মাহিনের বদলে যাওয়া
গল্প নূর আঙ্গেজ অক্টোবর ২০২৪
মাঠ জুড়ে বল খেলার হইচই। দুই পক্ষই খুব উত্তেজিত। শহরে তো আর এ-পড়া ও-পাড়া নেই। তাই উত্তর দক্ষিণ ফ্ল্যাট থেকে আছে মাহিন, পলাশ, আরাফাত আর তুহিন। বাকি কয়েকজন অন্যান্য ফ্ল্যাটের। এগারো জনের টিম না হলেও ওরা কয়েকজন মিলে বেশ খেলার টিম বানিয়েছে। খেলা চলছে তো চলছেই। উত্তেজিত সবার চোখ বলের দিকে। এই বুঝি গোল হলো। কিন্তু না বল পাশ কাটিয়ে গেল মাহিনের দিকে। এবার মাহিনকে আর ঠেকায় কে? খুব জোরে বলে কিক করতেই বল মাঠের বাইরে চলে গেল। মাঠের বাইরে হলেও ঠিক ছিল। কিন্তু সেই বল পড়লো কিনা ফারুক সাহেবের গায়ে। আর যায় কোথায়। গোল করতে না পারায় এমনিতেই মাহিনের মেজাজ খারাপ ছিল। উলটো কথা শুনতে হলো মাহিনকেই।
- খেলার সময় হুঁশ কোথায় থাকে? দিলে তো পাঞ্জাবিটা নষ্ট করে।
- আঙ্কেল, আপনিও তো দেখে চলতে পারতেন। দেখছেন আমরা এখানে খেলছি।
- দেখো ছেলে, এটা রাস্তা। মানুষ হাঁটাচলা করবেই। খেলার সময় খেয়াল করা দরকার ছিল তোমাদের। যেন তোমাদের কারণে কেউ পথ চলতে গিয়ে অসুবিধে না হয়। স্কুলে পড়াশোনা করার সাথে সাথে আদব কায়দাটাও শিখে নিও।
আর খেলায় মন বসে না মাহিনের। খেলার সাথীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বাসায় ফেরে। আজ সন্ধ্যাটাই যেন অন্যরকম। বেখেয়ালি। মা দুধের গ্লাস এগিয়ে বলেন- ব্রেডে মাখন লাগানো আছে। খেয়ে নিও। চুপচাপ মাহিন দুধের গ্লাস শেষ করে। সাথে ব্রেড খেতেও ভোলে না।
অন্য সময় হলে মায়ের সাথে একটু কথা কাটাকাটি হতোই। এটা যেন নিত্য দিনের রুটিন।
খোলা বইয়ের পাতায় চোখ রেখেও পড়ায় মন বসে না মাহিনের। বারবার কেবল ফারুক আঙ্কেলের কথাটাই মনে ঘণ্টা বাজায়। পড়ালেখার সাথে সাথে আদব কায়দাটাও শিখে নিও।
এতদিন এসব কথা গায়েও মাখেনি মাহিন। মনে হয়েছে বড়োরা তো ছোটদের শাসন করবে, হুকুম করবে এটাই স্বাভাবিক। আজ যেন ফারুক আঙ্কেলের কথাটা খুব খারাপ লাগলো। আর কয়েকদিন পরেই তো মাহিন ক্লাস নাইনের ছাত্র হবে। নিজের ভেতর বড়ো হওয়ার বোধের সাথে আত্মসম্মান বোধটাও কি অনুভব হচ্ছে মাহিনের? এসব বোধ এতদিন কোথায় ছিল?
আবারও প্রশ্ন আসে মনে। এইতো কিছুদিন আগে বন্ধুদের সাথে মজা করতে গিয়ে কী কাণ্ডটাই না ঘটালো মাহিন। আহিলের স্কুল ব্যাগ থেকে তার টিফিনের জমিয়ে রাখা টাকাটা শুধুমাত্র মজা করার জন্য নিজের কাছে রেখেছিল। আহিল খুব হিসেবি ছেলে। অযথা এটা-সেটা কিনে টাকা নষ্ট করে না। আর তাই তার করুণ মুখটাই মাহিনের খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
সেটা যে এত দূর গড়াবে ভাবনাতেও আসেনি মাহিনের। একেবারে হেড স্যারের কাছে নালিশ।
ছি! ছি! কী লজ্জাই না পেয়েছিল সেদিন। নিজেকে বাঁচানোর জন্য কতগুলোই না মিথ্যে কথা বলতে হয়েছে। ছবির রিলের মতো আরও কত সব কথা, ঘটনা চোখে ভাসছে। এত সব ভাবনার মাঝে কখন যে রাতের খাবারের সময় হলো বুঝতেই পারেনি। মায়ের ডাকেই নিজের ভেতর ফেরে মাহিন।
- মাহিন, তোর পড়া শেষ হলো? খাবার দেবো টেবিলে? কথা বলতে বলতেই ফিরোজা বেগম মাহিনের কাছে এসে দাঁড়ান। প্রতিদিন চ্যাঁচামেচি করা ছেলেটা যেন আজ কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। কিছু একটা তো হয়েছেই।
মা আবারও বলেন- কিরে ভাত দেবো টেবিলে?
