রাসূল আমার জোছনানদীর চাঁদ
প্রচ্ছদ রচনা আবু মিনহাল জাদীদ সেপ্টেম্বর ২০২৪
‘ওই চাঁদ দেখেছিল আলো আলো মায়ামুখ তাঁর’!
এ তো চাঁদের সৌভাগ্য! সে দেখেছে এমন এক চাঁদকে, যিনি নিজেই ছিলেন আলোর নদী। কারো কাছ থেকে আলো ধার করতে হয়নি তাকে। বরং তাঁর আলোতেই আলোকিত হয়েছে তামাম জাহান। নক্ষত্ররাজি। জিন-ইনসান। মাখলুকাত।
তিনি আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (সা)!
আমরা তাঁকে দেখিনি। না দেখেই অবিরাম ভালোবেসে যাই। যে ভালোবাসার কোনো তুলনা নেই। উপমা নেই। কোনো মানুষই কোনো মানুষকে এভাবে ভালোবাসতে পারে না। না নিজেকে, না বাবা-মাকে, না নিজ ছেলেমেয়েকে! আমাদের বুকের ভেতর অবিরাম আবেগের ঢেউ ওঠে। হায়! যদি একবার নবীজিকে দেখতে পেতাম। তখন জাবির বিন সামুরার মতো একবার তাঁর দিকে তাকাতাম, একবার চাঁদের দিকে। তারপর বলতাম- তিনি আমার কাছে চাঁদের চেয়েও সুন্দর! অথবা আবু হুরাইরাহর মতো অনুভব করতে পারতাম- যেন সূর্য তাঁর চেহারায় বিচরণ করছে! (তিরমিজি)
কারো চোখে তিনি চাঁদ, কারো চোখে চাঁদের চেয়েও সুন্দর আবার কারো চোখে সূর্য! শুধু কি তাই? তিনি রাগ করলেও তাঁর চেহারার রং হতো দেখার মতো। আবদুল্লাহ বিন আমর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর সাহাবীদের নিকট বের হয়ে এলেন। তখন তারা তাকদীর নিয়ে বাদানুবাদ করছিল। ফলে তাঁর চেহারা লাল হয়ে যায়, যেন তাঁর চেহারায় ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে ডালিমের দানা! (ইবনে মাজাহ)
আর খুশির সময়?
কাব বিন মালিকের ভাষায়, রাসূলুল্লাহ যখন খুশি হতেন, তাঁর চেহারা জ্বলজ্বল করতো। মনে হতো চাঁদের একটি টুকরো! (বুখারী)
মূলত তাঁকে কোনো উপমায় বাঁধা সহজ নয়। তিনি উপমার চেয়ে সুন্দর। ভাষার চেয়ে কারুময়। তবুও যারা তাকে দেখেছে, তারা তাঁকে আঁকতে চেয়েছে শব্দের তুলিতে। যে তুলির আঁচড়ে আঁচড়ে ছড়িয়ে পড়েছে উপমার রং! হৃদয়ের দেওয়ালে তারা খোদাই করে রেখেছে তাঁর রূপা রূপা মুখ। তাদেরই একজন উম্মে মা’বাদ! নবীজিকে নিয়ে বলা তার প্রতিটি শব্দ যেন একেকটি সমুদ্র। যার ঢেউয়ে ঢেউয়ে উথলে ওঠে হৃদয়গলা আবেগ।
কী বলেছিলেন উম্মে মা’বাদ?
‘আমি যাকে দেখেছি, তাঁর গায়ের রং উজ্জ্বল! ঝলমলে চেহারা। উত্তম চরিত্রবান। তাঁর মাঝে নেই পেট বড়ো হওয়ার ত্রুটি। মাথার গঠনে নেই ক্ষুদ্রতা। কমনীয়, মনোরম! কাজল-কালো ডাগর চোখ। চোখের পাতায় দীর্ঘ পাপড়ি। গলার আওয়াজে দৃঢ়তা। উজ্জ্বল, দীর্ঘ গ্রীবা। ঘন দাড়ি। মসৃণ জোড়া ভ্রু। চুপ থাকলে আভিজাত্য ছেয়ে যায়। কথা বললে মাথা উঁচু হয়, দীপ্তি ঠিকরে পড়ে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে চমৎকার। কাছ থেকে দেখলে মনে হয় সবচেয়ে মিষ্টি, সবচেয়ে রূপবান। সুমধুর ভাষা- সাবলীল, না আছে অপূর্ণতা না বাহুল্য। বাক্যগুলো যেন ক্রমশ ঝরে পড়া মুক্তামালার দানা। মাঝারি গড়ন। এতটা লম্বা নন, যা হতাশ করে। এতটা খাটো নন, যা খারাপ লাগে। যেন দুটি ডালের মাঝে আরেকটি ডাল। তিনজনের মাঝে সবচেয়ে দীপ্র এবং মর্যাদায় সেরা। তাঁর সাথীরা তাকে ঘিরে রাখে। তিনি কিছু বললে তারা মনোযোগ দিয়ে শোনে। কোনো আদেশ করলে সাথে সাথে পালন করে। সবাই তাঁর সেবা করে, তাঁর জন্য সমবেত হয়। তিনি রুক্ষ স্বভাবের নন। বলেন না কোনো অনর্থক কথা।’
উম্মে মা’বাদ নবীজিকে যেসব শব্দ ও উপমার বুননে তুলে ধরেছেন, তা অসাধারণ। অন্য কোনো ভাষায় তার সরল অনুবাদ করা বড়ো কঠিন। ব্যাখ্যা না করলে যেন অনেক কিছুই বাদ পড়ে যায়। আরবি থেকে বুঝতে পারলে যে কেউ একবার নয়, বারবার বলে উঠবে সুবহানাল্লাহ! প্রথম দেখাতেই একজন মানুষকে এভাবেও মনের মাঝে গেঁথে রাখা যায়? যায়, শুধু বরকতের ফেরিওয়ালা রাসূলুল্লাহকেই এভাবে জড়িয়ে রাখা যায় স্মৃতির মসলিনে!
