বাংলা নববর্ষ
বিশেষ রচনা মঈনুল হক চৌধুরী এপ্রিল ২০২৫
বাংলা বছরের প্রথম মাস বৈশাখ। বৈশাখ থেকেই শুরু হয় বাংলা সনের গণনা। ইংরেজি নববর্ষের যতটুকু আনন্দ এবং উন্মাদনা থাকে, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি থাকে বাংলা নববর্ষ বৈশাখকে ঘিরে। গ্রামের অনেক মানুষ এখনো ইংরেজি মাস এবং দিন সম্পর্কে তেমনটি জানেন না। কিন্তু তাদের প্রতিদিনের কর্ম প্রবাহে, কৃষিকাজে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বাংলা সন এবং তারিখ নির্ভুলভাবে ব্যবহার করেন। তারা যে-কোনো সময় বলে দিতে পারেন এটা বাংলা মাসের কোন তারিখ। কোন দিন। আসলে বৈশাখ গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলা নববর্ষ আমাদের আবহমান সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। পহেলা বৈশাখের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতিসত্তার উজ্জ্বলতা। বৈশাখ আমাদের প্রেরণার প্রেরণা, ইতিহাস এবং ঐতিহ্যে গাঁথা এক অমর কাব্য। ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বলা হয়ে থাকে এদেশে অনুষ্ঠিত হয় বারো মাসে তেরো পার্বণ। ঋতুকে আহ্বান করে পালন করা হয় ঋতু উৎসব। উল্লেখ্য, সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ৯৬৩ হিজরি মুতাবিক ১৫৫৬ খিষ্টাব্দে। উনত্রিশ বছর রাজত্ব করার পর তিনি পঞ্জিকা ও বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। হিজরি সন ও স¤্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের বছরকে যুক্ত করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। বলা হয়ে থাকে ফসল কাটার মৌসুমে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য এই সন চালু করা হয়েছিল। হিজরি সন হলো চান্দ্রসন। চাঁদ দেখে গণনার ওপর এই সনের ভিত্তি। বাংলা সৌরসন। সৌরসনে দিনক্ষণ গণনা সহজ এবং এর একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি আছে। সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা আমীর ফাতেউল্লাহ সিরাজী বাংলা মাসের নামগুলো নক্ষত্রের নাম থেকে নিয়ে সৌর মাসের দিন মিলিয়ে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। এ ব্যাপারে ১৫৮৫ সনের ১০ মার্চ সম্রাটের নির্দেশনামা জারি হয়। তবে এর কার্যকারিতা দেখানো হয় ১৫৫৬ সনের ১১ই মার্চ থেকে। কারণ দিনটি ছিল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে বসার তারিখ। সেই থেকেই শুরু। আমাদের ইতিহাস ও জীবনযাত্রায় বাংলা সনের প্রভাব ব্যাপক ও গভীর। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে উৎপাদনমুখী নানা কর্মকাণ্ড এই বাংলা সনকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। কৃষকের ফসল বোনা, ফসলের সময়ভিত্তিক যত্ন বা পরিচর্যা ও ফসল কাটাসহ যাবতীয় কৃষিকাজ বাংলা সন, তারিখ, পঞ্জিকা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বহুকাল থেকে পহেলা বৈশাখ পালন করে আসছে।
পহেলা বৈশাখে এদেশের গ্রাম-বাংলার ব্যবসায়ীরা নতুন খাতা খুলতো। একে তারা বলতো হালখাতা। হালখাতা মানে বর্তমান খাতা। পুরোনো খাতার লেনদেন তারা পহেলা বৈশাখে শেষ করতে চাইতো। এজন্য তারা উৎসবের আয়োজন করতো। পাওনাদার ও দেনাদার নির্বিশেষে এলাকার সকলকে নিমন্ত্রণ করতো। যারা অংশগ্রহণ করতো তাদের মিষ্টি খাওয়ানো হতো। উদ্দেশ্য একটাই। পাওনা টাকা উসুল করা। আগে এ আমন্ত্রণ জানানো হতো মুখে। মুদ্রণযন্ত্র আসার পর জানানো হয় ছাপানো পত্রে। একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, নিমন্ত্রণপত্রের কোথাও লেখা থাকে না যে, আসার সময় পাওনা টাকা নিয়ে আসবেন। লেখা থাকে এ হালখাতা উৎসবে আপনি/আপনারা সবান্ধব/ সপরিবারে আমন্ত্রিত। পহেলা বৈশাখের বিশেষ দিনে বিগত বছরটির সব হিসাব নিকাশ চুকিয়ে নির্ঝঞ্জাট সুন্দর একটি বছর শুরু করতে চায় সবাই।
