হামহাম জলপ্রপাত

হামহাম জলপ্রপাত

ফিচার আবদুল হাই ইদ্রিছী এপ্রিল ২০২৫

মানবমন সর্বদা মুক্তি পিয়াসী, চিরচঞ্চল। একটু অবকাশ পেলেই মানুষ ছুটে যায় দিগ দিগন্তে সৌন্দর্যের আকর্ষণে। জন্মগতভাবেই মানুষ কৌতূহলী। তার সে কৌতূহল নতুন নতুন বিষয়ের প্রতি। প্রকৃতি ও মানুষের সৃষ্ট সৌন্দর্যের নানা নিদর্শন সে মানবীয় সত্তা দিয়ে অনুভব ও উপলব্ধি করতে চায়। তাহলে পরিচয় করিয়ে দেই এক আকর্ষণীয় পর্যটন নগরীর সাথে। যেখানে দীর্ঘ পথ জুড়ে সবুজ গালিচা বিছিয়ে আছে সারি সারি চা-বাগান। চা কন্যারা নিপুণ হাতে দু’টি পাতা আর একটি কুঁড়ি সংগ্রহ করে ঝুলিতে ভরছেন। এরই মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ছায়াবৃক্ষ। তাতে শিস দিচ্ছে নানা রূপরঙের সুরেলা পাখি। পিচঢালা পথে চলতে চলতে স্বর্গীয় এক অনুভূতি ছুঁয়ে যায়। এমনই এক অপার মায়াবী সৌন্দর্যের প্রতীকের নাম হামহাম জলপ্রপাত।

অরণ্যঘেরা মায়াবী হামহাম জলপ্রপাত এর কাচের মতো স্বচ্ছ পানি পাহাড়ের শরীর বেয়ে আছড়ে পড়ছে বড়ো বড়ো পাথরের গায়ে, গুঁড়ি গুঁড়ি পানিকণা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা। বুনোপাহাড়ের প্রায় ১৬০ ফুট ওপর থেকে গড়িয়ে পড়া স্রােতধারা কলকল শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে পাথরের পর পাথর কেটে, সামনের দিকে তার গন্তব্যে। চারিপাশ গাছ গাছালি আর নাম না জানা হাজারো প্রজাতির লতাপাতা ও লতাগুল্ম আচ্ছাদিত হয়ে আছে পাহাড়ি শরীর। স্রােতধারা সে লতাগুল্মকে ভেদ করে গড়িয়ে পড়ছে ভূমিতে। তৈরি করছে স্রােতস্বিনী জলধারা। সে যে কি এক বুনোপরিবেশ না দেখলে বিশ্বাস করানো সম্ভব নয়। শ্রাবণের প্রবল বর্ষণে যখন পুরো জঙ্গল ফিরে পায় তার চিরসবুজ, হয়ে ওঠে সতেজ আর নবযৌবনা। হামহাম ঝরনা তখন ফিরে পায় অপরূপ সৌন্দর্য। ঝরনার সতেজতায় পাহাড়ি ঝিরিগুলো হয়ে উঠে কর্মচঞ্চল। সাঁই সাঁই করে ধেয়ে চলে ঝিরির জলরাশি। স্বচ্ছ জলস্রােত যখন পা গলিয়ে চলে যায় নদীর দিকে সে জলের কোমল পরশে শরীর জুড়িয়ে যায় মুহূর্তেই। 

হামহাম জলপ্রপাত সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের গহিন অরণ্যে অবস্থিত। কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত রাজকান্দি পাহাড়ের কুরমা বনবিট এলাকার আয়তন ৭ হাজার ৯৭০ একর। কুরমা বনবিট এলাকার পশ্চিম দিকে চাম্পারায় চা বাগান, পূর্ব-দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। এই বনবিটের প্রায় ৮.৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন এই হামহাম জলপ্রপাতটির অবস্থান। কমলগঞ্জ থেকে কুরমা চেকপোস্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তা। কুরমা চেকপোস্ট থেকে চাম্পারায় চা বাগান পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার মাটির রাস্তা। সেখান থেকে আবার প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্ত এলাকায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসতি কলাবনপাড়া। সেখান থেকেই শুরু দুর্গম জঙ্গল। সেই জঙ্গলের প্রায় ৮.৫ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত হামহাম জলপ্রপাত।

শুধুমাত্র উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও প্রচার প্রচারণার অভাবে বাংলাদেশের অন্যতম এই জলপ্রপাতটি আজও রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। কেবলমাত্র দৃষ্টিনন্দন ঝরনা নয়, পথের দু’পাশের বুনো গাছের সজ্জা দৃষ্টি কেড়ে নেয় অনায়াসে। জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন ডানা মেলে দেয় হাজারো প্রজাপতি। চশমা বানরের আনাগোনা ডুমুর গাছের শাখায়। চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল। ডলু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এ বাগানগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন একরূপ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব মনকে ভালোলাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। দূর থেকে কানে ভেসে আসে বিপন্ন প্রায় বনমানুষের ডাক। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর শুরুতে দু’চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাহাড় থেকে ধোঁয়ার মতো ঘন কুয়াশা ভেসে ওঠার অপূর্ব দৃশ্য। মনে হয় যেন ওই নয়নাভিরাম পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে যাবে  কাক্সিক্ষত হামহাম জলপ্রপাতের কাছাকাছি। কিছু দূর এগোলেই শুনতে পাবে হামহাম জলপ্রপাতের শব্দ। কাছে গিয়ে দেখতে পাবে প্রায় ১৫০ ফিট ওপর হতে আসা জলপ্রপাতের সেই অপূর্ব দৃশ্য। প্রবল ধারায় ওপর হতে গড়িয়ে পড়ছে ঝরনার পানি নিচে থাকা পাথরের ওপর। পাথরের আঘাতে জলকণা বাতাসে মিলিয়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশা। চারিদিকে এক শীতল শান্ত পরিবেশ। ডানে বামে চোখ ফেরানোর উপায় নেই। কেবলই ইচ্ছে করবে তাকিয়ে থাকি সৃষ্টিকর্তার এই অনন্য সৃষ্টির জন্য। জঙ্গলে উল্লুক, বানর আর হাজার পাখির ডাকাডাকির সাথে ঝরনার ঝরে পড়ার শব্দ মিলে মিশে তৈরি হয়েছে অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ। ক্ষণিকের জন্য ভুলেই যেতে হবে কোথায় আছেন, কীভাবে আছেন! ওপরে আকাশ, চারিদিকে বন, পায়ের নিচে ঝিরির স্বচ্ছ পানি আর সম্মুখে অপরূপ ঝরনা। নিজেকে না হারিয়ে আর কি কোনো উপায় আছে?

