মধুমাস জ্যৈষ্ঠ
প্রচ্ছদ রচনা মঈনুল হক চৌধুরী মে ২০২৪
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে জ্যৈষ্ঠ মাস আসে একটু ভিন্ন আবেশ নিয়ে। জ্যৈষ্ঠ প্রকৃতিকে যেমন নাড়া দেয় ভিন্নভাবে, তেমনি জনজীবনে দেখা দেয় এর বিচিত্র প্রভাব। সারা বিশ্বব্যাপী এখন জলবায়ুতে যেখানে অনেক পরিবর্তন, সেখানে আমাদের এই ষড়ঋতুর এই দেশে জলবায়ুতে পরিবর্তন খুবই স্পষ্ট। তবে ঋতু চক্রের পরিক্রমায় ঋতু পরিবর্তিত হচ্ছে তার আপন গতিতে। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস মিলে আমাদের দেশে গ্রীষ্মকাল। একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, প্রকৃতির মাঝে জ্যৈষ্ঠের আড়ালে থাকে কড়া রোদের মাতামাতি। জ্যৈষ্ঠ মাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো, এ সময় দিন বড়ো হয়, প্রকৃতিতে থাকে তাপদাহের তাণ্ডব, শরীরে জ্বালা দিয়ে ঘাম ঝরা দিন, খালবিল, ছোটো নদী শুকিয়ে পানি শূন্য হয়। ফলে জ্যৈষ্ঠ গ্রাম বাংলার মাঝে আনে অন্য রকম ছন্দ। তাই বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাস হলো সকালে সূর্য ওঠার সাথে সাথে আকাশ ঝরানো তাপের দাহ প্রখর আলো জ্বালায় রুদ্রমুখী ধরণি, শুষ্কতায় মাঠ ঘাট ফেটে চৌচির, ফসলের শ্যামল ধরণিতে যেন শ্যামলতাহীন রুক্ষ মরুর পরিবেশ। জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা রোদে গ্রীষ্মের পদধ্বনি যেন প্রখর তীব্র বেগে ছুটে চলা ঘোড়া। চৈত্রে ও বৈশাখে তাপদাহ যতটুকু তার চেয়ে জ্যৈষ্ঠ সেই তীব্রতাকে আরও বৃদ্ধি করে। সূর্যের প্রখর তাপে সমস্ত প্রকৃতি ঝিমিয়ে পড়ে। সেই সাথে গাছের সবুজ পাতাও তাপে ঝিমিয়ে পড়ে। জগতের সকল ক্লান্তি যেন তাদের মাঝেও। এ সময় হঠাৎ ঘূর্ণি বাতাসে ধূলিতে ঢাকা পড়ে ঝকঝকে প্রকৃতি, ঝরে পড়ে গাছের সবুজ পাতা। আকাশে ইচ্ছেমতো পাখা মেলে চিল যেন মেঘ বৃষ্টিকে নিমন্ত্রণ জানায়। গাছের পাতায় পাতায় লুকিয়ে থেকে নানান পাখিরা মনের আনন্দে নিজের সুরে গান গেয়ে যায়। উল্লেখ্য, জ্যৈষ্ঠের দুপুর গ্রামজীবনে নিয়ে আসে বিশ্রামের সুযোগ। কেউ কেউ নির্জন দুপুরে দিবানিদ্রায় ঢলে পড়ে। গৃহিণীরা সংসারের কাজের একটু অবসরে বিশ্রামের সুযোগ খোঁজে। তালপাখার বাতাসে একটু প্রাণ জুড়ায়। শীতল পাটিতে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। আম বাগানের দুষ্টু ছেলেদের আনাগোনা বেড়ে যায় তখন। ক্লান্তি ও শ্রান্তি ঘিরে ধরে কর্মচঞ্চল জীবনপ্রবাহকে।
জ্যৈষ্ঠের শান্ত দুপুর মনে করিয়ে দেয় পৃথিবীর সাথে মানুষের জন্ম-জন্মন্তরের সম্পর্কের কথা। অন্য এক উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায় মানুষকে।
