মিছে আর সত্যির চমক ভেলকি

মিছে আর সত্যির চমক ভেলকি

গল্প আতা সরকার মার্চ ২০২৫

রমরমা জমজমাট বাজার। এখানে তরি-তরকারি মাছ-মাংস বাসন-কোসন পাওয়া যায় না। এই আজব বাজারে বেচা-কেনা হয় মানুষ। এরা ক্রীতদাস। রাজা-রাজড়া উজির-নাজির অভিজাত ধনবানদের বাড়িতে এরা আমৃত্যু গোলামি করে কাটায়। এই গল্পের সময়কাল সেই কালের।

এমন একজন ক্রীতদাস কাফুর। সে একসময় উচ্ছল উদ্দাম মুক্ত বালক ছিল। বয়স তার মাত্র আট বছর। সেই বয়সকালেই একদিন মগ দস্যুরা তাদের গাঁয়ে হানা দেয়। লুটপাট করে। ডাকাতি করে। গ্রাম থেকে ফিরে যাওয়ার সময় তারা অনেক শক্ত-সমর্থ পুরুষ, সুন্দরী মেয়ে আর উঠতি বয়সের বালক কিশোরদের ধরে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে আট বছরের কাফুরও ছিল। তাদের বেচার জন্য আরাকানের এক হাটে তোলা হয়। হাট থেকেই আরাকান-রাজের এক পারিষদ কাফুরকে কিনে নেয়।

কাফুর সেই আট বছর বয়স থেকেই মানুষের হাতে হাতে ঘুরে ফিরছে। ক্রীতদাস হিসেবে সে কর্মঠ, বিশ্বস্ত, সত্যবাদী ও সৎ। সে যখন যার ঘরে গিয়েছে, সেই মালিকই তাকে পছন্দ করেছে। সে তারই ডান হাত হয়ে উঠেছে। 

কিন্তু এত সব সত্ত্বেও এক বছর পুরো হতে না হতেই মালিক তাকে অন্য মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। এর কারণ একটাই, সে বছরে একবারই মিথ্যা কথা বলে। এই মিথ্যা এমন ভয়াবহ যে তা সহ্য করার শক্তি কোনো মালিকেরই হয় না। তারা তাকে বিক্রি করে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

যখন তাকে মানুষ কেনা-বেচার হাটে তোলা হয়, তখন হাটের দালালরা তার গুণপনার লম্বা ফিরিস্তি দেয়। এতে তার বাজার-দর চড়চড় করে উঠে যেতে থাকে। ঠিক এই সময়েই কাফুর জানিয়ে দেয় যে সে বছরে একবারই মিথ্যা কথা বলবে। এই মিথ্যা কথা না বলে সে থাকতে পারে না। এজন্য কোনো ধকল যদি হয়, তা মালিককেই সইতে হবে। তার পূর্বতন মালিকরাও এই কথার স্বীকৃতি দেয় এবং জানায়, মিথ্যাটা এতই ভয়াবহ যে এর ধাক্কা সহ্য করার শক্তি তাদের থাকে না। 

এমন একটি তথ্য জানার পরই তার দাম নামতে থাকে এবং তার মতো সুঠামদেহী পরিশ্রমী ক্রীতদাস খুবই সস্তা দরে বিক্রি হয়ে যায়।

কাফুরের বয়স তখন আটাশ বছর। বিশ নম্বর মালিকের হাত থেকে সে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাকে আবার হাটে তোলা হয়েছে। শহরের ধনবান ব্যক্তি আবদাল্লাহ কোনো এক কাজে হাটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। কাফুরকে দেখতে পেয়েই সে দাঁড়িয়ে পড়লো।

আবদাল্লাহ কাফুরকে আগে থেকেই চিনত। তারই বন্ধু জালাল আলদীনের গোলাম ছিল সে। কাফুর একজন ভালো কর্মী, বিশ্বস্ত ও সৎ গোলাম এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মনিবের অত্যন্ত অনুগত। কাজে-কর্মে যেমন দক্ষ, তেমনি চৌকস। এমন একজন গোলামকে তার বন্ধু হাটে বিক্রি করে দিচ্ছে সে যারপরনাই অবাক হলো।

কাফুরকেই সে জিজ্ঞেস করলো : তুমি এখানে কেন? 

