রেজাল্ট কার্ড
গল্প নূর আঙ্গেজ জুন ২০২৪
ক্লাসে পিনপতনেরও শব্দ নেই। ক্লাস টিচার একে একে সবার নাম ডেকে রিপোর্ট কার্ড হাতে তুলে দিচ্ছেন। চঞ্চল মাহিন একদম চুপচাপ। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে- বাবা-মা’র কথা না শুনে খুব ভুল করেছে সে। সব প্রশ্নের জবাব জানা না থাকায় পরীক্ষাও ভালো হয়নি। তপু, নিশু, রিপন ওরা সবাই অন্য স্কুলের ছাত্র। একই এলাকায় থাকার কারণে ওদের সাথে বন্ধুত্ব। সারা বিকেল ওদের সাথে আড্ডায়-খেলায় মেতে থেকে ক্লান্ত শরীরে সন্ধ্যায় পড়ায় আর মন বসতে চাইতো না। যত সব ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেতো। মাহিন চোখ তুলে আর একবার ক্লাসের সাথীদের দিকে তাকায়। ওদের প্রমোশন আজ থেকে ওপরের ক্লাসে। আর মাহিন থেকে যাবে এই ক্লাস রুমেই। অনুশোচনা, লজ্জা, ভয় সব মিলিয়ে মাহিনের মাথা আরও হেড হয়ে যায়।
নিজের নাম কানে আসতেই উঠে দাঁড়ায় মাহিন। ক্লাস টিচার সায়মা ম্যামের দিকে তাকাতেও সংকোচ হচ্ছে।
: মাহিন!
: ইয়েস ম্যাম।
: ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে? তোমার রিপোর্ট কার্ড দেখবে না? সারা বছরের পড়াশোনার ফলাফল।
পা যেন চলতেই চাচ্ছে না। তবুও ধীর পায়ে টিচারের কাছে এসে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে সায়মা ম্যামের কাছ থেকে রিপোর্ট কার্ড নেওয়ার সময় টিচার বলে ওঠেন, তোমার কাছ থেকে এটা আমি আশা করিনি মাহিন। পড়ায় মনযোগী হও।
ঘাড় নিচু করে রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসে মাহিন।
ক্লাসের সবাই খুব হাসিখুশি। মাহিনের দিকে তাকানোর সময় নেই। কেউ কেউ ওদের বাবা-মাকে রেজাল্ট দেখাচ্ছে। মাহিনের মা দাঁড়িয়ে আছে ক্লাস রুমের বাইরে। মাহিন কাছে আসতেই বললেন, চলো, বাসায় চলো। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর কী করবে।
বাসায় ফিরে সোজা নিজের রুমে এসে পড়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলে রিপোর্ট কার্ড রাখতে রাখতে ভাবে- এই কার্ড কীভাবে বাবাকে দেখাবে। মায়ের অপমানিত মুখ স্কুলে দেখেছে সে। কী লজ্জা কী লজ্জা।
রাতে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে। একটা কথাও বলেননি বাবা। গম্ভীরভাবে নিজের খাওয়া শেষ করেন। চলে যান আজিজ সাহেব। মাহিনের মনে হয়। বাবা যেন কিছু না বলেও অনেক কথা বলে গেলেন।
মা আসেন রাতের কাজ শেষ করে। একটু রাত করেই। এগারোটার কাছাকাছি সময়ে। সারাদিনের পাথর চাপা কান্নাটা আর ধরে রাখতে পারে না মাহিন। একা ঘরে বালিশে মুখ গুজে চোখের পানিতে বালিশ ভিজায়। মাহিন আজ বুঝতে পারে তার বাবার সামান্য বেতনের চাকরিতে তাকে কীভাবে পড়ার খরচ জুগিয়েছে। আবারও সেই একই ক্লাসে একই খরচ।
বাবা কী আর আগের মতো মাহিনকে ভালোবাসতে পারবে? কোনোদিনও না। বাবার স্বপ্ন চুরমার করার জন্য মাহিনই দায়ী। আজ আফসোস করেও কী চলে যাওয়া একটি বছর ফিরে পাবে?
