সবুজ চাদর

সবুজ চাদর

গল্প মতিউর রহমান মিয়াজী জানুয়ারি ২০২৫

শীতের সকাল। কুয়াশার চাদরে আচ্ছন্ন চারিদিক। আজ প্রচুর শীত পড়েছে। চৌমুহনী রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশনে কয়েকজন কুলি আগুন জ¦ালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে। তারা অপেক্ষা করছে উপকূল এক্সপ্রেসের জন্য। ট্রেন প্লাটফর্মে ভিড়লে তাদের কাজ শুরু হয়ে যাবে। মালামাল নামানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে তারা। তখন আর শীত থাকবে না। কাজের চাপে এমনিতেই শীত উবে যাবে। তার আগ পর্যন্ত অন্তত আগুন জ্বালিয়ে হলেও শীত নিবারণ করতে হবে। একজন কুলি কিছু কাগজ এনে আগুনের মধ্যে দিলো। কুয়াশায় কাগজগুলো ভিজে গিয়েছিল। আগুনের গতিটা কিছুটা কমে গিয়ে ধোঁয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি হলো। অন্য একজন কুলি তাকে বকা দিতে লাগলো, ফাজলামি তুমি একটু বেশিই করো। কী দরকার ছিল ভেজা কাগজ দেওয়ার? তখন ভুক্তভোগী কুলিটা আগুনের গতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিল। কাগজগুলো আস্তে আস্তে পানি শুকিয়ে শুকনো হয়ে উঠলো। আর আগুনও বাড়তে লাগলো। এমন সময় আট-দশ বছরের একটা ছেলে ও পাঁচ-ছয় বছরের একটা মেয়ে এসে তাদের পাশে বসলো।

ছেলেটার জীর্ণ-শীর্ণ দেহ। গায়ে একটা ময়লাযুক্ত পোশাক। আর মেয়েটার পরনে একটা ফ্রক। দু-এক জায়গায় ছেঁড়া। গায়ের জামাটাও ছেঁড়া। দু’জনেই শীতের প্রকোপে কাঁপছে। ওরা দু’জন ভাই-বোন। ছেলেটার নাম ফাহিম আর মেয়েটার নাম ফাহিমা। ওদের দাদা-ই এমন মিল করে ওদের নাম রেখেছিল। চার বছর হলো ওদের দাদা মারা গেছে। আর দাদী মারা গেছে তারও কয়েক বছর আগে। ওদের কিছু জমি ছিল। সেই জমিতে চাষাবাদ করে যা ধান পেতো তা দিয়ে ওদের সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু সর্বনাশী মেঘনা ওদের ঘর-বাড়ি-জায়গা-জমি সবকিছু কেড়ে নিয়ে ওদের পথে বসিয়ে দিয়েছে। কিছুদিন ওরা ওদের নানা বাড়িতে ছিল। তার বাবা যেদিন কুলির কাজটা পেল তার কিছুদিন পরেই ওরা রেলস্টেশনে চলে এলো। স্টেশন মাস্টার খুব ভালো মানুষ। তিনি স্টেশনের পাশে একটা পরিত্যক্ত ঘরে ওদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। তারপর থেকে রেলস্টেশনই ওদের বাড়ি-ঘর হয়ে উঠলো। ওদের বাবা কুলির কাজ করে আর মা অন্যের বাসায় ঝি-এর কাজ করে।

ঘন কুয়াশা ভেদ করে একটা আলো ছুটে আসছে স্টেশনের দিকে। কুলিরা সবাই প্রস্তুত মালামাল নামানোর জন্য। তারা আলো দেখেই বুঝে ফেলেছে যে ট্রেন আসছে। সবাই যার যার পজিশন নিয়ে নিল। এমন সময় গমগম আওয়াজ তুলে, সাইরেন বাজিয়ে ট্রেন এসে থামল প্লাটফর্মে। কুলিরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল মালামাল নামানোর জন্য। আর এদিকে ফাহিম তার বোনকে নিয়ে এসে দাঁড়াল একটা বগির সামনে। টার্গেট কারো ব্যাগ সিএনজি বা রিক্সাতে তুলে দিয়ে কিছু টাকা ইনকাম করা।

দুই.

