শীতের পরিযায়ী পাখি
প্রচ্ছদ রচনা মঈনুল হক চৌধুরী জানুয়ারি ২০২৫
পরিবেশের সঙ্গে মানুষের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পেলে, রক্ষা পায় মানবজাতি। তাই পরিবেশকে নির্ভর করতে হয় কিছু অনুষঙ্গের ওপর। পাখি সেইসব অনুষঙ্গের অন্যতম। ফলে প্রকৃতি, পরিবেশ ও বনের জন্য পাখি অপরিহার্য। পাখির সংখ্যা যেখানে কম, সেখানে প্রকৃতি মৃতপ্রায়। তাই প্রকৃতির সৌন্দর্যেও পাখির ভূমিকা অনেক। পাখির কিচিরমিচির ডাক, চঞ্চলতা, বৈচিত্র্যময় জীবন কার না পছন্দ। একসময় এ দেশে প্রচুর পাখি ছিল। কারণ এখানকার আবহাওয়া পাখির বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক। উল্লেখ্য, পৃথিবীর আদিযুগে মানুষ যে পরিবেশে বসবাস করতো, সেখানে প্রাণিজগতের কেউ তার বন্ধু ছিল না। সবাই শত্রু এবং তাদের কেউ কেউ অনেক ভয়ংকর ও প্রাণঘাতী ছিল। সে সময় কেবল মাত্র পাখি তাদের ভয়ের কারণ ছিল না। বলা যায়, মানুষ প্রকৃতি থেকে দুটি বড়ো উপহার পেয়েছে। তার একটি হলো উদ্ভিদ আর অন্যটি হলো পাখি। পাখি প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর সাথে এর তফাত অনেকখানি। এটা সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর এক অপার রহস্য।
পরিযায়ী পাখি
পরিযায়ী পাখি বলতে নির্দিষ্ট প্রজাতির কিছু পাখির, প্রতি বছর বা কয়েক বছর পর পর একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে বা সময়ে কম করে দু’টি অঞ্চলের মধ্যে আসা-যাওয়াকেই বোঝায়। ফলে যেসব প্রজাতির পাখি পরিযানে অংশ নেয় তাদের পরিযায়ী পাখি বলে। এ পাখিরা প্রায় প্রতি বছর পৃথিবীর কোনো এক বা একাধিক দেশ বা অঞ্চল থেকে বিশ্বের অন্য কোনো অঞ্চলে চলে যায় কোনো একটি বিশেষ ঋতুতে। সে ঋতু শেষে সেগুলো আবার ফিরে যায় যেখান থেকে এসেছিল সেখানে। এমন আসা-যাওয়া কখনো এক বছরে সীমিত থাকে না। এ ঘটনা ঘটতে থাকে প্রতি বছর এবং কমবেশি একই সময়ে। উল্লেখ্য, কিছু প্রজাতির মাছ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, এমনকি পোকামাকড়ও ফি-বছর পরিযান ঘটায়। তবে পাখির মতো এত ব্যাপক আর বিস্তৃতভাবে কেউই পরিযানে অংশ নেয় না। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতিই পরিযায়ী পাখি।
যে কারণে পাখিরা পরিযান করে
পরিযায়ী পাখি প্রতি বছর যে ভৌগোলিক পথে এক দেশ থেকে অন্য দেশে বা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে নিয়মিতভাবে পরিভ্রমণ করে থাকে তাকে ‘উড়ন্ত পথ’ বলে। পাখিদের দেশান্তরী হওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে ঋতু পরিবর্তন, খাদ্যের স্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও বংশানুক্রমিক ধারা অন্যতম। শীত মৌসুমে হিমালয় পর্বতমালা এবং সাইবেরিয়া থেকে, কদাচ উত্তর মেরু থেকেও কিছু পাখি আমাদের দেশে প্রতি বছরই আসে এবং আবার ফিরে যায়। বার্ষিক এই আসা-যাওয়াই হচ্ছে পাখির পরিব্রজন, অভিপ্রায়ন। অভিপ্রায়ত পাখিকে আমরা বলি শীতের পাখি, অতিথি পাখি, পরিব্রাজক, যাযাবর বা পরিযায়ী পাখি। আমাদের দেশে দু’দলের শীতের পাখি বা অতিথি পাখি আসে।
