বাবার উপহার
গল্প কামাল হোসাইন সেপ্টেম্বর ২০২৪
শহরতলি গ্রামের আধাপাকা একটা বাড়ি। একসময় এই বাড়ির চৌহদ্দি অনেকটাই বড়ো ছিল। মোটামুটি চার একরের মতো। আগেকার দিনে গ্রামের কারো কারো বাড়ির আয়তন অনেক বেশি হতো। সুবিশাল সেই জমিতে মাত্রই কয়েকটা ঘরবাড়ি থাকতো। আর বেশির ভাগ জায়গাজুড়েই থাকতো নানারকম গাছপালায় ঠাসা। তার মধ্যে আম, জাম, আতা, কাঁঠাল, জামরুলসহ প্রায় সব রকম গাছপালাই শোভা পেতো বাড়ির চারপাশে।
আর মাঠে হতো ধান, গম, যব, ভুট্টা, কলাই, মসুর, ছোলা, সরিষা, অড়হর, তরমুজ, ফুটি। তরকারি হিসেবে থাকতো বেগুন, মুলা, শালগম, গাজর, টমেটো, আলু, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি। আর পুকুর থাকতো নানারকম খলবলানো দেশি মাছে ভর্তি। রুই, কাতল, টেংরা, পুঁটি, কই, শিং, চিতলসহ সব ধরনের দেশি মাছ থাকতো সেই পুকুরে।
থাকতো গোয়াল ভরা গরু-ছাগল। তাই দুধ, ঘিয়ের অভাব হতো না কিছুতেই। উঠোনের একপাশে থাকতো হাঁস-মুরগির পালান।
জমিতে উৎপাদিত সরিষা, তিল, তিসি ঘানিতে ভাঙিয়ে তেল পাওয়া যেত। বাড়ির আশপাশে কিংবা মাঠে ক্ষেতের আলে থাকতো সারি সারি খেজুর গাছ। শীতের দিনে গাছি সেই খেজুর গাছ কাটতেন। শীতের সকালে খেজুরের টসটসে মিষ্টি রস যেন অমৃত। খেজুর রসের পায়েস-পিঠা তুলনাহীন। রস জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি বানানো হতো। খেজুর গুড় মাটির পাতিলে সংরক্ষণ করা হতো। তাতেই চলে যেত সারা বছর। ফলে ঘরেই সবকিছু মিলতো সেসময়।
মানে কোনোকিছুর জন্যই কারো কাছে যাওয়া লাগতো না বলা যায়। সেসময় যার বাড়ির আয়তন যত বেশি, তিনি সেই গ্রামের ততটাই বনেদি হিসেবে সম্মান পেয়ে আসতেন। তার অবশ্য একটা কারণও ছিল। আর তা হচ্ছে, সবাই তখন যৌথ পরিবারে বসবাস করতেন। এক বাড়িতেই দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, তাদের ছেলেমেয়ে- সবাই একসঙ্গে থাকতেন। এরকম কোনো কোনো পরিবারের লোকসংখ্যা ৩০-৪০ জনও থাকতো। আর পরিবারের লোকসংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন, রান্না হতো এক জায়গায়। সবাই এক জায়গায় বসে খাওয়াদাওয়া করতো। বাড়ির জন্য সদাই করলে গরুর গাড়িতে করে আনতে হতো। সে এক আনন্দময় দিন ছিল বটে!
কিন্তু আজকাল আর তেমনটা দেখা যায় না বললেই চলে। মানুষ বেড়েছে। সংসারে যত লোক বেড়েছে, জমিজমাও তত ভাগে বিভক্ত হয়েছে। ফলে বড়ো জমিগুলো ভাগ হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। জমির মতো সংসারও পৃথক হয়েছে। ফলে আগের মতো অতটা আয়তনঅলা বাড়ির দেখা মেলে না এখন।
এখনকার ছেলেমেয়েরা এই ব্যাপারটা ভাবতেই পারবে না। এখন কেউ আর যৌথ পরিবারের সঙ্গে থাকে না। যে যার মতো আলাদা আলাদা সংসার নিয়ে কেবল নিজের ছেলেমেয়েসহ আলাদা বাড়ি বানিয়ে বসবাস করে। বড়োজোর তাদের সঙ্গে বৃদ্ধ বাবা-মা থাকেন।
এখনকার মতো তখন ঘরে ঘরে নিয়নবাতির চাকচিক্য না থাকলেও সাধারণ হারিকেন আর কুপিবাতির ঔজ্জ্বল্য ছিল আকাশছোঁয়া।
এরকমই একটা বাড়ির ছেলে তাওহীদ মিজান। তাদের বর্তমান বাড়ির আয়তন অতটা না হলেও, একেবারে কমও নয়। ও এবার ক্লাস সিক্সে পড়ছে। একান্নবর্তী পরিবারের কথা তাওহীদ শুনেছে ওর বাবার মুখে। ওর দাদা ওই রকম একটা বাড়ির মালিক ছিলেন। তিনি তাওহীদের জন্মের আগেই মারা গেছেন। দাদিও বেঁচে নেই। পরে সেই বড়ো আয়তনের বাড়িটা চার ভাগ হয়ে গেছে তাওহীদের বাবার অন্য ভাইদের মধ্যে। ফলে বাড়ির সেই আয়তন এখন আর নেই। তবুও যেটুকু আছে তাও এখনকার সময়ে কম নয়। পুরোনো দিনের এসব গল্প তাওহীদকে প্রাণিত করে। গর্বিত করে। আনন্দে ভাসিয়ে রাখে সময় সময়।
