতা। মে-জুন মাসের প্রজননকালে ইউরোপ, সাইবেরিয়া ও উত্তর-আমেরিকার তুন্দ্রা-অঞ্চলের স্যাঁতসেঁতে তৃণবহুল জায়গায় ছেলে-পাখি একাধিক বাসা বানায়। মেয়ে-পাখি সেখান থেকে একটি বাসা বেছে নিয়ে ডিম পাড়ে।
বালুচরা
বালুচরা বাংলাদেশের বিরল পরিযায়ী সৈকত-পাখি। ইংরেজি নাম Sanderling এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Calidris alba.
এদের বাংলাদেশে আগমন ঘটে অক্টোবরে, আর ফিরে যায় মার্চ-এপ্রিলে। শীতকালে সুন্দরবনসহ উপকূলের বালুকাবেলায় দেখা যায়। সাধারণত এরা ছোট ঝাঁকে থাকে এবং প্রায়ই কাদা বাটান, গুলিন্দা বাটান ও অন্য ছোট জলচর-পাখির মিশ্রদলে ঘুরে বেড়ায়। সাগরের পাড়ে ঘুরে ঘুরে শিকার ধরে খায়। খাবারের তালিকায় রয়েছে কেঁচোজাতীয় প্রাণী, শামুক ও চিংড়িজাতীয় প্রাণী। দেশে ফেরার পরই জুন-জুলাইতে বাসা বানানোর মৌসুম শুরু হয়। এ সময় রাশিয়া, কানাডা ও গ্রিনল্যান্ডের সুমেরুর তুন্দ্রা-অঞ্চলে লতাপাতার ঝোপের কাছে গর্ত করে বাসা বানায়।
মোটাঠুঁটো বাটান
সুদূর সাইবেরিয়া থেকে খাবার ও উষ্ণতার সঙ্কটে আমাদের দেশে যেসব পাখি পরিযায়ন করে মোটাঠুঁটো বাটান তাদেরই একটি। পাখিটি বাংলাদেশের দুর্লভ পরিযায়ী হিসেবে পক্ষীবিদদের কাছে বিবেচিত। পাখিটির ইংরেজি নাম Broad-billed Sandpiper এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Calidris falcinellus.
মোটাঠুঁটো বাটান সৈকতের কাদাচর, জলাভূমি, মোহনা কিংবা লবণ চাষের জমিতে বিচরণ করে। কখনো একা বা অন্যান্য সৈকত-পাখির ঝাঁকের সাথে থেকে খাবার সংগ্রহ করে। ছোট পোকা, অমেরুদণ্ডী প্রাণী কিংবা বীজ এর পছন্দের খাবার। জুন থেকে আগস্ট মাসের প্রজননকালে সাইবেরিয়ায় হালকা ঘাসে ঢাকা মাঠে পুরুষ পাখি কয়েকটি বাসা বানায়। মেয়েপাখি সেখান থেকে একটি বাসা পছন্দ করে ডিম পাড়ে।
বড়ো চাপাখি
বাংলাদেশের পাখির তালিকায় বিরল পরিযায়ী সৈকত-পাখি বড়ো চাপাখি। পাখিটির ইংরেজি নাম Great Knot এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Calidris tenuirostris.
এদের প্রজনন আবাস উত্তর-পূর্ব সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা-অঞ্চলে। শীতকালে উষ্ণতা, আশ্রয় ও খাবারের সন্ধানে পরিযায়ী হয়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-এশিয়ার উপকূলে চলে আসে। শীতকালে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের সৈকতে সাধারণত মাঝারি আকারের ঝাঁকে বিচরণ করে। মাঝে মাঝে অন্য সৈকত-চারী পাখির মিশ্রঝাঁকেও দেখা যায়। অল্প পানি-কাদার মধ্যে ধীরে ধীরে হেঁটে বালি ও কাদার মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে খাবার খোঁজে। শামুকজাতীয় প্রাণী, পোকা ও অন্য ক্ষুদ্র সামুদ্রিক প্রাণী তাদের প্রিয় খাবার। জুন-জুলাই মাসে ডিম পাড়ার সময় হলে সাইবেরিয়ার পর্বত-শিখরে শ্যাওলা বিছিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
ডোরালেজ জৌরালি
পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে একটানা সবচেয়ে বেশি দূরত্ব অতিক্রমের রেকর্ড আছে ডোরালেজ জৌরালির। পাখিটির দেহের লম্বা গঠন, সূঁচালো পাখা আর মসৃণ দেহকাঠামোর জন্য একে জেট বিমানের মতো মনে হয়। এর এরকম শারীরিক অবকাঠামো পরিযানে বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিতে সহায়ক। ডোরালেজ জৌরালি বাংলাদেশের বিরল পরিয়ায়ী পাখি। ইংরেজি নাম Bar-tailed Godwit এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Limosa lapponica.
