মুয়াজ্জিন হতে চান মঈন আলী

মুয়াজ্জিন হতে চান মঈন আলী

খেলার চমক আবু আবদুল্লাহ জুলাই ২০২৪

অনেক দিন ধরেই ইংল্যান্ড ক্রিকেট টিমের নিয়মিত সদস্য মঈন আলী। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অভিষেক। একই বছর জুন মাসে দেশের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পা রাখেন টেস্ট আঙিনায়। এরপর গত এক দশক ধরে নিয়মিত খেলে চলেছেন ইংল্যান্ড দলের হয়ে। দলটির হয়ে একজন কার্যকর অলরাউন্ডার হিসেবে ভূমিকা রাখছেন ব্যাট ও বল হাতে। ২০২৩ সালের অ্যাশেজ সিরিজের পর টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান মঈন। এরপর খেলে চলেছেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে। ইংল্যান্ডের হয়ে জিতেছেন ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ^কাপ ও ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপ শিরোপা।

ডানহাতি অফস্পিন বোলিং আর বামহাতে মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করে থাকেন তিনি। লিডসে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টেই (২০১৪) খেলেন অপরাজিত ১০৮ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। পরের মাসে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজটাও দারুণ কাটে তার। এরপর থেকেই কখনো ব্যাট হাতে, কখনো বল হাতে পারফর্ম করে গেছেন। ২০১৭ সালে ওভাল টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে করেছেন হ্যাটট্রিক। তবে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড়ো অর্জনটি তার এসেছে ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের মাধ্যমে।

৬৮ টেস্টে ৫ সেঞ্চুরিতে ৩ হাজার ৯৪ রানের পাশাপাশি উইকেট নিয়েছেন ২০৪টি। আর ১৩৮ ওয়ানডেতে রান প্রায় আড়াই হাজার, সেঞ্চুরি আছে ৩টি। ওয়ানডেতে উইকেট নিয়েছেন ১১১টি। বর্তমানে ইংল্যান্ড টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে দলের সহ-অধিনায়ক তিনি। ইতঃপূর্বে দলকে বেশ কয়েকটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে নেতৃত্বও দিয়েছেন। তারও আগে অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতাও রয়েছে ৩৬ বছর বয়সি মঈনের।

ঘরোয়া ক্রিকেটে মঈন আলীর উত্থানটা ছিল চমক জাগানিয়া। ২০০১ সালে স্থানীয় অনূর্ধ্ব-১৫ পর্যায়ের একটি ২০ ওভারের ম্যাচে খেলেছিলেন অপরাজিত ১৯৫ রানের ইনিংস। সেদিন তার বয়স ১৪ বছর হতে বাকি ছিল ৩ দিন। আরেকটি ম্যাচে ১১তম ওভারে যখন আউট হয়েছেন, তখন তার রান ছিল ১৩০। ২০০৬ সালের যুব বিশ্বকাপে তার নেতৃত্বে সেমিফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড।

যার কারণে মাত্র ১৫ বছর  বয়সে সুযোগ পান কাউন্টি দল ওয়ারউইকশায়ারে। কয়েক বছর খেলার পর যোগ দেন ওরচেস্টারশায়ারে। আইপিএলে তিন মৌসুম রয়েল চ্যালেঞ্জার্স  বেঙ্গালুরুতে খেলে যোগ দিয়েছেন চেন্নাই সুপার কিংসে। পিএসএলে খেলেছেন মুলতানের হয়ে। ঢাকার ঘরোয়া ক্রিকেটে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন এক মৌসুম।

১৯৮৭ সালে বার্মিংহামে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ পরিবারে জন্ম মঈন আলীর। তার দাদা আজাদ কাশ্মির থেকে ইংল্যান্ডে অভিবাসী হয়েছিলেন। বাবা মুনীর আলী ছিলেন সাইক্রিয়াটিক নার্স, কাজের ফাঁকে ট্যাক্সিও চালাতেন। মঈন আলীর আরো দুই ভাই ও এক বোন রয়েছে। দুই ভাই কাদির ও ওমর খেলছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট। সংসারে অভাব থাকলেও তার বাবা ছেলেদের ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ দেখে সব রকম সহযোগিতা করেছেন।

একবার মঈন আলীকে নিয়ে গেছেন কাউন্টি দল সমারসেটে ট্রায়াল দিতে। ঘরে যা পয়সা ছিল তা দিয়ে যাতায়াত খরচের পর দু’জনের দুপুরে খাওয়া সম্ভব নয়। মঈন আলীর জন্য একটি স্যান্ডউইচ কিনে দিয়ে বাবা মাঠের পাশে বসে ছিলেন। মঈন টের পেলেন যে বাবার কাছে খাবার কেনার মতো পয়সা নেই। ইনিংস বিরতির সময় ড্রেসিং রুম থেকে দৌড়ে গিয়ে বাবার পাশে বসে ভাগ করে একটি স্যান্ডউইচ খেয়েছেন দু’জনে। বাবাই ছিলেন তার পৃষ্ঠপোষক। ইংল্যান্ডের আরেক ক্রিকেটার কবির আলী ছিলেন মঈনের চাচাতো ভাই। মহল্লার গলিতে ও পার্কে চাচাতো ভাইয়েরা মিলে ক্রিকেট খেলতেন। সেখানেই টেপটেনিসে ক্রিকেট খেলার শুরু তার।