কিন্তু ও বিস্ময়ের সঙ্গে খেয়াল করে, ওদের বাড়িতে এখন আর আগের মতো তেমন গাছপালা নেই। সাপখোপের ভয়ে তার বাবা গাছপালা কেটে সাফ করে ফেলেছেন। এখন তাদের বাড়িতে তেমন গাছপালা না থাকার ফলে বলতে গেলে তেমন ছায়াও নেই কোথাও। সম্প্রতি তীব্র গরমে সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে। হাঁসফাঁস করে দিন পার করেছে কত কত দিন। বাড়ির চারপাশে কিছু গাছপালা থাকলে এই বিরূপ আবহাওয়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলতো তাদের। কিন্তু ছায়ায় একটু বিশ্রাম নেবে, সেরকম ছায়াদার গাছপালা তাদের বাড়িতে আর অবশিষ্ট নেই।
গাছপালার উপকারিতার কথা ও স্কুলের স্যারের কাছে শুনেছে। এমনকি তার পাঠ্যবইয়েও পড়েছে, প্রকৃতিতে পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকার কারণে, ফসিল ফুয়েল বাতাসে মিশে যাওয়ার কারণে, অবাধে পাহাড় কাটার কারণে আবহাওয়া এমন বিরূপ হয়েছে। বৃষ্টি নেই। দ্রুত পানির লেয়ার নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই সহজে টিউবওয়েলে আর পানি তোলা যাচ্ছে না। গাছপালা নেই বলে শীতল বাতাস নেই। প্রকৃতি হারিয়েছে তার স্বকীয়তা। এর জন্য আমরাই দায়ী। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের এই প্রকৃতিকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। যার যতটুকু সুযোগ আছে, প্রকৃতিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে। গাছ লাগাতে হবে। ফসিল ফুয়েল না পুড়িয়ে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে পরিবর্তিত শক্তির উৎস খুঁজতে হবে। পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। নদীকে বাঁচাতে হবে।
স্যারের এসব কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে তাওহীদ। বিষয়টা তার মনের ভেতর দারুণভাবে রেখাপাত করে।
স্কুলশেষে বাড়ি ফিরে বইখাতা রেখে সোজা ওর বাবার ঘরে যায় তাওহীদ। বাবা তখন ঘরে আলগা শরীরে খাটের ওপর বসে আছেন। বিদ্যুৎ নেই। দরদর করে ঘামছেন তিনি। ও নিজেও ঘেমে একসা। শরীরে থাকা জামা ঘামে ভিজে লেপ্টে রয়েছে।
তাওহীদ কোনো ভূমিকা না করে সরাসরি তার বোধের মধ্যে থাকা বর্তমান বিষয়টা সুন্দর করে বোঝাতে চেষ্টা করলো ওর বাবাকে।
বাবা মন দিয়ে ওর বলা যুক্তিপূর্ণ কথাগুলো শুনলেন। তাওহীদ যখন কথা বলছিল, তখন তিনি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মনে মনে ভাবলেন, ছেলেটা মাথায় বড়ো না হলেও চিন্তায় বড়ো হয়ে গেছে। তার এই ভাবনার মর্যাদা দিতে হবে।
ছোট্ট তাওহীদের কথা কেন জানি খুব সহজেই মেনে নিলেন তিনি। না মেনেই বা উপায় কী? যার ফলাফল তো তিনি নিজেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ছেলেটা বয়সে এতটুকু হলেও, তার কথাগুলোয় তো যুক্তি আছে। আসলে এসবের জন্য সবাই কষ্ট পাচ্ছে। তার মতো অন্যরাও গাছ কেটে সাফ করে নতুন নতুন আবাদ শুরু করেছে। আবাদঘাটের পাশাপাশি গাছপালারও দরকার সমানভাবে। নির্ভেজাল অক্সিজেনের জন্য বড়ো বড়ো গাছপালার বিকল্প নেই।
তাওহীদের মা-ও ছেলের কথায় পূর্ণ সমর্থন দিলেন। গাছ কাটার প্রতিবাদ করেও একসময় তিনি কিছু করতে পারেননি। ছেলের কথাগুলো বাবাকে চুপ করে শুনতে দেখে এই সুযোগে তিনিও উষ্মা প্রকাশ করলেন। তাকে মৃদু ভর্ৎসনাও করলেন কিছুটা। তাতে মনে হলো তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করছেন ব্যাপারটা। না হলে ছোটোদের কথা, কিংবা তার কথা এভাবে নির্বিবাদে শোনার মানুষ তিনি নন।
তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। ছেলেকে কাছে নিয়ে আদর করে বললেন, তোমরা আর এভাবে বলো না। আমার চোখ খুলে গেছে। এগুলোকে আমি জঞ্জাল ভাবতাম। আমি কথা দিচ্ছি, আমি আবার গাছ লাগাবো। সবুজে সবুজে যেন ভরে ওঠে এই আঙিনা, সেই ব্যবস্থা করবো শিগগিরই।
তাওহীদ তখন ‘হুররে’ বলে লাফিয়ে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। খুশি আর আনন্দরা ওর চোখেমুখে খেলা করতে লাগলো।
আরও পড়ুন...