তাফহীম তার বাবা-মা’র সাথে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসছে। রাত দশটায় কমলাপুর থেকে তাদের ট্রেন ছাড়ল। তার বাবা মতিঝিল আইডিয়ালের গণিত শিক্ষক। সে-ও মতিঝিল আইডিয়ালে ক্লাস সিক্সে পড়ে। তার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। আবার তাদের স্কুলও শীতকালীন ছুটি। সবমিলিয়ে তারা গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করলো। প্রতি শীতেই তারা গ্রামে বেড়াতে আসে। তারা গ্রামে এলে একটা শীতকালীন উৎসবের মতো কিছু একটা হয়ে যায়। তাফহীমের চাচারাও এই সময়ে বেড়াতে আসে। 

তার বাবারা চার ভাই। তাফহীমের বাবা সবার বড়ো। সে হিসেবে তার চাচা তিনজন। মেঝো চাচা থাকেন চট্টগ্রাম আর ছোট চাচা সিলেটে। বড়ো চাচা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। সবাই ছেলে সন্তান নিয়েই বেড়াতে আসে। যার কারণে তাফহীমও খুঁজে পায় তার খেলার সাথী। কাজিনরা মিলে একসাথে মাতিয়ে তোলে পুরো বাড়ি।

অনেক দিন পর তাফহীম আবার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। তার চাচারাও আসবে ফ্যামিলি নিয়ে। তার মানে কাজিনরাও আসবে। তার কাছে খুবই ভালো লাগছে। খুব মজা হবে। তাফহীম বসে বসে এসব ভাবছে। আর এদিকে তার মা-বাবা ঘুমে অচেতন। মাঝে মাঝে স্টেশন এলে হকাররা এসে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করছে। তাফহীম মনে মনে চিন্তা করছে তার দাদা-দাদীর জন্য শীতের কিছু কিনবে। কারণ দাদা-দাদী তাকে খুব আদর করে। বেড়াতে গেলে কত কিছু যে কিনে দেয় তার ইয়ত্তা নেই! নরসিংদী আসার পর একজন হকার এলো চাদর নিয়ে। তাফহীম ঠিক করলো ২টা সবুজ চাদর কিনবে দাদা-দাদীর জন্য। যেই ভাবা সেই কাজ। সে হকারকে ডাক দিলো। হকার এগিয়ে এসে বললো- শাল নেবে? তাফহীম একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো, হুম। দাদা-দাদীর জন্য ২টা নেব। দাম কিন্তু কম রাখতে হবে। হকার লোকটির বয়স আনুমানিক ৫০-এর কাছাকাছি। লোকটি চাদরের বান্ডেল খুলে কয়েকটা চাদর দেখাল তাফহীমকে। তাফহীম বললো, আমাকে সবুজ চাদর দিন। লোকটি বান্ডেল থেকে দুটো সবুজ চাদর বের করে দিলো। তাফহীমের দুটোই পছন্দ হলো। সে দাম জিজ্ঞেস করলো এবার। লোকটা একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো, সাধারণত প্রতিটা চাদর আমরা ছয়শ করে বিক্রি করি। তোমার জন্য পাঁচশ করে রাখব। তাফহীম আর কিছু জিজ্ঞেস না করে তার স্কুলব্যাগের ভেতরের পকেট থেকে ১টা এক হাজার টাকার নোট বের করে দিলো। টাকাটাও ছিল তার খুব শখের। সে ক্লাসের একটা সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতায় ১ম হয়ে হেড স্যার থেকে টাকাটা পেয়েছিল। তখন থেকেই তার ইচ্ছা দাদা-দাদির জন্য কিছু কিনবে। আজ তার ইচ্ছা পূরণ হলো। 

লোকটি এক হাজার টাকার চকচকে নোট পেয়ে খুশিতে আটখানা। যাওয়ার সময় তাফহীমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, তুমি একদিন অনেক বড়ো হবে। তাফহীম এক পলক লোকটির চেহারার দিকে তাকিয়ে চাদরের দিকে মনোযোগ দিলো। চাদর দুটো তার খুব পছন্দ হয়েছে। তারপর সে তার ব্যাগের মধ্যে চাদর দুটো রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। 