কাফুর নির্বিকার। জবাব দিলো : আমাকে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। 

আবদাল্লাহ জানতে চাইলো : তোমাকে হঠাৎ বিক্রি করে দেওয়ার কারণ? 

কাফুর বললো : আমার এক বছর পুরো হয়েছে। আমাকে কেউই এক বছরের বেশি রাখতে চায় না।

আবদাল্লাহ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো : কেন? তোমার দোষটা কী?

কাফুর বললো : আমি বছরে একবার মিথ্যা কথা বলি।

এ কথায় আবদাল্লাহ চমৎকৃত হয়ে বললো : তাই নাকি! কেন? 

কাফুরের জবাব : ঐ একটা দিনই আমি মিথ্যা কথা না বলে থাকতে পারি না বলে আমি কোনো মালিকের কাছে টিকতেও পারি না। আমার মালিকরা সেটা জানেন, জেনেশুনেই তারা আমাকে কিনে নেন। কিন্তু আমার মিথ্যার ভার তারা শেষ পর্যন্ত সইতে পারেন না। 

কাফুরের বর্তমান মালিক জালাল আলদীন তার পাশেই একটা চেয়ারে বসে ছিল। সে ভুরু কুঁচকে খানিকটা বিরক্তির সাথে বললো : না ভাই, এরকম ভয়াবহ গোলাম আমি পুষতে পারবো না। দাম যাই পাই, সেই দামেই ওকে বিক্রি করে তবে আজ আমি বাড়ি ফিরবো।

আবদাল্লাহ একটু অবাকই হলো। জানতে চাইলো : কেন? গোলাম হিসেবে কি সে ভালো নয়?

জালাল আলদীন এক বাক্যে স্বীকার করলো : তার মতো ভালো গোলাম এই হাটে দ্বিতীয়টি নাই। তারপরও আমি তাকে আমার কাছে রাখবো না। সে বছরে একদিনেই যে একটি মাত্র মিথ্যা কথা বলেছে, তাতেই আমার ভয়ানক সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে। আমি আর দ্বিতীয়বার কোনো সর্বনাশের চেহারা দেখতে চাই না। 

আবদাল্লাহ একটু ভেবে নিয়ে বললো : তুমি যা-ই বলো বন্ধু, একদিনের একটি মিথ্যার জন্য এত ভালো গোলামকে হারানো বোকামি। যে গাই দুধ দেয়, তার লাথিও সওয়া যায়। একে আমি হাতছাড়া করতে চাই না। আমিই একে কিনলাম একদম ন্যায্য দামে।

আবদাল্লাহ ভালো একটা দাম দিয়েই কাফুরকে কিনে নিলো। কেনা গোলামকে নিয়ে এলো নিজের বাসভবনে। নতুন একজন গোলাম পেয়ে আবদাল্লাহর স্ত্রী মর্জিনাও খুব খুশি। 

আবদাল্লাহ, মর্জিনা ও পরিবারের সবার মন জয় করে ফেলল কাফুর। বাসভবনে আরো দশটা ক্রীতদাস রয়েছে। কাফুর মতো বন্ধু ভাবাপন্ন সঙ্গী পেয়ে তারাও খুশি। কাফুর তার নিজের কাজ নিষ্ঠার সাথে তো করেই, সময় অবসর পেলে অন্যদের কাজও সে নিজের আনন্দেই করে দেয়।

এক বছর না পেরুতেই কাফুর আবদাল্লাহ পরিবারের অপরিহার্য সদস্য হয়ে গেল। সবাই তাকে ভালোবাসে। এই পরিবারের সুখে-দুঃখে সে জড়িয়ে পড়েছে অঙ্গাঙ্গিভাবে।

