বিড়াল কথা
গল্প সোলায়মান আহসান মার্চ ২০২৫
সাদেক আলী বাসায় ফিরলেন একটা সাদা বাক্স হাতে। জুতার বাক্স যে রকম সাইজ হয়, সেরকম।
বকুল ভাবলো সাদেক নতুন জুতা কিনেছে। কিন্তু সে ভাবনার সমর্থনে যুক্তি খুঁজে পেল না। গত রোজার ঈদে সাদেক এক জোড়া জুতা কিনেছে। পাঁচ মাসের ব্যবধানে আবার আরেক জোড়া নতুন জুতা কেনার কথা নয়। সাদেক সেরকম অমিতব্যয়ী লোক না।
সাদা বাক্সটা নিয়ে সোজা লনে রেখে আসলো সাদেক। মুচকি হেসে শোবার ঘরে এসে বসলো খাটে। ড্রেসিং টেবিলে বসা বকুলের মুখোমুখি।
বকুল সাদেকের আচরণে খানিকটা রহস্যের আভাস পেল।
- তুলতুল কোথায়? মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো সাদেক।
- ছাদে। খেলতে গেছে। জবাব দিয়ে উঠে দাঁড়ায় বকুল। উদ্দেশ্য বিকেলের চা-টা রেডি করা। চায়ের সঙ্গে ‘টা’ ডালপুরি একটু আগেই বানিয়ে রেখেছে। ওভেনে গরম করে পরিবেশন করার অপেক্ষা। চা-টা সাদেক সদ্য বানানো খেতে পছন্দ করে। বলে, ফ্লাস্কে রাখা চায়ে স্বাদ কমে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল কিচেনের দিকে, চুলায় পানি চড়াবে বলে। কৌতূহল নিবৃত্ত করতে না পেরে ঘুরে জিজ্ঞেস করে- সাদা বক্সের ভেতর কী?
- তুলতুলকে খবর দাও। পরে বলছি। ওর সামনেই ওপেন করা হবে।
- বাসায় তো কেউ নেই। বিলু গেছে গিটার শিখতে। আর মিনহাজের ফিরতে আরো দেরি হবে। জ্যামে আটকে থাকে। আমাকেই যেতে হবে আনতে। চায়ের পানি চড়িয়ে যাচ্ছি।
- থাক, তুমি থাকো। আমিই যাচ্ছি তুলতুলকে আনতে।
বকুল কিচেনের দিকে আর সাদেক সিঁড়িঘরের দিকে পা বাড়ালো।
সাদেকের বাড়ি পাঁচ তলা। তারা থাকে চারতলায়। তাই ছাদে যাওয়া-আসা খুব কষ্টকর নয়। তাছাড়া ছাদে একটা বাগান করেছে সাদেক-বকুল মিলে। যাওয়া-আসা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বাড়ির মালিক সাদেক একা নয়। তারা চার বন্ধু মিলে বানিয়েছে। এর আগে সাদেক যে বিদেশি ঔষধ কোম্পানিতে চাকুরি করতো, তারা করোনা ক্রাইসিসের সময় ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা পায় গ্রাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা। সে সময় দেশে-বিদেশে চলছে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট। জায়গা-জমি-ফ্ল্যাটের দাম পড়তি। সাদেক ও অপর তিন বন্ধু বুদ্ধি করে মিরপুরে এ জায়গাটা বেশ কম মূল্যে কিনে ফেলে। তারপর ধীরে ধীরে বিল্ডিংটা নিজেরাই করে। নীচতলা গ্যারেজ ও খানিকটা কমার্শিয়াল কাজে ভাড়া দেওয়া। ভাড়া বাড়িতে থাকার শাস্তি থেকে বাঁচা।
সাদেক ছাদে এসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে পেয়ে যায় পানির ট্যাংকির পাশে তুলতুলকে। অন্যান্য বান্ধবী রিমঝিম, পিংকি ও বিন্দির সাথে ক্যারাম খেলছিল।
তুলতুলের স্কুল মর্নিং শিফটে। সকাল আটটা থেকে দুপুর দেড়টা। তার মানে দুপুরের পর তুলতুলের স্বাধীন জীবন। মাঝে তিনটের টিচার আসেন। ঘণ্টাখানেক বন্দি। এরপর ছাদ অথবা কারু বাসায় কাটে খেলাধুলায় তুলতুলের সময়।
- আব্বু, তুমি! তুলতুল উচ্ছসিত। অবাক হয় এমন সময় ছাদে আব্বুকে দেখে।
- চলো মামনি, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
- গিফ্ট?
