লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে
ভ্রমণ কামরুল আলম অক্টোবর ২০২৪
সময়টা গ্রীষ্মকালের শেষার্ধ। ঝড়-বৃষ্টির দিন প্রায় শেষ। প্রকৃতিতে চলছে গরমের তীব্রতা। মাঝেমধ্যে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে গরমের প্রভাব কিছুটা কমে। বাসা-বাড়িতে লোডশেডিংয়ের কারণে বৈদ্যুতিক পাখা বন্ধ হয়ে গেলে গরম সহ্য করা খুব কঠিন হয়ে যায়। এবার প্রকৃতি যেন একটু বেশিই তাপ ছড়াচ্ছে বাংলাদেশে। বেড়াতে যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু আল্লাহ কখন কার ভাগ্যে কী নির্ধারণ করেন তা আগে থেকে মোটেই টের পাওয়া যায় না।
২০২৩ সালের ২ মে বিকেলে অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় মুঠোফোনের রিংটোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। তাজওয়ার আলম ও ইরতিকা আলমের মায়ের কল। ফোন রিসিভ করতেই একটু আবেগতাড়িত কণ্ঠে বললেন, জানো কী হয়েছে?
আমি বললাম, না বললে জানবো কী করে?
আমাকে এক সপ্তাহের ট্রেনিংয়ের জন্য কুমিল্লা যেতে হবে।
যেতেই হবে?
হ্যাঁ, যেতেই হবে। আমাদের উপজেলা থেকে আমাকে সিলেক্ট করা হয়েছে।
কথা প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, তাজওয়ারের আম্মু খালেদা কলি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের আন্ডারে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের ইনচার্জ, অফিসিয়াল ভাষায় ‘কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডর’ বা সংক্ষেপে সিএইচসিপি।
‘বাসায় এসে কথা বলছি’ বলে ফোন রেখে দিলাম তখনকার মতো। বাসায় গিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম সপরিবারে কুমিল্লায় যাবো। বাচ্চারাও সঙ্গে থাকবে, আনন্দ হবে। ট্রেনের টিকিট কাটতে অনলাইনে ঢুঁ মারলাম। টিকিট হয়ে গেল। এভাবেই হুটহাট কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই জীবনে প্রথমবারের মতো কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হলো।
৮ মে সকাল ১১টায় সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উপবন এক্সপ্রেসে যাত্রা শুরু হলো। দিনের বেলা ট্রেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার জীবনেও খুব কম। এদিকে তাজওয়ার আলম ও ইরতিকা আলমের এটাই জীবনের প্রথম ট্রেন ভ্রমণ। তাদের মায়ের সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভ্রমণ এটি। তাজওয়ার ক্লাস টু’র ছাত্র আর ইরতিকার বয়স তিন ছুঁই ছুঁই। ট্রেনের জানালার ধারে বসে বসে সবাই উপভোগ করছি রাস্তার দু’ধারে সারি সারি গ্রাম, নানা কাজে ব্যস্ত মানুষজন। গ্রাম-বাংলার চমৎকার দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতেই বিকেল হয়ে গেল। কুমিল্লা স্টেশনে গিয়ে নামলাম বিকেল পাঁচটার দিকে। কোথায় উঠব, কী করবো কিছুই ঠিক করা ছিল না। প্রিয়জন বা আপনজনও কেউ নেই সেখানে। স্নেহভাজন ছড়াকার আহমেদ ইসহাকের বাড়ি কুমিল্লায়। একবার সিলেটে এসেও দেখা করেছিল। যাওয়ার আগে তাকেই নক দিয়েছিলাম। সে গাড়ির ব্যবস্থা করে রাখবে এটা ভাবতে পারিনি। অপরিচিত স্টেশনে নামার পূর্বমুহূর্তেই একটি ফোনকল এলো অপরিচিত নম্বর থেকে। ড্রাইভার হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে লোকটি বললো, ইসহাক ভাই আপনাদের কথা বলেছেন। আমি স্টেশনে আছি। আপনারা যেখানে যেতে চান, আমাকে নিয়েই যেতে পারবেন। যাক, আপনজনের অভাব কিছুটা হলেও পূরণ হলো।
