অদ্ভুত

অদ্ভুত

গল্প আগস্ট ২০১৪

দেলোয়ার হোসেন

Advutছট্টু মিয়া বিদেশ যাবে শুনে গাঁয়ের একদল লোক খুশি হলেও আরেক দল বড় ভাবনার মধ্যে পড়ে গেলো। কেননা ছট্টু মিয়ার সঙ্গ ছাড়া তাদের দিন কাটে না। দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানো, গল্প করা সেই ছোটবেলা থেকে। ছট্টু টেনে টুনে এসএসসি পাস করার পর আর পড়ালেখার ধারে কাছে যায়নি। ওর বড় তিন ভাই বিদেশ থাকে। ভাইয়েরা ছট্টুকে বিদেশ নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু ছট্টু রাজি হয়নি। তবে প্রতি মাসে তার নামে হাজার হাজার টাকা আসে। ছট্টু তার সাথীদের নিয়ে দেদার টাকা পয়সা খরচ করে। দরবেশ, ফকির আর ভূত তাড়ানো ওঝাদের সাথে তার ওঠাবসা। গান বাজনাও শুনে বেড়ায় এগাঁও-সেগাঁও। সংসারে কোনো কাজকর্মে তার মন বসে না। যেখানে জিন-ভূত আর পরীর গল্প সেখানেই ছট্টু মিয়া। শুধু কি তাই! শ্মশান, বিল, বড় বড় জঙ্গল এবং পড়ো ভিটায় ছট্টু ঘুরে বেড়ায়, তার মতো কৌতূহলী সাথীদের নিয়ে। নিজের চোখে ভূত, জিন পরীদের দেখার বড় বাসনা তার। কিন্তু এ পর্যন্ত ছট্টু মিয়ার সে আশা পূরণ হলো না। গভীর রাতে নির্জন পথে কালো বিড়াল, সাদা বিড়াল দেখেছে। মরা নদীর তীরে উল্কার বেগে ঘোড়া ছুটতে দেখেছে। শ্মশান ঘাটে বড় বড় দাঁত বের করা ভয়ঙ্কর শিয়াল দেখেছে। তাতে তার মন ভরে না। ছট্টু শুনেছে বিদেশী ভূত কিম্বা পরীরা বাংলাদেশের ভূত-পরীদের মতো নয়। তারা নাকি সন্ধ্যা নামলেই লোকালয়ে হেঁটে বেড়ায়। সবাই ওদের চিনতে না পারলেও কেউ কেউ ঠিকই চিনতে পারে। আর একটু গভীর রাতে পরীদেরও উড়ে যেতে দেখা যায়। পরীরা নাকি সশরীরে মানুষের সঙ্গে কথাও বলে। ভাইদের অনুরোধে ছট্টু মিয়ার বিদেশ যাওয়ার কারণ ওই একটাই। অশরীরী আত্মাদের সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা। তার ধারণা বিদেশে সবারই স্বাধীনতা রয়েছে। সে ভূত হোক আর মানুষই হোক। শিক্ষিত ভূত আর অশিক্ষিত ভূতের মধ্যে পার্থক্য তো থাকবেই। কেননা মানুষ মরেই তো ভূত হয়। তবে জিন-পরীদের কথা আলাদা। ওদের আলাদা দেশ আছে। সমাজব্যবস্থাও অন্য রকম। তবু ওরা মানুষকে ভালোবাসে। এবার আর ছট্টু মিয়া বসে না থেকে মেজো ভাইয়ের পাঠানো টিকেটে লন্ডন চলে গেলো। তার বাবা-মা ভাবলো, আমাদের ছট্টু এবার যদি মানুষ হয়। ছট্টু মিয়া যাওয়ার সময় বলে গেলো, বিদেশে ভূত আর পরীর সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত আমি আর দেশে আসবো না। একে একে তিন মাস কেটে গেলো, ছট্টুর কোনো সংবাদ নেই, ছট্টুর বন্ধুদের আর দিন কাটে না। ওরা প্রায়ই