বুকের ভেতর দারুণ ঝড়

বুকের ভেতর দারুণ ঝড়

উপন্যাস হারুন ইবনে শাহাদাত এপ্রিল ২০২৫

‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না’

‘না। এভাবে চলতে পারে না। কয়েকজন মাস্তানের হাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী পণবন্দি থাকতে পারে না। একটা কিছু করতেই হবে।’ চোখের পানিতে ভেজা পত্রিকাটি বিছানায় রেখে তাওহিদ ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কান্না লুকাতে চোখে বালিশ চেপে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে।

ফ্যাসিস্ট দুঃশাসনে নিপীড়িত স্কুল শিক্ষক বাবার সন্তান। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে তাওহিদের বাবা তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল এবং চাকরি হারিয়েছেন। কিন্তু এই পরিবারের প্রতিটি সদস্য নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন। শুধু এই পরিবারের মতো প্রতিদিন ফ্যাসিস্ট সরকারের স্বৈরশাসনে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে দেশের লাখ লাখ মানুষ।

এমন প্রতিটি ঘটনাই ওর বুকের ভেতর ঝড় তোলে। প্রতিটি নির্যাতিত মানুষকেই তার বড়ো আপন মনে হয়। তাই তো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের শাহাদাতের ঘটনা শোনার পর থেকে সে কিছুতেই নিজের মন শান্ত করতে পারছে না।

তাওহিদ ভাবতে পারছে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটেও আধিপত্যবাদী সন্ত্রাসীদের থাবা। না! এভাবে চলতে পারে না। একটা সমাধান করতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? তবে একা তো আর লড়াই করা যায় না। না হলে এখন কী করব...

‘আমাকে পারবে না থামাতে... আমাকে পারবে না দমাতে...আমি তো চাই না ক্ষমতা’ তাওহিদের মোবাইলের হ্যালো টিউন কলার বেজে ওঠে। এই গানটি ওর খুব প্রিয়। তাই তো গানটি হ্যালো টিউন হিসেবে সেট করেছে। ওর বুকের ভেতর বয়ে যাওয়া ঝড় আরো বেড়ে যায়। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। নামটা দেখেই ওর মনে আশার সঞ্চার হয়। কারণ সামির সাথে মনের কষ্টগুলো শেয়ার করলে ওর শক্তি সাহস বেড়ে যায়। মনটা শান্ত হয়।

: আসসালামু আলাইকুম।

: ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছো তাওহিদ

: আলহামদুলিল্লাহ। আজকের পত্রিকা দেখেছো? বুয়েটে... আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে কান্নাচাপা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে তাওহিদ।

: দেখলাম...। ছাত্ররাজনীতির নামে হচ্ছেটা কী!

: না আর মেনে নেওয়া যায় না, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ওরা বানিয়েছে একটা টর্চার সেল। ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষে শুধু...

: না বন্ধু শুধু ফ্যাসিস্ট সরকার না, আধিপত্যবাদী শক্তি ভারতের সমর্থক...

: নট অনলি সমর্থক, ভাড়াটিয়া পেটুয়া বাহিনীর সদস্য ছাড়া আর কেউ নিরাপদ নয়।

: কথাটা আংশিক সত্য।

: ওরাও নিরাপদ নয়, কারণ স্বার্থের দ্বন্দ্বে ওরা নিজেরা নিজেদের কীভাবে শিকারে পরিণত করছে, দেখতে পাচ্ছো তো?

: সভাপতি গ্রুপ সেক্রেটারি গ্রুপ আরো কত গ্রুপ।

: তা ঠিক, ওরা খুনের নেশায় মত্ত।

: ওদের এই গ্রুপিংটাই আমাদের কাজে লাগাতে হবে।

: আমরা আবরার, জুবায়ের, মুজাহিদ, শাহীন, জনি ইসলাম, আব্দুল করিম, আলমগীর হোসেন, দেলোয়ার হোসেন মিশু, সাইফুল ইসলাম তারেক, নুরুল আমিন, কামারুজ্জামান, আলী রায়হান আবু বকর কতজনের নাম বলব। এদের অনেকের লাশও পায়নি স্বজনরা। নিষ্পাপ মেধাবী ছাত্ররা আর কত এভাব ঝরে পড়বে? চুপ করে বসে থাকলে আমাদের নামও হয়তো একদিন যোগ হবে এ তালিকায়।

: মা-বাবা কত বড়ো আশা নিয়ে দেশের সেরা সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের আদরের সন্তানদের পাঠানা!

