বীথিকার চিঠি

বীথিকার চিঠি

গল্প এনায়েত রসুল মার্চ ২০২৫

অনেকগুলো টাকা হাতে নিয়ে মা সারিকার ঘরে এলেন। সারিকা তখন বই খুলে বসেছিল। তবে ওর চোখ বইয়ের ওপর নয়, সেই ঘরের সিলিংয়ের বুকে থির হয়ে ছিল। সম্ভবত কিছু ভাবছিল সারিকা।

টাকাগুলো গুনতে গুনতে মা বললেন, ‘চার হাজার টাকা তোর বাবার কাছ থেকে নিয়ে এলাম। তোর জন্য।’

মা হাসি হাসি মুখ নিয়ে কথাটা বললেও সারিকা তা শুনতে পেয়েছে কি পায়নি, মা তা বুঝতে পারলেন না। সারিকা অনড় চোখে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়েছিল, তেমনই তাকিয়ে রইলো। সুতরাং কথাটা আবার বলতে হলো মাকে। মা বললেন, ‘এই যে দেখ, তোর জন্য টাকা নিয়ে এলাম। ইফতারের পর দু’জন বের হবো। এবার তোকে একটা সুন্দর ড্রেস কিনে দেবো।’

এবার সারিকা মায়ের দিকে তাকালো। তারপর ছোট্ট করে বললো, ‘দিও।’ 

গত পনেরো দিন ধরে যে মেয়ে ঈদের কাপড় কিনে দেওয়ার জন্যে বাবা-মাকে অস্থির করে তুলছিল, তার অমন একটি ছোট্ট জবাব শুনে মা অবাক হলেন। তাই তিনি বললেন, ‘কী বলেছি শুনেছিস তো? তোর জন্য টাকা নিয়ে এসেছি। ইফতার করার পর তোর কাপড় কিনতে যাবো- তুই আর আমি।’

সারিকা বললো, ‘আচ্ছা।’

মা জবাবটা শুনলেন, অথচ তার মনে হলো তিনি কিছু শুনতে পাননি- যেন বহু দূর থেকে ক্ষীণ একটি শব্দ ভেসে এসেছে। 

মা এবার সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘তোর হয়েছে কী? এমন ছাড়া ছাড়াভাবে জবাব দিচ্ছিস কেন? আজ কাপড় কিনে দেবো বললাম, তোর মাঝে কোনো খুশিই দেখছি না! কারণ কী?’

সারিকা বললো, ‘কথা বলতে ভালো লাগছে না মা। আমার কিছু ভালো লাগছে না।’

খাটের ওপর টাকাগুলো রেখে মা সারিকার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ‘দেখেই বোঝা যাচ্ছে তোর মন ভালো নেই। মন ভালো নেই কেন? বলেছি তো আজ তোকে কাপড় কিনে দেবো। তোর বাবা দিয়েছেন চার হাজার টাকা। আমিও কিছু টাকা সঙ্গে নিয়ে নেবো। তোর যা ইচ্ছে কিনবি।’ 

সারিকা বললো, ‘এসব শুনতে আমার ভালো লাগছে না। আজ দুপুর থেকে কিছু ভালো লাগছে না মা। আমার খুব মন খারাপ।’

‘কেন রে? মন খারাপ কেন?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে মা জানতে চাইলেন।

সারিকা বললো, ‘বীথিকার চিঠি পড়ে খুব খারাপ লাগছে।’

মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী লিখেছে বীথিকা? ও ভালো আছে তো?’

সারিকা বললো, ‘ওরও মন খারাপ। চিঠিটা পড়ে দেখো, তোমারও মন খারাপ হবে।’

যে বইটা খোলা ছিল তার ভেতরে বীথিকার চিঠি রাখা ছিল। সারিকা ওটা বের করে মায়ের হাতে দিলো। মা দেখলেন বীথিকা লিখেছে :


প্রিয় সারিকা,

ভালোবাসা নিস। তুই জানতে চেয়েছিস ঈদের জন্য এবার আমি কী কী কিনেছি। কিনেছিলাম অনেক কিছুই। আর ড্রেসগুলো খুব সুন্দরও ছিল। কিন্তু ওগুলোর একটাও এখন আর আমার কাছে নেই। যেদিন কিনে এনেছি সেদিনই আবার সেগুলো ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি। দোকানি আমাকে টাকাও ফেরত দিয়েছেন। সেই টাকা এখন আর আমার কাছে নেই। তাই এবার ঈদে কাপড় কেনা হবে না। তাতে অবশ্য আমার খারাপ লাগছে না- খারাপ লাগছে ইশারার কথা ভেবে।

ইশারাকে তুই চিনিস না। আমার রুমমেট ইশারা। আমরা একই ক্লাসে পড়ি। তাই তোর মতোই ইশারা আমার এক ভালো বন্ধু। শুধু তফাত এই যে, তোর-আমার বাবার মতো ওর বাবা কোনো বিজনেসম্যান নন- তিনি অটো রিকশা চালান। বুঝতেই পারছিস ওদের আর্থিক অবস্থা। একেবারেই নাজুক। তার ওপর ইশারাকে হোস্টেলে রেখে পড়াতে হচ্ছে। এসব করতে গিয়ে রাতদিন অটো রিকশা চালাতে হয় বেচারাকে। দুটো টাকা বাঁচাবার জন্য প্রায় দিনই অভুক্ত থাকতে হয়। এ কারণে অনেকগুলো অসুখ বেঁধেছিল ইশারার বাবার শরীরে। তিনি তা বুঝতে পেরেও চিকিৎসা করাননি। এসব নিয়ে মাঝে মাঝেই ইশারা মন খারাপ করতো। ওর সমস্যার কথা শুনে আমারও মন খারাপ হতো।