দেখতে দেখতে বছরটা যাই-যাচ্ছি করছে। বছরের একদম শেষ দিন। 

শহরতলিতে আবদাল্লাহর একটা বাগানবাড়ি রয়েছে। পাঁচ একর জায়গার ওপর বিশাল বাগান ও বাড়ি। নানান জাতের গাছ-গাছালিতে ছাওয়া। একটা আকর্ষণীয় বাংলোবাড়ি। বিশাল আকারের পুকুর। সে-পুকুরে হরেক কিসিমের মাছ। তার একপাশে ছোটখাটো চিড়িয়াখানা। সেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার থেকে শুরু করে হরিণ, জিরাফ, গণ্ডার, এমনকি বনমোরগও রয়েছে। পুরো বাড়িতেই দেশি-বিদেশি ফুলগাছের সমাহার। 

আবদাল্লাহ সেদিন তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সেই বাগানবাড়িতে এলো। বছরের শেষ দিনের পুরোটা সময় আনন্দ-ফুর্তিতে কাটাবে। তার সাথে রয়েছে বিশ্বস্ত কাফুরও।

এই উপলক্ষ্যে বাগানবাড়িতে এলাহি আয়োজন। নানান ধরনের সুস্বাদু ভোজের ব্যবস্থা হয়েছে। খাবার-দাবারের রকম ও পরিমাণের কমতি নেই। আনন্দে মেতে থাকার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। এমনকি মাছ শিকারের ব্যবস্থাও রয়েছে।

কাফুর আবদাল্লাহর বন্ধুদেরকে তীক্ষè দৃষ্টিতে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করলো। বন্ধুদেরকে তার পছন্দ হলো না। মনে হলো, এরা সবাই লোভী ও ব্যক্তিত্বহীন; এদের কেউই আবদাল্লাহর ভালো তা চায়ই না, বরং ঈর্ষা করে। ফুর্তির নাম করে আবদাল্লাহর সম্পদ নষ্ট করতে তারা বেশি পছন্দ করে, এমন করতে পারলেই তারা খুশি।

কাফুর চুপিসারে কানে কানে তার পর্যবেক্ষণ ও মতামত জানাতেই আবদাল্লাহ রেগে উঠল। বললো : আমার ভালো ভালো বন্ধুদের নিয়ে এরকম বাজে কথা আর কখনোই বলবে না। ওরা আমার কতো ভক্ত অনুরক্ত! 

কাফুর বুঝতে পারলো, বন্ধু-প্রেমে তার মনিব ঘোরতর অন্ধ। এখন কোনো কিছু বলেও তাকে বোঝানো সম্ভব হবে না। বরং অপেক্ষা করতে হবে। সময় হলেই চোখে-আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে। 

দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর সবাই বিশ্রাম নিলো। বিকালে নাস্তা-পর্ব। এরপর বাগানবাড়ির পুকুরে মাছ ধরা। অনেকগুলো ছিপ-বড়শি আর মাছ ধরার জন্য আহার-খাদ্য আনা হয়েছে। 

সবাই হৈ-হৈ করে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসল পুকুরের পানিতে ছিপ-বড়শি ফেলে। পুকুরের পানিতে মাছদের খলবল। কিন্তু বড়শিতে তারা ধরা দেয় না। আধঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও বড়শিতে মাছ আটকালো না। 

বন্ধুদের একজন খেদ প্রকাশ করে বললো : আহারে! পুকুরজুড়ে এত এত মাছ। কিন্তু মাছ নেই আমাদের কপালে। আর এজন্যই বড়শি ফাঁকা। 

আরেকজন বললো : আহা! থাকতো যদি জাল তাহলে পুকুরের গভীর পানিতেও মাছের তড়পানি বুঝিয়ে দিতাম।

সাথে সাথেই খোঁজ পড়লো জালের। আবদাল্লাহ আমতা আমতা করে বললো : হ্যাঁ,  জাল তো আমার ছিল দুই তিন জাতের। ছিপ জাল। কই জাল। এ রকম আরো আরো জাল।