: ঠিক বলেছ, শহীদ আবরারের মা বলেছেন, তিনি এবং আবরারের বাবা তাকে কোনোদিন একটি থাপ্পড় দেননি। 

: হ্যাঁ যাকে বলা হয় বাবা-মা হাতের ফুলের টোকা পর্যন্ত দেননি।

: ‘আমাদের সেই আদরের ভাইটিকেই ওরা সারা রাত নির্যাতন করে হত্যা করেছে।’ ওদের দু’জনেরই কান্নার আবেগ বাঁধ ভেঙে প্লাবন হয়ে চোখে ফেটে বেরিয়ে আসে।

: ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহি না’। দুই বন্ধু এক সাথে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা সমস্বরে আবৃত্তি করতে থাকে : মুসলিম তোরা আজ জয়নাল আবেদীন/ ওয়া হোসেনা ওয়া হোসেনা কেঁদে তাই যাবে দিন

/ফিরে এল আজ সেই মহরম মাহিনা/ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহিনা।/উষ্ণীষ কোরআনের হাতে তেগ আরবির

/দুনিয়াতে নত নয় মুসলিম কারো শির।/তবে শোন ঐ শোন বাজে কোথা দামামা/শমশের হাতে নাও বাঁধ শিরে আমামা/বেজেছে নাকাড়া হাঁকে নাকিবের তূর্য/ হুঁশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সূর্য/জেগে ওঠো মুসলিম হাঁকো হায়দারী হাঁক/ শহীদের দিলে সব লালে লাল হয়ে যাক...

: ‘হ্যাঁ লালে লাল হয়ে যাক।’ বলে তাওহিদ

: ‘একা একা লালে লাল মানে হলো আবরার আর আবু বকরের মতো শাহাদাত বরণ করে জান্নাতের পাখি হয়ে উড়ে যাওয়া...’ 

সামির কথা শেষ হতেই তাওহিদ প্রশ্ন করে : ‘তাই বলে কি আমরা বসে থাকবো?

: অবশ্যই না, আমাদের জাগ্রত হৃদয়ের আগুন সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষের সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে জালিমরা পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।

: ঠিক বলেছো। আমাদের থামা যাবে না।

মুচকি হেসে সামি তাওহিদের প্রিয় গানটি গেয়ে ওঠে : ‘আমাকে পারবে না থামাতে আমাকে পারবে না দমাতে...আমি তো চাই না ক্ষমতা।’

: অবশ্যই আমরা থামবো না। জালিমতন্ত্র উৎখাত করতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অঙ্গীকার : ১. সাম্য (ইনসাফপূর্ণ বণ্টন) ২. মানবিক মর্যাদা, ৩. সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ব্যক্ত করে একটি গণতান্ত্রিক দেশ গড়ার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা মাঠে থাকবো।

: ‘ভুলে গেলে চলবে না, স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়নি।’ 

সামির কণ্ঠের এ দীপ্ত উচ্চারণে তাওহিদ আরো সাহসী হয়ে বলে : ‘ঠিক। ১৯৭১ আমরা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইল বা প্রায় ১৪৮ হাজার বর্গকিলোমিটার জমিন পেয়েছি, পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। কিন্তু মূল লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি। তাই তো দিল্লির জিঞ্জির বারবার আমাদের বন্দি করে। ভারতের সেবাদাস শাসক...

