লাল জামা
গল্প মুহাম্মদ ইব্রাহিম বাহারী এপ্রিল ২০২৪
আজ সতেরো রমজান। আর মাত্র কয়টা দিন গেলেই মহা খুশির ঈদুল ফিতর। ঈশা, ইতি, ইভা, শিরিন, আমেনার ঈদের নতুন জামা জুতো কেনা হয়ে গেছে। ঈশা মনির ছোটো আব্বু তার জন্য একটা নতুন স্কুল ব্যাগও কিনে দিয়েছে কয়দিন আগে। স্কুল খুললেই নতুন জামা জুতোর সাথে নতুন ব্যাগ পিঠে বাঁধিয়ে স্কুলে যাবে সে। পাশের বাড়ির তুলিকে ডেকে ঈশা মনি দেখিয়েছে তার নতুন নতুন জামা-জুতো। ঈশা মনির মন আনন্দে ভরপুর। কখন আসবে ঈদ, সেই প্রতীক্ষায় তার সময় কাটতে চাচ্ছে না। তুলি তার বান্ধবী। একসাথে খেলে, একসাথে মাদরাসায় যায়, মাদরাসায় তারা পাশাপাশি বসে। তাদের মধ্যে খুবই নিবিড় সম্পর্ক। ঈশা মনির নতুন জামা, জুতো, ব্যাগ দেখার পরও তুলির মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, নেই কোনো অনুভূতি। তার মন খারাপ, সবসময় এই মেয়েটার কেন জানি খুব চিন্তা। চিন্তিত হবে না কেন? ঈশা মনির আব্বুর মতো তুলির আব্বুও চাকরি করতো একটি বেসরকারি মাদরাসায়। তাদের পরিবারে খুব সুখ ছিল। গত বছর মার্চ মাসের শেষের দিকে তুলির আব্বুকে রাতে কারা যেন তুলে নিয়ে গেছে। সেই থেকে আর বাসায় ফিরে আসেননি তিনি।
কোথায় নিয়ে গেছে? কেন নিয়ে গেছে? এসব কিছু জানার মতো বুদ্ধি তার হয়নি।
এখন তুলি প্রথম শ্রেণিতে পড়ে, আব্বুর অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে সে। আব্বু কোথায়?
মেয়ের এমন প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারে না তাসলিমা খাতুন। আঁচলে মুখ ঢেকে রাখে তাসলিমা খাতুন, শাড়ির আঁচল ভিজে গড়িয়ে পড়ে চোখের পানি।
তার আম্মুকে আবারও জিজ্ঞেস করে আব্বু কবে বাড়ি আসবে? আব্বুর সাথে বাজারে যাবো। ঈশা মনির মতো জামা, জুতো, ব্যাগ কিনে নেবো আব্বুর কাছ থেকে।
বিকেলে ঈশা মনি তুলির সাথে খেলতে যায়। কিন্তু তুলির মন খারাপ।
- ও তুলি, তুলি।
- ঈশা মনি আমি খেলবো না।
- কেন? তোমার কি মন খারাপ? তুমি ঈদের জামা কিনবা কবে?
ঈশা মনির প্রশ্নে তুলি জবাব খুঁজে পায় না।
তবু সে বলে, জানো ঈশা, আমার আব্বু বাড়ি এলে একটা খুব সুন্দর লাল জামা কিনে নেবো। আমার আব্বু আমার ব্যাগ কিনে দেবে তোমার চেয়ে খুব সুন্দর।
- তা তুলি, তোমার আব্বু কবে বাড়ি আসবে?
- আমার আম্মু বলেছে ঈদের আগে আসবে। ঈশা আমি আজ খেলবো না, তুমি বাড়ি যাও।
তুলি তার আম্মুর পাশে গিয়ে বসলো। তুলির আম্মু আজ একটা বছর অনেক কষ্ট করে সংসারের হাল ধরে রেখেছে। এখন পরের বাড়িতে বুয়ার কাজ করে। কাজ না করলে তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না সংসারের খরচ জোগানো।
ঈদের আর মাত্র তিন দিন বাকি। তুলির আব্বু বাড়ি এলো না। তুলির আরো মন খারাপ হয়ে গেল। বাস্তবে তো তুলির আব্বুর বাড়ি আসার সম্ভাবনা নেই। আজ পর্যন্ত তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। তুলির আম্মু অনেক বেশি চিন্তিত। তুলি তার আম্মুকে জিজ্ঞেস করে, আম্মু, আব্বুর কথা তোমার মনে পড়ে না? আমার খুব মনে পড়ে আম্মু!
গতকাল বিকেলবেলা ঈশা মনির মন্টু মামা ঈদ উপহার হিসেবে তাকে আরেকটি টুকটুকে লাল জামা কিনে দিয়েছে। তার শরীফ ভাই আরো একজোড়া চামড়ার জুতো কিনে দিয়েছে। ঈশা মনি খুব খুশি, খুব আনন্দিত।
ঈশা মনির আব্বু ঈশা মনির সাথে অনেক গল্প করে। নতুন নতুন গল্প। গরিবদের দান করার গল্প। প্রতিবেশীদের হক আদায়ের গল্প। নবী-রাসূলের গল্প, সাহাবিদের গল্প।
আরো কত গল্প...। এসব গল্প শুনে তার শিশুমনে দাগ কাটে। অন্যের কষ্টে ব্যথিত হয়ে যায়। তুলির আব্বু আজ পর্যন্ত বাড়ি এলো না। তুলিতো বলছিল তার আব্বু বাড়ি এলে লাল জামা কিনে নেবে। কিন্তু...।
ঈশা মনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্টু মামার দেওয়া লাল জামাটা আর শরীফ ভাইয়ের দেওয়া জুতো জোড়া তুলিকে দেবে।
ঈদের আর একদিন বাকি আছে, আগামী পরশু ঈদ।
ঈশা মনি তার আম্মুকে জানালো তার এই শিশুমনের সিদ্ধান্তের কথা। তার আম্মু ঈশা মনির এই কথা শুনে আনন্দিত হলো, তৃপ্তিতে মন ভরে গেল তার।
ঈশা মনির আব্বু আসলে মেয়ের এই মহৎপ্রাণ, উদার মানসিকতার কথা জানালো সালমা ইয়াসমিন। ঈশা মনির আব্বু ঈশা মনিকে ডাকলেন, ঈশা মনি, ও ঈশা মনি। এদিকে এসো আম্মু!
আমি তোমার আম্মুর কাছে সব শুনেছি। তোমার সিদ্ধান্ত খুবই চমৎকার, খুবই মহৎ। খুবই ভালো কাজ। এই নাও আরো এক হাজার টাকা। তুলিকে দেবে। ঈদের দিন ওর মন যা চাইবে তাই কিনবে, তাই খাবে। তুলি তোমার একটা বোন। তোমরা একসাথে ঈদে ঘোরাঘুরি করবে।
ছোটো বড়ো সবাইকে সালাম দেবে। মুখে মুখে বলবে ঈদ মুবারক, ঈদ মুবারক।
আরও পড়ুন...