বৃদ্ধাশ্রম মানবসভ্যতার এক নিকৃষ্ট উদাহরণ
প্রবন্ধ নিবন্ধ আবদাল মাহবুব কোরেশী এপ্রিল ২০২৫
বৃদ্ধাশ্রম! এ যেন তথাকথিত প্রগতিশীল শিক্ষিত সমাজের এক নিষ্ঠুর নিয়তির নাম। অবহেলিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। যে স্থানে অতিবাহিত হয় জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান দিনগুলো। একাকিত্বের চরম বাস্তবতা সঙ্গী করে জীবনের শেষ দিনটির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয়। আর ফেলে আসা সোনালি দিনের রঙিন খোয়াব ও আনন্দ মুহূর্তগুলো পদ্মায় ভাসিয়ে শুধু আক্ষেপ করতে হয় আহ্-হা রে জীবন। এই বুঝি তোর প্রতিদান। যৌবনের উত্তাল গতি আর চাকচিক্যে ভরা আত্মীয়-স্বজনের রোমান্টিক সময়টুকু আজ সবই অতীত। বিশেষ করে নয়নের পুতলি ছেলেমেয়ের চাঁদমাখা হাসি আর এটা-ওটা কিনে দেবার বায়না। এমনি জীবন সংসারের হাজারও ঘটনা তারা-নক্ষত্রের মতো মিটমিট করে চোখে ভাসে। কানে ভাসে আজও ছোট্ট খোকার সেই আওয়াজ, বাবা। আহ! কি যে যন্ত্রণা। বুকটা কেমন যেন ধড়ফড় করে ওঠে। একটি পাথর চাপা কান্নায় প্রতিনিয়ত শরীরটা অবশ হয়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু পারি না। এক অশুভ শক্তি ঠোঁট চেপে ধরে। কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে ধূসর আকাশ দেখি। প্রাণ খোলে আকাশের মালিকের কাছে ক্ষমা চাই। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলি, হে আকাশের মালিক, কিছু পথভ্রষ্ট মানুষ আর শয়তানের খপ্পরে পড়ে জীবনে আমি যে ভুল করেছি তার ষোলোআনা ভোগ করে চলেছি। আর উপলব্ধি করছি, কত নিখুঁত আপনার দেওয়া জীবন ব্যবস্থা। চিন্তা-চেতনায় সীমাহীন দূরদর্শী সর্ব কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ মহামানব রাসূলে করিম (সা)-এর নির্দেশিত পথ। তা মেনে যদি সন্তানদের গড়ে তুলতাম, তা হলে আজ এমন নিষ্ঠুর উপহাসের পাত্র হতাম না। জীবনের শেষ বেলায় এসে ঠের বুঝতে পারলাম, আমি এক ব্যর্থ পরাজিত সৈনিক। ক্ষমা করো রব, আমাকে ক্ষমা করো।
পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম
ইতিহাস থেকে জানা যায় পৃথিবীর সর্বপ্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয় সুদূর চীন দেশে। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে চীনের রাজা শান-এর শাসনামলে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীতে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে এর বিস্তার হয়।
পাশ্চাত্যে সংস্কৃতির এক উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো এই বৃদ্ধাশ্রম। এ বৃদ্ধাশ্রমগুলো তাদের প্রয়োজনেই গড়ে উঠেছিল। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় খুব কম সময়েই বৃদ্ধাশ্রম তার জনগণের আশীর্বাদে পরিণত হয়। জনগণের আগ্রহের প্রতি সম্মান জানিয়ে সরকারের মুক্তহস্ত বাড়িয়ে দেবার কারণও ছিল যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। সরকার তার সিনিয়র সিটিজেনদের মৌলিক চাহিদাগুলো যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে ছিল বদ্ধপরিকর। যার কারণে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ তাদের সংস্কৃতিতে পরিবারের সবাই একত্রে বসবাস করা ছিল সুদূর কল্পনা। আমাদের মতো একান্নবর্তী পরিবারে বাস করাটা ছিল তাদের কাছে এক অসহনীয় যন্ত্রণার নাম। মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দাদি নিয়ে আনন্দ ফুর্তি করে বসবাস করার যেহেতু কোনো রীতি ছিল না, সেহেতু বৃদ্ধ পিতা-মাতার শেষ আশ্রয়স্থলই ছিল এই বৃদ্ধাশ্রম। যার ধারাবাহিকতা পশ্চিমা দুনিয়ায় আজও বিদ্যমান। দুঃখজনক হলেও সত্য যে কালের বিবর্তনে আমরাও পশ্চিমাদের এই নষ্ট সংস্কৃতি আমদানি করে মানবতাহীন এক সমাজ জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি।
