রিজিক
গল্প খন্দকার নূর হোসাইন জানুয়ারি ২০২৫
এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি উড়ে গেল। ওগুলো বালিহাঁস। জানুয়ারির শীতে ইউরোপের দেশগুলো থেকে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। এখান থেকে মেঘনার চরটা দূরে নয়। ওদিকে তাকালো টম। দুটো হিজল গাছের নিচে পড়ে আছে ও। পেছনের পা দুটো ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। দুটো পায়ের হাড়ই ভেঙে গেছে। গড়িয়ে গড়িয়ে কোনোরকমে নড়াচড়া করা যায়। ‘আশপাশে কেউ আছো?’ কয়েকবার ডাকলো ও।
কেউ নেই এখানে। কোনো মানুষ থাকলে শুধু শুনতে পেতো ওর ম্যাও ম্যাও ডাকটা। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনা জল। মানুষের কথা মনে হতেই স্মৃতিপটে ভেসে উঠলো গতকালের ঘটনাটা। যেন ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন। একজন লোক তাড়া করেছিল ওকে। গাছে উঠে পড়েছিল টম। তবে লাঠির আঘাত থেকে বাঁচতে পারেনি। মার খেয়ে গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিল নিচের নোংরা খাদে। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু শুনতে পেয়েছিল লোকটার বকাবকি। তার পোষা কুকুর মেজরকে বলছে, ‘শুধু খাস আর ঘুমাস, না? তুই থাকতে বিল্লিটা মুরগির বাচ্চা খায় কী করে?’
এরপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর দেখেছিল মেজর কোন ফাঁকে ওকে এখানে নিয়ে এসেছে। অন্য দিন ওকে দেখলেই তাড়া করতো মেজর। তবে গতকাল কেন এ উপকারটুকু করলো জানে না টম।
লোকালয় থেকে অনেক দূরে জায়গাটা। নড়াচড়ার চেষ্টা করলো টম। পারলো না। ওভাবেই কেটে গেল আরো একটি দিন। পরদিন দুটো কাঠবিড়ালি চোখে পড়লো ওর। ডাকলো ওদের। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকলো ওরা। টম বুঝতে পেরেছে, উঠে দাঁড়াতে হলে ভাঙা হাড় জোড়া দিতে হবে। কাঠবিড়ালি দুটোকে সে কথা বললো। হাড় জোড়া দেবার প্রাকৃতিক উপায় জানা আছে। ওদের কাছে বর্ণনা করলো। কাঠবিড়ালি দুটো বুঝলো ওর কথা। নির্দ্বিধায় সাহায্য করতে রাজি হলো। প্রাণীদের মধ্যে মানুষের মতো হিংসা-দ্বেষ নেই। মাংসাশীরাও প্রয়োজন ছাড়া শিকার করে না।
দুপুরে গাছের পাতাগুলো খুঁজে আনলো কাঠবিড়ালিরা। পেছনে ছড়ানো দুই পায়ে পাতাগুলো লাগিয়ে লতা দিয়ে বেঁধে দিলো ওরা। এবার অপেক্ষার পালা। ওরা দু’জন চলে গেল।