জ্যৈষ্ঠের দুপুরের প্রখর তাপ প্রকৃতি ও জনজীবনের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এই প্রভাব শুধু বাইরের নয়, মনের ভেতরেরও। রহস্যময় প্রকৃতির এ যেন এক গোপন আয়োজন। জ্যৈষ্ঠের তপ্ত আকাশে একসময় দেখা যায় সজল কাজল মেঘ। নেমে আসে স্বস্তির বৃষ্টি। জ্যৈষ্ঠের দুপুরের ঝিমধরা প্রকৃতি আর নিশ্চল স্থবির জনজীবন, শস্যহীন মাঠ, নদীর ঘাটে বাঁকা নৌকা, রোদ ঝলসানো তপ্ত বাতাসের এই পরিচিত দৃশ্যের কথা এ সময় ভুলে যায় মানুষ।
সারা বিশ্বব্যাপী জলবায়ুতে অনেক পরিবর্তন এলেও প্রকৃতির নিয়মে চলে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাস। জ্যৈষ্ঠ মাস অর্থই মধু মাস।
প্রকৃতি যখন খরার কবলে, দেহ যখন শুষ্ক তৃষ্ণিত তখন মনে প্রশান্তি মিলাতে নানান রসালো সুস্বাদু ফলের অধিক সরবরাহ আর এই কারণেই এই তীব্র তাপদাহের মাসটি মধুমাস নামেই পরিচিত। বছরজুড়ে কমবেশি নানান ফল পাওয়া গেলেও সবচেয়ে বেশি ফল পাওয়া যায় এ জ্যৈষ্ঠ মাসে। নানান রং বাহারি ফলের মৌ মৌ গন্ধে ভরিয়ে তোলে চারপাশ। ষড়ঋতুর এদেশে যখন কড়া রোদে মানুষ তথা প্রাণিকুল জ্যৈষ্ঠে তৃষ্ণার্থ তখন মানুষ পিপাসা মেটায় বিভিন্ন প্রজাতির রসালো ফল দিয়ে। জ্যৈষ্ঠ দাবদাহের মাঝে তৃষ্ণার্থ প্রাণকে শীতলতার পরশ বুলিয়ে দিতে গ্রীষ্ম ঋতুর শেষ মাস জ্যৈষ্ঠে আমের দেখা মেলে। প্রাচুর্য নিয়ে যেন প্রিয় ফল আম আসে, যেন ফুরাবার নয়। সেই সাথে তরমুজ, বাঙ্গিতে বাগান, উঠান বাজার হাট পরিপূর্ণ হয়। সেই তালিকায় যোগ হয় জাতীয় ফল কাঁঠাল, আনারস, লিচু, কালো জাম, আমলকী, আতা, করমচা, জামরুল, বেল, ইত্যাদি ফল। যত ফলই পাওয়া যাক না কেন এই জ্যৈষ্ঠে এক এক ফলের এক রকমের স্বাদ। কোনোটা টক, কোনোটা তিতা, কোনোটা নোনতা, কিংবা পানসে যাই হোক না কেন তবে রসালো ফলের মধ্যে মিষ্টির আধিক্যই বেশি। এ ফলকে কেন্দ্র করে গ্রামাঞ্চলে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ থাকে। কেউ কেউ নিজের গাছের বিভিন্ন ফল নিয়ে বেড়াতে যান আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। পাশাপাশি শহরেও ফল উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ সময় নতুন নতুন ব্যবসায়ীর আগমন ঘটে। অস্থায়ী তাঁবু করেও বিক্রি হয় ফল। অনলাইনেও জমে ওঠে ফলের বেচাকেনা। আম-লিচুর জন্য বিখ্যাত অঞ্চলগুলোতেও জমে ওঠে অস্থায়ী ব্যবসা। মৌসুমি ফলের ব্যবসা করতে দেখা যায় অন্য পেশার মানুষকেও। কারণ ফল পেকে গেলে তা আর বেশি দিন ঘরে রাখা