হ্যালুসিনেশন
সাইন্স ফিকশন সাদ মোহাম্মদ জুলাই ২০২৪
প্রফেসর আহমদ জামীর চোখে পৃথিবীটা যেন নীল সবুজের অপূর্ব এক বিশাল বল। নীল অংশটুকুতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হলে হীরার মতো ঝলকে ওঠে কিছুক্ষণ পর তা আবার উবে যায়। মাধ্যাকর্ষণ স্তরে ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে ভাবছেন- আল্লাহ তায়ালা কী চমৎকারভাবে এ জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তিনি যে কত বড়ো বিজ্ঞানী তা বোঝা বড়ো দায়। বর্তমান বিজ্ঞানের এ মহা প্রযুক্তির যুগে হাড়ে হাড়ে তা বোঝা যাচ্ছে।
সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুরই ব্যবহার ক্ষেত্র অসীম। কোনো বস্তুরই ব্যবহার ক্ষেত্র সীমিত নয়। যদি এ নশ্বর পৃথিবীটা অবিনশ্বর হতো, তাহলে কোটি কোটি মহাকাল অতিক্রান্ত হলেও প্রতিটি বস্তুর ব্যবহার ক্ষেত্রের শেষ সীমানা খুঁজে পাওয়া যেত না। যেমন বাতাস, মানুষ কত উপকারই না গ্রহণ করে এ বাতাস হতে। আদিম যুগের মানুষ যা কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু যুগের প্রবর্তনে মানুষ এবার বাতাসের শতবিধ ব্যবহার শিখেছে। যেমন অক্সিজেনে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, কার্বন-ডাই-অক্সাইডে গাছপালা বেঁচে থাকে। এর ওপর ভর করে বিভিন্ন নভোযানের চলাচল। বিশেষ করে তরঙ্গ। যা শুধু পৃথিবীর বাতাসেই বিদ্যমান। যার ফলে শব্দ চলাচল, বিভিন্ন সংকেতের আদান-প্রদান, নানা ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এভাবে আরও কত কিছু! বর্তমানে যা কল্পনা করতে পারছি না কয়েক শতকে তা ঘটে যাবে, শুধুমাত্র বিস্তীর্ণ ব্যবহার যোগ্যতার ফলে।
জামী এখন ভীষণ একাকিত্ব অনুভব করছেন। শূন্যতায় হৃদয়টা খাঁ খাঁ করছে। ওপরে তাকিয়ে বড়ো এক নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার ভাবতে থাকেন- মানুষ এক ধরনের প্রাণী। বড়োই অদ্ভুত। একাকী থাকতে পারে না। ভাবছেন- কোনো একজন মানুষ যদি তার কাছে এখন থাকতো, বেশ আনন্দ করতেন তিনি। হোক সে অন্য দেশের, অন্য বেশের, অন্য বর্ণের কিংবা অন্য ধর্মের। ঘুরে বেড়াতেন তাকে নিয়ে। কথা না হয় নাই বললেন! এমন এক জনমানব শূন্য নিস্তব্ধ, নিথর, নির্জন স্থানে একজন স্বজাতিকে পেলে এর চেয়ে আনন্দের কী হতে পারে!
ছোটো মেয়েটার কথা খুব মনে পড়ে তার। ভীষণ মায়া মেয়েটার জন্য। স্কুলে যেতে শুরু করেছে। ফুটফুটে গোলগাল চেহারাটা বেশ মায়াবী। কণ্ঠটা ভারি সুন্দর। জামীর পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো লাগে মেয়ের কণ্ঠে মিষ্টি ‘আব্বু’ ডাকটি। ওকে একদিন দেখতে না পেলে ছটফট করে। অথচ দু’মাস হলো মেয়েটাকে দেখেন না। কলিজাটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
জামী অনুভব করেন তার চোখের কোণে ক্ষুদ্র এক বিন্দু অশ্রু জমেছে। অশ্রুটুকু মুছে ফেলেন চোখ বুজে। এরপর চোখ খুললেই দৃষ্টি চলে যায় পায়ের তলায়। সাদা রঙের কিছু একটা অনেক দূরে। খুব ছোটো, বোঝা যায় না। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন জামী। অবাক হন না। কত যন্ত্রইতো পৃথিবী হতে তার সাহায্যার্থে পাঠানো হয়। অপেক্ষা করেন যন্ত্রটার জন্য। বড়ো ও স্পষ্ট হতে থাকে। কিছুক্ষণ পর যন্ত্রটা তার সামনে এসে থামে। একটি একটি করে এর পার্টস খুলতে থাকে। জামীর গভীর মনোযোগ সেদিকে।
প্রযুক্তির এ যুগে বিস্ময়কর কত কিছুই তাকে দেখতে হয়। সবই মানুষের তৈরি, অথচ অবাক হতে হয়। এত জ্ঞান মানুষের! যা কি না প্রভুর জ্ঞানের তুলনায় কিছুই না। তাহলে এ বিশ^জাহানের স্রষ্টার কত জ্ঞান?