গত সপ্তাহে বাবা ঈদের কাপড় কেনার জন্য আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে গেছেন। সে টাকা দিয়ে আমি তিন সেট কাপড় কিনেছি। পুরো টাকাটাই খরচ করেছি। কাপড়গুলো খুব সুন্দর ছিল, তাই মনটাও ভালো ছিল। কিন্তু হোস্টেলে ফিরে মন খারাপ হয়ে যায়। রুমে ঢুকে দেখতে পাই ইশারা কাঁদছে। ওর বাবা নাকি স্ট্রোক করে হসপিটালে ভর্তি হয়েছেন। সে জন্য অনেক টাকা দরকার। কিন্তু যারা দিন এনে দিন খায়, প্রতিদিন খাবার জোটাতেও পারে না, তারা অনেক টাকা পাবে কোথা থেকে?

আমাকে দেখেই ইশারা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে, বীথিকা! আমার কিছু টাকা দরকার। অন্তত দু-তিন হাজার। নইলে বাবাকে বাঁচানো যাবে না। 

তুই তো জানিস, আমার হাতে কখনো অতিরিক্ত টাকা থাকে না। নিমিষে সব খরচ করে ফেলি। সেদিনও দু-এক ঘণ্টা আগে আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা ছিল। অযথাই পুরো টাকা খরচ করে কতগুলো কাপড় কিনে এনেছি।

আমি ইশারাকে সাহায্য করতে চাই অথচ হাতে একটিও টাকা নেই- সে কথা ভেবে যখন কাঁদছিলাম তখন ডোনা আপু বলেন, তুমি যদি ইশারাকে হেল্প করতে চাও তবে তোমার কাপড়গুলো ফেরত দিয়ে এসো। চলো, আমিও যাবো তোমার সঙ্গে। দোকানিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একটা ব্যবস্থা করে নেবো।

আমি তাই করেছি সারিকা, অনেক অনুরোধ করে দোকানিকে কাপড়গুলো ফেরত দিয়ে এসেছি। তার জন্য তিনি তিনশো টাকা কেটে রেখেছেন। তাতে আমার আফসোস নেই, অন্তত চার হাজার সাতশো টাকা তো আমি ইশারার হাতে তুলে দিতে পেরেছি। সেটাই আমার তৃপ্তি। কিন্তু চিকিৎসা চালিয়ে যাবার জন্য ওদের অনেক টাকা দরকার। ওরা টাকা পাবে কোথায়, তা ভেবে আমি কূল পাচ্ছি না। মন খুব খারাপ। আমার আর ইশারার জন্য দোয়া করিস। আন্টিকেও দোয়া করতে বলিস।

আজ আর লিখবো না। মন ভালো নেই, তাই তোকে লিখলাম। আল্লাহ তোকে ভালো রাখুন- এ দোয়া করি। ওহ হ্যাঁ, এবার ঈদে কী কী নিচ্ছিস, তা জানাস।

ইতি,

তোর বীথিকা।


সারিকা ততক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়েছিল। চিঠি পড়া শেষ হতেই একটা দীর্ঘশ^াস বেরিয়ে এলো মায়ের ভেতর থেকে। মা বললেন, ‘সত্যিই মন খারাপ হয়ে গেল। তবে ভালো লাগছে বীথিকার কথা ভেবে। বীথিকা খুব ভালো মেয়ে।’

সারিকা বললো, ‘আমিও ভালো মেয়ে হতে চাই মা। বাবা যে টাকাগুলো দিয়েছেন, তা যদি ইশারাকে পাঠিয়ে দিই, তুমি রাগ করবে?’

মা বললেন, ‘তাহলে তোর কাপড়? ঈদের কাপড় কিনবি না এবার?’

সারিকা বললো, ‘এবার না হয় ঈদে কাপড় না-ই কিনলাম। কাপড় তো আমার কতই আছে। টাকাগুলো দিয়ে দিই মা। দেবো? বলো মা, দিয়ে দিলে তুমি রাগ করবে?’

মা বললেন, ‘কি বোকা মেয়ে তুই! রাগ করবো কেন? বরং আমার মেয়েটির মনও বীথিকার মতো সুন্দর, সে কথা ভেবে আমার ভালো লাগবে। ঠিক আছে, তোর টাকা আমরা বীথিকার কাছে পাঠিয়ে দেবো। সেই সঙ্গে ইশারা আর বীথিকার জন্য ঈদের কাপড়ও কিনে পাঠাবো। ভালো হবে না?’

সারিকা বললো, ‘খুউব ভালো হবে মা। তবে ওদের সঙ্গে যদি আমার জন্যও কাপড় কিনে আনো, তাহলে আরো ভালো হবে। একসঙ্গে সবার মন ভালো হয়ে যাবে।’

মা মিষ্টি হেসে সারিকাকে জড়িয়ে ধরলেন। মা-মেয়ের মন ভালো হয়ে গেল।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