প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির বর্ণনা যতটা সুন্দর ও লোভনীয় যাত্রাপথ কিন্তু ততটা নয়। উঁচু নিচু পাহাড় আর টিলা, বুনো জঙ্গল, পাথুরে আর কর্দমাক্ত পথ, কোথাও হাঁটু সমান আবার কোথাও কোমর সমান ঝিরিপানি। শুধু তাই নয় এই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে  প্রবল শত্রু হিসেবে পেয়ে যাবে অসংখ্য বন্য মশা মাছি এবং রক্তচোষা জোঁক। এই পথ পাড়ি দিয়েছে অথচ কেউ জোঁকের কবলে পড়েনি এমনটি ভাবা স্বপ্নবিলাস। পাহাড়ি পথ মাড়াতে গিয়ে আপনাকে ঘাম ঝরাতে হবে, পরিশ্রান্ত হতে হবে, কখনো পিছু হটতে মন চাইবে। খাদ্য আর পানীয়র অভাব তোমাকে কখনো অসহায় করে তুলতে পারে। তারপরও সৌন্দর্য পিপাসুদের অদম্য ইচ্ছার কাছে এইসবের কোনোকিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি বন রেঞ্জের কুরমা বনবিট এলাকার প্রায় ১০ কিলোমিটার গহিন অরণ্যেও এই দুর্গম দৃষ্টিনন্দন হামহাম জলপ্রপাতে সরাসরি যানবাহন নিয়ে পৌঁছার ব্যবস্থা নেই। উপজেলা সদর থেকে কুরমা চেকপোস্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তায় স্থানীয় বাস, জিপ, সিএনজি ও মাইক্রোবাসে যেতে হয়। বাকি ১০ কিলোমিটার যেতে হয় পায়ে হেঁটে। সেখান থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে সীমান্ত এলাকায় ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পল্লী। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা তৈলংবাড়ী কলাবন বস্তি থেকে পায়ে হেঁটে রওনা হতে হবে। প্রায় ৬ কিলোমিটার পাহাড় টিলা ও ২ কিলোমিটার ছড়ার পানি অতিক্রম করে ৩ ঘণ্টা পায়ে হাঁটার পর দেখতে পাওয়া যায় ১৬০ ফুট উচ্চতার এই ঝরনা সুন্দরী হামহাম জলপ্রপাতের আঙিনা।

হামহাম যাবার জন্য সাথে একজন গাইড নিয়ে যাওয়া অত্যাবশ্যক। কারণ প্রথমবার যারা যাবে তাদের জন্য রাস্তা ভুল করাই স্বাভাবিক। কলাবন গেলে গাইড পাওয়া যায়। একজনকে সাথে নিয়ে যেতে পারো। গাইডকে প্রতিজনে ২০০-৩০০ টাকা দিলেই হবে। ট্র্যাকিং করার সময় সবার হাতে একটি করে বাঁশ বা লাঠি নিয়ে যাবে। এটি  ভারসাম্য রক্ষা করতে, হাঁটতে এবং সাপ বা অন্যান্য বন্যপ্রাণী হতে নিরাপদ রাখবে। দুপুরে খাবার জন্য হালকা শুকনো খাবার নিয়ে যাওয়া ভালো। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ডেটল, নাপা, তুলা এগুলো নিয়ে নিতে পারো। বর্ষাকালে ঝরনার প্রকৃত রূপটা দেখা যায়। তবে সেক্ষেত্রে যাবার রাস্তায় কষ্টও বেশি হবে। শীতকালে রাস্তায় তেমন পানি থাকে না বলে যাওয়াটা একটু সহজ। কিন্তু শীতে অধিকাংশ ঝরনাতেই একদম পানি থাকে না। সেটা দেখাও খুব একটা সুখকর নয়।

হামহাম জলপ্রপাতে পৌঁছার পর অপরূপ নির্মল ওই সৌন্দর্যে নিমেষে জুড়িয়ে যায় পথের সব ক্লান্তি। পথের দু’পাশের বুনো গাছের সজ্জা যে-কোনো পর্যটকের দৃষ্টি ফেরাতে সক্ষম। জারুল, চিকরাশি ও কদম গাছের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন ডানা মেলে দেয় হাজারো প্রজাপতি। চশমা বানরের আনাগোনা ডুমুর গাছের শাখায়। চারদিকে গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক বাঁশবনে ভরপুর এ বনাঞ্চল। ডলু, মুলি, মিটিংগা, কালি ইত্যাদি অদ্ভুত নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ এ বাগানগুলোকে দিয়েছে ভিন্ন এক রূপ। পাথুরে পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমধুর পাখির কলরব মনকে ভালোলাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেয়।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