শীতকালে বাংলাদেশের উপকূলীয় কাদাচর ও মিঠাপানির জলাশয়ে দেখা যায়। সাধারণত বড়ো বড়ো দলে বিচরণ করে। অগভীর পানি কিংবা নরম কাদায় লম্বা ঠোঁট ঢুকিয়ে এরা খাবার খায়। খাবারের তালিকায় আছে কাদার পোকা ও শামুকজাতীয় প্রাণী। জোয়ারের সময় পানির ধারে এক পায়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম করে। জুন-জুলাই এদের প্রজননকাল, এ সময় উত্তরের তুন্দ্রা-অঞ্চলের প্রাকৃতিক খোঁদলে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
বিল বাটান
বিল বাটানের মূল-আবাস সাইবেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় নিজের আবাসভূমি যখন বরফে ঢেকে যায় তখন এরা আফ্রিকা, ভারতীয় উপমহাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অথবা অস্ট্রেলিয়ায় পরিযান করে। শীতকালে এদেশের সব বিভাগের নদী, জলাভূমি ও উপকূলে এদেরকে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি বিল বাটানের ইংরেজি নাম Marsh Sandpiper এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Tringa stagnatilis.
এরা সাধারণত এককভাবে বা অন্য জলচর পাখির মিশ্রদলে বিচরণ করে। অগভীর পানিতে হেঁটে, নরম কাদায় ঠোঁট ঢুকিয়ে কিংবা পুরো মাথা ডুবিয়ে খাবার খায়। ছোট শামুক, চিংড়িজাতীয় প্রাণী, জলজ-পোকা, কেঁচো এবং ছোট মাছ এদের প্রিয় খাবার। এপ্রিল থেকে আগস্ট এদের প্রজননকাল। এ সময় অন্যান্য জলচর-পাখির সঙ্গে দল বেঁধে নিজ-আবাসের খাড়া পর্বতে উদ্ভিদপূর্ণ মিঠাপানি কিংবা সামান্য নোনাপানির উপকূলে বাসা বানায়।
চামচঠুঁটো বাটান
ঠোঁট যেন একজোড়া চা-চামচ; পাখিটির ঠোঁটের বিশেষ এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই এর নাম হয়েছে চামচঠুঁটো। চামচঠুঁটো বাটান বাংলাদেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি। ধারণা করা হয়, মহাবিপন্ন প্রজাতির এ পাখির সংখ্যা সারাবিশ্বে মাত্র এক’শ জোড়ার মতো আছে। পক্ষীবিদরা অচিরেই পাখিটিকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্তির আশঙ্কা করছেন। চামচঠুঁটো বাটানের ইংরেজি নাম Spoon-billed Sandpiper এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Calidris pygmaea.
ছোট্ট সুন্দর এ পাখিটির মূল-আবাস রাশিয়ার চুকোৎকা থেকে বাংলাদেশে আসতে এবং ফিরে যেতে ২০ হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দেয়। বাংলাদেশ চামচঠুঁটো বাটান পাখির গুরুত্বপূর্ণ শীতকালীন আবাস। শীতকালে বরিশাল, চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের সৈকতের কাদাচরে বিচরণ করে। এরা সাধারণত অন্যসব ছোট জলচর-পাখির মিশ্র ঝাঁকে থাকে। সমুদ্রের ভাটার সময় ভেজা বালি-কাদার উপর পিলপিল করে খুব দ্রুত হেঁটে বা দৌড়িয়ে এরা খাবার সংগ্রহ করে। জুলাই-আগস্টের প্রজনন-মৌসুমে পূর্ব-সাইবেরিয়ার চুকোৎকা উপদ্বীপ ও কামচাটকা উপকূলের কাছাকাছি ঘাস, পাতা, শ্যাওলা দিয়ে বাসা বানিয়ে এরা ডিম পাড়ে।
বাংলা রাঙাচ্যাগা
অন্তরালপরায়ন, লাজুক, ডাগর চোখের সুন্দর একটি পাখি। বাংলা রাঙাচ্যাগা বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। ইংরেজি নাম Greater Painted-snipe এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Rostratula benghalensis.
