মহানবী (সা)-এর আদর্শ

মহানবী (সা)-এর আদর্শ

বিশেষ রচনা ফেব্রুয়ারি ২০১২

ইকবাল কবীর মোহন...

মহানবী (সা)। সবার সেরা মানুষ। সকল যুগের সেরা নবী। সর্বশেষ নবী। আবদুল্লাহর পুত্র হযরত মুহাম্মদ (সা), যাকে সৃষ্টি না করলে এ দুনিয়া এত শোভা-সৌন্দর্যে কুসুমিত হতো না। সেই নবীর উম্মত আমরা। তাঁর উম্মতই শ্রেষ্ঠ উম্মত। যে মানুষটি সবার সেরা, তাঁর আদর্শ নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম। মহানবী (সা)-এর জীবনাচরণ ছিল সুষমা ও সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। দয়া-মায়া, ভ্রাতৃত্ব-ভালোবাসা, ক্ষমা-করুণা, ধৈর্য-সাহস, সততা, ন্যায়নিষ্ঠাÑএসব দিক থেকে তিনি ছিলেন সেরা। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আদর্শ। তাইতো তখন যারা তাঁকে শত্রু ভাবতো, তারাও তাঁকে পছন্দ করতো। আরবের এসব লোক মহানবী (সা)-কে আল-আমিন বলে ডাকতো। আজকের যুগেও বিধর্মী অনেক গবেষক, নেতা ও চিন্তাবিদ তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব উল্লেখ করেছেন। আমাদের প্রিয়নবীর সুন্দর ও অনাবিল জীবনের দু-চারটা অপূর্ব ঘটনা তোমাদের শুনাচ্ছি।
আরবের ইয়ামামার সর্দার সুমামা। তিনি ছিলেন ইসলামের ঘোরবিরোধী। তিনি মক্কায় এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। এতে মক্কার কুরাইশরা তার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো। তারা সুমামাকে মক্কায় খুব অপমান করলো, মারধরও করলো। এতে সুমামা যারপরনাই দুঃখ পেলেন। তখন ইয়ামামা খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার বলে পরিচিত ছিল। ইয়ামামা থেকে মক্কায় খাদ্য আসত। সুমামা তার দেশে ফিরে গেলেন। তিনি তার গোত্রের সকলকে তার অপমানের কথা জানালেন। অবশেষে সবাই মিলে ঠিক করলো তারা মক্কায় কোন খাদ্যশস্য পাঠাবে না। এতে মক্কায় খাদ্যের অভাব পড়ে গেল। তাই মক্কাবাসীরা বিচলিত হয়ে পড়লো। উপায় না দেখে মক্কার লোকেরা সুমামার নিকট মাফ চাইতে ইয়ামামায় ছুটে গেল। সুমামার নিকট তারা ক্ষমা চাইলো। তারা আবারো মক্কায় খাদ্য পাঠানোর অনুরোধ জানালো। ইয়ামামা মক্কার লোকদের এক শর্ত দিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি বিষয়টি সুরাহার ভার নবীজির ওপর ছেড়ে দিলাম। তিনি যদি অনুমতি দেন, তা হলেই আমরা মক্কায় খাদ্য সরবরাহ করবো।’