বাংলাদেশে প্রথম বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা প্রবর্তন করেন ডা: এ.কে. এম আবদুল ওয়াদুদ। তিনি ১৯৬০ সালে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বার্ধক্যে উপনীত দেশের অসহায় নারী-পুরুষদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলেন। যাদের লালন-পালন করার মতো কোনো আপনজন ছিল না, বা থাকলেও তাদের ভরণ-পোষণের জন্য কোনো আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না- তিনি তাদেরকেই অগ্রাধিকার দিয়ে তাঁর বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় দিতেন। যা ছিল একেবারে নিজের দায়বদ্ধতা থেকে সেবামূলক চিন্তা । যার নাম ছিল বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান। মানবিক ও সেবার দৃষ্টিকোণ দিয়ে অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো নিঃসন্দেহে সওয়াবের কাজ এবং সে কাজ করতে ইসলাম আমাদের উৎসাহিত করে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের যে হাল-চিত্র, তার পরিসংখ্যান দেখলে গা শিউরে ওঠে। এ কয়েক দশক আগেও বৃদ্ধাশ্রম নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব মানুষের কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু বর্তমানে তা ব্যাঙের ছাতার মতো দেশের আনাচে-কানাচে পাড়ার অলিতে-গলিতে গজিয়ে উঠেছে। ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবরে প্রকাশিত সমাজসেবা অধিদফতরের তথ্য মোতাবেক বর্তমান বাংলাদেশের নিবন্ধনকৃত বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা ৬টি। এছাড়া সরকারি আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামে গড়ে উঠেছে। চাহিদা অনুপাতে এ সব প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় আমাদের মানবিক, পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থানে যে ধস নেমেছে তা সহজে অনুমান করা যায়।
বৃদ্ধাশ্রমে যাদের ঠাঁই হয়
আমাদের দেশে সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত নারী-পুরুষদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বৃদ্ধাশ্রম সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় নৈতিক মানকে পা দিয়ে মাড়িয়ে আজ সুবিধাবঞ্চিত বাক্যটি একশ্রেণির ধনী ও শিক্ষিত মানুষের নামের পাশে শোভা পাচ্ছে। যদিও তাদের নিজ হাতের কষ্টার্জিত অঢেল ধন-সম্পদের কোনো অভাব নেই। মর্মান্তিক বিষয় হলো, নিজ হাতের কামাই করা এ সম্পদই যেন তাদের সাথে প্রতারণা করে আজ বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে। সংসারে সহায়-সম্পদ সব কিছু ঠিকঠাক থাকলেও তারা সন্তানহারা এতিম মিসকিনের মতো শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বৃদ্ধাশ্রমকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা বা সামাজিক মাধ্যম ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায় যে মানুষ সাধারণত স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় গ্রহণ করে। যারা স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেয় তাদের মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই পরিবার ছাড়া অবহেলিত, ঠিকানাহীন, ভবঘোরে, আশ্রয়হারা। আবার কেউ একাকিত্ব ঘোচাতে বাধ্য হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের দ্বারস্থ হয়। সবচেয়ে বড়ো ট্র্যাজেডি হলো একসময় যাদের মান-সম্মান, যশ-খ্যাতি ছিল আকাশচুম্বী; যাদের দাপটে পাড়া-পড়শি ছিল তটস্থ; ক্ষমতার সর্বোচ্চ সিঁড়িতে আরোহণ করে মানুষের সাথে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল সর্বদা- এ রকম ধরাকে সরা জ্ঞান মনে করা ব্যক্তিরাই আজ অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। অথচ এদের জীবনে কি ছিল না! ক্ষমতার পাশাপাশি ছেলেমেয়ে বউ নিয়ে ছিল এক সোনার সংসার। রঙিন চশমার ভেতরে লুকিয়েছিল পৃথিবীর সকল সুখ। সুখের মোহে নিজের অস্তিত্ব ভুলে তথাকথিত প্রগতিশীল প্রমাণ দিতে নিজের চিন্তা-চেতনা কোনো এক আবর্জনায় বন্ধক রেখে সা-রে-গা-মার তালিম দিতে সন্তানদের পেছনে হাজার