কিন্তু বাগানবাড়িতে কোনো ধরনের জালই খুঁজে পাওয়া গেল না। তখনই খোঁজ পড়লো কাফুরের। তাকে যেতে হবে আবদাল্লাহর বাসভবনে। সেখানেই স্টোররুমে জালগুলো রয়েছে। 

আবদাল্লাহর কাছ থেকে হুকুম পেয়ে কাফুর ছুটলো শহরে আবদাল্লাহর বাসভবনে।

কাফুর আবদাল্লাহর বাসভবনে পৌঁছে গেল। ফটক পেরিয়ে ভবনে ঢুকলো। ঢুকেই মেঝের ওপর আছড়ে ধপাস করে বসে  পড়লো। তারস্বরে সে বিলাপ শুরু করে দিলো। একই সাথে তার দুই চোখ বেয়ে পানি গড়াতে লাগলো। কখনো কখনো সে নিজের মাথার চুল টেনে টেনে ছিঁড়তে লাগলো। সে এমনভাবে হামলে কান্নাকাটি করতে লাগলো যেন তার ভয়াবহ ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে গিয়েছে।

কাফুরের কান্নাকাটি চ্যাঁচামেচিতে আবদাল্লাহর বউ মর্জিনা ও ছেলেমেয়েরা ছুটে এলো। এলো বাসভবনের সব চাকর-বাকর দাসী-বাঁদী, কর্মচারী-পাহরাদাররা। কাফুরের কান্না বাসভবন ছাড়িয়ে বাইরে, আশপাশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ঘটনা দেখতে ও বুঝতে পাড়া-প্রতিবেশীরাও ছুটে এলো। তারা ঘটনা জানার জন্য কাফুরকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করতে লাগলো। কিন্তু কাফুর এত উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করছে যে কারো কোনো কথাতেই তার মনোযোগ নেই, কোনো কথা তার কানেও ঢুকছে না।

শেষ পর্যন্ত মর্জিনা তাকে ধমক দিয়ে বললো : কী হয়েছে? এত কান্না কীসের জন্য? কেন?

এই ধমকেই কাফুরের কান্না ও চিৎকার থামলো। সে ভেজা চোখে ফ্যালফ্যাল করে মর্জিনার দিকে তাকিয়ে রইলো। 

একটু পরেই আবার নিজের কপাল থাপড়াতে থাপড়াতে কান্না শুরু করলো। একই সাথে বিলাপ করতে করতে সে তার কান্নার কারণ খোলাসা করলো। জানালো : আমার মালিক। তাঁর বন্ধুদের নিয়ে বাগানবাড়ির এক পুরোনো ঘরে বসে আমোদ-আহ্লাদ ফুর্তি-ফার্তি করছিলেন। এইসময়েই আচানক ঘরটা কেঁপে ওঠে আর ঘরের পুরো ছাদ তাঁদের ওপর ধসে পড়ে। কিছুক্ষণ আগেও যে মানুষগুলো মজা করছিলেন, মুহূর্তে  তাঁরা জীবন্ত চাপা পড়ে যান। তাঁদের প্রত্যেকের মৃত্যু হয়। সেসময় আমি মালিকের হুকুমে পুকুরপাড়ে বসে বড়শি দিয়ে মাছ মারছিলাম বলে এই দুর্ঘটনার কবল থেকে রেহাই পাই। কিন্তু পুরো ঘটনাটাই আমার চোখের সামনে ঘটলো, আমি কিছুই করতে পারলাম না। হায়! হায়! আমার মনিব আমারই চোখের সামনে মারা গেলেন, অধম আমি তাঁর জন্য কিছুই করতে পারলাম না!