এরা আড়ালে-আবডালে থাকে বলে সহজে চোখে পড়ে না। পাখিদের রূপবৈচিত্র্যে পুরুষ সুন্দর হলেও বাংলা রাঙাচ্যাগার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম; এদের স্ত্রী পাখিই সুন্দর এবং আকারেও একটু বড়ো। চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের জলাভূমি, স্যাঁতসেঁতে তৃণভূমি কিংবা প্লাবনভূমির ধানখেতে সাধারণত একা, জোড়ায় অথবা বিচ্ছিন্ন ঝাঁকে বিচরণ করে। এরা অগভীর পানিতে হেঁটে ও মাটিতে ঠোঁট ঢুকিয়ে খাবার খায়। খাদ্য-তালিকায় আছে পোকামাকড়, শামুক, চিংড়ি, কেঁচো, শস্যবীজ ও শস্যদানা। ভোর এবং গোধূলি লগ্নে বেশি কর্মচঞ্চল থাকে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রজননকাল। এ সময় ঘাসের গোছায় ঘাস বিছিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
দলপিপি, জলপিপি, তালপিপি
দলপিপি বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। ইংরেজি নাম Bronze-winged Jacana এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Metopidius indicus.
প্রায় সবগুলো বিভাগের বিল, বাদাভূমি, হ্রদ, নর্দমা ও জল-বনে দেখা যায়। সাধারণত জোড়ায় কিংবা ছোট পারিবারিক দলে বিচরণ করে। এরা জলজ-উদ্ভিদের উপর হেঁটে ও ভাসমান বস্তু উলটিয়ে খাবার খায়। খাবারের মধ্যে আছে জলজ-পোকামাকড়, লার্ভা, শামুকজাতীয় প্রাণী এবং জলজ-উদ্ভিদের বীজ। জুন-জুলাই মাসের বর্ষাকালে প্রজনন-মৌসুমে ভাসমান উদ্ভিদে ঘাস ও জলজ-আগাছার স্তূপ করে বাসা বানায়।
নেউপিপি, জলময়ূর
নেউপিপি বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি। ইংরেজি নাম Pheasant-tailed Jacana এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Hydrophasianus chirurgus.
হাওর ও বিল, হ্রদ, ডোবা, ভাসমান-উদ্ভিদসহ জলাভূমিতে বিচরণ করে। ভাসমান পাতায় হেঁটে কিংবা অগভীর পানিতে সাঁতরিয়ে বীজ, জলজ-উদ্ভিদের অঙ্কুর, জলজ-পোকা খেয়ে থাকে। এদের প্রজননকাল জুন থেকে সেপ্টেম্বর।
গঙ্গা তিতাই, চরমুরগি, ঢেঁকিচ্যাগা, বড়ো মোটাহাঁটু
বড়ো বড়ো ডাগোর চোখের অদ্ভুতদর্শন গঙ্গা তিতাই বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। তবে বাংলাদেশে এই পাখিটির ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য নেই পক্ষীবিদদের কাছে। ইংরেজি নাম এGreat Thick-knee, Great stone-curlew এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Esacus recurvirostris.
এদেরকে নদীর তীর, সাগরের মোহনায় কিংবা লবণ চাষের জমিতে সাধারণত জোড়ায় কিংবা ছোট ঝাঁকে বিচরণ করতে দেখা যায়। সুন্দরবনের ডিমের চরে এদের কয়েকটিকে প্রায় নিয়মিতই দেখা যায়। দিনে কিংবা রাতে এরা খাবার খায়, তবে ভোরবেলা ও গোধূলিলগ্নে বেশি কর্মচঞ্চল থাকে। এরা ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের প্রজননকালে বালুতট বা পাথুরে চরে মাটিতে নুড়ি বিছিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
কালাপাখ ঠেঙ্গি
শরীরের আকারের চেয়ে দীর্ঘতম পায়ের পাখি হিসেবে আছে বিশ্বরেকর্ড, গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের খাতায় উঠেছে নাম। ইংরেজি নাম Black-winged এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Himantopus himantopus.