হাজার টাকার অপব্যয় আজ নিজেদের গলায় কাঁটা হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের দালান দেখিয়ে দিয়েছে। তাদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত আমলা, চাকরিজীবী, নামিদামি বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, অভিনেতাসহ অনেকের আবাসস্থল এই বৃদ্ধাশ্রমে হলেও দেখা যায় না সহজ-সরল সাদা সফেদ পাজামা-পানজাবি পরিহিত কোনো ধর্মীয় আলেমকে। অথচ জীবনভর ঐসব তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্র লোকেরাই তাদের ধর্মান্ধ ব্যাকডেটেড বা সেকেলের বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে দেখা যেত। আবার সমাজের একেবারে দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর অক্ষর জ্ঞানহীন কৃষক, শ্রমিক জেলে- এদের কারো নাম বৃদ্ধাশ্রমের খাতায় না দেখে কেমন যেন মাথায় খটকা লাগে। বিভিন্ন প্রকার প্রশ্ন ভনভন করে মস্তিষ্কে। জানতে খুব ইচ্ছে হয় আসলে বাংলাদেশের বৃদ্ধশ্রমগুলো কাদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে? সুবিধাবঞ্চিত মানুষ-ই-বা কারা? কি-ই-বা তাদের পরিচয়? উত্তরগুলো খুব যে কঠিন, তা নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এই সহজ উত্তর সহজে দেওয়া কঠিন, কারণ এই সুবিধাবঞ্চিত মানষগুলোই যদি হয় এক সময়ের প্রতাবশালী তথাকথিত চেতনাধারী কোনো অধ্যাপক, উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তা, ডাক্তার বা কোনো ইঞ্জিনিয়ার। আল্লাহ আমাদের অহংকার মুক্ত করো। আর সকল ধরনের পাপাচার থেকে আমাদের বাঁচাও। কারণ কথায় বলে- যে যাহা করো-রে বান্ধা আপনার লাগিয়া’।
ধর্মহীন শিক্ষা, আমাদের পরিবার ও বৃদ্ধাশ্রম
বিচিত্র এই পৃথিবীর বিস্ময়কর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মাখলুকাত মানুষ। মানুষকে আল্লাহ মেধা বুদ্ধি আর জ্ঞান দিয়ে তাঁর সকল সৃষ্টির সেরা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তাই মানুষই হলো এই সুন্দর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। সেই আদিকাল থেকে মানুষই ধাপে ধাপে রাষ্ট্র, সমাজ-পরিবার গঠন করে পৃথিবীর আলো বাতাসকে বসবাসের উপযোগী করে তুলেছে। দাদা-দাদি, মা-বাবা, ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন নিয়ে পারিবারিক বন্ধন, আর পাড়া-পড়শি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সামাজিক বন্ধনের যে সংস্কৃতি তা একমাত্র মানুষই তিল তিল করে গড়ে তোলে। পবিত্র কুরআনের শ্বাশত বাণী ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক’ এই বাণীর নির্দেশ অনুসরণ করে জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করে মানুষ একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজব্যবস্থা উপহার দিতে সক্ষম হয়। তবে দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, বর্তমানে সে ধারাবাহিকতা আর তেমন একটা নেই। মডার্ন হতে গিয়ে আজকাল মানুষ নামের কিছু নাস্তিক ধর্মশিক্ষাকে আফিম মনে করে শুধু জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে গোটা মানবসভ্যতাক ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করে দিয়েছে। তাদের প্রতারণায় কিছু মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে তার ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা ও বিবেক বিসর্জন দিয়ে সেই জাহেলি যুগের সমাজ ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে দ্রুত অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এই অন্ধকারের একটি উল্লেখযোগ্য অভিশাপ হলো আজকের এই বৃদ্ধশ্রম। যে মানবতাবোধ ও দরদ নিয়ে অসহায়, গরিব বৃদ্ধদের প্রতি করুণার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি তৈরি করা হয়েছিল তা আজ কিছু ধনাঢ্য উচ্চ শিক্ষিত মা-বাবার চোখের পানি আর করুণ আর্তনাদে তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার মুখোশ উন্মোচিত