আল্লাহর নবী ইউসুফ (আ)!
তার রূপ-লাবণ্যের কথা কে না জানে? তাকে দেওয়া হয়েছিল সমুদয় সৌন্দর্যের অর্ধেক। মিশরের নারীরা তাঁকে দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। ফল কাটার পরিবর্তে নিজেদের হাত কেটে ফেলেছিল! আর বলেছিল, ‘আল্লাহর মহিমা! এ তো মানুষ নয়, এ তো এক সম্মানিত ফেরেশতা!’ (সূরা ইউসুফ : ৩১) তারা ভেবেছিল, মানুষ কখনোই এত সুন্দর হতে পারে না!
তাহলে কি তিনি আমাদের নবী (সা)-এর চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় ছিলেন? বেশি সুন্দর ছিলেন?
না!
আনাস বিন মালিক (রা) বলেন, সকল নবীকে আল্লাহ সুন্দর কণ্ঠ ও সুন্দর চেহারা দিয়ে পাঠিয়েছেন। তবে তোমাদের নবী তাদের চেয়েও সুন্দর চেহারা ও সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী। (আদ্-দারাকুতনী) ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম বলেন, নবীজিকে যে সৌন্দর্য দেওয়া হয়েছিল, তার অর্ধেক দেওয়া হয়েছিল ইউসুফ (আ)-কে। (বাদায়ি’ আল-ফাওয়ায়েদ)
এই তো, আমাদের নবী!
তিনি যখন ঘেমে যেতেন, তখনও ভালো লাগতো। আলী (রা) বলেছেন, তাঁর চেহারার ঘাম মুক্তার মতো ঝলমল করতো! আয়েশা (রা) একদিন দেখলেন, নবীজির চেহারা ঘামে ভিজে আছে। যেন তার রোশনাই বেড়ে গেছে বহুগুণ! তাই বলতে লাগলেন আবু কুবাইর হাজলির কবিতা, ‘তাঁর চেহারায় তাকিয়ে দেখতে পেলাম, দ্যুতিময় মেঘ যেন চমকায় অবিরাম!’
শুধু কি তাই? নবীজির ঘামে ছিল অপার সৌরভ!
আনাস বিন মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ আমাদের ঘরে এলেন এবং আরাম করলেন। তিনি ঘেমে গেলেন। আর আমার মা একটি ছোটো বোতল নিয়ে তাতে ভরতে লাগলেন। নবীজি জেগে উঠলেন। প্রশ্ন করলেন, উম্মু সুলায়ম! এ কী করছ? আমার মা বললেন, এ হচ্ছে আপনার ঘাম। যা আমরা সুগন্ধির সাথে মেশাই। আর এ তো সব সুগন্ধির সেরা সুগন্ধি! (মুসলিম)
আহা! নবীজির একফোঁটা ঘামও যদি পেতাম, পরম মমতায় আমরাও মেখে নিতাম শরীরে!
তিনি যখন হাসতেন, জ্যোতির চমকে দেওয়ালও জ্বলজ্বল করে উঠতো! আর মুচকি হাসির হাসনাহেনা তো ফুটেই থাকত মুখে। যখন কথা বলতেন, দাঁত ঠিকরে বেরিয়ে পড়তো আলো। আবু হুরাইরাহ্ (রা) ঠিকই তো বলেছেন- ‘আমি রাসূলের চেয়ে সুন্দর আর কোনো কিছুই দেখিনি’। (তিরমিজি) তাঁর সকল কিছুই ছিল নান্দনিক, শিল্পশৈলিতে একাকার! ছিলেন বাঁধভাঙা এক জোছনানদীর চাঁদ। তিনি দেখতে যেমন ছিলেন, তাঁর জীবনের প্রতিটি কাজেই ছিল আলো আর আলো। সে আলোয় গড়ে উঠেছে কত আলোর মানুষ। আমরাও সে আলোর পথ ধরে অবিরাম চলতে চাই হেরার রাজতোরণের দিকে।
আমরা তাকে দেখিনি।
তবে একদিন ঠিকই দেখা হয়ে যাবে। তারপর? তারপর এক পেয়ালা কাউসার চেয়ে নেবো তাঁর কাছে থেকে। ইনশাআল্লাহ। এ কারণেই বারবার গেয়ে উঠি-
‘রাসূলকে ভালোবেসে চলে যাবো কাউসার তীরে
পিপাসার কাতরতা আসবে না কখনোই ফিরে!’
আরও পড়ুন...