এদের এক দল কেবল এদেশেই আসে এবং এখান থেকেই ফিরে যায়। অন্য দল বাংলাদেশ থেকে আরো দক্ষিণে যায়। তারা এই আসা যাওয়ার সময় বাংলাদেশে কিছু সময় ব্যয় করে। কোনো দেশে যাবার জন্য শীতের পাখিদের দেহে কিছু বাহ্যিক এবং কিছু অভ্যন্তরীণ উদ্দীপক কাজ করে। প্রথম উদ্দীপক হচ্ছে চামড়ার নিচে খুব পুরু হয়ে জমে ওঠা চর্বি। দ্বিতীয় হচ্ছে, আবহাওয়াগত যেমন দিনের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি, দৈনিক গড় তাপমাত্রা এবং বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ। উল্লেখ্য, হামিংবার্ডও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে খাবারের প্রাচুর্য থাকলে প্রচণ্ড শীতেও এরা বাসস্থান ছেড়ে নড়ে না। আলোর তীব্রতাও এদের পরিযানের অন্যতম কারণ।
কোথা থেকে আসে পরিযায়ী পাখিগুলো
এক সময় ধারণা ছিল যে রাশিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে অতিথি পাখি অর্থাৎ পরিযায়ী পাখিগুলো এ অঞ্চলে আসে কিন্তু এখন এর ভিন্নমত পাওয়া যাচ্ছে। এসব পাখি নিয়ে গবেষণা করেছেন পরিযায়ী পাখি বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, রাশিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে এসব পাখি আসে বলে যে তথ্য প্রচলিত আছে সেটি ঠিক নয়। বরং পাখিগুলো মূলত আসে উত্তর মঙ্গোলিয়া, তিব্বতের একটি অংশ, চীনের কিছু অঞ্চল, রাশিয়া ও সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে। অর্থাৎ উত্তর মেরু, ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু এলাকা ও হিমালয় পর্বতমালার আশপাশ এলাকা থেকেই পাখিগুলো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে আসে যেখানে তুলনামূলক কম ঠাণ্ডা পড়ে ও খাবার পাওয়া যায়। আবার মার্চ মাসের শেষ দিকে যখন এ অঞ্চলে গরম পড়তে শুরু করে ও শীতপ্রধান এলাকায় বরফ গলা শুরু হয় তখন আবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পাখিগুলো নিজ এলাকায় ফেরত চলে যায়। তবে পরিযায়ী পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, পাখি শুধু এ অঞ্চলেই আসে তা নয় বরং নানা পরিস্থিতিতে পাখি বিশ্বের নানা অঞ্চলে পরিভ্রমণ করে যা মূলত তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামেরই অংশ।
কেন পরিযায়ী পাখিরা বাংলাদেশে আসে
পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত বাংলাদেশে শীতের সময়ে জলাশয়গুলোতে পানি কমে যায় এবং সে সময়কার কচিপাতা, শামুক, ঝিনুকসহ কিছু উপাদান এসব পাখির প্রিয় খাবার। সে কারণে ওই সময়ে বাংলাদেশের জলাশয়গুলো হয়ে ওঠে তাদের খাবারের উপযোগী স্থান। ফলে পাখিগুলো যেখান থেকে আসে সেখানে শীতে বরফে সব ঢেকে যাবে এবং খাদ্য সংকট তৈরি হবে। সে কারণেই বেঁচে থাকার একটি উপযোগী এলাকা খুঁজতে খুঁজতেই কিছু পাখি এ অঞ্চলে আসে। মার্চ মাসের শেষে তারা আবার ফিরে যায়। ভারতেরও কিছু এলাকায় পরিযায়ী পাখিকে স্বল্পকালীন আবাস গড়তে দেখা যায়। তবে বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়াও নেপালের দু-একটি এলাকাতেও এসব পাখি অল্প হলেও দেখা যায়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ১৯৯৪ সালে পরিযায়ী পাখি এসেছিল ৮ লাখের বেশি। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা নেমে এসেছে দুই লাখের নিচে। অর্থাৎ গত ২০ বছরে প্রায় ছয় লাখ পাখির আসা কমে গেছে। তবে এখন এ সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের মতো বলে বলছেন পরিযায়ী পাখি গবেষকরা।