নববর্ষ এলে ইচ্ছে হয় ভোরে ঘুম থেকে সবাই জাগার আগে চুপি চুপি বনে গিয়ে আম কুড়াতে। নববর্ষ এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বজ্রের চোখ ঝলসানো আলো আর বাতাসের শাঁই শাঁই শব্দ। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। এভাবে গ্রাম-বাংলার লোকজ জীবনের সাথে পহেলা বৈশাখ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। পহেলা বৈশাখে নববর্ষ উপলক্ষ্যে বসে বৈশাখী মেলা। মেলায় বিভিন্ন কৃষিপণ্য, কুটিরশিল্পে তৈরি পণ্য, হস্তশিল্প, মৃৎশিল্প পাওয়া যায়। শিশুদের জন্য থাকে নানা রকমের খেলনা। বৈশাখী মেলা উপলক্ষ্যে থাকে বিনোদনের আয়োজন। নববর্ষে আমরা অনেকভাবেই শুভেচ্ছা বিনিময় করি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইদানীং সব জায়গাতেই নববর্ষের কার্ড, হোক তা ছাপানো কিংবা নিজে বানানো, এই কার্ড বিনিময় হয় খুব। হৃদয়ের সমস্ত আকুতি মিশিয়ে লেখা হয় এইসব কার্ডের ভাষা। কাছের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা ঝরে ঝরে পড়ে এই সব কার্ডে। কবিতা, কবিতার লাইন, ছড়া, বন্ধুত্বের অকৃত্রিম ছোঁয়া জড়ানো আঞ্চলিক কথামালা- এসবই থাকে শুভেচ্ছা কার্ডে। অনেকে কাগজ ছাড়াও অন্য মাধ্যমে, স্যুভেনির বা শুভেচ্ছা উপহার তৈরি করে থাকেন। ধনী কিংবা দরিদ্র অথচ সৃজনশীল অনেক শিশু কিশোর, বাবা-মা বড়ো ভাইবোনদের জন্য পাঠানো অন্য কাউকে কেটে ছেঁচে নতুন করে রং-তুলির আঁচড় দিয়ে মজার সব কার্ড তৈরি করে প্রিয়জনকে বিলি করে। মোট কথা, নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম কার্ড। এছাড়া নববর্ষের শুরু থেকেই গরমের যে যন্ত্রণা শুরু তার আগেই মায়েরা, বোনেরা, স্ত্রীরা তাদের প্রিয়জনের জন্য স্মৃতি জাগানিয়া নববর্ষের উপহার ঠিক করে রাখেন যাতে বাতাসের প্রতিটি পরশ তাদের কথা মনে করে দেয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গত কয়েক বছর ধরে যুক্ত হয়েছে একটি নতুন ধারা, আর তা হলো বইমেলা। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে নানা স্থানে বিভিন্ন ক্লাব বা পাঠাগারের উদ্যোগে আয়োজন করা হয় বইমেলার। এর ফলে দেশের বইপ্রিয় নাগরিক নববর্ষ উপলক্ষ্যে প্রিয়জনকে বই উপহার দেওয়ার একটা তাড়া অনুভব করে। যে কারণে ঐদিন বই কেনা এবং প্রিয়জনকে বই উপহার দেওয়া একটি রীতিতে পরিণত হতে চলেছে। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঐদিন সরকারি ছুটি থাকে। ফলে লোকেরা ছুটির দিন কাটানোর আমেজ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। আবার রাষ্ট্রীয় বেতার ও টেলিভিশনে এবং বেসরকারি চ্যানেলগুলো ও পত্রপত্রিকায় ঐদিন নববর্ষ উপলক্ষ্যে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। পত্রপত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের সুবাদে লেখক-কবি-সাহিত্যিকগণ নানা নিবন্ধ, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি রচনা করে থাকেন। বিশেষ সাময়িকপত্রও প্রকাশিত হয় এ উপলক্ষ্যে। বেতার-টিভিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মধ্যে টকশো, আলোচনা, গান, আবৃত্তি, সরেজমিন প্রতিবেদন ইত্যাদি নানা মাত্রার আয়োজন থাকে।
বাংলা নববর্ষ আমাদের জীবনে নবচেতনার আলোকে অবগাহনের দিন। পহেলা বৈশাখের আগমনে জীবন থেকে মুছে যাক পুরাতন বছরের জীর্ণ আবরণ। চির নতুনকে বরণ করার জন্য আমাদের অন্তর ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাই পহেলা বৈশাখ জীবনে নব উন্মেষের দিন। গত একটি বছরের সব দুঃখ কষ্ট বেদনাকে হাসি গান আর আনন্দ দিয়ে ঢেকে ফেলার দিন। ঐতিহ্যমণ্ডিত এই দিনটি আমাদের সংস্কৃতি ও ভালোবাসার প্রতীক। পহেলা বৈশাখ ও নববর্ষের আগমনে আমরা সবাই উজ্জীবিত হই, জেগে উঠি নতুন প্রেরণায়। আমরা চাই, বৈশাখের প্রকৃত আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সারা বাংলাদেশে। সেই সাথে চালু হোক সর্বস্তরে বাংলা সন ও তারিখের ব্যবহার। তাহলেই সার্থক হয়ে উঠবে বৈশাখ ও নববর্ষ কেন্দ্রিক আমাদের সকল আয়োজন ও আনন্দ। এ বৈশাখে জীবনের সকল জড়তা-জীর্ণতা মুছে যাক, ঘুচে যাক অন্ধকার ও অপ্রাপ্তি জীবন থেকে। নতুন পত্র পল্লবে ভরে উঠুক আমাদের সবুজ গ্রাম-বাংলা।
আরও পড়ুন...