সুখের আবাদ
গল্প খাতুনে জান্নাত কণা এপ্রিল ২০২৫
‘আম্মাকে খবরটা দিতেই হয়’। ভাবতে ভাবতে, শীতের তীব্রতায়, কুয়াশাভেজা সকালের তীক্ষè ফলার মতো শরীরে বিঁধে যেতে থাকা ঠাণ্ডা বাতাসের দাপটে কাঁপতে কাঁপতে ইব্রাহীম তাঁবুর ভেতর ঢোকে।
: আম্মা, আম্মা গুল কী করেছে আজ জানেন?
: আমার জানের টুকরা ইব্রাহীম, কী করেছে তোমার বোন? কোনো যুদ্ধ বিমান ছোট পাথরের টুকরোর ঢিল ছুঁড়ে যদি নামিয়ে থাকে তো বলো। ও তো ঘুমে স্বপ্নের মাঝে প্রতিদিন এটা করে।
: না আম্মা। কল্পনা নয়। সত্যিকারের একটা ভালো কাজ ও করেছে। দেখবেন, আসুন।
: তোমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা কোথায় করবো তাই নিয়ে পেরেশান আছি বাবা। তাঁবুর ভেতর প্রচুর বৃষ্টির পানি জমে আছে; এ পানি বের করতে না পারলে তো এখানে থাকা যাবে না।
: রেড় ক্রিসেন্টের একটা গাড়ি পাশের গ্রামে ঢুকেছে। খালিদ চাচা আর আব্বা সেখানে গিয়েছেন। গুল নাহার ওর সাথী মেয়েদের নিয়ে সেই দিকে গিয়েছে। আপনি এখন আমার সাথে একটু আসুন। আপনার মন ভালো হয়ে যাবে।
: মন ভালো হওয়ার মতো ঘটনাও তবে ঘটেছে? চলো তাহলে দেখি গিয়ে। ফাতিমা অবাক বিস্ময়ে তার ১৩ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ের তৈরি কূপটা দেখলেন। গুল নাহারের চার বছরের বড়ো ভাই ইব্রাহীম আপন মনে বলে যাচ্ছিল,
: জানেন আম্মা, গুল ওর সাথীদের নিয়ে, চোখা দেখে পাথর আর কাছের টুকরো এনে, এখানে কয়েক দিন ধরে গর্ত খুঁড়েছে, ওর ইচ্ছে ছিল দশ ফুট গভীর গর্ত খুঁড়ে পানি জমিয়ে রাখবে। কিন্তু ওর সাথীরা এত বেশি কষ্ট করতে রাজি হয়নি। মাত্র সাত ফুট করতে পেরেছে। দেখেছেন? চারদিকে পাঁচফুট প্রশস্ত? এত কম গভীরতায় নিচে থেকে পানি উঠবে না, বুঝতে পেরে ছোট ছোট পাথর আর কয়লা এনে কুয়ায় পাটিতে বিছিয়ে দিয়েছে। কিছু স্বচ্ছ বালি দিয়ে তার ওপর আবার পাথর দিয়েছে। ওর সাথীদের সাথে করে প্রতিদিন কয়েক বালতি ভরা খাবার পানি এখানে ঢেলে দিয়ে কুয়ো ভরিয়েছে। তারপর, একটা ত্রিপল এনে, চারদিকে খুঁটি পুঁতে, তার ওপর ঢেকে দিয়ে, কোনাগুলো বেঁধে দিয়েছে। ত্রিপলের ওপর কিছু আগাছা রেখেছে; যেন ড্রোন বা বিমান থেকে এটাকে জঙ্গল মনে হয়। ওর ভয় ছিল, একসময় আমাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। তখন বেশি জরুরি দরকার হবে ‘খাবার পানি’। আজ বৃষ্টির সময়, ত্রিপলের দুই কোনা খুলে, বৃষ্টির পানি কুয়ায় ধরে রেখেছে। পুরো কুয়া ভর্তি খাবার পানি। দেখেছেন আম্মা? আমাদের জন্য আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। ফাতিমার চোখ অশ্রুসজল হয়ে আসে। গলার ভেতর কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠছে। কিছু বলতে পারলেন না; শুধু ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকালেন। বললেন,
: আমার মেয়েটা যেমন বুদ্ধিমতী, ছেলেও তো বুদ্ধিমান। সে আমাদের আর তার প্রতিবেশীদের জন্য কী করেছে?
: আম্মা, আমি তো আমার বন্ধুদের নিয়ে একটা টয়লেট বানিয়েছি।
: সত্যি বলছো? কোথায়?