সামি যোগ করে : ‘আর তাদের গুণ্ডারা আমার দেশের সীমানায় ঢুকে আমাদের ভাইদের হত্যা করার দুঃসাহস দেখায়।’

: ‘ওরা সাহস পায় কারণ অর্থবিত্ত আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে এদেশে ভারত অনেক মীর জাফর, মীরণ, উমিচাঁদ আর জগৎশেঠ সৃষ্টি করেছে।’ সামি বললো। 

: ‘তাই তো স্বাধীনতার এত বছর পর ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবরেও ওরা বুয়েটের শেরেবাংলা হলের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যা করার সাহস পায়।’ কান্নায় আবারও তাওহিদের কণ্ঠ কেঁপে কেঁপে ওঠে।

: খুনিরা কিন্তু বাইরের কেউ নয় বুয়েটেরই ছাত্র। এদেশেরই সন্তান। ওরাও মেধাবী। কিন্তু ফ্যাসিস্ট হাসিনার ছাত্রলীগ ওদের মাথা কিনে নিয়েছে।

: ওরা এখন ভারতের ভাড়াটিয়া খুনি।

: ঠিক যেন ক্লাইভের ভাড়াটিয়া খুনি মীরণ, মুহাম্মদী বেগ...

: ঘসেটি বেগমের কথা বললে না?

: ‘যুগে যুগে ঘসেটি বেগমরাই তো ওদের সৃষ্টি করে। আর ঘসেটি বেগমদের জন্ম হয় ক্ষমতার লোভে।’

সামির কথা শেষ হতেই তাওহিদ প্রশ্ন করে : কী এমন অপরাধ করেছিল আবরার, ফেনী নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার কথা বলেছিল। বিনা ভোটের অবৈধ সরকারের অবৈধ প্রধানমন্ত্রী তো নিজেই বলেছেন, তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন, ভারত চিরদিন মনে রাখবে।

: সেই সত্য কথাটি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার কারণেই শিবির ট্যাগ লাগিয়ে নির্যাতন করে তাকে হত্যা করলো...

তাওহিদ দৃঢ় কণ্ঠে বলে : ‘সব হিসাব আমরা কড়াগণ্ডায় আদায় করব।’

: আমরা ২০১৮ সালে মাঠে নেমেছিলাম, বৈষম্যমুক্ত দেশ, নিরাপদ সড়ক আর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে। দাবি যতদিন আদায় না হবে আবার বার বার নামবো...

: কিন্তু!

: তাওহিদ, কোনো কিন্তু নয়, তুমি এখনই আসো। বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সাথে আমরাও মাঠে থাকব। আবির, আতিক, ফাহামকে নিয়ে আমরা স্যারের বাসায় যাব। 

: সামি ঠিক বলেছে, সাবিত ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে বিরক্ত। তাকে সাথে নিতে হবে।

: ছাত্রলীগের সাথে সে আর থাকতে চায় না। কিন্তু ছাত্রলীগ ছাড়লে ওকে তো দুনিয়া ছাড়া করবে।

: না পারবে না। ওর প্রভাবের কারণে ওরা ওর সাথে বিরোধে জড়াবে না।

: তাওহিদ, হায়াতের সাথে কি তোমার কথা হয়েছে?

: হয়েছে।

: ঠিক আছে। এখন তাহলে রাখি। তুমি দ্রুত আসো।

: আল্লাহ হাফেজ।


২. শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না


‘টর্চার সেল গেস্টরুম কালচার আর র‌্যাগিং এর নামে অকথ্য ও অসভ্য নির্যাতন বন্ধ করতে না পারলে ব্রেন-ড্রেন অর্থাৎ মেধাপাচার বন্ধ হবে না। দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো সুশিক্ষিত সভ্য ও দক্ষ মেধাবী নেতৃত্ব দূরের কথা যোগ্য জনশক্তিও তৈরি করতেও ব্যর্থ হবে। জ্ঞান, কাজ এবং কাজের উপযোগী মানুষ সৃষ্টি করাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র এজেন্ডা। কিন্তু ছাত্রলীগ নামের দানবের কারণে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হতে চলেছে মাদকাসক্ত, চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী নেতৃত্ব বিকাশের অভয়ারণ্যে। এ অবস্থার পরিবর্তনে তোমাদেরই ভূমিকা পালন করতে হবে।’ সবাই স্যারের কথাগুলো এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল। তার কথা শেষ হতেই প্রথমে মুখ খোলে ফাহাম। 