খালেদা কলির ট্রেনিং পরদিন থেকে অনুষ্ঠিত হবে বার্ডে। বার্ড সম্পর্কে আমার খুব একটা জানাশোনা ছিল না। কুমিল্লা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর নেট ঘেঁটে ঘেঁটে মোটামুটি অবাক করা তথ্য পেলাম। এই বার্ড মানে ‘পাখি’ নয়। বার্ড হচ্ছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির সংক্ষিপ্ত নাম। ইংরেজিতে Bangladesh Academy for Rural Development (BARD)। ১৯৫৯ সালের ২৭ মে পল্লী উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে। বার্ড স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ১৫৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বার্ড ক্যাম্পাসে রয়েছে ৫টি হোস্টেল, ৪টি কনফারেন্স কক্ষ, ২টি ক্যাফেটারিয়া, ১টি মসজিদ, ১টি গ্রন্থাগার ও ১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটি কুমিল্লা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে কোটবাড়ীতে অবস্থিত। আমরা প্রাথমিকভাবে কুমিল্লা শহরেই রাত যাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম। উঠলাম কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় এলাকায় টাউনহলের নিকটবর্তী হোটেল সোনালীতে। রাতের ডিনার করতে গেলাম একটি রেস্টুরেন্টে। এদিকে টাউনহল চত্বরটিও সন্ধ্যার পরে বেশ জমে ওঠে। পুরো চত্বরজুড়ে চটপটি, ফুচকাওয়ালা আর বাদামওয়ালাদের ভিড়। মানুষে গিজগিজ করে। এর মধ্যেও একটা আনন্দ উপভোগ করা যায়। রাতের খাবার শেষ করে টাউনহল চত্বরে বাচ্চাদের নিয়ে এক চক্কর দিলাম। বার্ডের মতোই টাউনহল সম্পর্কে আগে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এবং নেট ঘেঁটে টাউনহল সম্পর্কেও একটি ধারণা পেলাম এ সময়। সিলেটে যেমন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ রয়েছে, কুমিল্লার টাউনহলটা অনেকটা এরকমই কিছু। পার্থক্য হচ্ছে, টাউনহল সরকারিভাবে পরিচালিত হচ্ছে, কেমুসাস পরিচালিত হয় বেসরকারিভাবে। কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে একটি পরিচালনা পরিষদ টাউন হল পরিচালনা করে। বর্তমানে এর সাধারণ সদস্য সংখ্যা এক হাজার। টাউন হলে দু’টি বিভাগ রয়েছে। একটি গণপাঠাগার, অন্যটি নগর মিলনায়তন। এর মধ্যে পাঠাগারের নিয়মিত সদস্য সংখ্যা ৬০০। আজীবন সদস্য ১৪ জন। পাঠাগারে এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটেনিকাসহ বিভিন্ন ভাষায় রচিত প্রায় ২৪ হাজার বই রয়েছে। এ টাউন হলটি কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে মহারাজ বীরন্দ্রচন্দ্রের স্মৃতিকে ধরে রেখেছে। কুমিল্লার ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে যেন দাঁড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন এটি, যা সবার কাছে ‘কুমিল্লা টাউনহল’ নামে পরিচিত। ১৩৭ বছরের পুরোনো সেই কুমিল্লার বীরচন্দ্র গণ-পাঠাগারটি আজও শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে জ্ঞানের প্রদীপ ছড়াচ্ছে। অবিভক্ত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের স্মৃতি বহন করা এ টাউনহলটি কুমিল্লাবাসীর গৌরবেরও প্রতীক। কুমিল্লায় ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন স্বাধিকার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল এ টাউনহল। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে অবস্থিত এ টাউন হলকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছে কুমিল্লার শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আর্থসামাজিক ও কল্যাণমুখী নানা কার্যক্রম। এখানে পদধূলি পড়েছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহাত্মা গান্ধী, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ ও ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের।
