মাছ বেলুন

মাছ বেলুন

গল্প মনির বেলাল এপ্রিল ২০২৫

এদিকের ভ্যান ট্রাফিক মোড়ের ওপারে যায় না। তাই ভ্যানভাড়া বুঝিয়ে দিয়ে এখন তারা হাঁটা ধরেছে। কারো ছায়া হেলছে না কোনোদিকে। গতকাল তবুও একটু বাতাস ছিল। আরামে ছিল মানুষ। আজ যেমনি রোদ, তেমনি গরম। দু’জন যেন দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ভ্যানে আসতে আসতে একজন বলল, ‘এখন ৪০ ডিগ্রি। ২ টার সময় আরো এক ডিগ্রি বাড়বে।’

তবু বাজার বসেছে। ঢলের পানির মতো গ্রাম ছেড়ে বাজারের দিকে আসছে মানুষ। নারী-পুরুষ, বাচ্চাকাচ্চা পরিবারের সবাই- একসাথে। সবাই নিজেরটা নিজে পছন্দ করে নিতে চায়। আগের মতোন পা-ভ্যান হলে- ভ্যানওয়ালাদের ইনকাম যাইহোক- অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। এই চার্জার ভ্যান উঠে সুবিধা হয়েছে, সবারই।

মোক্তার নিজে সিয়ামের হাতটা ধরে আছে। তবে সিজান মুক্ত। ছোট হলেও সিজান কথা শোনে, বোঝে সবকিছু। কিন্তু সিয়ামটা কিচ্ছু বোঝে না। তাকে সামলানোও কঠিন। রোজা উনত্রিশটা হলে আর দু’দিন! রোজা উনত্রিশ, না তিরিশটা... এ নিয়ে মানুষের গবেষণার শেষ নেই। হাটে-বাজারে, মসজিদেও এই আলোচনা।

কুরবানির ঈদে মানুষের এত ভিড় হয় না। তখন কলেজ মাঠে বসে গরুর হাট। গরুর হাটে মেয়েরা এখনো যেতে শুরু করেনি। কিন্তু এ বাজারে আবার পুরুষ নেই। চারদিকে দেখে নিজেকে একা মনে হলো মোক্তারের, সে মাথাটা নিচু করলো।

গেল বছর গরুর হাটে আসার জন্য জেদ ধরেছিল সিয়াম। কিন্তু মোক্তার নিয়ে আসেনি। তার বুদ্ধিসুদ্ধি একটু কম। রাস্তায় ছোট-বড়ো-মাঝারি, চকচকে-ঝকঝকে, ভাঙাচোরা সব রকমের গাড়ির চাপ। কসাইয়ের হাত থেকে ছোটা গরুর মতোন ছুটছে গাড়িগুলো। গরুর মতোন এ গাড়িগুলোও হয়তো কোথাও বাঁধা ছিল। এ মুহূর্তে রাস্তা পার হওয়া ভীষণ কঠিন। কিন্তু গার্মেন্টসের দোকানগুলো সবই রাস্তার ওপারে।

জনতা ব্যাংকের নিচতলায় তিনটা কাপড়ের দোকান, বাকি দুটা জুতা-স্যান্ডেলের। দোকানের ভেতরে খদ্দেরের জায়গা হয়নি। বাইরে অপেক্ষায় আছে অনেকে। রাস্তার পাশের ছোট্ট ছাতিমগাছটা আর ক’জনকে আশ্রয় দেবে? সিয়ামের মা বলল, ‘এখিনে দেখি!’

খেঁকিয়ে উঠে মোক্তার বলল, ‘পহেলা দিন বাজারে আসিছিস তো তাই, বুঝতে পারছিসনি। এগিন বড়োলোকের মার্কেট, এহিনে কুনু জিনিস হাতে ধরার উপায় আছে? একিই জিনিস- ঐ নিচের চায়ে একশো-দেড়শো ট্যাকা দাম বেশি। পা টান করি হাঁট।’

সিয়ামের বাবা এতখানি বুঝের লোক? এতদিন একসাথে সংসার করছে সে বুঝতেই পারেনি। লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গেল সিয়ামের মা। ভক্তিভরা চোরাচোখে একবার সে তাকাল সিয়ামের বাবার মুখপানে। সে আজ খুব খুশি। সিয়ামের বাবা কোনোদিন তাকে স্কুল মোড়েও নিয়ে যায়নি। যা এনে দিয়েছে, তাই তাকে পরতে হয়েছে।

ধানহাটার কাছে যেতেই বাবার হাত টেনে ধরে সিয়াম বলল, ‘আব্বা আমি মাছ বেলুন লিব। দেখো কত বেলুন! মাছ, মুরগি, বাঘ, সিংহ, মুটু-পাতলু- একটা লিব আব্বা। খালি একটা।’ সিজান কোনো ব্যাপারেই খুব একটা জেদ করে না। তবে সেও বলে উঠল, ‘আমি কিন্তু মুটু-পাতলু নিব। আমি মুটুকে চাই। মুটু অর পাতলু ক্যা জোড়ি...!’