: ‘মাত্র ত্রিশ-চল্লিশজন সন্ত্রাসী মাস্তান হেরোইনচির অত্যাচার নির্যাতন কেন মাথা নিচু করে মেনে নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র? যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভয় পায়, বড়ো বড়ো ডিগ্রি নিয়ে ওরা দেশের জন্য কী করবে? বিসিএস করে বড়ো বড়ো অফিসার হবে? আর ঐ মাস্তানরা হবে মন্ত্রী, তারপর এই সব ভীরু কাপুরুষ অফিসারদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে, দেশের বারোটা বাজাবে। তাওহিদের কথা শুনে বিস্ফারিত চোখে সবাই তার দিকে তাকায়।

: ‘এই সমস্যার সমাধান করতেই হবে। আমাদের ঐক্যবব্ধ হতে হবে।’ সবাই এক সাথে বলে ওঠে।

তাওহিদ আবার তার কথা শুরু করে : ‘তা ঠিক তবে কোনো দলীয় লেজুড়ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের ব্যানারে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে সবাইকে এক ছাতার নিচে আসতে হবে।’

: ‘ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে, তা বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখে দেশের স্বার্থে একই পতাকার নিচে সবাইকে আসতে হবে।’ স্যার বলেন।

: ‘সেই লক্ষ্য পূরণেই তো আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা কাজ করছি। ফ্যাসিস্ট হাসিনার সমর্থকরা ছাড়া সব রাজনৈতিক দল-মত এবং সাধারণ প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। নিরাপদ সড়ক, কোটা বৈষম্য দূর আর রাষ্ট্র সংস্কারের এজেন্ডা নিয়ে ইতোমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি।’ রবিন বলে।

: ‘গুড। এটিকে কাঠামোগত রূপ দিতে হবে। একটি টেকসই সাংগঠনিক রূপ ছাড়া সাফল্য আসবে না।’ বলেন স্যার।

: ‘স্যার, এক্ষেত্রে আমার একটি আইডিয়া আমি উপস্থাপন করতে চাই।’ ফাহাম বিনীতভাবে বলে।

: ‘অবশ্যই।’ সবাই এক সাথে বলেন।

: ‘আমরা আবরার, আবু বকরের মতো শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না। কিন্তু স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দাবি আদায় এবং গণতান্ত্রিক সরকারের নিকট থেকে আদায় একই পন্থায় হয় না, এ কথা মনে রেখে আমাদের কর্মনীতি ও কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।’ ঘরোয়া বৈঠকের সিনিয়র জুনিয়র শিক্ষার্থীরা সবাই ফাহামের দিকে তাকিয়ে মন দিয়ে ওর কথা শুনছে। সবার প্রত্যাশা একটি নতুন আইডিয়া। 

ফাহাম আতিকের দিকে তাকিয়ে বলেন : ‘রহমান স্যারের সাথে বৈঠকে উনি একটা আইডিয়া আমাদের সাথে শেয়ার করেছিলেন...

: ‘হ্যাঁ, তুমি বলো।’ আতিক ফাহামকে বলে।

: ‘আচ্ছা। মানে আমরা কোনো একজনকে আন্দোলনের নেতা হিসেবে উপস্থাপন করব না।’

: ‘নেতা নয়, সমন্বয়কের মাধ্যমে সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে দেবো।’ চুপচাপ বসে এতক্ষণ প্রানেশ রায় সবার কথা শুনছিলেন এবার তিনি মুখ খোলেন।

: ‘এই কথাটিই তো রহিম ভাই আমাদের বারবার বলছেন। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না...’