আমাদের পরিযায়ী পাখিরা
বাংলাদেশের শীতকে উপযোগী জেনে প্রতি বছরই অপেক্ষাকৃত বেশি শীতের অঞ্চলগুলো থেকে আসে লাখো পরিযায়ী পাখি। এই পাখিরা বাংলাদেশের প্রকৃতিতে ঠাঁই নেয়, প্রিয় অতিথি হয়ে থাকে গোটা শীতের মৌসুম। তাদের কলতানে মুখরিত হয় দেশের বিভিন্ন জলাভূমি। এসব পাখির পাখা ছড়িয়ে দেওয়া উড়ে চলার সৌন্দর্য বাংলাদেশের আকাশকে করে তোলে আরও সুন্দর। উল্লেখ্য, প্রতি বছর শীতকাল এলেই আমাদের আশপাশের বিভিন্ন জলাশয়, খাল-বিল, হাওর, পুকুর ভরে যায় নানা রংবেরঙের নাম না জানা পাখিতে। এসব পাখিকেই বলা হয় পরিযায়ী পাখি বা অতিথি পাখি।
তাই পৌষ মাঘ মাসে সচরাচর যেসব পাখি দেখা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- লেঞ্জা, কুন্তি হাঁস, জিরিয়া হাঁস, নীলশির, গ্যাডওয়াল, লালশির, পাতারি হাঁস, বামনীয়া, ভুটি হাঁস, কালো হাঁস, চখা-চখি, বালি হাঁস, বড়ো সরালী, ছোট সরালী, রাজ হাঁস, কানি বক, ধূসর বক, গো বক, সাদা বক, ছোট বক, মাঝলা বক, কালেম বা কায়েন, জল ময়ূর, ডুবুরি, খোপা ডুবুরি, ছোট পানকৌড়ি, বড়ো পানকৌড়ি, শামুক ভাঙা বা শামুক খোলা, কালো কুট, কাদা খোঁচা বা চ্যাগা, জলের কাদাখোঁচা পাখি, ছোট রিয়া, বাটান, চা পাখি, সবুজ পা, লাল পা পিও, লাল লতিফা বা হটটিটি, গঙ্গা কবুতর, কাল মাখা গঙ্গা কবুতর, রাজসরালি, পিন্টেল, পাতিসরালি, বালিহাঁস, ল্যাঞ্জাহাঁস, সাদাবক, দলপিপি, পানমুরগি, কাস্তেচড়া, বেগুনিকালেম, পানকৌডড়ি, ঈগল প্রভৃতি। পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে পৃথিবীতে প্রায় ৫ লাখ প্রজাতির পাখি আছে। এসব পাখিদের মধ্যে অনেক প্রজাতিই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অন্য দেশে চলে যায়। সেইসব দেশ বরফে ঢেকে যাওয়ায় এতই ঠাণ্ডা আবহাওয়া থাকে যে আমাদের দেশের শীতকাল সেই পাখিদের জন্য অনেক আরামদায়ক। এসব পাখি আমাদের দেশে প্রতি বছর বেড়াতে আসে। তাই প্রতি বছর শীতকাল এলেই জলাশয়, বিল, হাওর, পুকুর ভরে যায় নানা রংবেরঙের নাম না জানা পাখিতে। আদর করে আমরা সেগুলোকে বলি অতিথি পাখি। নাম অতিথি হলেও এই পরিযায়ী পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের দেশে হাজির হয় নিজেদের জীবন বাঁচাতে।
পরিযায়ী পাখি কমে যাওয়ার কারণ
পাখির আবাসস্থল ধ্বংস, বন ও গ্রামীণ গাছগাছালি হ্রাস, প্লাস্টিক দূষণ, জলাভূমির জবরদখল, পরিযায়ী পাখির নীলাভূমি হাওর-বাঁওড়ে ব্যাপক হারে মাছ শিকার, নদী ও সমুদ্রের নতুন চরে জেলে এবং শিকারিদের উৎপাত, যথেচ্ছভাবে পাখি পাচার ও নিধনের ফলে ইতোমধ্যে আমাদের দেশে আশঙ্কাজনকভাবে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এছাড়া জলাভূমিতে কৃষি সম্প্রসারণ, অধিক ফলনশীল শস্য উৎপাদনের জন্য যথেচ্ছভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োগ, চোরা শিকারি কর্তৃক ব্যাপক হারে অতিথি শিকার ও বাজারজাতকরণ, কলকারখানার প্লাস্টিক ও রাসায়নিক বর্জ্য ও কীটনাশকের প্রভাবে পানি দূষণ, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রের পানি লবণাক্ততার বৃদ্ধি এবং নতুন জেগে ওঠা চরে মানুষের বসতি ও কৃষিজমির সম্প্রসারণের কারণে পাখির সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে।
