শ্রাবণের বাদল দিনে

শ্রাবণের বাদল দিনে

প্রচ্ছদ রচনা মুহাম্মদ রবিউল ইসলাম জুলাই ২০২৪

তোমাদের একটি ছড়া শোনাই-


 ‘বৃষ্টি এল কাশ বনে

জাগল সাড়া ঘাস বনে

বকের সারি কোথা রে

লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে

নদীতে নাই খেয়া যে

ডাকল দূরে দেয়া যে

কোন সে বনের আড়ালে

ফুটল আবার কেয়া যে...’

কে লিখেছেন এই ছড়া? আমি জানি খুব সহজেই তোমরা বলে দেবে, কবি ফররুখ আহমদ। তিনি এই লেখাতে খুব সাবলীলভাবে, সহজে ও অল্প কথায় পুরো বর্ষাকালের রূপ বর্ণনা করেছেন। আর বর্ষা মানেই কদম ফোটার দিন, টিনের চালে টাপুরটুপুর সুর।

বাংলাদেশের ছয়টি ঋতু, এ কথা তোমাদের জানা। আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল, এ কথাও তোমরা অনেক আগেই পড়ে ফেলেছো। কিন্তু কী বলো তো, বর্ষাকালে পুরো বাংলাদেশ যেন নতুন রূপে সাজে। এ সময় রাস্তার পাশের ঘাসগুলোও নিজের সৌন্দর্যকে মেলে ধরে। যা দেখে আমরা মুগ্ধ হই। গাছের পাতাগুলো সবুজ থেকে আরও সবুজ হয়ে ওঠে, খালে-বিলে পানি থৈ থৈ করে। সন্ধ্যার পরে শুরু হয় ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক। পড়ন্ত বিকেলে বৃষ্টিতে ভেজা কলমি লতার দোল আরও একবার মনে করিয়ে দেয়, আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি কত সুন্দর!

এজন্যই তো কবি মতিউর রহমান মল্লিক লিখেছিলেন,

‘তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর

না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর

সেই কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় লগ্ন

ভরে যায় তৃষিত এ অন্তর...।’

বাংলা ক্যালেন্ডারে দ্বিতীয় ঋতু বর্ষা। সব ঋতুর মতো বর্ষারও নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এ সময় আকাশ কালো হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে তো কয়েক দিন সূর্যের দেখা মেলে না। অঝোরে শুধু বৃষ্টিই ঝরে যায়। তাই গ্রীষ্মের তীব্রতা শেষে বর্ষা যেন মানুষের জীবনে স্বস্তির বার্তা নিয়ে আসে। বর্ষার রূপ-রস আর সৌন্দর্যে চারপাশের প্রকৃতি সজীব হয়ে ওঠে। বৃষ্টির টাপুর টুপুর শব্দ বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় গ্রামে। তোমরা যারা শহরে থাকো, তারা হয়তো বৃষ্টির শব্দকে সেভাবে উপভোগ করতে পারো না। কিন্তু যারা গ্রামে থাকে তারা কিন্তু বৃষ্টির আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। বিশেষ করে টিনের চালে ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দ তোমাদের মুগ্ধ করবে।

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। এ কথা যেন আরও বেশি সত্যি হয়ে ওঠে বর্ষাকালে। মরা নদীও বর্ষায় জেগে ওঠে, নদীগুলো যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। নদীর ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধ, কালো পানি সব নিমিষে হারিয়ে যায়। শুধু নদী নয় নতুন করে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি। এজন্য হয়তো বর্ষাকে প্রকৃতির রাণী বলা হয়। এ সময় পুরো প্রকৃতি হয়ে ওঠে একটি ক্যানভাস। আর সেই ক্যানভাসে রং মাখিয়ে দেন কোনো এক শিল্পী। আচ্ছা সেই শিল্পী কে? তিনি হলেন সবকিছুর স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা। আমরা কিন্তু মাথা নত করে এই শিল্পীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো, ইবাদত করবো।

বর্ষাকালে অনেক রকমের ফুল ফোটে। বলতে গেলে বর্ষা বাহারি রঙের ফুলের সমাহার নিয়ে হাজির হয়। এ সময়ের সবচেয়ে পরিচিত ফুল কদম। তাই বর্ষাকালের কথা উঠলে তার সঙ্গে ওঠে কদম ফুলের কথা। এ কথা বলাই যায়, বর্ষা হলো কদম ফোটার দিন। মূলত বর্ষার শুরুতেই গাছে গাছে ফুটতে থাকে কদম ফুল। কদম ফুলের আগমন বলে দেয় এই বুঝি বর্ষাকাল এসে হাজির হলো। আর বিলেঝিলে ফোটে আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা। এছাড়াও বর্ষাকালে প্রকৃতিকে সাজাতে বনে বনে ফোটে নানা রকমের ফুল। এই যেমন- কেয়া, তমাল, হিজল, জারুল, করবী, সোনালু, বকুল, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা, রঙ্গন, অলকানন্দ, কলাবতী, চন্দ্রপ্রভা, কামিনী, কলমি ফুল, পদ্ম, বনতুলসী, দোলনচাঁপা, ঝিঙেফুল, সোনাপাতি, কচুফুল, হেলেঞ্চা ফুল, উলটকম্বল, ঘাসফুল, শিয়ালকাটা, কেন্দার, কুমড়ো ফুল। এরপরও নানা রঙের অর্কিডসহ বাহারি অনেক ফুল বর্ষাকালে ফোটে।