এক ঘুমে সকাল হয়ে গেল তার। এই তাফহীম ওঠো বাবা! আমরা চলে এসেছি। মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে তার। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্নে দেখেছিল তার ব্যাগ খুঁজে পাচ্ছে না। ঘুম ভাঙতেই তাই সে প্রথমে তার ব্যাগ চেক করলো। দেখল যে ব্যাগ এবং চাদর ঠিকঠাক মতো আছে। তারপর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মায়ের সাথে ট্রেন থেক নামল। ট্রেন থেকে নেমেই দেখতে পেল এক কাণ্ড। তার বাবার হাত থেকে ব্যাগ নেওয়ার জন্য একটা ছেলে বায়না ধরেছে। ছেলেটা কিছুটা অসহায় ভঙ্গিতে বলছে, স্যার, অনেক বড়ো ব্যাগ আপনার কষ্ট হবে। আমি সিএনজিতে তুলে দিচ্ছি। আমারে বিশ টাকা দিলে হবে। আমি আর আমার বোনটা চিপস খাব। ফারুক সাহেব তার কথায় হাসলেন। তিনি পকেট থেকে বিশ টাকা বের করে বললেন, এত বড়ো ব্যাগ তুমি পারবে না। বরং তুমি এই টাকা নিয়ে চিপস কিনে নাও। তাফহীম খেয়াল করলো ছেলেটা টাকা নিচ্ছে না। বলছে, কাজ না করে টাকা নিতে আমার বাবা নিষেধ করেছে। কাজ না করে টাকা নেওয়া নাকি ভিক্ষার শামিল। ভিক্ষা করা নাকি অনেক খারাপ। সম্মান কমে যায়। পিচ্ছি ছেলের মুখে এমন কথা শুনে সবাই তো অবাক! তাফহীম তার ব্যাগটা ছেলেটার হাতে দিয়ে বললো, এটা ছোট আছে। তুমি এটা নিয়ে আমাদের সাথে এসো। ছেলেটা খুশি হয়ে এবার তাফহীমের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। সে মনে মনে বললো, যাক বাবা অন্তত বিশ টাকা ইনকাম করা গেল। 

আগে থেকেই স্টেশনের সামনে তাফহীমের দাদা একটা সিএনজি রিজার্ভ করে দাঁড়িয়েছিল। ফোনেই তাফহীমের বাবার সাথে তাঁর যোগাযোগ ছিল। তাফহীম গিয়ে দাদাকে জড়িয়ে ধরলো। তার দাদাও তাকে জড়িয়ে ধরল। সে দেখলো তার দাদার গায়ে একটা সবুজ চাদর। তাফহীম মনে মনে ভাবল নিশ্চয় দাদীর জন্যও চাদর চাদর কেনা হয়েছে। তাহলে এগুলো কোনো গরিব মানুষকে দান করে দেওয়া যাবে। 

সে দেখল যে ছেলেটা তার ব্যাগ নিয়ে আসলো সে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে একটা ফুটফুটে মেয়ে। সে ওদের নাম জিজ্ঞেস করলে ছেলেটা বললো, আমার নাম ফাহিম আর ওর নাম ফাহিমা। তাফহীম অবাক হয়ে বললো, খুব সুন্দর মিল তো! তার মানে তোমরা ভাই-বোন! ছেলেটা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। 

তাফহীম কথা বলতে বলতে খেয়াল করলো মেয়েটা শীতে থরথর করে কাঁপছে। আর ছেলেটাও কিছুটা কাঁপছে। সে কৌতূহলের সাথে জিজ্ঞেস করলো, তোমাদের কি শীতের জামা নেই? ওরা দু’জনেই মাথা দুলিয়ে বোঝাল- নেই। 

তারপর সে তার ব্যাগ থেকে সবুজ চাদর দুটো বের করে ২ জনের হাতে তুলে দিলো। আর বড়োদের মতো করে বললো, এখন থেকে চাদর পরে ঘর থেকে বের হবে। আমার আব্বু বলেছে, ছোটদের ঠাণ্ডা লাগলে নিউমোনিয়া হয়। নিউমোনিয়া হলে কিন্তু বাঁচবে না। তারপর পকেট থেকে বিশ টাকার একটা নোট ছেলেটার হাতে তুলে দিলো। ওরা দুই ভাইবোন খুশিতে আত্মহারা হয়ে স্টেশনের দিকে ছুটল।

আর এদিকে তাফহীমের বাবা-মা এবং দাদা তাফহীমের কাণ্ড দেখে মুখ টিপে টিপে হাসছে। তাদের দিকে চোখ পড়তেই লজ্জায় তাফহীমের মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