এ কথা বলার পরই কাফুরের ডুকরে কান্না আবার শুরু হলো।

মর্জিনার সামনে পুরো জগৎটাই প্রচণ্ডভাবে দুলে উঠল। তার মাথা চক্কর খেতে লাগলো। ছেলেমেয়েরা হায়-হায় করে কাঁদতে শুরু করলো। আশপাশের যে লোকজন ভিড় জমিয়েছিল তারাও পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। 

মর্জিনা দ্রুত ছুটে তার কামরায় ঢুকে পড়লো। সেখানে থেকে ঝনঝন শব্দ শোনা গেল। সাথে সাথে উচ্চস্বরে কান্না। কাফুর দ্রুত মর্জিনার কামরায় এলো। 

মর্জিনা ঘরের সব জিনিসপত্র আছড়ে ছুড়ে মেরে ভাঙচুর করছে। আর কাঁদতে কাঁদতে বলছে : এসব জিনিসপত্র আসবাব দিয়ে আমার কী হবে যদি আমার স্বামীই বেঁচে না থাকলেন! 

তাকে সাহায্য করার জন্য কাফুরও এগিয়ে এলো। শোকাহতা মর্জিনার সাথে হাত লাগিয়ে কাফুরও আবদাল্লাহর বাসভবনের সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিলো। 

মর্জিনা দুঃখে-শোকে তার কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে ফেলল। হা-হা-কার বিলাপে চারপাশের বাতাস ভারী করে তুলল। পরিবারটির  দুঃসংবাদ ও কান্নাকাটিতে প্রতিবেশীদের কারো কারো চোখেও পানি এসে গেল। কেউ আবার গোপনে মুখ টিপে হাসল। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো : টাকার কুমির হয়ে আবদাল্লাহর খুব বাড় হয়েছিল। এবার কেমন মজা!

কাফুর কাঁদতে কাঁদতে মনিব-পত্নীকে বললো : বেগম সাহেবা, সাহেব যেখানে মারা গিয়েছেন  আমাদের সবাইকে সেখানে যেতে হবে। 

মর্জিনা বললো : আমি তাঁর মৃতদেহ সহ্য করতে পারবো না। এরপরও আমাকেই যেতে হবে। কাফুর, তুমি আগে যাও। আমরা তোমার পেছনে পেছনে আসছি। আমরা তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে এনে এখানেই দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করব।

মর্জিনা, ছেলেমেয়েরা, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের পেছনে নিয়ে কাফুর বাগানবাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। সারা পথেই তারা বিলাপ করতে করতে চলল। রাস্তার লোকজন তাদের দেখে থমকে দাঁড়াল। ঘটনা কি ঘটেছে তারা জানতে চাইল। এতগুলো লোকের কেন এই পথযাত্রা? পথ চলতে চলতে কেন এমন বিলাপ? কোথায় তাদের গন্তব্য?

কাফুর পথ চলতে চলতে দুর্ঘটনায়  আবদাল্লাহর মৃত্যু সংবাদ জানাল। 

আবদাল্লাহ শহরের একজন গণ্যমান্য বিশিষ্ট নাগরিক। তাকে সবাই চেনে জানে, মানেও। মুহূর্তে সারা শহরে এই খবর রাষ্ট্র হয়ে গেল। শত শত লোক আবদাল্লাহর বাগানবাড়ির দিকে ছুটে আসতে লাগলো। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবদাল্লাহর মৃত্যুতে দুঃখ ও শোক প্রকাশ করে আফসোস করতে লাগলো। আবার কেউ কেউ  চাপা উল্লাস করে তার কাজকর্ম ও আচরণ নিয়ে নিন্দাবাদ গালমন্দ করতে লাগলো।

কাফুর খানিকটা দ্রুত ছুটেই সবার থেকে বেশ আগেই বাগানবাড়িতে এসে হাজির হলো। আবদাল্লাহ ও তার সঙ্গী-সাথীরা হতচকিত। একটু দূরে হলেও শহরবাসীদের হৈচৈ এখান থেকেই তাদের কানে এসে পৌঁছছিল। এদিকে কাফুরও এখানে এসে ঢুকেছে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে। 

আবদাল্লাহ উৎকণ্ঠিত হয়ে কাফুরকে জিজ্ঞেস করলো : কী হয়েছে কাফুর? 