যায় না। অন্য ফসলের পাশাপাশি দেশীয় ফলের চাষ করেন অনেক কৃষক। এ থেকে বাড়তি আয়ও করেন। অল্প সময়ের মধ্যে ফলের মৌসুম শেষ হয়ে যায় বলে অনেকেই ফল ব্যবসাকে পার্টটাইম কাজ হিসেবে নিয়েও লাভবান হন। এ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ফল বিক্রি করতে দেখা যায় বিভিন্ন পেশার মানুষকে। অনেক সবজি বিক্রেতাকেও এ মৌসুমে ফল বিক্রি করতে দেখা যায়। এ সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যালয়ে ফল উৎসবের আয়োজন করে।
বাজার থেকে হরেক রকম ফল কিনে সহকর্মীদের নিয়ে এ উৎসব পালন করা হয়। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনও ফল উৎসব পালন করে। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও ফল উৎসবের আয়োজন করা হয়। উল্লেখ্য, জ্যৈষ্ঠের শেষ ভাগে যদি কেউ জ্যৈষ্ঠের প্রকৃতির ভিন্ন সৌন্দর্য উপভোগ করতে চায় তাহলে আরেকটু নিবিড়ভাবে চোখ রাখতে হয় গাছে গাছে। জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড দাবদাহে জীবন যখন ওষ্ঠাগত, খাঁ খাঁ রোদ্দুরে চারদিক যখন উত্তপ্ত, ঠিক তখন এক ঝলক নির্মল আনন্দ নিয়ে সবচেয়ে চটকদার রঙের যে ফুলটি অনেক দূর থেকে আমাদের নজর কাড়ে তার নাম কৃষ্ণচূড়া।
কৃষ্ণচূড়া আমাদের এতই আপন ও পরিচিত যে তাকে নতুন করে আর কাউকে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। চারিদিকে যখন জারুল, সোনালু, কাঠগোলাপ, লালসোনাইল ইত্যাদি নানান ফুলের সমারোহ ঠিক তখন অন্যান্য দৃষ্টিনন্দন ফুলের ভিড়ে প্রকৃতিতে টুকটুকে লাল রঙের শূন্যতা পূরণ করতেই যেন আসে কৃষ্ণচূড়া। এত রং বোধ হয় আর অন্য কোনো ফুলে নেই। মাঝারি উচ্চতার চিরল চিরল পাতার এই গাছটি আমাদের খুবই চেনা। পাঁচ পাপড়ির মধ্যে একটি একটু বড়ো ও তাতে হলুদ বা সাদা দাগ থাকে। তবে টকটকে লাল রক্তবর্ণ কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে মাঝে মাঝে কমলা রঙের কৃষ্ণচূড়াও দেখতে পাওয়া যায়। বাংলা বৈশাখ আর ইংরেজি এপ্রিল মাসে কৃষ্ণচূড়া ফুটতে শুরু করে। ফোটে জুন পর্যন্ত। গাছজুড়ে এতই ফুল ফুটে যে লাল ও কমলা রঙের ফুলে যখন চারপাশ রঙিন হয়ে ওঠে তখন সেটা অনেক দূর থেকেই সবাইকে আকৃষ্ট করে। আমাদের অতিপ্রিয় গন্ধহীন এই ফুলের আদি নিবাস পূর্ব আফ্রিকার মাদাগাস্কার।