- হ্যাঁ দাও মা।
- কিছু কী হয়েছে তোর? এভাবে চুপ হয়ে আছিস?
- মা, আমি কি খুব বেয়াদব?
- বেয়াদব? এ কথা কেন জানতে চাইছিস? নিশ্চয়ই কোনো কাণ্ড ঘটিয়েছিস?
- কাণ্ড কিছু নয় মা। মাহিন মুখ তুলে চায় মায়ের দিকে।
- আমি তো পালটাইনি মা। এতদিন তো কত কিছুই ঘটেছে। স্কুলে আহিলকে না জানিয়ে তার ব্যাগ থেকে টিফিনের টাকা সরিয়েছি। শুধুমাত্র মজা করার জন্য। স্কুলের হেড স্যার শাসন করলেও এতটা খারাপ লাগেনি। আমি জানি মা। আমার কথায়, আচার-আচরণে অনেকেই কষ্ট পায়। এত সব কিছু আমি কোনোদিনও ভাবিনি। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে আজ। ফারুক আঙ্কেলের কথাই আমাকে বুঝিয়ে দিলো। শুধুমাত্র লেখাপড়া করলেই হয় না। সাথে ব্যবহারও শিখতে হয়।
- এই ছোট্ট কারণে তুই এত গম্ভীর?
- মা, তুমি কত সহজেই বললে এটা ছোট্ট কারণ। নিজেকে আমার খুব অপরাধী মনে হচ্ছে আজ। বন্ধুরা সব আমাকে কী ভাবলো বলো তো।
ফিরোজা বেগম মাহিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন- মাহিন, এই যে তুই তোর ভেতর অপরাধ বোধটা অনুভব করছিস। ভাবছিস নিজেকে নিয়ে। এই বোধটাই তোকে আগামীর পথ দেখাবে। নিজেকে বড়ো ভাবলেই বড়ো হওয়া যায় না। তুই তখনই বড়ো হবি যখন মানুষ বড়ো বলবে। নিজেকে গড়তে হবে। জীবনটা অনেক বড়ো। নৈতিক শিক্ষাটা একটা মানুষের সবচেয়ে জরুরি। বয়স্কদের সম্মান করাটা এ শিক্ষার বাস্তব ব্যবহার।
এবার আসি আহিলের কথায়। এই যে তুই না বলে টাকা সরিয়েছিস। এটাতো চুরিই। একটা কথা মনে রাখবি।
একটা মিথ্যে কথা আরও দশটা মিথ্যের পথ খুলে দেয়। মিথ্যে কথা হলো লতাপাতায় জড়িয়ে থাকার মতো। সহজে ছাড়ানো যায় না।
মাহিন চুপচাপ মায়ের কথাগুলো শুনে যায়। এতদিন ভেবেছিল তর্ক আর গায়ের জোরে জিতলেই বুঝি বড়ো হওয়া যায়। যোগ্যতার কথাটা একবারও মনে আসেনি। মায়ের মুখে শুনে যাওয়া কথাগুলো বারবার মনের ভেতর ঘুরপাক খায়। মাহিন কি শোধরাতে পারবে?
এই প্রথম মাহিন অনেকটা সময় নির্ঘুম কাটায়। পরীক্ষার সময়ও আর বেশিদিন নেই। পড়ায় মন না বসালে রেজাল্ট ভালো হবে না।
রোববার স্কুলে গিয়ে প্রথমই আহিলের সাথে দেখা করবে। আহিলকে স্যরি না বলা পর্যন্ত মাহিন কিছুতেই মনে শান্তি পাবে না।
আরও পড়ুন...