ছুটে যায় ছট্টুদের বাড়িতে। ছট্টুর বাবা-মায়ের কাছে খবর নেয়, ছট্টু কেমন আছে, ও কবে দেশে ফিরবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্ধুরাও প্রহর গুনতে থাকে, কবে ছট্টু ফিরে আসবে। ওরা বিদেশী ভূতের গল্প শুনবে। এভাবেই ছয় মাস কেটে গেলো। হঠাৎ একদিন খবর এলো ছট্টু দেশে আসছে। খবরটা পেয়ে ছট্টুর বাবা-মা তেমন খুশি না হলেও ছট্টুর বন্ধুরা খুশিতে আত্মহারা। তাদের কাছে ছট্টু একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার প্রাণ। সে কি আর সং সেজে বিদেশে পড়ে থাকতে পারে! পরদিন ছট্টুর বাবা-মা এয়ারপোর্ট থেকে ছট্টুকে নিয়ে এলো বাড়িতে। খবর শুনে গাঁয়ের ছেলেরা মৌমাছির মতো ছুটে এলো। ছট্টুকে দেখে সবাই কেমন হাঁ হয়ে গেলো। সে আর আগের মতো নেই। একেবারে সাহেব হয়ে গেছে। বন্ধুরা এ কথা সে কথা বলার পর বললো, ছট্টু ভাইয়া তুমি কি ভূতের দেখা পেয়েছো? ছট্টু বললো, পেয়েছি বলেই তো ফিরে এলাম। সে অনেক কথা। কাল সন্ধ্যায় খেলার মাঠে সবাই এসো। একে একে তিন দেশের গল্প শোনাবো। যাই হোক সন্ধ্যার পর সবাই খেলার মাঠে গিয়ে বসলো। একে একে ছট্টুর বন্ধুরা প্রশ্ন করতে শুরু করলো। কেউ বললো লন্ডন শহরে কি ভূত আছে? কেউ বললো, আমেরিকার ভূতরা দেখতে কেমন? আবার কেউ বললো, দুবাই শহরে পরীদের সাথে তোমার দেখা হয়েছে? ছট্টু হাসতে হাসতে বললো, তোরা এতো ব্যস্ত হোস না তো। একে একে সব বলছি। সত্যি আমার ভাগ্যটা ভালো। কেননা লন্ডন শহরে গিয়েই ভূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেলো। তবে সেটা বাচ্চা ভূত। ছেলেরা বললো, ছট্টু ভাইয়া তুমি একেবারে প্রথম থেকে বলো, কোথাও বাদ দিও না। ছট্টু বললো, আচ্ছা তাই হবে। লন্ডন এয়ারপোর্টে নামতেই কানে বাজলো ভূতের হিসহিস তুরু তুরু একটা শব্দ। মেজো ভাই গাড়ি করে নিয়ে গেলো তার ফ্ল্যাট বাড়িতে। হায় হায় বাড়িতো নয় যেনো রাজপ্রাসাদ। আমি বললাম, মেজো ভাই তোমরা দু’জন মানুষ এতো বড় বাড়ি কেন? বাড়িটা বেশ পুরনো তবে ভেতরটা দেখলে তা আর মনে হয় না। মেজো ভাই হাসতে হাসতে বললো, এইতো এ মাসেই উঠেছি। বাসাটা খুব সস্তায় পেয়ে গেলাম। হেসে খেলে থাকা যাবে। তো এই বাড়িতেই একেবারে জীবন্ত ভূতের সাক্ষাৎ পেয়ে গেলাম। বাংলাদেশের মতো নো ছলচাতুরী নো ভয়-ডর। সে এক অবাক করা কাণ্ড! পীর ফকির ওঝাদের ভয়ে এ দেশের ভূতরা তো গাছের ডাল নাড়িয়েই পালায় কিন্তু ওদের সে ভয় নেই। দু’দিন পর রাত দুপুরে ভাবীর হইচই শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। ভাবী বলছে, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছো, তোমার