কৃষ্ণচূড়ার সমগোত্রীয় জ্যৈষ্ঠের আরেকটি সুদর্শন ফুলের নাম রাধাচূড়া। কৃষ্ণচূড়ার পাশাপাশি এই ফুলের সৌন্দর্যও সবাইকে মোহিত করে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আগত এই ফুলের গাছ, পাতা ও ফুলের গড়ন কৃষ্ণচূড়ার কাছাকাছি, পার্থক্য শুধু রঙে। লাল ও হলুদ রঙের কমনীয় এই ফুলগাছ শীতকালে পাতাশূন্য হয়ে পড়ে। বসন্তের মাঝামাঝি আবার গাছটিতে নতুন পাতা গজায়। ফুল ফোটে গ্রীষ্মের শুরুতে এবং প্রায় সারা বছরই দেখতে পাওয়া যায়। সবুজ পাতাভরা গাছের বড়ো বড়ো খাড়া মঞ্জরিতে থোকা থোকা হলুদ ফুলে থাকে কড়া সুগন্ধ। রাধাচূড়ার গাছে বর্ষার শেষে ছোটো ছোটো চ্যাপ্টা, তামাটে রঙের ফল আসে। এর শোভাও অত্যন্ত মনোহর। কৃষ্ণচূড়া ও রাধাচূড়া নামের সাথে মিল রেখে জ্যৈষ্ঠের আরেকটি নান্দনিক ফুলের নাম কনকচূড়া। এটিও আমাদের দেশের নিজস্ব গাছ নয়। এটি শ্রীলঙ্কা, আন্দামান, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এসব এলাকার প্রজাতি। বৈজ্ঞানিক নাম peltophorum pterocarpum. আমাদের নিসর্গীরা নামকরণ করেছেন কনকচূড়া। গাছ মোটামুটি কুড়ি মিটারের মতো লম্বা হতে পারে। চারপাশে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দিয়ে বেড়ে ওঠে। পাতা যৌগিক। গাছ, পাতার আকৃতি কৃষ্ণচূড়া গাছের মতোই। তবে ফুল উজ্জ্বল কমলারঙের হলেও দূর থেকে হলুদ দেখায়। কনকচূড়ারও শীতের শেষভাগে পাতা ঝরে যায়। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠে নতুন কচি পাতা আর ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ফুলে পাপড়ির সংখ্যা পাঁচটি, পাপড়িগুলো কুঞ্চিত। ফুল ফোটে শাখার ডগার লম্বা মঞ্জরিতে। অজস্র প্রস্ফুটনের ফলে দূর থেকে সবুজের ওপর স্বর্ণালির প্রলেপের মতো দ্যুতিময় দেখায়। ফুল সুরভিময়।
কনকচূড়ার ফল শিমের মতো। দুই থেকে ছয় সেন্টিমিটার লম্বা, রং তামাটে। জ্যৈষ্ঠের তাপদাহের আবহাওয়া একসময় বলে দেয় তপ্ত ধরাকে শীতল করতে প্রাণের বর্ষা আসছে আর বর্ষার আগমনে কৃষক জেলে শুরু করে দেয় জীবন গানের সূচনা পর্ব আর প্রস্তুতি নিতে থাকে জ্যৈষ্ঠের বিদায়ের। রোদ-ছায়া এই বৃষ্টি এই রোদ্দুরের এমনি এক মনোরম আবহাওয়ায় জ্যৈষ্ঠকে যেন আমরা পাই একেবারে প্রাণের মধ্যখানে। কোথাও হারিয়ে গিয়ে শান্তি প্রশান্তির মধ্যখানে। গ্রীষ্ম ঋতুতে জ্যৈষ্ঠ যেমনই হোক আমাদের হৃদয় পটে আঁকা থাকে। জ্যৈষ্ঠ মাস সেই আমাদের চিরচেনা প্রাণের জানা বিশাল নীল আকাশে তীব্র রোদের দাপট, সন্ধ্যা নামলে গুমোট গরমের পাশাপাশি দমকা বাতাসের ছোঁয়ায় একটি মনোরম পরশ। তাই যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলাদেশের ঐতিহ্য থাকবে, ততদিন বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাস অন্যরকম অনুভব নিয়ে উপস্থিত হবে আমাদের আবহমান গ্রামবাংলার সবুজ শ্যামল প্রকৃতিতে।
আরও পড়ুন...