সুমামার কথা শুনে কুরাইশদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। মুহাম্মদ (সা) তাদের প্রধান শত্র“। তিনি কুরাইশদের দেবতা উজ্জার দুশমন, বাবা হোবলের শত্র“। আর এই দুশমন মুহাম্মদের কাছে তাদের যেতে হবে? তাঁর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে? তারা মহা চিন্তায় পড়ে গেল। মাথায় ঠিক কাজ করছে না। কিন্তু তাদের কাছে আর অন্য কোন উপায়ও ছিল না। তারা যে নিরুপায়। খাদ্য না পেলে মারা যাবে গোষ্ঠীশুদ্ধ। অগত্যা তারা মদিনার উদ্দেশে ছুটল। তাদের মনে অনেক ভয়। শত্র“ মুহাম্মদ কি রাজি হবে তাদের আবদার শুনতে? এভাবে ভাবতে ভাবতে মক্কার লোকেরা অবশেষে মদিনায় গিয়ে পৌঁছল। তারা নবীজির সাথে দেখা করে কুরাইশদের দুঃখের কথা খুলে বললো। কথা শুনে নবীজীর মন বিগলিত হলো। তিনি তখনই সুমামাকে খবর পাঠালেন। তিনি খাদ্য সরবরাহের ওপর অবরোধ তুলে নিতে সুমামাকে নির্দেশ দিলেন। মহানবী (সা) বললেন, একজন মুসলমান ক্ষুধাতুর মানুষের খাবার কেড়ে নেয় না, বরং ক্ষুধার্তকে  খাবার দিয়ে সাহায্য করে। মহানবীর এই মহত্ত্ব দেখে কুরাইশরা অবাক হলো।
এক যুদ্ধে জয়লাভ করে মুসলিম সেনারা মদিনায় পা রাখলেন। সাথে আছেন নবী মুহাম্মদ (সা)। তাই মদিনায় বয়ে গেল আনন্দের উতরোল। মুসলমানদের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। কিন্তু নবীজীর মুখে হাসি নেই, মনে তেমন উচ্ছ্বাস নেই। মদিনায় এসেই তিনি প্রথমে মসজিদে নববীতে গেলেন। কৃতজ্ঞতাভরে সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন সেখানে। যুদ্ধ জয়ের জন্য মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। নামাজ পড়ে সাহাবাদের সাথে জরুরি আলোচনায় বসলেন। সেখানেও খুশির কোন আমেজই ছিল না তাঁর মধ্যে। এদিকে নবীস্ত্রী আয়েশার (রা) মনজুড়ে উল্লাস। নবীজি বিজয়ের বেশে ঘরে ফিরছেন। মহানবী (সা)-কে তিনি ধন্যবাদ জানাবেন। আয়েশা (রা) তাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তার পর্ণ কুটিরে আজ আনন্দের ধারা যেন বইছে। খেজুর পাতার ছাউনিঘেরা ঘর। পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের আলো দেখা যায়। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে যেই কুটিরে সেটাকেই আয়েশা (রা) আজ সাজালেন সুন্দর করে। ছাদে সুন্দর একটি সামিয়ানা টানিয়ে দিলেন। ঘরের দেয়ালগুলো রঙিন কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। তাতে ঘরটা বেশ ঝকঝক করছে। তিনি ভাবলেন, রাসূল (সা) এসে ঘর দেখেই আনন্দিত হবেন। এক সময় নবীজী ঘরে এসে ঢুকলেন। রাসূল (সা)-এর মুখের দিকে তাকাতেই আয়েশা (রা) দেখলেন তাঁর মুখ ভীষণ গম্ভীর। আয়েশা (রা) বুঝতে পারলেন ঘরের সাজসজ্জা নবীজী পছন্দ করেননি। মহানবী (সা) আয়েশা (রা)-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেখ আয়েশা! ইটপাথরকে পোশাক পরানোর জন্য আল্লাহ আমাদেরকে দৌলত দেননি।’ আত্মসংযমের কি মহৎ নমুনাই ছিল নবীজীর চরিত্রে!