: কয়েকটা বড়ো ছোট পাথর জোগাড় করে, ঐ যে কাঁটা ঝোপটার সাথে ঢিবির মতো দেখছেন, সেখানে। পাশে একটা বড়ো গর্ত করে ময়লা যাওয়ার অবস্থা রেখেছি। নূর চাচার বাড়ি বানানোর সময় একটা বড়ো সিমেন্টের শ্লট আমরা চেয়ে নিয়েছিলাম। সেটা নিয়ে গর্তটা ঢাকার সময়, চাচা এসে দেখে বললেন, আগে বললে আমি তোমাদের আরো সহযোগিতা করতে পারতাম। অসুবিধা নেই। মাটির তলা দিয়ে পানির বন্দোবস্ত কীভাবে করতে পারি দেখি। এ কথা বলার পর, চাচা আমাদের ঐ টয়লেটের আশপাশে আরো দুটো টয়লেট, পানির রিজার্ভ ট্যাংক বানিয়ে দিয়ে, টয়লেটের ভেতর পাইপ লাইন টেনে, পানির বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন, মাটির ঢিবির আড়ালে একটা মোটর এমনভাবে রেখেছেন, যা কেউ সহজে দেখতে পাবে না। বড়ো ব্যাটারি রাখা আছে মোটর চালানোর জন্য। সোলার প্যানেলও রাখা আছে।
সব শুনে, ফাতিমা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। তার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি ঝরছিল। এমন কিছু সংবাদেও আনন্দিত হওয়া যায়? আজ তারা কী খাবেন এই আয়োজনও নেই। ইব্রাহীম বললো,
: আম্মা, চলুন আমরা খাবারের ব্যবস্থা করি,
: কী খাব আমরা বাবা? ফাতিমার জন্য একরাশ বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ইব্রাহীমের কাছে শুনলেন, কেমন করে ওর নূর চাচা, জাকারিয়া চাচা, ওর আব্বা ইউসুফ মিলে, খোলা মাঠের নিচের অংশে রাত জেগে, গোপনে, কঠোর পরিশ্রম করে, গুদাম ঘর, গবাদি পশু রাখার জায়গা, আর রান্নার সরঞ্জাম রাখার কক্ষ তৈরি করেছেন। সেখানে কম্বল, শীতের কাপড় মাদুরও আছে। সব শুনে ফাতিমা খুব খুশি হলেন। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানালেন। জালিমের চোখ এড়িয়ে এভাবে আমাদের বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা জারি রাখতে হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে গুলনাহার আর তার বাবা ইউসুফ ফিরে এলেন। রেড় ক্রিসেন্ট থেকে তারা কিছু প্রাথমিক সিকিৎসা সরঞ্জাম, গুঁড়ো দুধ আর বিস্কুটের একটা বক্স পেয়েছে। গুলনাহার আসার সাথে সাথে তার আম্মা ফাতিমা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক দোয়া করলেন। বললেন, গুল আমার কলিজার টুকরা মামনি। কুয়া তৈরি করে তোমরা খুব ভালো কাজ করেছো। এভাবে শত্রুর মোকাবিলায় আমাদের কৌশলী হয়ে বাঁচতে হবে। দুঃখজনক খবর হলো, প্রতিবেশী ইদ্রিস ভাইয়ের ছোট্ট সন্তানটা অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় অসুস্থ হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আল্লাহ এই বেহেশতি পাখিকে শান্তিতে রাখুন। আমিন।
বিকেলের মধ্যে ইব্রাহীমদের তাঁবুতে অনেকটা স্বস্তি ফিরে এলো। ওরা নিজেদের চেষ্টায় পানি সেঁচে তাঁবুর ভেতরটা শুকিয়েছে। খোলা প্রান্তরের বালি এনে ফেলা হয়েছে তাঁবুর মেঝেতে। তার ওপর বিছানা তৈরি করে কম্বল গায়ে ঘুমানোর সময় পরিবারগুলো ভাবছিল, ‘আল্লাহ মহান’। আমাদের আজ খাওয়া, ঘুম, সবকিছুর জন্য স্বস্তিদায়ক ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। প্রাসাদোপম বাড়ির আরামদায়ক ঘরটি বোমা হামলায় ধ্বংস হলেও ফাতিমাদের মনে আনন্দ; তাদের বেশির ভাগ প্রতিবেশী এখনো জীবিত আছে। আল্লাহ চাইলে আবার নিজেদের ঘর হবে। এখন ঈমানের পরীক্ষায় আল্লাহ যেন উত্তীর্ণ করেন, এমন প্রার্থনাই তাদের কাছে মুখ্য। আল্লাহ যাদের ভালোবাসেন, তাদের তো পরীক্ষা দিতেই হয়।
আরও পড়ুন...