কাফুর তার নিজের মাথা থাবড়ে হায়-হায় করে উঠল। তার দুই চোখ বেয়েই পানি ঝরছে। সে ধরা গলায় বললো : দুঃখের কথা আর বলবেন না হুজুর! ঘর চাপা পড়ে বেগম সাহেবা আর আপনার ছেলেমেয়েরা মারা গিয়েছেন। আমি যখন জাল আনার জন্য আপনার বাসভবনের কাছাকাছি গিয়েছি, ঠিক তখনই হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হয়। কয়েক সেকেন্ড মাত্র। অতোবড়ো পাকা বাড়িটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। তার নিচেই চাপা পড়েন বেগম সাহেবা আর ছেলেমেয়েরা! হায়! আমি যে কেন বেঁচে রইলাম! হায় আল্লাহ! 

আবদাল্লাহ স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে দিশেহারা হয়ে চিৎকার করে বলে উঠল : কী সর্বনাশ! বলছো কি তুমি? বেগম সাহেবা বেঁচে নেই! 

কাফুর সজোরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললো : না হুজুর! উনারা সবাই মারা গিয়েছেন। কেউ একজনও বেঁচে নাই। এমনকি দারোয়ান চাকর-বাকর সবাই বাড়ি-চাপায় মারা পড়েছে।

কাফুরের কথা শুনে আবদাল্লাহ ধপাস করে বসে পড়লো। চিৎকার করে সে কেঁদে উঠল। তার চিৎকারে বন্ধুরা কেউ কেউ ছুটে এলো। আবার কেউ কেউ আড়ালে দাঁড়িয়ে তার এমন দুর্দশা নিয়ে হাসি-তামাশা করতে লাগলো।

আবদাল্লাহর কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আলুথালু বেশে উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে এলো বাগানবাড়ি থেকে। নেমে এলো পথে। তার পেছনে পেছনে বন্ধু-বান্ধবরা, বাগানবাড়ির চাকর-বাকর খিদমতগাররা। চারপাশেই হুলস্থূল। দূর থেকে ভেসে আসছে হায় হায়, কান্নার রোল, জনতার হল্লা। আবদাল্লাহ সেদিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে উঠল। সে পথের ধুলোবালির ওপরেই বসে পড়লো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দূরের লোকজনের দল বাগানবাড়ির কাছাকাছি এসে পৌঁছাল। শহরের শত শত মানুষ এগিয়ে আসছে। সবার সামনে আবদাল্লাহর স্ত্রী মর্জিনা। লোকজনের দলবল দেখে আবদাল্লাহ রাস্তার ধুলো থেকে উঠে দাঁড়াল। 

সম্মুখে জীবিত আবদাল্লাহকে দেখে মর্জিনা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো তার পেছনের শহরবাসীরাও। সবার মধ্যেই চরম বিস্ময়। যাদেরকে যাদেরকে মারা গিয়েছিল বলে তারা শুনতে পেয়েছিল তারা সবাই বেঁচে আছে, জীবিত অবস্থায় এখন তারা পরস্পরের মুখোমুখি। সবাই তারা বুঝতে পারলো, ক্রীতদাস কাফুর তাদের প্রত্যেককে মিথ্যা কথা বলেছে।

কোথায় কাফুর?

কাফুর নিশ্চিন্তে নির্বিকার ভঙ্গি নিয়ে দুই দলের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। কাফুরকে দেখতে পেয়েই আবদাল্লাহ তাকে তেড়েমেরে মারতে আসলো।

কাফুর  তার দুই হাত জোড় করে বিনয়ত গলায় বললো : হুজুর, আপনি আমার সবকিছুই জেনেশুনে আমাকে গোলাম হিসেবে কিনেছেন। আমার আগেকার মনিব আপনাকে বলেছেন, আমিও বলেছি, বছরে একবার আমি মিথ্যা কথা বলি। আজ আমি সেই মিথ্যা কথাটিই বলেছি। আপনি জেনে-বুঝে আমাকে শাস্তি দিতে পারেন না। বিশেষ করে আমি এখনো আস্ত একটা মিথ্যা কথা বলি নাই মাত্র অর্ধেক মিথ্যা বলেছি। 