মক্কায় একবার কাবাঘর মেরামতের কাজ চলছিল। অনেকেই কাজ করছে। কেউ পাথর আনছে। কেউ পানি তুলছে। কেউবা কাঠ ফাড়াই করছে। বালক মুহাম্মদ (সা)-এর মনও এই ভাল কাজ থেকে দূরে থাকতে চাইল না। তিনি পাথর টেনে আনছিলেন। বড় পাথর। বহন করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। কাঁধে পাথর বসে গর্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তাই ভারী পাথরটা এক সময় মাটিতে পড়ে গেল। তিনি রক্তাক্ত হয়ে গেলেন। সবাই ছোট বালকের প্রতি সমবেদনা দেখাল। তারা তাঁকে পাথর টানতে নিষেধ করলো। তিনি  শুনলেন না কিছুই। তার পরনে কাপড়। সারা গা খালি। কেউ কেউ বললো পরনের কাপড়টা খুলে কাঁধে ভাঁজ করে দিয়ে প্রয়োজনে পাথর টানতে। তখন বালক-বালিকা, পুরুষ মহিলাদের উলঙ্গ হওয়া কোন ব্যাপার ছিল না। যুবক-যুবতীরা উলঙ্গ হয়ে কাবাগৃহ তওয়াফ করতো। মুহাম্মদ (সা) তাতে মোটেও রাজি হলেন না।
একজন এসে মুহাম্মদের পরনের কাপড়টা টান দিয়ে খুলে ফেললো। বালক মুহাম্মদ তো হতবাক। লজ্জায় মুহূর্তেই তিনি জ্ঞান হারালেন। তিনি লুটিয়ে পড়লেন বালুর ওপর। সবাই এ অবস্থা দেখে ব্যাকুল হয়ে পড়ল। তারা ঘাবড়ে গেল। এমন সময় একজন এসে কাপড়টা বালক মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর ছুড়ে মারল। আর অমনি মুহাম্মদ (সা) জ্ঞান ফিরে পেলেন। তাঁর চোখের পাতা নড়ে উঠল। কী অপূর্ব লজ্জাবোধ ছিল এই মহামানবের। শিশু বয়সেও তাঁর মধ্যে গভীর লজ্জাজ্ঞান ছিল।
মক্কা বিজয়ের পরের ঘটনা। মখযুম গোত্রের এক মহিলার ঘটনা। কুরাইশদের একটি সম্মানিত শাখা গোত্র এই মখযুম। অন্য গোত্রের বিচার সালিসি করে তারা। কিন্তু এখন চুরির ঘটনায় মহিলার হাত কাটা যাবার ব্যবস্থা। ইসলামী আইনে এর কোন ব্যতিক্রম নেই। এতবড় একটা মানী গোত্র। অথচ এ গোত্রের মহিলার হাত কাটা গেলে কী যে বেইজ্জতি তা সবার মনকে পীড়িত করলো। তাই তারা ভাবল নবীজীকে বুঝাবার একটা পথ বের করতে হবে। তাই তারা বেছে নিল ওসামাকে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পালিত পুত্র মুক্ত ক্রীতদাস যায়েদের পুত্র এই ওসামা। তিনি নবীজির বড় আদরের। এই ওসামাকেই আপন উটের ওপর বসিয়ে মক্কা বিজয়ের দিন শহরে প্রবেশ করেছিলেন রাসূল (সা)। সেই ওসামাই মহিলাকে নিয়ে হাজির হলেন রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট। মখযুমের লোকেরাও রয়েছে তার পেছনে। নবীজি ওসামাকে তার কথা শুনাতে বললেন। ওসামা নম্র ও বিনীতভাবে নবীজিকে বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ। মখযুম গোত্রের কথা বিবেচনা করে তাকে ক্ষমা করা যায় কি?’ নবীজি ওসামার কথা শুনে বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে তারপর ওসামাকে বললেন, ‘ওসামা! আল্লাহ যে শাস্তি স্থির করে দিয়েছেন, তুমি কি আমাকে তার ব্যতিক্রম করতে বলছো?’ ওসামা নবীজির কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন। তিনি বিনীতভাবে ক্ষমা চাইলেন মহানবী (সা)-এর নিকট। নবীজি তারপর বললেন, ‘তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ, সঠিক বিচারের অভাবে অতীতে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বড় লোকেরা অন্যায় করে ছাড়া পেয়ে যেত আর একই অপরাধে গরিবের ওপর নেমে আসত কঠোর সাজা। কেবল এ কারণে বনি ইসরাইল জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’ নবীজির কথা শুনে সাহাবারা সবাই নীরব হয়ে গেলেন। বনু মখযুম গোত্রের লোকেরাও স্থির ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। সবার নীরবতা ভঙ্গ করে নবীজি বললেন, ‘তোমরা জেনে রাখ, যার হাতে আমার জীবন সেই আল্লাহর কসম, আজ যদি আমার কন্যা ফাতেমাও এ অপরাধে লিপ্ত হতো সেও আল্লাহর নির্ধারিত সাজা থেকে রেহাই পেতো না। আমি তখনই তার হাত কাটতাম।’ ন্যায়বিচারের কি পরাকাষ্ঠাই না ছিল নবী মুহাম্মদ (সা)-এর মধ্যে।