এরপর থেকে ওরা মাঝেমধ্যে এসে টমকে দেখে গেছে। ওর জন্য নিয়ে এসেছে খাবার পানি। কাঠবিড়ালিরা ফল খায়। টম সেটা খায় না। তাই ওরা টমের জন্য খাবার আনতে পারেনি। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে দিন যাচ্ছে ওর। এসব ছাপিয়ে প্রধান সমস্যা দেখা দিলো খাদ্যের। কোনো খাবার না পেয়ে প্রাণ বাঁচাতে একটা মুরগির বাচ্চা খেয়েছিল ও। সেটাও সাতদিন আগের কথা। এর মধ্যে পানি ছাড়া পেটে আর কিছু পড়েনি। ক্রমেই আরো দুর্বল হয়ে পড়লো টম। শুধু পানি খেয়ে কি বাঁচা যায়? শীতের মধ্যে জ¦রে কাঁপতে লাগলো ও। দশ দিন পর ওর প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
সেদিন দুপুরে ঘুম ভাঙার পর চোখ কচলে তাকালো ও। এটা কি সুন্দর কোনো স্বপ্ন? না, দেখে বাস্তবই মনে হচ্ছে। ওর সামনে দুটো মাছ। মাছ দুটো নিজ থেকে পানি ছেড়ে উঠে আসেনি। কেউ না কেউ রেখে গেছে। আশপাশে কাউকে দেখা গেল না। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। সাত-পাঁচ না ভেবে মাছগুলো খেতে শুরু করলো।
খাওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়লো টম। বিকেলে একবার জেগে উঠলো। কাঠবিড়ালি দুটো এসেছিল তখন। তারা মাছ দুটো আনেনি। ওরা কিছু জানে না। সন্ধ্যার পর আবার ঘুমিয়ে পড়লো টম।
সেদিন থেকে প্রতিদিনই ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর মাছ পেতে লাগলো ও। কে রেখে যায় জানা যায় না। প্রতিদিন খাবার আর অফুরন্ত বিশ্রামে সুস্থতার দিকে যেতে লাগলো টম। এখানে আসার পর এক মাস কেটে গেল। এখন আস্তে আস্তে হাঁটতে পারে টম। ব্যথাও কমেছে অনেক। পুরোপুরি সেরে উঠতে আরো সময় লাগবে। শিকার করার অবস্থা এখনো আসেনি। কে ওর জন্য মাছ রেখে যাচ্ছে জানা হয়নি। কীভাবে সেটা জানা যাবে? ভাবছে টম- ঘুম থেকে জাগার পরই সে এটা দেখতে পায়। তবে তা দিনের বেলা। রাতে ঘুম ভাঙার পর কখনো দেখেনি। পরদিন দিনের বেলা জেগে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো ও। সকাল থেকে ঘুমের ভান করে থাকলো।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর দুপুরে কারো পাখা ঝাপটানোর শব্দে কান খাড়া করে ফেললো ও। চোখের পাতা খুব সামান্য খুলে দেখলো, একটি পরিযায়ী বালিহাঁস মাটিতে নেমে ওর দিকে সাবধানে হেঁটে আসছে। মুখে দুটো মাছ। হাঁসটি মাছ দুটো রেখে চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে টম বললো, ‘বন্ধু, ধন্যবাদ তোমাকে!’
দাঁড়িয়ে পড়লো পাখিটা। ফিরে তাকালো, ‘জেগে আছো? কেমন আছো এখন?’
‘তুমি এগুলো জানলে কীভাবে?’