সান্টু মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়ে সিজান এবং তার ঢঙেই কথা বলে। যে কারণে বাড়িতে সবাই তাকে ‘বিলাতি সাব’ বলে ডাকে। সিয়াম-সিজানের দুজনকেই ধমক দিলো মোক্তার, ‘আরে না, এই বেলুন লিতে হবে না। লোক ঠকানোর বুদ্ধি বানাছে। মাথাতে সব গোবর পুরা, খাওয়ার জিনিস কী খাবি চল। কিনি দিছি। কিছু খালে, তাও গায়ে লাগবে... বেকুব সগ’- এ কথা বলেই সে সিয়ামের হাত ধরে টান দিলো।

সিয়ামের মাথায় চক্কর লাগলো। লম্বা-পাতলা, ফর্সা কিন্তু সিয়ামের স্বভাবটা খিটমিটে। ধুলো-বালি-কালি-আম-কাঁঠাল-জিগার আঠা নিয়েই থাকে। সিয়ামের বয়স আন্দাজ করা যায় তবে তা তার মায়ের হিসাবের সাথে মিলবে না। তার মায়ের দাবি, ‘গেল জষ্টি মাসে ন’বছর পার হলো। তবে এ নিয়ে পাড়ার কেউ সিয়ামের মায়ের সাথে তর্কে জড়ায় না।

দিন গেলেই গার্মেন্টসের দোকানগুলো চালহাটার ভেতরে ঢুকে আসছে। মোক্তারের গ্রামের একজন এ বাজারে গার্মেন্টের দোকান দিয়েছে। তারা তার কাছে গেল। সিয়াম-সিজানের পছন্দ মতো শার্ট-প্যান্ট কিনল। তার মায়ের জন্যও শাড়ি কিনল একটা। চামড়ার স্যান্ডেলও নিল সবার জন্য। সবাই অনেক খুশি। পাড়ার মেয়েদের কাছে মান থাকল সিয়ামের মায়ের। মনে মনে সে ভাবল, ‘দোকানের এ ব্যাগগুলো সহজে নষ্ট করা যাবে!’

মোক্তার নিজের জন্য কিনল একটা লুঙ্গি। নতুন একটা লুঙ্গি ছাড়া চলে না। ঈদের নামাজে, শ্বশুর বাড়ি, বোন-ভগ্নিপতির বাড়িতে যাওয়া লাগে। বাবা-মা দু’জনেই রোজা। কিন্তু সিয়াম-সিজান দু’জনেই ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় ছটফট করছে। মোক্তার তাদের নারায়ণ পালের হোটেলে নিয়ে গেল। হোটেলে সিয়াম খেল তিনটা সাদা মিষ্টি আর এককাপ দই। আর সিজান খেল শুধু এককাপ দই। 

গ্রামের ভ্যান পেতে হলে তাদের আবারো ঐ ট্রাফিক মোড়ে যেতে হবে। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় সিয়ামের মাও ভীষণ ক্লান্ত। পায়ের ধাপ উঠছে না। তবু সে আজ খুব খুশি। ফেরার পথে সিয়াম ফিরে আবারো দেখল, ঐ লোকটা বেলুন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কতজন কিনছে। অথচ তার বাবা ধমকের জোরে তাদের কথাটা উড়িয়ে দিলো। ঐ বেলুন বিক্রেতার পাশ দিয়ে তারা ফিরে এলো কিন্তু দু’জনের কেউই আর বেলুনের দাবি তুলল না।

বাড়ি ফিরে সিয়াম বড়ো একটা পলিথিনকে ফুঁ-দিয়ে ফুলিয়ে নিলো। সুতা বেঁধে উড়িয়ে দিলো আকাশের দিকে। কিন্তু পলিথিনটা উড়ছে না। পড়ে যাচ্ছে। সিয়াম মনে মনে ভাবলো, ‘ঈদের দিন সকালে সে শার্ট-প্যান্ট-স্যান্ডেল কিচ্ছু পরবে না!’

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