বনু হানিফা গোত্র। দুর্ধর্ষ এক কুচক্রী গোত্র ছিল এটি। বহু অপরাধের ধারক বাহক এই গোত্রের লোকেরা। মুসাইলামার মত মিথ্যুক নবীর জন্ম হয়েছিল এই গোত্রে। এই গোত্রেরই প্রচণ্ড বিদ্বেষী ও খুনি সর্দার সুমামা ইবনুল আদাল। বহু খুনে তার হাত রঞ্জিত হয়েছে। অসংখ্য মুসলমানের সর্বনাশ হয়েছে তার হাতে। এবার সে বন্দী। তাই সবাই তার কতলের জন্য দাবি তুলল। কেননা, ইসলামের এ বড় দুশমনের একমাত্র শাস্তি হলো কতল। বন্দীকে হাজির করা হলো নবীজির কাছে। তিনি বন্দীটির দিকে তাকালেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার কি কিছু বলার আছে?’ বন্দী বললো, ‘হে মুহাম্মদ! আপনি যদি আমাকে হত্যা করেন তা হলে একজন বড় দুশমন, অপরাধী এবং হত্যাকারীকেই কতল করবেন। আর যদি দয়া করেন তা হলে আমার প্রতি অনুগ্রহ করবেন। আর তা না করে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিলে বলুন তা হলে কত মুক্তিপণ দিতে হবে?’ সুমামার কথা শুনে রাসূল (সা) চুপ থাকলেন এবং কিছু না বলেই উঠে চলে গেলেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনও একই প্রশ্ন করলে সুমামা নবীজিকে একই উত্তর দিল। এ দিনেও নবীজি আর কোন কথাই আর বললেন না। সুমামা জানত মুত্যুই হবে তার শাস্তি। এ জন্য সে প্রস্তুতও ছিল। একদিন অকস্মাৎ নবী (সা) একজন সাহাবীকে সুমামার বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে মুক্ত করে দিতে বললেন। সাহাবী সেই নির্দেশ পালন করলেন। নবীজির কাণ্ড দেখে বিস্মিত হলো সুমামা। সে মুক্ত হবে-এটা সুমামা কল্পনাও করতে পারেনি। মুক্ত হয়ে সে চলে গেল নীরবে। সাহাবারা ভাবলেন, সুমামা আবার গোত্রের লোকদের নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি নেবে। কিন্তু না একটু পরে সে ফিরে এলো নবীজির নিকট। এরই মধ্যে মদীনার উপকণ্ঠে একটি কূপ থেকে গোসল সেরে এসেছে সুমামা। এসেই নবীজিকে বিনতির সুরে বলল, ‘সত্য ধর্মের দীক্ষা দিন আমাকে।’
নবীজি তাকে ভাবতে বললেন। কিন্তু সুমামা বলল, ‘না, এখনই আমি সত্য ধর্মে ফিরে আসতে চাই।’ সে আবেগভরা কণ্ঠে জানালো, ‘এ শহর ছিল আমার কাছে ঘৃণার, আর আজ তা সবচেয়ে প্রিয়। কিছুক্ষণ পূর্বেও এ ধর্ম ছিল আমার কাছে জঘন্য, আর এখন এটা সবচেয়ে উত্তম। আর আপনার চেয়ে অধিক প্রিয় মানুষ আর কেউ নেই।’ এ কথা বলেই সুমামা ইবনুল আদাল নবী (সা)-এর পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ক্ষমার মহিমায় রাসূলুল্লাহ (সা) মানুষকে এভাবেই আপন করে নিলেন। আবৃত করলেন নিজেকে আল্লাহর দ্বীন ইসলামে। মহানবী (সা)-এর জীবনের প্রতিটি ঘটনায় তিনি উত্তম আচরণ, আদর্শ পেশ করেছেন। এ কারণেই ইসলাম হয়েছিল বিজয়ী। এ জন্যই দুনিয়াজুড়ে ইসলাম মানুষের মুক্তির দিশা হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজও এ মহান আদর্শ অক্ষত রয়েছে। আমরা মুসলমানরা সেই উত্তম আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছি বলেই আজ আমাদের এ দুর্দশা। আমরা যেন মহানবী (সা)-এর আদর্শে উদ্ভাসিত হতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দিন।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