আবদাল্লাহ কাফুরকে ঘুসি মারার জন্য তার হাত তুলেছিল, কাফুরের কথা শুনে তার মারনোদ্যত হাত থেমে গেল। বললো : তুমি মাত্র অর্ধেক কথা বলেছ! তাতেই এতসব কাণ্ড!

কাফুর বললো : আমার এই মিথ্যা কথায় আপনি এমন কিছু সত্য ও বাস্তব চিত্র দেখতে পাচ্ছেন, যা এর আগে কখনো দেখেন নাই,  দেখতে পারতেনও না। আমার মিথ্যাকে আপনি সত্যের আয়না হিসেবেও মানতে পারেন। আপনি আপনার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, আপনার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শহরে আপনার যতো বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন রয়েছে, সবাই ছুটে এসেছে। এদের অনেকেই আপনার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দুঃখিত হয়েছে, কষ্ট পেয়েছে, কান্না করেছে। আবার কেউ কেউ মনে মনে খুশি হয়েছে। আপনি যদি একটু ভালোমতো তাকিয়ে দেখেন, মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করেন, তাহলে তাদের মুখভঙ্গি দেখলেই বুঝতে পারবেন। 

আবদাল্লাহ চারপাশে তাকিয়ে সবাইকে দেখল। তারপর মাথা নিচু করে বললো : যা হবার হয়েছে। এবার সবাই বাড়ি চলো। 

আবদাল্লাহ তার পরিবার চাকর-বাকর এমনকি কাফুরকেও নিয়ে শহরে তার বাসভবনে ফিরল। 

বাসভবনে ঢুকেই তার চোখ চড়কগাছ। ভাঙা জিনিসপত্র চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তাই দেখে সে দুই হাতে মাথা চেপে সোফায় ধপাস করে বসে পড়লো। মর্জিনাও বসল তার পাশের সোফায়। মাথা নিচু করে বললো : তোমার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আমার মাথাটা ঠিক ছিল না। তখন মনে হচ্ছিল, তুমিই যদি না থাকলে, এতসব জিনিসপত্র বাড়িঘর দিয়ে আমার কী হবে! তাই আমি সব ভাঙচুর করি মনের শোকে। আর আমাকে সাহায্য করে কাফুর।

আবদাল্লাহ উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল। কাফুরকে কাছে ডেকে আনল। বললো : এই বুঝি তোর আধা মিছে কথা! আমার সবকিছু ভেঙে ফেলেছিস। তোর অর্ধেক মিথ্যাতেই যদি এই অবস্থা হয়, তবে পুরো মিথ্যা কথা বলে তুই একটা আস্ত নগরকে ধ্বংস করে ফেলবি। তোকে আমি আমার গোলাম হিসাবে আর রাখবো না। 

কাফুর মুখ ব্যাজার করে বললো : জানি। এও জানি, আমাকে আবার মানুষের কেনা-বেচা হাটে তোলা হবে।  আমিও প্রস্তুত। 

আবদাল্লাহ বললো : না। আমি তোকে কোনো হাটে-বাজারে তুলব না। অন্য কোনো মনিবের হাতে তুলে দিয়ে তার ঘরে সর্বনাশ টেনে আনার সুযোগ তোকে আর দেবো না। তোর গোলামির এটাই শেষ বাড়ি। তোকে আমি মুক্ত করে দিলাম। আজ এই মুহূর্ত থেকে তুই স্বাধীন।

কাফুর আট বছর বয়সে গোলাম হয়ে মনিবদের বাড়িতে ঢুকেছিল। আজ আটাশ বছর বয়সে স্বাধীন মানুষ হিসেবে মনিবের বাড়ি থেকে মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এলো।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