মাথায় আদরের একটি ছোঁয়ায় উঠে বসে মাহিন। মায়ের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে বলে, আমাকে মাফ করে দাও মা। তোমাকে আমি কষ্ট দিয়েছি। বাবাকে কষ্ট দিয়েছি। ক্লাসে সবার সামনে আমি অপমানিত হয়েছি। লজ্জিত হয়েছি। এইসব কিছু আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে মা।
সুফিয়া বেগম নিজের শরীর থেকে মাহিনকে আলাদা করেন। দু’কাঁধে হাত দিয়ে বলেন, আমার চোখের দিকে তাকা মাহিন। হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়লে আবার নিজেকেই উঠে দাঁড়াতে হয়। কিছু আঘাত মানুষকে সাহস জোগায়।
যেসব দিন জীবন থেকে চলে গেছে- ভুলে যা সব। তুই হাজারো চেষ্টা করলেও। চলে যাওয়া দিন ফিরে পাবি না। মনে কর এটা তোর একটা দুর্ঘটনা। সবেমাত্র তুই একটা ফুলের কুঁড়ি। আগামীর জন্য নিজেকে তৈরি কর। নতুন করে আবার পড়াশোনায় মনোযোগী হ। কষ্টের ফল কখনোই বিফলে যায় না। আশা করি আমার কথাগুলি তুই বুঝতে পেরেছিস।
: পেরেছি মা। তুমি দেখো এবার আমি আর পড়ায় অমনোযোগী হবো না। তোমাকে অপমানিত করবো না। বাবার কষ্টের মূল্য আমি দেবো। আমার জন্য দোয়া করো মা।
মা চলে যেতেই উঠে দাঁড়ায় মাহিন। ঝেড়ে ফেলে সারাদিনের অবসাদ। ভুল দিন নিয়ে ভাবনার সময় নেই। এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে আগামী দিনের জন্যে। এই আঘাতটা খুব দরকার ছিল মাহিনের। নইলে সে হয়তো সংশোধনই হতো না। ইদানীং তার ব্যবহারও মার্জিত ছিল না। বড়োদের সম্মান করে কথা বলাটাও সে ভুলে গিয়েছিল। এই আঘাত তাকে বুঝতে শিখিয়েছে- জীবন মানে শুধুমাত্র দিন পার করা নয়। কেবলমাত্র পুথিগত শিক্ষা মানুষকে বড়ো করে না। যদি না থাকে আচার-আচরণ মার্জিত ব্যবহার।
পরদিন ভোর থেকেই মাহিন তার প্রতিদিনের রুটিন পরিবর্তন করলো। স্কুল, পড়াশোনা, খেলা কোনোটাই বাদ থাকলো না। আজ দিনটা যেন শুরু হলো অন্যভাবে। শেষ বিকেলে বাবা ঘরে ফিরেই মাহিনকে ডাকলেন। মাহিন কাছে আসতেই বললেন, দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।
আনোয়ার ভাইকে দেখে মাহিন সালাম দিলো।
বাবা বললেন, আগামীকাল থেকেই আনোয়ার তোমাকে পড়াতে আসবে। এতদিন পড়ায় ফাঁকি দিয়ে কী রেজাল্ট করেছো তাতো তুমি জানোই। আমি আশা করবো সেই ভুল আর করবে না। আনোয়ার তোমাকে পড়ার ব্যাপারে সাহায্য করবে।
মাহিন এতদিনে বুঝতে পারে- কঠিন মনে করলেই সবকিছু কঠিন। আগে খোলা বইয়ের পাতায় চোখ রেখে ভাবতো- এত এত পড়া কী করে শিখবে সে? কিন্তু এখন মনে হয় পড়াতেও আনন্দ আছে। আনোয়ার ভাই কত সহজভাবে বুঝিয়ে দেন।
মাহিনের নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু আর শুরু হয় জীবনের নতুন অধ্যায়। বেশ লাগে। আনোয়ার ভাই শুধুমাত্র ক্লাসের বই-ই পড়ান না। সাধারণ জ্ঞানের বই থেকেও জানতে পারে অনেক কিছু। নিজের ভেতর উত্তেজনা বোধ হয়। আনোয়ার ভাই বলেন, তোমরা আগামী দিনের তরুণ। দেশের জন্য, সমাজের জন্য তোমাদের প্রয়োজন। তোমরাই তো ছিনিয়ে আনবে আগামী দিনের রাঙা প্রভাত।
আরও পড়ুন...