যাই হোক, আমাদের প্রথম দিনটি দীর্ঘ ভ্রমণের কারণে খুব একটা আনন্দদায়ক ছিল না। এর মধ্যে রাতের বেলা বৈদ্যুতিক বিড়ম্বনায় পড়তে হলো। প্রচণ্ড গরমের কারণে রাতের ঘুমটাও ভালো হয়নি কারো। সকালবেলা নাস্তা না করেই রওয়ানা হলাম কুমিল্লার পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিত ‘ময়নামতি’ এলাকায়। একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় আধা ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ময়নামতিতে। সেখানে গিয়েই নাস্তা সেরে নিলাম। প্রথমেই শালবন বিহার ঘুরে দেখলাম। কুমিল্লার ময়নামতিতে খননকৃত সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে শালবন বিহার অন্যতম প্রধান। কোটবাড়িতে বার্ডের কাছে লালমাই পাহাড়ের মাঝামাঝি এলাকায় এ বিহারটির অবস্থান। বিহারটির আশপাশে এক সময় শাল-গজারির ঘন বন ছিল বলে এ বিহারটির নামকরণ হয়েছিল শালবন বিহার। এর সন্নিহিত গ্রামটির নাম শালবনপুর। এখনো ছোট একটি বন আছে সেখানে। বাংলাদেশে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম এই শালবন বৌদ্ধবিহার। আগে এই প্রত্নকেন্দ্র ‘শালবন রাজার বাড়ি’ নামে পরিচিত ছিল। পরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে একে শালবন বিহার নামে আখ্যায়িত করা হয়। শালবন বিহারের ভেতরে ঘুরতে গিয়ে সত্যিই অন্যরকম অনুভূতি সৃষ্টি হলো হৃদয়ে। চারদিকে সবুজ প্রান্তর। তার সঙ্গে রাঙা ইটের তৈরি প্রাচীন প্রাচীরের মিতালি। কসমস, ডালিয়া, জিনিয়াসহ নানা প্রজাতির ফুলের সমাহার ছড়িয়ে আছে চারদিকে। দু’চোখ যেন জুড়িয়ে গেল ছায়া সুনিবিড় সবুজ অরণ্যের ফাঁকে ফাঁকে রোদের খেলায় মত্ত চমৎকার এই শালবন বিহার দেখে। কুমিল্লার লালমাই ও ময়নামতি পাহাড়কে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য প্রত্নসম্পদ। শালবন বিহারের পাশেই রয়েছে ময়নামতি জাদুঘর। এখানে রয়েছে অসংখ্য পুরাকীর্তি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আওতাধীন ঐতিহাসিক এ দুটি প্রতিষ্ঠান।
শালবন বিহার ঘুরে দেখার পর গেলাম ময়নামতি জাদুঘরে। পরে ছোট ছোট পাহাড় ঘেরা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও ঘুরে দেখলাম এক চক্কর। এরপর চলে গেলাম ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্কে। ২০টির অধিক রাইড, ডাইনোসর পার্ক, পিকনিক স্পটসহ এই পার্কটি কুমিল্লার সবচেয়ে বড়ো ও সুন্দর অ্যামিউজমেন্ট পার্ক। মনোরাম এই পার্কের গেটটি বেশ আকর্ষণীয়। ভেতরটাও চমৎকার।
এই ভ্রমণকাহিনীর শিরোনাম যে পাহাড়কে কেন্দ্র করে সেই পাহাড়ের গল্প তো বলাই হলো না। লালমাই পাহাড়ের মাটির রং লাল হওয়ার কারণেই একে লালমাই পাহাড় বলা হয়। এটি কুমিল্লা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলায় অবস্থিত একটি বিচ্ছিন্ন পর্বতশ্রেণি। প্রায় পঁচিশ লক্ষ বছর আগে প্লাইস্টোসিন যুগে এই পাহাড় গঠিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। পাহাড়টির উত্তর অংশ ময়নামতি পাহাড় এবং দক্ষিণ অংশ লালমাই পাহাড় নামে পরিচিত।
কুমিল্লা ভ্রমণ সবমিলিয়ে বেশ আনন্দদায়ক ছিল। লালমাই পাহাড়ের পাদদেশে ঘোরাঘুরি শেষ করে ফিরে আসার পর কেবলই মনে পড়ছে সেই আনন্দময় মুহূর্তের কথা।
আরও পড়ুন...