করে দিয়েছে। যে মা-বাবা নিজেদের আরাম-আয়েশকে হারাম করে শুধু তার সন্তানদের মানুষ করার উদ্দেশ্যে জীবনের উল্লেখযোগ্য একটা সময় ব্যয় করেছেন, সেই সন্তান যখন তাদের সাথে রুক্ষ আচরণ ও অপমান করে, তখন সে মা-বাবার দুনিয়াতে বেঁচে থাকার সকল সাধ বিষাদে পরিণত হয়। মুহূর্তে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সন্তানের নিষ্পাপ সময়ের সেই ছোট্ট মুখখানি! আহারে! এইতো সেই দিন। খোকার সামান্য অসুখে কত পেরেশান থাকতাম, তার হাসিমাখা মুখ দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে দিগি¦দিক ছুটতাম, কত রাত না ঘুমিয়ে অসুস্থ খোকার শিয়রে নির্ঘুম ঠায় বসে থাকতাম। ডাক্তার, কবিরাজের পেছনে ধরনা দিতে দিতে নিজের সহায়-সম্পদ বিক্রি করে কাঙাল হলাম। আজ কি না, সেই খোকা আমাদের হাতে বৃদ্ধাশ্রমের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে পৃথিবীর নিকৃষ্ট এক প্রাণীতে পরিণত করলো। ধিক্কার জীবন! ধিক্কার দেই নিজেকে। আজ যদি কুরআন-হাদিসের শিক্ষা দিয়ে সন্তানদের বড়ো করতাম তাহলে এমন পরিণতির জন্য প্রস্তুত হতাম না। আজকের এই কঠিন সময়ে বারবার মনে হচ্ছে রাসূলে করিম (সা)-এর সেই অমর বাণী, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞানদান করো, কেননা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (মুসলিম)
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) বলেন, সন্তানের জীবন চলার গতিপথ নির্ণয় করেন তার পিতা-মাতা। তাদের আচরণ-উচ্চারণ ও শিক্ষা-দীক্ষা সন্তানকে সুপথে পরিচালিত করে। অথবা বিপথে ধাবিত করে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করিম (সা) বলেন, ‘প্রত্যেক নবজাতক সুস্থ প্রকৃতি, সুবোধ ও সত্য গ্রহণের যোগ্যতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু পরবর্তীতে তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি, অগ্নিপূজক ও খ্রিষ্টানে পরিণত করে।’ (বুখারী ও মুসলিম)
মনে পড়ে পবিত্র কুরআনের চিরন্তন সত্য বাণী, ‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া আর কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনো একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদের উফ্ (পর্যন্ত) বলো না এবং তাদের ধমক দিও না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো। এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো। দোয়া করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।” (বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৩-২৪)
এছাড়া সূরা লুকমানের ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেন এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার (আল্লাহর) প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে।”
সূরা আহকাফের ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “আর আমি (আল্লাহ) মানবজাতিকে নির্দেশ দিয়েছি তারা যেন তাদের পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করে; তার মা তাকে অতিকষ্টে গর্ভে ধারণ করেছেন ও অতিকষ্টে প্রসব করেছেন এবং লালন-পালন করেছেন।”
আহ এমন সদুপদেশ এবং দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য আর কী হতে পারে? যদি কুরআন-হাদিসের এই শিক্ষা দিয়ে সন্তানদের শিক্ষিত করতাম তা হলে আমাকে আজকের এমন কঠিন পরিণতির বোঝা বহন করতে হতো না। আজ নিজে নিজেকে আত্মহনন করে বয়সের শেষ ভাটিতে এসে ষোলোআনাই শিক্ষা হলো। শিক্ষা দুই প্রকার। একটা সুশিক্ষা আরেকটা কুশিক্ষা। সুশিক্ষা একজন মা-বাবাকে আলোকিত ভবিষ্যৎ উপহার দেয় আর কুশিক্ষা একজন মা-বাবাকে জাহান্নামের যন্ত্রণা ও নিখুঁত অন্ধকারের জীবন ভোগ করতে বাধ্য করে। যার বাস্তব এক জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের এই বৃদ্ধাশ্রম। পরিশেষে বলাই যায়- কুরআন ও হাদিসের শিক্ষা ব্যতীত অনৈতিক কুশিক্ষাই হলো বৃদ্ধাশ্রমের মূল নিয়ামক।
আরও পড়ুন...