বিজয় দিবসের অঙ্গীকার

বিজয় দিবসের অঙ্গীকার

প্রচ্ছদ রচনা জয়নুল আবেদীন আজাদ ডিসেম্বর ২০২৩

মহাবিশ্বের ছোট্ট একটি গ্রহ আমাদের এই পৃথিবী। পৃথিবীতে কত দেশ, কত নদী, কত সাগর। আকাশ কিন্তু একটাই। এক আকাশের নিচেই আমাদের বসবাস। মহান ¯্রষ্টা মানব-বান্ধব করে পৃথিবী সমৃদ্ধ করেছেন। পৃথিবীতে ফল আছে, ফুল আছে, শস্য আছে, আছে বন-বনানী, পশু-পাখিসহ আরও কত কিছু। এসব কিছুকে আমরা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য হিসাবেও অভিহিত করতে পারি। জানার ইচ্ছেতো মানুষের মধ্যে প্রবল। শিশু-কিশোরদের কৌতূহলও কম নয়। তাইতো ওরা বলতে চায়-

থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে

দেখব এবার জগৎটাকে

কেমন করে ঘুরছে মানুষ

যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে। 

দেশ হতে দেশ দেশান্তরে

ছুটছে তারা কেমন করে, 

কিসের নেশায় কেমন করে

মরছে যে বীর লাখে লাখে।

কিসের আশায় করছে তারা

বরণ মরণ যন্ত্রণাকে।

পাতাল ফেড়ে নামব আমি

উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে, 

বিশ^জগৎ দেখব আমি

আপন হাতের মুঠোয় পুরে। 


‘সঙ্কল্প’ কবিতায় কী চমৎকারভাবে কিশোর মনের আকাক্সক্ষার কথা তুলে ধরেছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কিশোর অভিযাত্রী পুরো পৃথিবীটাকে দেখতে চায়। আকাক্সক্ষাটি সুন্দর হলেও কাজটি তেমন সহজ নয়। আমরা এই যে পৃথিবীর কথা বলছি, এর মানচিত্রটা কেমন? অনেকগুলো দেশ মিলেইতো আমাদের প্রিয় এই পৃথিবী। তাই বলা যায়, একটি একটি করে দেশ দেখা হলেতো এক সময় পুরো পৃথিবীটাই দেখা হয়ে যাবে। এমন কর্মে হয়তো অনেক সময় লেগে যাবে, কয়েক যুগও লেগে যেতে পারে। তবুও স্বপ্নতো পূর্ণ হবে, পুরো পৃথিবীর সাথেতো পরিচয় ঘটবে। পৃথিবীটাতো আর আমাদের গ্রাম নয় যে, সকালে বেরিয়ে বিকেলেই পরিভ্রমণ সমাপ্ত করা যাবে। বিশাল কাজেতো কিছুটা ধৈর্যের প্রয়োজন হবেই। পৃথিবী পরিভ্রমণের কথা বলছিলাম, বলছিলাম দেশ দেখার কথা। যদি প্রশ্ন করি, প্রথমে কোন দেশটা দেখা প্রয়োজন, স্বদেশ নাকি ভিনদেশ! নিজ দেশের কথাইতো আগে মনে আসবে। কারণ মানুষ মাত্রই নিজের দেশকে, জন্মভূমিকে সব দেশের চাইতে বেশি ভালোবাসে। 


সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা আমাদের প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে আমরা ভালোবাসি। দেশপ্রেম মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। মানুষতো একদিনে মানুষ হয়ে যায় না। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে মানুষ পরিণত মানুষ হয়। এই দীর্ঘ সময়ে মায়ের কোল পেরিয়ে দেশের কোলে মানুষ বড় হয়। দেশের আকাশ বাতাস ও প্রকৃতির সাথে জড়িয়ে থাকে মানুষ। শৈশবের পুকুর, নদী ও মাঠ-ঘাটের কথা কি ভোলা যায়! সাঁতার শেখার কত কসরত, খেলার মাঠে পিছলে পড়ার আনন্দ- এসব শুধু স্বদেশেই সম্ভব। দেশ আমাদের ফসল দিয়েছে, সৌরভ দিয়েছে, শিক্ষা দিয়েছে, বেড়ে ওঠার কত সুযোগ দিয়েছে। তাইতো দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রোথিত হয়ে আছে আমাদের হৃদয়ের গভীরে। স্বভাবজাত এই যে ভালোবাসা, তা আরো অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে দেশকে জানার মাধ্যমে। দেশ সম্পর্কে সাধারণ কিছু তথ্য নানাভাবে আমাদের জানা হয়ে যায়। কিন্তু দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে হলে একটু কষ্ট করতে হবে, অধ্যয়ন করতে হবে। আর একটি কথা, আমাদের দেশে ভালো লাগার মতো অনেক বিষয় আছে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা কতটা অবগত? আমরা কি দেশের প্রিয় সব ফুল ও পাখির নাম জানি! নদীমাতৃক বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বাহন নৌকা। আমরা কি সব রকম নৌকার নাম জানি? জানি কি তরুলতা ও বৃক্ষের নাম? বলা হয়ে থাকে মাছে ভাতে বাঙালি। আমাদের খালে-বিলে-নদীতে কত রকম মাছ। জমিতে কত রকম ধান। এসবের সাথে আমাদের পরিচয় থাকতে হবে, নামগুলোও জেনে নিতে হবে। দেশের প্রকৃতি, ফুল-ফসল ও জীববৈচিত্র্যের সাথে সম্পর্ক নিবিড় হলে দেশপ্রেম আরও গভীর হবে। দেশকে জানার কর্তব্য পালিত হলে, দেশ নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারবো। 


আমরা দেশপ্রেমের কথা বলি, দেশকে ভালোবাসার কথা বলি। এক্ষেত্রেও আমাদের ধারণাকে পূর্ণতা দিতে হবে। শুধু দেশের ফুল-ফসল, প্রকৃতি ও মাটিকে ভালোবাসলেই চলবে না, দেশের শ্রেষ্ঠ সম্পদ মানুষকে ভালোবাসতে হবে সবার আগে। আসলে মানুষকে ভালো না বাসলে দেশকেও ভালোবাসা যায় না। মহান ¯্রষ্টা যেমন এই পৃথিবীকে মানব-বান্ধব করে সৃষ্টি করেছেন, তেমনি আমাদেরও দেশকে গণ-বান্ধব করে নির্মাণ করতে হবে। এখন নির্মাণ অভিযাত্রায় বড়দের যেমন করণীয় আছে, তেমনি করণীয় আছে ছোটদেরও। ছোটদের মূল কাজ হলো, নিজেকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজে অবদান রাখা। এ প্রসঙ্গে আমরা মানব জাতির পথপ্রদর্শক, শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সা)-এর জীবনী থেকে বার্তা নিতে পারি। নবী হওয়ার আগেও তারুণ্যে তিনি সমাজের কল্যাণে, মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আমরা ‘হিলফুল ফুজুল’-এর কথা উল্লেখ করতে পারি। রাসূল (সা)-এর বয়স যখন পনেরো বছর, তখন ফুজ্জারের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের পর জিলকদ মাসে গঠিত হয় হিলফুল ফুজুল। এই সংগঠনের সদস্যরা অঙ্গীকার করলেন যে, মক্কায় জুলুম-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন তাঁরা। এই সংগঠনের মূল লক্ষ্যই ছিল সমাজের যাবতীয় অন্যায় দূর করে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। আমরা জানি, নবী হওয়ার পর রাসূল (সা) মানবজাতির জন্য বিশাল দায়িত্ব পালন করেছেন। তবুও হিলফুল ফুজুলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের ঘরে এমন অঙ্গীকারে শরিক ছিলাম, যার বিনিময়ে লাল উটও আমার পছন্দ নয়। ইসলামী যুগে সেই অঙ্গীকারের জন্য যদি আমাকে ডাকা হতো, তবে আমি অবশ্যই হাজির হতাম। উপলব্ধি করা যায়, সমাজে ইনসাফ তথা ন্যায় প্রতিষ্ঠার কাজটি মানুষের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তারুণ্যে এ কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন, আরও ব্যাপকভাবে যুক্ত ছিলেন নবী হওয়ার পরে।


আমরা এখন স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের রক্তাক্ত মহাসড়ক পেরিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এ মহাসড়কে ছিল ভাষার লড়াই, স্বায়ত্তশাসনের লড়াই, অবশেষে স্বাধীনতার লড়াই। স্বাধীনতার লড়াই আমাদের উপহার দিয়েছে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস। তাইতো ১৬ ডিসেম্বর, ২৬ মার্চ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল দিন। স্বাধীনতার সুফল সব নাগরিকের প্রাপ্য। সাম্য ও ন্যায়ের চেতনায় সব নাগরিকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে তাঁদের প্রাপ্য। বিজয় দিবসে এটাই যেন হয় আমাদের অঙ্গীকার।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