‘এদিক দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়েছিল। বুঝতে পারছি তুমি খাদ্যাভাবে আছো।’
‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া, তোমাকে পাঠিয়েছেন। সাবধানে থাকবে। জানো তো, এখানে দুষ্ট লোকেরাও আছে।’
‘ঠিক বলেছো। তবে ভালো মানুষও আছে। গত বছর আমার ডানায় গুলি করেছিল এক দুষ্ট লোক। সেখান থেকে উড়ে কিছুদূর গিয়ে পড়েছিলাম। ভাগ্য সহায় ছিল। এক ভালো লোক আমাকে দেখতে পেয়েছিল। এরপর চিকিৎসা করে ছেড়ে দিয়েছে।’ যাওয়ার আগে ফিরে দাঁড়ালো বালিহাঁস, ‘তোমাদের এ দেশটা সত্যি সুন্দর। আবার দেখা হবে। চলি।’
বালিহাঁস চলে গেল। এরপর থেকে প্রতিদিন তার সাথে কথা হতো। বালিহাঁসের সাথে গল্প করে একঘেয়েমি কেটে গেল। এভাবে চলে গেল দু’মাস। টম এখন হাঁটতে পারে। দুর্বলতা অনেকটাই কেটে গেছে।
একদিন বিকেলে মেঘনার পাড় ঘেঁষে হাঁটছিল ও। তিন মাস পর প্রথম একটি কাঁকড়া শিকার করলো টম। এতদিন পর নিজের শিকার করা খাবার খেতে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করলো। খাওয়ার পর মেঘনার চর থেকে বড়ো কয়েকটি শামুক সংগ্রহ করলো ও। মুখে করে নিয়ে এলো হিজল তলায়। শামুকগুলো ইটের টুকরো দিয়ে ভেঙে রাখলো। কচুরিপানা, চাল ভেজা আর শামুক দিয়ে বানিয়ে রাখলো বিশেষ ধরনের খাবার। কাঠবিড়ালি দুটো এ কাজে সাহায্য করলো।
কাজ শেষে বালিহাঁসের জন্য অপেক্ষা করলো টম। প্রায় তিনমাস ওর জন্য মাছ এনেছে। একদিন অন্তত আপ্যায়ন করতে পারলে ভালো লাগবে ওর। অধীর আগ্রহে বালিহাঁসের জন্য অপেক্ষা করলো টম। ছন্দপতন হলো সেদিন। সন্ধ্যা হয়ে গেল। এলো না বন্ধু বালিহাঁসটি। নানা জল্পনাকল্পনা করতে লাগলো টম। রাতে ঘুম এলো না। মনের কোণে উঁকিঝুঁকি দিলো অজানা আশঙ্কা। বালিহাঁস কোনো বিপদে পড়েনি তো? সকালে আর বসে থাকতে পারলো না টম। মেঘনার কোল ঘেঁষে বালুচরের দিকে হাঁটা ধরলো। দেড় মাইল হেঁটে এলো। পৌঁছে গেল ও। সাদা বালুর এ চরে অতিথি পাখির দল তিন মাস আগে অস্থায়ী কলোনি গড়ে তুলেছিল। তাদের সাথে ছিল ওর বন্ধু হাঁসটি। এখানে এসে কাউকে আর দেখলো না টম। দেখা গেল ওদের পদচারণার চিহ্ন। ওরা নেই। চলে গেছে। আকাশের দিকে তাকালো টম। রোদের তাপ বেড়েছে। মার্চ মাসের শুরুতেই অতিথি পাখিরা আবার রওনা দেয় নিজ মাতৃভূমির দিকে। গত দুদিন থেকেই আকাশে ওদের ওড়াউড়ি কম দেখছিল টম। বালিহাঁস চলে যাচ্ছে এ কথা ওকে বলার সুযোগ পায়নি হয়তো।
টম অসুস্থ থাকাকালীন পুরোটা সময় বালিহাঁস ওর জন্য মাছ নিয়ে এসেছিল। ও খাদ্যের জন্য কতই না দুশ্চিন্তা করেছিল। অথচ আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল কত নিখুঁত। ছোটবেলায় আম্মু ওকে সূরা হুদের ৬নং আয়াতের কথা বলেছিলেন, “জমিনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহরই এবং তিনি জানেন তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল। সবকিছু আছে স্পষ্ট কিতাবে।”
রবের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে মাথা নুয়ে এলো ওর। শুকরিয়া আদায় করলো। একঝাঁক বালিহাঁসের ডাক শুনতে পেলো টম। দূর দিগন্তে উড়ে যাচ্ছে ওরা। ছোট ছোট বিন্দু মনে হচ্ছে ওদের। কে জানে হতেও পারে সে দলে ওর বন্ধুটিও আছে। সামনের এক পা তুলে ওদিকে নাড়লো টম। ‘বিদায় বন্ধুরা! ভালো থেকো। আবার দেখা হবে আগামী শীতে।’
আরও পড়ুন...