বড়ো তারকা হলেও মঈন কখনোই তার নৈতিক অবস্থান থেকে সরে আসেননি। ম্যাচ জেতার পর ইংলিশ রীতি অনুযায়ী সতীর্থরা যখন শ্যাম্পেন ছিটিয়ে উদযাপন করেন, মঈন চুপচাপ নিজেকে সরিয়ে নেন সেখান থেকে। ক্রিকইনফোকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমার ধর্ম সবকিছুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দল থেকে বাদ পড়ার ভয় কিংবা অবসরের পর কী করবো সেসব নিয়ে আমার মাঝে কোনো চিন্তা নেই। আমি শুধু সেরা মানুষ হতে চাই। কতটি সেঞ্চুরি করলাম বা কতগুলো উইকেট নিলাম, সৃষ্টিকর্তার কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই।

মঈন যখন ইংল্যান্ড জাতীয় দলে পা রাখেন সে সময়টাতে বিশ^ব্যাপী বিশেষ করে ইউরোপে ইসলামভীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। শে^তাঙ্গরা মুসলিম মানেই সন্ত্রাসী ভাবতে থাকে এবং তাদের সাথে চলতে ফিরতে আপত্তি জানায়। মুসলিমদের সাথে রেস্টুরেন্টে একসাথে খাওয়া, একসাথে বাসে চড়া নিয়ে আপত্তি ছিল অনেকের। সেই সময়টাতেই মঈন নিজের মুসলিম পরিচয় গোপন করা তো দূরের কথা, তার বদলে আরো বেশি করে নিজের সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

মঈন বলেন, প্র্যাকটিসিং মুসলিম পরিচয়টা কখনোই গোপন করতে চাইনি। তাই দাড়ি রেখেই ক্রিকেট খেলছি। দাড়িওয়ালা মুসলিমদের সম্পর্কে মিডিয়ার চিত্রটা ইতিবাচক নয়। এই অবস্থার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারলেই ক্যারিয়ার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবো। আমি চাই, আমাকে দেখে সবাই যেন ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পায়।

২০১৪ সালে ভারতের বিপক্ষে সাউদাম্পটন টেস্টের দ্বিতীয় দিনে একটি ব্রেসলেট পরেছিলেন মঈন, যাতে লেখা ছিল ‘সেভ গাজা, ফ্রি প্যালেস্টাইন’। ঘটনাটি ওই সময় বিশ^ মিডিয়ায় আলোড়ন তুলেছিল। এমনকি বেনামী চিঠি পাঠিয়ে তাকে হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। এসব ব্যাপারে সবসময়ই ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড ও সতীর্থদের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছেন। ওরচেস্টারশায়ারে খেলার সময় ক্লাবের পক্ষ থেকে তাকে আলাদা নামাজের ঘর দেওয়া হয়েছিল। ক্লাবটিকে মঈন আলী অনুরোধ করেছিলেন বিয়ার কোম্পানির লোগো বাদ দিয়ে তার জন্য আলাদা জার্সি তৈরি করতে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছিল তার দাবি।

বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার সাথেও জড়িত আছেন এই অলরাউন্ডার। স্ট্রিট চান্স নামের একটি সংস্থার হয়ে ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ফ্রি ক্রিকেট কোচিং করান। অরফানস ইন নিড নামের একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার গ্লোবাল ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর তিনি।

বিয়ে করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফিরোজা হোসেনকে। একসময় সিলেট শহরের পীর মহল্লা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন ফিরোজার বাবা-মা। পরবর্তীতে তারা ইংল্যান্ডে চলে যান, সেখানেই জন্ম ফিরোজার। বিয়ের পর জামাই মঈন আলীও বেড়াতে এসেছিলেন শ্বশুরবাড়িতে। আবু বকর নামে একটি পুত্র ও হাদিয়া নামের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে এই দম্পতির।

২০১৬ সালে বিশ^ব্যাপী উগ্রবাদের বিস্তারের কারণে যখন ইংল্যান্ডের ক্রিকেটাররা বাংলাদেশ সফরে আসতে চাচ্ছিলেন না, তখন মঈন আলী তার সতীর্থদের আশ^স্ত করেছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে। সেবার ইংল্যান্ড দলের বাংলাদেশ সফরের পক্ষে তিনি নিয়মিতই ইতিবাচক মত দিয়ে গেছেন সংবাদমাধ্যমে।

অবসরের পর অনেক ক্রিকেটারেরই আগ্রহ থাকে কোচিং কিংবা ধারাভাষ্যে ক্যারিয়ার গড়ার। কিন্তু মঈন জীবনের সফলতা খোঁজেন অন্য কিছুতে। অবসরের পর হতে চান মুয়াজ্জিন, থাকতে চান মানুষের পাশে। তিনি বলেন, মসজিদে আজান দেওয়া কিংবা মসজিদ পরিষ্কারের কাজ পেলে আমি সবচেয়ে খুশি হবো। জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি, বাকি সময়টুকু মানুষের মাঝে কাটাতে চাই। আমার মনে হয় এতেই আমি সবচেয়ে বেশি তৃপ্তি পাবো।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