পরিবেশ সংরক্ষণে পরিযায়ী পাখি
আমরা হয়তো গভীরভাবে কখনোই উপলব্ধি করি না কিন্তু পরিযায়ী পাখি পরিবেশকে সুস্থ রাখার জন্য অনবদ্য অবদান রেখে চলছে প্রতিনিয়তই। পরিযায়ী পাখিরা সাধারণত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও পোকামাকড় নিধন করে। পরিযায়ী পাখি ফুল ও শস্যের পরাগায়ন ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শীতের সময় ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখির আগমনের ফলে নৈসর্গিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখির বিষ্ঠা জমিতে পড়ার ফলে জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি পায়। জমিতে নাইট্রোজেনের আবির্ভাব ঘটিয়ে জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পরিযায়ী পাখি পানিতে সাঁতরানোর ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। পরিযায়ী পাখির বিষ্ঠায় মাছের খাবার তৈরি হয়, ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া পরিযায়ী পাখির দৈহিক সৌন্দর্য, আকাশে ওড়ার দৃশ্য, বৈচিত্র্যময় জীবনাচরণ মানুষকে বিনোদন প্রদান করে থাকে।
পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
পরিযায়ী পাখিদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে ডিম, মাংস ইত্যাদি আহার করে থাকি তা আসে প্রধানত খামারজাত পাখি থেকেই। তবে অনেক দেশে প্রকৃতি থেকে পাখি ধরে মাংস হিসাবে বাজারজাত করছে। সুতরাং খাদ্যের উৎস হিসেবে পাখি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, পরিযায়ী পাখিদের সাহায্যে দূর-দূরান্তের গাছের বীজ চলে আসে নতুন জায়গাতে। ফুলের পরাগায়নেও পাখিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষত ছোট ছোট পাখিরা যখন এক ফুল থেকে অন্য ফুলে যায় তখন পালকে ফুলের পরাগরেণু মেখে নেয়। এভাবে পরাগায়ন হয়ে ফুল থেকে ফল হয়। চড়–ই বা অন্য পাখিরা খেতের ধান খেয়ে আদৌ কোন ক্ষতি করে কিনা, বা কতটুকু ক্ষতি করে সেটা নির্ণয় সাপেক্ষ। বাংলাদেশে চড়–ইসহ অন্যান্য পাখি কেবল ধানই খায় না, ধানের ক্ষতিকারক বিভিন্ন কীটপতঙ্গও খেয়ে থাকে। সুতরাং এদের শস্যের ক্ষতিকারক বলা যাবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এভাবে আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত গভীরভাবে জড়িত হয়ে আছে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। পাখি আমাদের ইকো-সিস্টেমের অংশ এবং এদের সংখ্যা কমে গেলে তার প্রভাব আমাদের ওপর পড়বে। আমাদের দেশের হাওর-বাঁওড় ও চরাঞ্চলে শীতের অতিথি পাখি দেখার জন্য হাজার-হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে থাকে। পরিবেশ পর্যটনকে উৎসাহিত করার জন্য পরিযায়ী পাখি ও আবসস্থল সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে পাখি মরার সঠিক তথ্য ও উপাত্ত আমাদের হাতে নেই। তবে প্রতিদিন সারা দেশে বিভিন্ন জাতের পাখি শিকার, পাচার ও নিধনের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই আমাদের দেশ থেকে পাখি বিলুপ্ত ও বিপন্ন হয়ে যাবে।
পরিযায়ী পাখির বিশেষ দিবস