পার্টসগুলো খুলে ছোটো একটি মানুষ আকৃতির রূপ নেয় যন্ত্রটি। না যন্ত্র নয়, লৌজ্যাকেটাবৃত ছোটো একটি মানব শিশু। অবাক হন না জামী। অবশ্য জ্যাকেটটির মডেল তৈরি করে প্রথম দেখে নিজেই বেশ অবাক হয়েছিলেন। জ্যাকেটটিকে বের করে বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছে এর কোম্পানি। পাখি হওয়ার স্বপ্ন এবার বাস্তব।
অন্যদিকে ঘুরে থাকা ছোটো মেয়েটি ওর বাবার দিকে তাকিয়ে অসম্ভব সুন্দর একটি হাসি দেয়। এ হাসি জামীর চির পরিচিত। গবেষণাগার থেকে দু-একদিন পর ঘরে ফিরে এমন ভোলানো হাসিতে নিমিষেই মাথাটা রিফ্রেশ হয়ে যায়।
জামী যারপরনাই অবাক হন। বিশ্বাস করতে পারেন না চোখকে। এটাই তার দেখা জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ও অবিশ্বাস্য দৃশ্য। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। বা এক কথায় সোনার হরিণ। মেয়েকে কোলে তুলতে জামীর মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। চারপাশে ঘুর ঘুর করা ক্যামেরাগুলো উপেক্ষা করে ছুটতে থাকেন মেয়েটার পেছনে পেছনে। জামীর অন্তর জুড়ে বয়ে যায় আনন্দের ফোয়ারা। চেহারা হাস্যোজ্জ্বল । মুখে হাসি লেগে আছে। চিৎকার করে ডাকতে থাকেন- দাঁড়াও না মা, একটু দাঁড়াও!
কিন্তু কে শোনে কার কথা! অন্য সময়ে চললেও খেলার সময় কোনো খাতির চলবে না। যেভাবেই হোক তাকে এ খেলায় জিততেই হবে। এটাই শোভা পায় ওর দ্বারা। কিন্তু বাবার মন যে আর তর সইছে না।
জামীর ইচ্ছে হলো তীব্র গতিতে ছুটতে। সাথে সাথে যন্ত্রটিও তাকে নিয়ে ছুটতে থাকে। এবারে মেয়েটিও যন্ত্রের গতি বাড়ায়। তীব্র গতিতে মহাকাশে ছুটতে থাকে দু’জন। প্রাণপণে ছুটছে। কারও চেয়ে কেউ কম নয়। লড়াইয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। দূরত্বের পরিবর্তন নেই। পাশের ক্যামেরাগুলো তাদের সাথে ছুটতে পারছে না। পেছনে পড়ে আছে।
কন্ট্রোল রুমে সবার মুখে উত্তেজনার ছাপ। কী হয় শেষ পর্যন্ত। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সবাই। কারো মুখে কোনো কথা নেই।
এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে থমকে দাঁড়ান জামী। পেছনে তাকিয়ে মেয়েটিও থামে। হাসতে থাকে- আমাকে ছোঁয়া এত সোজা নয়। যাদের সাথে খেলি ভালো করেই তারা জানে। টেনে টেনে বলে মেয়েটি।
- আর খেলবো না মা, এদিকে এসো তোমাকে চিপস দেবো, চকলেট দেবো। লোভ লাগিয়ে বলেন জামী।
- আমি খাবো না, খেলে তুমি খাও, না হয় কাজে যাও। হাত নেড়ে বলে মেয়েটি- আজ আমি শুধু ঘুরবো।
- না। প্রতিবাদ করে বলেন জামী। হারিয়ে যাবে!