আগেই বলেছি বর্ষার আসল রূপ গ্রামের মানুষ বেশি উপভোগ করতে পারে। এ সময় গ্রামের কাদাময় পথঘাট, কৃষকের ক্ষেতে কিংবা মাঠে শিশু-কিশোররা ফুটবল খেলায় মেতে ওঠে। পুকুরে ঝাপাঝাপি ও সাঁতার কেটে বৃষ্টি উপভোগ করে। গ্রামের নদ-নদী, পুকুর-নালা, হাওড়-বাঁওড়সহ ছোটো-বড়ো জলাশয় পানিতে ভরে ওঠে। নকশিকাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত সময় পার করেন গ্রামের নারীরা। সদ্য লাগানো ধানের চারা বৃষ্টির পানিতে সবুজ রং ধারণ করে। একদল দামাল কিশোর ডোবা-নালায় শালুক কুড়িয়ে বেড়ায়, তারা নৌকা বোঝাই করে শাপলা তুলে নিয়ে আসে। কলার ভেলায় চড়ে আনন্দে মেতে ওঠে আরেক দল দুরন্ত কিশোর। চারদিকে থইথই পানির ঢেউয়ের তালে তালে এগিয়ে চলে বাইচের নৌকা। গ্রামবাংলার মানুষের অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম নৌকাবাইচের আয়োজন থাকে বর্ষাজুড়ে।

তোমরা যারা শহরে থাকো, তাদের কাছে বর্ষার এসব রূপ হয়তো অপরিচিত। কেন বলো তো? কারণ গ্রামের বর্ষা মানে অবারিত মাঠ, মেঘলা আকাশ, টলমলে জলের পুকুর, মাটির সোঁদা গন্ধ, ভেজা সবুজ ঘাস ও পাতার হাসি। অথচ শহরের বর্ষা হলো চার দেওয়ালে বন্দি থাকা। মাঝে মাঝে ব্যালকনিতে কিংবা ছাদে গিয়ে একটু ভিজে নেওয়া। এতে বর্ষাকে মনের মতো করে উপভোগের সুযোগ থাকে না। বর্ষার থইথই জলে টেংরা, পুঁটি, টাকি, কই, মাগুর, শোল, বোয়াল, রুই, মৃগেলসহ নানা প্রজাতির মাছের সমারোহ দেখা যায়।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে শ্রাবণ মাসটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য ধানের অধিকাংশ প্রজাতি যেমন আউশ, আমন, ইরি এ সময় রোপণ করা হয়। এসব ধান চাষে প্রয়োজনীয় সেচ বা পানির চাহিদা মেটায় বৃষ্টির পানি। এ সবই কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালার রহমত। তাই তাঁর প্রতি যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুল না করি। আমরা যত বেশি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো, ইবাদত করবো- আল্লাহ তাঁর রহমতের ভাণ্ডার থেকে আমাদের তত বেশি দান করবেন।

বর্ষায় প্রকৃতি অপরূপ সাজে সাজলেও মাঝে মাঝে জনজীবনে দুর্ভোগ ও বিপর্যয় নিয়ে আসে। ভারী বৃষ্টিতে পলি জমা নদীর পানি ফেঁপে ওঠে, এতে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। দেশের কোনো কোনো এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। তোমরা হয়তো পত্রিকায় কিংবা টিভির পর্দায় বন্যার সংবাদ দেখে থাকবে। সেসব খবরে সেখানকার মানুষের ভয়াবহ দুর্দশার দৃশ্য ফুটে ওঠে। খাবারের অভাব, পানির অভাবে মানুষকে অনেক কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়। আবার বর্ষার সময় অনেক দিনমজুর পরিবারকে কষ্টের মধ্যে থাকতে হয়। কারণ তারা কাজে যেতে পারেন না। আমাদের কিন্তু এ ধরনের মানুষের পাশে দাঁড়ানো দায়িত্ব। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের সাহায্য করতে হবে। দেখবে তোমরা কেউ একজন যদি তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসো, তাহলে তোমাকে দেখে আরও অনেকে এগিয়ে আসবে। আর এটাই হলো ভালো কাজের শক্তি।

বন্ধুরা তোমরা দেখেছো এবছর দেশব্যাপী তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। তীব্র গরমে মানুষকে কী পরিমাণ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে! এর অন্যতম কারণ জলবায়ু বিপর্যয়। একটু ভেবে দেখো তো দেশে আগের মতো গাছ আছে? বনভূমি আছে? নেই! কারণ মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে বন উজাড় করেছে, অবাধে গাছ কেটেছে। কিন্তু নতুন করে বৃক্ষ রোপণ করেনি। জলবায়ু বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ এটি।

বন্ধুরা, আল্লাহর দেওয়া প্রকৃতি থেকে শুধু নিলে হবে না, প্রকৃতিকে কিছু দিতেও হবে। আর তোমরা চাইলেই প্রকৃতিকে কিছু দিতে পারো। তোমাদের হাতেই শুরু হতে পারে নতুন কিছু, তোমাদের হাতে বদলে যেতে পারে দেশ। এজন্য তোমরা বেছে নিতে পারো বর্ষাকালকে। এ সময় বেশি বেশি বৃক্ষ রোপণ করতে পারো। দেখবে তোমরা এগিয়ে এলে আবারও দেশ ভরে উঠবে নানা রকম গাছে। সবুজে সবুজে ভরে উঠবে আমাদের প্রকৃতি। তাই এসো বন্ধুরা এই বর্ষাকালে বেশি বেশি গাছের চারা রোপণ করি। বদলে যাই এবং দেশকে বদলে দিই। নিজেকে সোনার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি। নিশ্চয়ই ভালো কাজে আল্লাহ তায়ালা আমাদের সাহায্য করবেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