- হ্যাঁ গিফ্ট- ভিন্ন ধরনের।
তুলতুল হাত ওপরের দিকে তুলে কোলে ওঠার বায়না করে। সাদেক হাসতে হাসতে তুলতুলকে কোলে তুলে নেয়। তুলতুল এখন ক্লাশ থ্রিতে পড়ে। কোলে ওঠার বয়স নয়। কিন্তু তুলতুল এখনও মাঝেমাঝে আব্বুর ঘাড়ে অথবা কোলে ওঠার বায়না করে। অবশ্য সেটা খুব অল্প সময়ের জন্যই।
তুলতুলকে কোলে নিয়ে ঢুকতেই বকুল কৃত্রিম রাগত কণ্ঠে বললো- বুড়ি মেয়ে কোলে চড়েছে- লজ্জা করে না?
- না করে না। মুখ ভেংচি কেটে বললো তুলতুল।
- চলো টেবিলে- নাস্তা খাবে তোমরা।
বকুল ঘর থেকে বের হলো। পেছন পেছন সাদেক ও তুলতুল। ডাইনিং টেবিলে এসে বসতে বসতে তুলতুল বললো- কোথায় আমার গিফ্ট আব্বু?
- ওই যে লনে রাখা, সাদা বাক্সের ভেতর। দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল বাক্সটা। সাদেক আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।
- বাক্সে কি আছে, আমি দেখবো। তুলতুল চেয়ার থেকে নেমে বাক্সের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যেতে উদ্যত হলে সাদেক বাধা দেন- এখন না মামনি। একটু পর আমরা সবাই একসঙ্গে দেখবো।
- নাস্তা খেয়ে নাও তুলতুল, আমরা সবাই একসঙ্গে দেখবো। বকুল বললো।
তুলতুল নিবৃত্ত হয়। নাস্তার টেবিলে এসে বসে।
তুলতুলের নাস্তা খাওয়ার দিকে মনোযোগ ছিল না। বারবার লনে রাখা সাদা বাক্সের দিকে নজর যাচ্ছিল।
- তুলতুল, তোমার মুখ নড়ছে না একদম- সস দিয়ে খাও মজা লাগবে। মা বললো।
তুলতুল সচকিত হলো। চা-নাস্তা পর্ব শেষ হলো।
- আমাদের বাসার ইঁদুরের উপদ্রব হতে বাঁচতে কী এনেছি? সাদেক আলী বললো মুচকি হেসে।
- বিড়াল! তুলতুল চিৎকার করে বলে উঠলো।
বকুল মিনমিন করে বললো- চারতলায় বিড়াল কেউ পোষে!
- আমার কত দিনের শখ! আব্বু ভেরি গুডবয়! তুলতুলের উচ্ছ্বাস। সাদেক আলী বললো- এসো বাক্সটা ওপেন করি। বাক্সের কাছে গিয়ে বাক্সের ডালা খোলা হলো। দেখা গেল একটা সাদা ছোট্ট বিড়ালছানা। মৃদুস্বরে ডেকে উঠলো- মিঁউ!
তার গলার আওয়াজ কেউ শুনেছে, কেউ শোনেনি।
আরও পড়ুন...