: ‘মানে।’ প্রশ্ন করেন স্যার।

: ‘উনি বারবার বলেন আপনারা সবাই নেতা। কেউ শহীদ হলে জেলে গেলে আন্দোলন বন্ধ হবে না। আরেকজন দায়িত্ব নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।’

: ‘ঠিক ঠিক তাই।’

: ‘তাহলে তোমার পরামর্শ কী?’ স্যার ফাহামকে প্রশ্ন করে।

: ‘সেই সমাধানই তো ইসলামের ইতিহাসের আলোকে তুলে ধরেছেন, রহমান স্যার।’

ফাহামের কথা শেষ হতেই প্রানেশ বলে : ‘কেমন যেন গন্ধ পাচ্ছি?’

: ‘গন্ধ খোঁজা বাদ দিয়ে চুপ করে বসো, ফাহাম ইতিহাসের আলোকে সমাধানটি তুলে ধরো। আর তোমাদের বলছি। আমাদের এই ফোরামে দলীয় সংকীর্ণ চিন্তার কেউ আসবে না। এমন চিন্তা করলে সন্দেহ অবিশ্বাস আমাদের লক্ষ্য অর্জনে বাধার সৃষ্টি করবে।’ স্যার কড়া কণ্ঠে বলেন।

উত্তেজনায় তার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। স্যারের কথার মাঝেই সাবিত, তাওহিদ, আবির প্রবেশ করে।

: ‘এত দেরি করলে যে?’ স্যার প্রশ্ন করেন।

: ‘স্যার টিকটিকি লেগেছিল পেছনে।’ আবির বলে।

: ‘সর্বনাশ!’ স্যার বিস্ফারিত চোখে বলেন।

: ‘স্যার, ভয়ের কিছু নেই। সাবিতকে এই জন্য সাথে আনলাম, ছাত্রলীগ নেতা।’ তাওহিদ বলে।

: ‘পরিচয় দিতে লজ্জা করে।’ সাবিত বলে।

: ‘কিন্তু উপায় নেই। আমাদের লক্ষ্য পূরণ না পর্যন্ত...’

কথা শেষ হওয়ার আগেই সাবিত বলে : ‘ভাইয়া। আমারও উপায় নেই। এটা অনেকটা আন্ডার ওয়ার্ল্ডের মতো প্রবেশ করা যায়, কিন্তু বের হওয়া কঠিন।’

: ‘ধৈর্য ধর ওরাই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে ইনশাআল্লাহ।’

আতিকের কথার মাঝে প্রানেশ ওকে সতর্ক করে : ইনশাআল্লাহ। এসব শব্দ উচ্চারণ করলে তো তোমাকে...। 

: ‘আলহামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ আমাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির অংশ। দেশটা যেমন কারো বাপের না, ঠিক তেমনি এ শব্দগুলোও কোনো দলের একার নয়। এ দেশের সকলের।’

আতিককে শান্ত করতে প্রানেশ বলে : ‘বন্ধু মনে হয় মাইন্ড করেছ। আমি তোমার কল্যাণ চিন্তা করেই বলেছি। দেখো আবুবকর, আবরার নিয়মিত মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তো। ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। ওদের মতো গুণ্ডামি মাস্তানি করতো না, সবার সাথে ভালো ব্যবহার করতো। তাই তো ওদের ব্যাপারে ওরা শতভাগ নিশ্চিত হয়ে...’

সাবিত প্রানেশকে থামতে বলে : ‘তোমার কথা ঠিক আছে। কিন্তু এভাবে আর বেশিদিন আমরা চলতে দেবো না।’

: ‘আমরা কিন্তু আসল জায়গা থেকে অনেক দূরে চলে গেছি। সমন্বয়ক নির্ধারণের বিষয়টি ইতিহাসের আলোকে রহমান স্যার তোমাদের যেভাবে বুঝিয়েছেন, তা আমাদের সামনে তুলে ধরো।’ স্যার ফাহামকে উদ্দেশ্য করে বলেন।