মেয়েটি হাসে।
- এ যুগে হারিয়ে যাওয়ার কোনো অপশন নেই। তুমি খামোখা আমাকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না।
- আকাশে অনেক হিংস্র পাখি উড়ে বেড়ায়, খেয়ে ফেলবে তোমাকে।
আবার হাসে মেয়েটি। এ হাসি জামীকে প্রভাবিত করে। ইতিবাচক নয় নেতিবাচক।
জামীর ভেতরের হিংস্র দানবটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। বলেন- পিটুনি দেবো তাহলে...।
মেয়েটির তাৎক্ষণিক উত্তর- আমাকে তো ধরতেই পারবে না।
এবার জামীর মেজাজ স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করে। প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে থাকেন জামী। বলেন- গুলি করবো কিন্তু! কণ্ঠে হিংস্রতা প্রকাশ পায়।
আবারও হাসে মেয়েটি। জামীর রাগ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। মাথায় রক্ত উঠে যায়। ভেতরের দানবটা গর্জে ওঠে। রক্তবর্ণ ধারণ করে চক্ষু। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন নিজের।
মেয়েটির দিকে হাত তুলেন জামী। ওর বুক বরাবর তর্জনী রেখে গুঁজে ফেলেন বাকি আঙুলগুলো। তর্জনীর গোড়ায় থাকা সুইচটি চাপ দিতেই বেরিয়ে আসে বন্দুকের নল। এক চোখ বুজে নিশানা ঠিক করেন। নিচে অপেক্ষমাণ ট্রিগারে মধ্যমা আঙুল রাখেন। জামী কামড়ে ধরে নিচের ঠোঁট। তীব্র উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে থুতনি। শ্বাস ঘন হয়ে আসে। রক্ত চক্ষু দু’টি বুজে ফেলেন।
ট্রিগারে রাখা আঙুলটি সংকুচিত হয়ে আসে। মুহূর্তেই গর্জে ওঠে বেয়নেটটি। সাথে কেঁপে ওঠে জামীর হাত। আগুনের ফুলকি নিয়ে ছুটতে থাকে জীবননাশী হিংস্র বুলেটগুলো। ধীরে ধীরে চোখ খুলেন জামী। সবকিছু এখন শান্ত। মেয়েটার দিকে তাকান। সহ্য করতে পারেন না এ বীভৎস দৃশ্য। হুঁশ হারিয়ে পড়ে থাকেন শূন্যে। নিথর দু’টি দেহ। স্তব্ধ চারিদিক শুধুমাত্র ক্যামেরা চারটি ঘুরছে নির্বাক দু’টি দেহের চার পাশে।
শোয়া হতে উঠে বসলেন জামী। চোখ কচলাতে লাগলেন। চারদিকে চোখ বুলিয়ে কিছুই ঠাওর করতে পারছেন না। এ আলোয় দিক নির্ণয় করা কষ্ট। শুধুমাত্র ভেজানো দরজার ফাঁক হতে আসা বাইরের আলো ছাড়া আলোর আর কোনো উৎস নেই। অন্তত দুটো, না একটি জানালা থাকলেও যথেষ্ট হতো। দম বন্ধ হয়ে আসছে। তড়িঘড়ি করে উঠে দরজার নিকট গেলেন জামী। বাইরে গুনগুন শব্দে কারা যেন অনবরত কথা বলেই যাচ্ছে।
ধীরে ধীরে চার-পাঁচজন লোকের সমাবেশটির দিকে এগুতে থাকেন। একটি গোল টেবিলকে কেন্দ্র করে লোকগুলো বসা। বৃদ্ধ লোক দুটোকে ছাড়া কাউকে চিনছেন না জামী। তাদের একজন জামীকে দেখে বলেন- যত দ্রুত সম্ভব আপনার পরিবারে মিলিত হোন। পরবর্তীতে সবকিছুই আপনাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
- কিন্তু আমি এখানে কেন?
- একটি পর্যবেক্ষণের জন্য আপনি মহাকাশে প্রেরিত হয়েছিলেন। আর তা হলো- মাটির সংস্পর্শ বিহীন মানুষের মানসিক অবস্থা জানা। আমরা তাতে জেনেছি- এ অবস্থায় মানুষের মানসিক অস্থিরতা ও চঞ্চলতা সৃষ্টি হয়।
আরও একটি পর্যবেক্ষণ ছিল, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার অর্থাৎ মানুষের পশুত্বকে দমন করতে পশুর গোশতের কার্যকারিতা। এতে আমরা যেটা পেয়েছি কিছুদিন পরপর মানুষকে পশুর গোশত খাওয়া উচিত। এক্ষেত্রে মুসলমানদের কুরবানির ঈদ মানুষের পশুত্ব দমন করতে অত্যধিক উপকারী এবং কার্যকরী।
জামী কোনো কথার শুরু-শেষ বুঝতে পারছেন না। শুনেই যাচ্ছেন শুধু। তার প্রশ্ন ও তাদের উত্তরের মিল খুঁজে পান না। বিরক্ত হয়ে ‘আচ্ছা, আজ তাহলে আমি আসি।’ বলে অবশেষে লিফটের সুইচে টিপ দেন জামী।
নতুন জয়েনকৃত চারজনের উদ্দেশ্যে বৃদ্ধ আবার বলতে থাকেন- উনি হচ্ছেন প্রফেসর আহমেদ জামী। এ সংস্থার সিনিয়র একজন সহকর্মী। দু’মাস যাবৎ মহাকাশে ছিলেন। সেখানে উনার খাবার হিসেবে শুধু নিরামিষ খাবারই পাঠিয়েছি। ফলে সেখানে তিনি নিষ্ঠুরতম একটি কাজ করে প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন। এরপর আমাদের ল্যাবে ব্রেইন স্ক্যান করে মানসিক আঘাতকারী সব স্মৃতি ভুলিয়ে রেখেছি। যা এক থেকে দেড় ঘণ্টা স্থায়ী রাখা সম্ভব। এর আগেই তাকে তার বাড়িতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছি। তার ছোটো মেয়েকে দেখতে পেলে আর মানসিক আঘাতটি থাকবে না। তার হ্যালুসিনেশনে মেয়েটিকে উপস্থিত করে রাগ তোলার চেষ্টা করেছি। এক পর্যায়ে নিজ কন্যাকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি।
কিশোরকণ্ঠ সায়েন্স ফিকশন লেখা প্রতিযোগিতা ২০২৩-এর পঞ্চম স্থান অধিকারী সায়েন্স ফিকশন
আরও পড়ুন...