বুনোলতার তারা

বুনোলতার তারা

গল্প তাসনীম মাহমুদ মার্চ ২০২৫

বুনো ঘাসগুলোর লকলকে ডগা আর পাতার ভরাট দেখে মনে হচ্ছে, ঘাসগুলো অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে চুষে খাচ্ছে কবরের মধ্যে চিরঘুমে বিভোর জারিয়ানের হাড্ডি-মজ্জা-শ্বাস। কি অদ্ভুত এই সৃষ্টি জগৎ! আজ যাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরে; হয়তো কাল-ই তাকে বুনোলতা, ঘাস আর পোকা-মাকড়ের খাবার করে ছুঁড়ে ফেলে বন-জঙ্গলে।

জুন-জুলাই মাস। প্রকৃতি যেন বৃষ্টির ছায়ায় হাজার বছরের চাপা কষ্ট কান্নার ছলে প্রকাশ করছে এমনই এক রাত। বিদ্যুৎহীন গ্রামের অন্ধকারে কালোমেঘ সেলেটের মতো চেপে ধরেছে পৃথিবীকে। ঝড়-বৃষ্টি আর বাতাসের ঝাপটার সাথে তাল মেলে শোকে-ক্লান্তিতে মুহ্যমান আত্মীয়-স্বজন ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু নাহিয়ানের চোখে ঘুম নেই। কফিনের মাথার কাছে মাথা রেখে শুয়ে আছে সে। আতর-লোবানের গন্ধ নাহিয়ানের বুকে যে ঝড় তুলছে, সে ঝড় যেন আটলান্টিকের তলদেশ থেকে উঠে এসে পুরো পৃথিবীকেই তছনছ করে দিয়ে এই রাতকে করে তুলবে মৃত। কয়েক ফোঁটা নিরলস অশ্রু গড়িয়ে ভিজিয়ে গেল নাহিয়ানের চিবুক। চোখ মুছতে মুছতে ওর মনে পড়ে চিত্রাপাড়ের এক শীতের সন্ধ্যার কথা...।

জারিয়ান কবিতা রচনা করতো বলে ওর আব্বু ওকে অনেক দিন বকাঝকা করেছেন। উনি নাকি বলতেন, “কবিদের জীবন দুঃখ কষ্টের হয়। ওদের না খেয়ে মরতে হয়। আবেগ-অনুভূতি-প্রেম ওদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।” চিত্রাবুকের প্রফুল্ল­ পানির মতো টলমলে চোখে জারিয়ান এ কথাগুলো বলছিল নাহিয়ানকে। ও বলেছিল, “জানিস নাহিয়ান, আব্বু কখনোই আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দের দাম দেন না। আমি যখন এলাকার ছেলেদের সাথে মসজিদে যাই, পাঠাগারে যাই, আব্বু তখন আম্মুকে বকাঝকা করে বলেন, ‘ওর এখন এসব করার দরকার কি? মসজিদে-পাঠাগারে-যাওয়ার নাম করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়াই ওর মতলব! আমি কি কিছু বুঝি না?’ 

নাহিয়ান তুই তো জানিস আমার আব্বুর অনেক টাকা! টাকা আর ব্যবসা ছাড়া আব্বু কিছুই বোঝেন না। আমাকে বলেন, লেখাপড়া শেষ করে অস্ট্রেলিয়া থেকে ব্যবসায়ের ওপর দুই বছরের কোর্স করে দেশে বড়ো ব্যবসা শুরু করতে। কিন্তু দোস্ত! আমার ওসব ভালো লাগে না। সেদিন আব্বুর এ কথার প্রতিবাদ করেছিলাম বলে রাতে আমাকে খেতে দিতে আম্মুকে বারণ করেছিলেন। পরের দিন আমাকে রুমে আটকিয়ে রেখেছিলেন। এসব বলতে বলতে জারিয়ানের চোখ পড়ে বাঁধের নিচে পলিথিন দিয়ে ঘেরা ছোট ছোট কয়েকটি ঘরের দিকে। নদী পাড়ের ঐ ঘরগুলোতে তখন খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা চলছে। আগুন ঘিরে বস্ত্রহীন দুটো-তিনটে শিশু খেলা করছে। কুয়াশার সাথে মিলিয়ে যাওয়া ধুমায়িত আলোর দিকে এগিয়ে গেল ওরা দুইজন। পরিচিত হলো সাফিনার সাথে। দারিদ্র্যের ভারে ন্যুব্জ হলেও যৌবনে আভিজাত্যের ছাপ সাফিনার চেহারায় স্পষ্ট। জারিয়ানের অল্প কয়েকটি কথায় আপ্লুত হয়ে সিন্দুকের তালা খুলে ধন-দৌলত বের করার মতো একটু একটু করে অতীত, বর্তমান সব বলে ফেলল সাফিনা বেগম। অবশ্য চিত্রা পাড়ের এই বস্তিতে ‘সাফিনাবুয়া’ নামেই সবাই তাকে চেনে। পাঁচ বছরে তিনটে ছেলে জন্ম দিয়ে তার স্বামী ইহলোক ত্যাগ করেছে। জায়গা-জমি যা ছিল রাক্ষুসী নদী সব গিলে খেয়েছে। তারপরও ছেলেদের অবলম্বন করে নিজ ঘরে থাকতে পারেনি সাফিনা। অপরাধ তার যৌবন! অবশেষে যক্ষের ধন তিনটিকে বুকে চেপে এই বস্তি ঘরে। বস্তির লোকগুলো অনেক ভালো। “গরিবের ঘরে গরিবের একমুঠো ভাত না জুটলেও মান-ইজ্জত রক্ষা পায়।”