এবার ফাহাম বলতে শুরু করে : ‘এটি ইসলামের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ মূতার যুদ্ধের ঘটনা। সময়টা অষ্টম হিজরির জামাদিউল উলা মোতাবেক ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট। মূতার ঐতিহাসিক যুদ্ধে তিনজন সেনাপতি শহীদ হয়েছিলেন। সেই তিন বীরের নাম যায়েদ বিন হারেসা, জাফর বিন আবু তালেব এবং আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু আনহুম। রাসূল (সা) এই বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেছিলেন যায়েদ বিন হারিসা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে। এরপর নির্দেশনা দেন, ‘যদি যায়েদ শহীদ হয়, তবে সেনাপতি হবে জাফর। জাফর নিহত হলে সেনাপতি হবে আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা’। রাসূল (সা) তাদের উপদেশ দেন,

‘তোমরা আল্লাহ তায়ালার নামে একনিষ্ঠভাবে তাঁরই রাহে যুদ্ধ করবে। বিশ্বাসঘাতকতা এবং সীমালঙ্ঘন যেন না হয়। কোনো শিশু এবং মহিলাকে যেন হত্যা না করা হয়। কোনো বৃদ্ধের গায়ে যেন আঘাত করা না হয়। কোনো ইবাদতগাহে যেন ধ্বংসের আঁচড় না লাগে। কোনো বৃক্ষের গায়ে যেন না লাগে অস্ত্রের আঘাত। কোনো স্থাপনাকে যেন না করা হয় বিচূর্ণ’।’ 

: ‘বাহ রাসূলের উপদেশ কত সুন্দর। আচ্ছা মূতার যুদ্ধ কেন নাম?’ প্রানেশ ফাহামকে প্রশ্ন করে।

ফাহাম আবার শুরু করে : ‘বর্তমান জর্ডানের উপকূলীয় শহর মা’আনে ‘মূতা’। এ জায়গার নামে এ যুদ্ধের নামকরণ করেছেন ঐতিহাসিকরা। এখানে মুসলিম বাহিনী মুখোমুখি হয় তৎকালীন পরাশক্তি রোমান বাহিনী। রোমীয় সৈনিকদের নেতৃত্বে ছিল তাদের রাজা হিরাক্লিয়াস নিজেই। প্রায় দু’লাখ সৈন্য নিয়ে তিনি এসেছিলেন, তিন হাজার মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলায়।’

: ‘দুই লাখের মোকাবিলায় মাত্র তিন হাজার!’ অবিশ্বাস্য বিস্ফারিত চোখে অনেকের মুখে উচ্চারিত হয়।

: ‘তারপর!’ ক্ষণিকের জন্য ওরা হারিয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়।

সবার আগ্রহ দেখে ফাহাম আবার শুরু করে : ‘তার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে মুসলিম বাহিনীর সদস্যরা আল্লাহু আকবার আওয়াজে এগিয়ে চলে। সেনাপতি যায়েদ বিন হারিসা ছিলেন এ যুদ্ধের প্রথম শহীদ। তার শাহাদাতের পর ইসলামী বাহিনীর পতাকা হাতে তুলে নেন আরেক সেনাপতি জাফর। রোমান সৈনিকদের আক্রমণে তার প্রথমে ডান হাত পরে বাম হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তিনি দুই বাহু দিয়ে পতাকা তুলে ধরে রাখেন। শত্রুদের তীর বিদ্ধ হয় বুকে। হৃৎপিণ্ড ছিদ্র হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। তিনি ঢলে পড়েন শাহাদাতের সুখনিদ্রায়। তুলে নেন রাসূল ঘোষিত অপর সেনাপতি আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা। বীরদর্পে যুদ্ধ করে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।

আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহার মৃত্যুর পর পতাকা হাতে তুলে নেন প্রসিদ্ধ সাহাবী বদরের যোদ্ধা সাবিত বিন আকরাম (রা)। তিনি বলেন, ওহে মুসলিম যোদ্ধাগণ, ভালো হয় আপনারা একজন সেনাপতি ঠিক করে নিন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আপনার হাতেই থাকুক পতাকা। তিনি বললেন, আমি এ কাজের যোগ্য নই। অতঃপর তিনি এগিয়ে যান মহাবীর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা)-এর দিকে। তাঁর হাতে তুলে দেন ইসলামী বাহিনীর পতাকা। তাকে বলেন, যুদ্ধের ব্যাপারে আমার চেয়ে অভিজ্ঞ আপনি। খালিদ (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের বয়স তখন মাত্র তিন মাস। তিনি বিনতস্বরে বলেন, আমার চেয়ে অধিক উপযুক্ত আপনিই। আপনি বদরের একজন গর্বিত মুজাহিদ। সাবিত (রা) তখন মুসলিম মুজাহিদগণকে একত্রিত করে খালিদ (রা)-এর হাতে তুলে দেন। পতাকা হাতে তুলে নিয়ে খালিদ (রা) ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এটিই ছিল তাঁর প্রথম যুদ্ধ। 

এ অবস্থাতেই যুদ্ধ চলেছিল পূর্ণ একদিন। মুসলিমরা এক মুহূর্তের জন্যও রণে ভঙ্গ দেননি। রোমীয়দের বিশাল সেনাবাহিনীর প্লাবনের সম্মুখে তারা ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন দুর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে। যুদ্ধ চলতে চলতেই অন্ধকার হয়ে আসে আকাশ। এগিয়ে আসে সূর্যাস্তের পালা। সকাল থেকে নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই লক্ষ সৈন্যের বিপরীতে তিন হাজার সৈন্যের লড়াই এবং রণক্ষেত্রে চালকের আসনে থাকার মতো বিস্ময়কর অবস্থার কথা চিন্তা করে পৃথিবীর সেরা সেরা সেনাপতি এবং ঐতিহাসিকরা আজও বিস্ময় প্রকাশ করেন।’

: ‘কীভাবে সম্ভব হলো?’ প্রানেশ জানতে চায়?

: খালিদ (রা)-এর অভূতপূর্ব রণকৌশলে। সে সময় রাতে যুদ্ধ করার প্রচলন ছিল না। তাই রোমানরা সে রাতে বিশ্রামের জন্য ফিরে যায় নিজ নিজ তাঁবুতে। খালিদ বিন ওয়ালিদ তাঁর বাহিনী নিয়ে নিরাপদ অবস্থানে যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সেই নিরাপদ অবস্থানে মুসলমানদের জন্য অনেক সাহায্য এসেছে, এমনটি শত্রুদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া। ফলে রোমানদের অন্তরে সৃষ্টি হবে ত্রাস। তিন হাজার সেনার সারা দিন যুদ্ধ করে টিকে থাকার বিস্ময়কর ঘটনায় এমনিতেই রোমানদের মধ্যে ব্যাপক ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল। এই ভয় আরো বাড়াতে খালিদ কিছু রণ কৌশল গ্রহণ করেছিলেন।’

: ‘কী সেই রণকৌশল?’ সাবিত জানতে চায়।

: কৌশলগুলো হলো : (১) সারা রাত ধরে তিনি মুসলিম বাহিনীর ঘোড়াগুলো দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ঘন ধুলোবালি উড়াতে থাকেন। যাতে করে রোমানরা বুঝতে পারে মুসলমানদের জন্য বিরাট কোনো সাহায্য এসেছে। (২) তিনি সেনাবাহিনীর বিন্যাস পাল্টে ফেলেন। মাইমানা তথা ডানভাগকে বানিয়ে ফেলেন মায়সারা তথা বামভাগ। মায়সারাকে বানিয়ে ফেলেন মাইমানা। এমনিভাবে অগ্রভাগকে নিয়ে যান পেছনে আর পেছন ভাগকে নিয়ে আসেন অগ্রে। সকালে উঠে মুসলিম বাহিনীর এই পরিবর্তিত অবস্থা প্রত্যক্ষ করে রোমানরা নিশ্চিত বিশ্বাস করে ফেলে মুসলিম বাহিনীতে নতুন নতুন দল যোগদান করেছে।

(চলবে)

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