কালাপাখ ঠেঙ্গি অতিশয় লম্বা গোলাপি পা আর সাদা-কালো শরীরের একটি ব্যতিক্রমী সৈকত-পাখি। বাংলাদেশের সুলভ পরিযায়ী পাখি। শীতকালে দেশের প্রায় সব বিভাগের হাওর, বিল, বাদা, উপকূলীয় লেগুন, লবণ চাষের জমিতে বিচরণ করে। সাধারণত প্রায় শ’খানেক পাখি একসাথে কিংবা অন্য পাখির মিশ্র-ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায়। লম্বা পায়ে কাদায় ও পানিতে ধীরে ধীরে হেঁটে নরম মাটি থেকে খাবার সংগ্রহ করে। জলজ পোকা, চিংড়িজাতীয় প্রাণী তাদের প্রিয় খাবার। এপ্রিল থেকে আগস্টের প্রজননকালে এরা পানির কাছে শুকনো মাটিতে ঘাস, লতাপাতার স্তূপাকার বাসা বানায়।
বড়ো বাবুবাটান
বড়ো বাবুবাটান বাংলাদেশের বিরল আবাসিক সৈকত-পাখি। ইংরেজি নাম Oriental Pratincole এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Glareola maldivarum.
চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেটের নদী-তীরে ও উপকূলে এদের দেখা যায়। নদীর পাড়, জলাভূমি ও পানির ধারের কাদাময় অংশ বা ধানখেতে এরা ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। মাটিতে দাঁড়িয়ে বা দৌড়ে বা উড়ে এরা উড়ন্ত পোকা, মথ, গুবরে পোকা প্রভৃতি শিকার সংগ্রহ করে খায়। ভোর ও গোধূলিতে এ পাখিগুলো বেশি কর্মচঞ্চল থাকে। রোদেলা দিনের উত্তপ্ত তীরের মাটিতে পেট লাগিয়ে বসে থাকে। এপ্রিল থেকে জুন মাস এদের প্রজননকাল, তখন এরা নির্জন তৃণভূমির রৌদ্রতপ্ত মাটিতে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
বড়ো টিকি পানচিল
বড়ো টিকি পানচিল বাংলাদেশের বিরল পরিযায়ী সামুদ্রিক পাখি। এর ইংরেজি নাম Great Crested Tern, Swift Tern এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Thalasseus bergii.
মূল-আবাস দক্ষিণ-আফ্রিকা থেকে মধ্য-প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে। শীতকালে চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের উপকূলের মোহনা ও সাগরের চরে বিচরণ করে। তীর থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। এরা দীর্ঘক্ষণ ধরে উড়ে বেড়াতে অভ্যস্ত এবং প্রায়ই গভীর সাগরে উড়ে যায়। সাধারণত একা বা ছোট বিচ্ছিন্ন দলে কিংবা অন্যান্য পানচিলের সাথে বিচরণ করে। এরা পানির সামান্য উপর দিয়ে উড়ে বেড়ায় এবং সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে খাবার সংগ্রহ করে। সামুদ্রিক মাছ ও চিংড়ি তাদের প্রিয় খাবার। মূল-আবাসে এপ্রিল-জুন মাসে সাগরের তীর থেকে দূরের দ্বীপে বালুর প্রাকৃতিক খোঁদলে কিংবা মৃত-প্রবালের মাঝে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে।
বাংলা টিকি পানচিল
বাংলা টিকি পানচিল বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। ইংরেজি নাম খবংংবৎ ঈৎবংঃবফ ঞবৎহ. এই পাখির দ্বিপদী বা বৈজ্ঞানিক নাম Lesser Crested Tern. দিয়েছেন পাখি-বিজ্ঞানীরা। এখানে Thalasseus bengalensis শব্দের অর্থ ‘বাংলার’। পাখিটির এই বৈজ্ঞানিক নামের সাথে বাংলা তথা বাংলাদেশ জুড়ে আছে। কিন্তু সামুদ্রিক এই পাখিটিকে এখন বাংলাদেশে সহজে দেখা যায় না।
এরা সমুদ্র তীর, পোতাশ্রয়, খাড়ি কিংবা লবণ চাষের জমিতে দলবদ্ধ বা বিচ্ছিন্ন ঝাঁকে বিচরণ করে। কখনো কখনো এদেরকে অন্যান্য পানচিলের সাথেও ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এরা পানির সামান্য উপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে হঠাৎ ছোঁ মেরে সমুদ্র থেকে খাবার সংগ্রহ করে। সমুদ্রের ছোট মাছ কিংবা চিংড়ি তাদের প্রিয় খাবার। মে থেকে জুন মাসে প্রজননকালে সাগরের চরে এরা বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে।
ছোট পানচিল,
খুদে গাংচিল
ছোট পানচিল ছোট আকারের সামুদ্রিক পাখি। বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও দুর্লভ দর্শন পাখি। এর ইংরেজি নাম Little Tern এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Sterna albifrons.
বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা ও রাজশাহীর নদীসমূহে ও সমুদ্র উপকূলে দেখা যায়। সাধারণত ছোট, বিচ্ছিন্ন দলে কিংবা ঝাঁক বেঁধে উপকূল, নদী, মিঠাপানির হ্রদ, লবণ চাষের জমি কিংবা জলাধারে বিচরণ করে। অগভীর পানিতে সামান্য উপরে উড়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে শিকার ধরে। ছোট মাছ, চিংড়িজাতীয় প্রাণী ও জলজ-পোকা এদের প্রিয় খাবার। মে থেকে জুন মাসের প্রজনন-ঋতুতে বালুকাবেলায় সামান্য খোঁদল করে এরা ডিম পাড়ে।
পাতি পানচিল
পাতি পানচিল বাংলাদেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি। শীতকালে উষ্ণতা আর খাবারের খোঁজে বাংলাদেশসহ বিষুবরেখার দক্ষিণের দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়। এর ইংরেজি নাম Common Tern এবং এর সায়েন্টিফিক নাম Sterna hirundo.
এরা সাধারণত উপকূল, মোহনা, নদী কিংবা পোতাশ্রয়ে ঝাঁকে বিচরণ করে। পানির সামান্য উপর দিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ায় এবং ছোঁ-মেরে পানি থেকে খাবার সংগ্রহ করে। ছোট মাছ, চিংড়ি, শামুকজাতীয় প্রাণী ও জলজ-পোকা এদের প্রিয় খাবার। জুন থেকে জুলাই মাস এদের প্রজননকাল। এ সময় তিব্বত ও সাইবেরিয়ায় পানির কাছে স্যাঁতসেঁতে ঘাস ও আগাছার মাঝখানে বালু সরিয়ে বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে।
বাংলা শকুন
বাংলা শকুন বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। ইংরেজি নাম White-rumped Vulture. এক সময় সারাদেশেই দেখা যেত। আকারে বিশাল, কদাকার এই পাখির দ্বিপদী বা বৈজ্ঞানিক নামের সাথে bengalensis অর্থাৎ বাংলা বা বাংলাদেশের নাম জড়িত। ঐতিহাসিকভাবেই এই পাখিটি বাংলাদেশের নিজস্ব পাখি।
প্রাকৃতিক এই পরিচ্ছন্নতা-কর্মীরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে মৃতদেহ কিংবা পচা-গলা মাংস খেয়ে পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে ব্যাপক সহায়তা করে। এই পাখিদের প্রাকৃতিক কোনো শত্রু নেই, ছিলও না, শিকারিদের কাছেও ছিল মূল্যহীন। এরপরও এরা প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশে প্রায় পঞ্চাশ হাজার শকুন ছিল, বর্তমানে এদের সংখ্যা তিনশও নেই। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মূলত গবাদিপশুর রোগ সারাতে Diclofenac নামের বিষাক্ত ওষুধের কারণে শকুন মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
********
পুনশ্চ :
মনে করো পৃথিবীতে পাখি নেই। তাহলে কী হবে? আমাদের চারপাশ মশা-মাছি ছারপোকায় ভরে যাবে। শস্যক্ষেতগুলো পঙ্গপাল অথবা ক্ষতিকারক পোকার অবাধ বিচরণস্থলে পরিণত হবে। ব্যাপক শস্যহানিতে মানুষের বসবাসের যোগ্যতা হারাবে পৃথিবী।
ষাটের দশকের শেষভাগে চীনের মহাদুর্ভিক্ষের কথা মনে আছে? সেখানে মাও সেতুংয়ের নির্দেশে কোটি কোটি পাখি নিধন করার ফলে ভয়াবহ এই দুর্ভিক্ষে কয়েক কোটি মানুষ না খেয়ে মারা গিয়েছিল। পাখি ছাড়া পৃথিবী কল্পনা করা সম্ভব নয়।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবীর সবকিছুকেই মানুষের কল্যাণের জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। পৃথিবীর সবকিছুই একটির সাথে অন্যটি ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। আমাদের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে, প্রকৃতির স্বার্থে পাখি সংরক্ষণ- তাদের আবাসের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজটি আমাদেরকেই করতে হবে।
আরও পড়ুন...