ছেলে তিনটে যদি কোনোদিন মানুষ হয় এই তার ভরসা! কিন্তু সাফিনা দিনদিন আর পারে না। খাবার জুটাতেই কষ্ট হয় তার; পরিধানের একটু কাপড় জোগাবে কীভাবে? জারিয়ান বিব্রত বোধ করতে থাকে। কুয়াশা ঘন হতে থাকে; অন্ধকারও হাত-পা ছড়াতে থাকে। ফিরে আসতে আসতে জারিয়ান দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নাহিয়ানকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বলতো দোস্ত! আমাদের সবুজ ঘেরা ছোট এ দেশটিতে কবে শান্তি ফিরে আসবে?’ নাহিয়ান উত্তরে বলেছিল, ‘যেদিন কেউ কারো পছন্দ-অপছন্দে হস্তক্ষেপ করবে না সেদিন।’ জারিয়ান তাচ্ছিল্যে হেসে বলে, ‘নারে! দেখ ওই শিশুগুলোকে। যেদিন ওদের মতো এদেশের সকল অবহেলিত শিশুর পরনে কাপড় থাকবে, ওদের পেটে খাবার থাকবে, স্কুলে যেয়ে পড়ালেখা করে সৎ চরিত্রবান মানুষ হবে সেদিন এদেশে শান্তি আসবে। দেখ নাহিয়ান, আমার আব্বুর অনেক বড়ো বাড়ি; এই বাড়ির একটা অংশে যদি একটা স্কুল খুলে ওদের মতো ছেলেমেয়েদের পড়ার সুযোগ করে দিতে পারতাম!’ সেদিন জারিয়ান ওদের কষ্টে কেঁদেছিল। নাহিয়ানের মনে পড়ে- বস্তির ওই ছেলেদের খাবার, পোশাক আর পড়ালেখার খরচ জারিয়ান হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে এবং গোপনে টিউশুনি করে জোগান দিতো।

স্কুল করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে নিজ বাড়ির ছাদের কার্নিশ থেকে পড়ে জারিয়ানের মাথাটা থেঁতলে মারা গেল। হায়! নাহিয়ানের দম বন্ধ হয়ে আসছে। চিৎকার করে রাতের ঝড়-বৃষ্টি থামিয়ে জারিয়ানের আব্বুকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘চাচা! আপনার জারিয়ানের কথা মনে করুন; ও-তো কখনো বড়োদের অশ্রদ্ধা করতো না। নামাজ পড়তো, পাঠাগারে যেতো, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করতে বলতো, ভালো ভালো উপদেশ দিতো! আর ওর কবিতা-গল্পের ডায়েরিটা খুুলে দেখেন, বঞ্চিত-বাস্তুহারা মানুষগুলোর কথা কীভাবে লেখার ভেতর ফুটে উঠেছে। আপনি টাকা ব্যবসা-বিলাসিতা ছাড়া কিছু বোঝেন না; বুঝতে চাননি নিজের ছেলেকে...। ‘‘প্রকৃতির নির্মল চরিত্র মানুষকে সত্যিকারের মানুষ করে তোলে।” অথচ; সকাল হলেই আপনার জারিয়ানকে কাদামাটির ম্যাড়মেড়ে সাড়ে তিন হাত কবরে বুনোঘাসের সঙ্গী করে দেবেন। আজ কোথায় আপনার দাম্ভিকতা, ব্যবসা, অর্থ-বিলাসিতা?’

না; নাহিয়ান কিছুই বলতে পারে না। আকাশের বুক থেকে কখনো কোনো তারা খসে পড়লে আকাশ যেমন কিছুই বলতে পারে না ঠিক তেমনই নাহিয়ানের চিৎকার দীর্ঘশ্বাস হয়ে অন্ধকারে ঝড়-বৃষ্টির সাথে মিলিয়ে গেল বুনোলতার মধ্যে...।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