বিশ্বজুড়ে পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে, পরিযায়ী পাখিদের গুরুত্ব সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া এবং প্রকৃতিতে পাখির অসামান্য অবদানের কথা বিবেচনা করে বিশ্ব বিবেকগণ ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের প্রথম শনিবার আড়ম্বরপূর্ণভাবে বিশ্বব্যাপী “পরিযায়ী পাখি দিবস” উদযাপন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমরা প্রত্যাশা করি, দিবসটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ছড়িয়ে যাক সবার মাঝে। তাহলেই বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস উদযাপন সার্থক হবে। পরিযায়ী পাখিদের আমরা মেহমানের দৃষ্টিতে দেখি, তাদের মুক্ত চলাচলে সহায়তা করি এবং স্বীয় নাগরিক দায়িত্ব পালন করি। আমরা আশা করি, পরিযায়ী পাখিতে সমৃদ্ধ হোক আমাদের এই ছোট্ট ভূখণ্ডটি।
পরিযায়ী পাখিদের প্রতি জাগ্রত হোক ভালোবাসা
পরিযায়ী পাখির জীবনযাপন ও পরিবেশ দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। বন-জঙ্গল কেটে উজাড় করে ফেলায় পরিযায়ী পাখিরা হারাচ্ছে তাদের বিচরণ ভূমি ও নিরাপদ আশ্রয়। ফসলি জমিতে কৃত্রিম সার ও মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে বিষে আক্রান্ত কীটপতঙ্গ খেয়ে তারা মারা যাচ্ছে। অনেকেই গুলি করে, বিষটোপ ব্যবহার করে, জাল পেতে পাখি শিকার করছে। যে পাখিগুলো শুধু শীত থেকে রক্ষা পেতে ও খাদ্যের সন্ধানে আমাদের দেশে আসে, তাদের রসনা তৃপ্তির জন্য শিকার করছি আমরা। অথচ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী, (অতিথি পাখি) পাখি হত্যার দায়ে একজন অপরাধীকে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। একইভাবে কোনো ব্যক্তি যদি পরিযায়ী পাখির মাংস, দেহের অংশ সংগ্রহ করেন, দখলে রাখেন কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করেন বা পরিবহন করেন, সেক্ষেত্রে তার সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার আইন প্রচলিত (বহাল) রয়েছে। তাই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আইন প্রয়োগে আমাদের কঠোর হতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে পাখিদের অবাধ বিচরণ অনেক সহজ হবে। পাখি পরিবেশের বন্ধু। মানুষের মনের খোরাক বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিযায়ী পাখির অবদান রয়েছে।
ঢাকা শহরের সরকারি-আধাসরকারি যেসব দফতর-প্রতিষ্ঠানের সীমানার মধ্যে রাস্তার ধার, পার্ক ও উন্মুক্ত প্রান্তরে গাছপালা আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে পাখির বাসা তৈরি এবং খাবার সরবরাহসহ লালন-পালনে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে নির্দেশনা গেলে বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে যাবে। প্রয়োজনে প্রত্যেক দফতরের দু’একজন কর্মচারী-কর্মকর্তাকে পাখি পরিচর্যা ও লালন-পালনের পদ্ধতিগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিভিন্ন জলাশয় বিশেষত টাঙ্গুয়ার হাওরকে কেন্দ্র করে পরিযায়ী পাখি এ মৌসুমে আরও কিছুদিন আসবে। ফলে বাসযোগ্য পরিবেশ বিনির্মাণে ওদেরও অবদান আছে। ওদের রক্ষা করতে হবে। তাই পরিযায়ী পাখিদের প্রতি জাগিয়ে তুলতে হবে হৃদয় থেকে সবার গভীর ভালোবাসা।
আরও পড়ুন...