নাম কী? ভাইয়া ভাবীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়া অবাক হয়ে বলছে, তুমি কাকে কী বলছো? ভাবী বললো, ওই দেখো কী সুন্দর একটি ছেলে ডাইনিং টেবিলের ওপর বসে খেলছে। Ñ কই কোথায়? আমি তো টেবিলের ওপর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। Ñ আশ্চর্য! আমি দেখতে পাচ্ছি, কথা শুনতে পাচ্ছি কিন্তু তুমি কেন দেখতে পাচ্ছ না। এমন অবাক করা কাণ্ড দেখে মেজো ভাই ভাবীর হাত ধরে সেখান থেকে নিয়ে গেলো। আমিও আমার ঘরে চলে গেলাম। একটু পর আমিও শুনতে পেলাম একটা ছোট্ট ছেলের মন ভোলানো হাসির শব্দ। হাসির শব্দে ভাই-ভাবী দু’জনেই আবার ডাইনিং রুমে এসে দাঁড়িয়েছে, আমিও গেলাম। হাসিটা ভাইয়াও বুঝি শুনতে পেয়েছে। সবাই গেলাম ঠিকই, কিন্তু ছেলেটাকে আর দেখতে পেলাম না। ভাবী বললো, এখনি তো ছেলেটি হাসলো, গেলো কোথায়! মনে হয় কোথাও লুকিয়েছে। সবাই এ-ঘর সে- ঘর খুঁজে দেখো তো। আমার কৌতূহল বেড়ে গেলো। আমি মনে মনে বললাম, এসব তো ভূতের খেলা। এ একটা বাচ্চা ভূতের আত্মা। ভূতের হাসি যখন শুনতে পেয়েছি তখন ভূতের দেখাও পাবো। ভাবীর কথামতো সবাই ছেলেটাকে খুঁজতে লেগে গেলাম কিন্তু তাকে কি আর পাওয়া যায়! অথচ ফ্ল্যাটের সব ক’টি দরজা বন্ধ। জানালাগুলোতেও গ্রিল দেয়া। আমি বললাম, ভাবী এ বাচ্চাটা আসলে মানুষ নয় ভূত। ভূতরা হাওয়ায় ভেসে আসে আবার হাওয়ায় মিশে চলে যায়। তবে সে আবার আসবে। পরদিন রাতে ভূত ছেলেটি আবার এলো। শোকেস থেকে কাপ পিরিচ বাসন পেয়ালা বের করে ঠাস ঠাস করে মেঝেয় ফেলছে। শব্দ শুনে আবার আমরা সবাই ডাইনিং রুমে গিয়ে হাজির। লাইট জ্বেলে দেখি ভাঙা টুকরো টুকরো প্লেট বাসনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছেলেটি কাঁদছে। ভাবী বললো, আহা, তুমি কাঁদছো কেন? ওগুলো ভেঙেছে তাতে কী হয়েছেÑ কাল আবার বাজার থেকে এনে নিলেই হবে। ছেলেটি তবু কাঁদে। ভাবী বললো, তোমার কি ক্ষুধা লেগেছে? আসলে ভাবীর কোনো সন্তান নেই। ভাবী আবেগে মায়ায় ছেলেটাকে আদর করার জন্য ধরতে গেলো অমনি অন্য একটি ঘরে দৌড়ে পালালো। ধরেও ধরতে পারলো না। শেষে কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, কোথায় ভাঙা বাসন, পেয়ালা, চোখের পলকে সবকিছুই আবার ঠিকঠাক। এভাবেই এক একদিন এক এক রকম ঘটনা ঘটতে লাগলো। মেজো ভাই দু’এক জন প্রতিবেশীর কাছে ঘটনাগুলো বর্ণনা করলে তারা বলেছে বাড়িটাতে একটা প্রেত্মাতা বাস করে। সে তেমন কোনো ক্ষতি না করলেও রাতে খুব উৎপাত করে। ফলে বাড়ির মানুষ ঘুমাতে পারে না। ভাড়াটে আসে আর চলে যায়। অনেক দিন আগে ঐ বাড়িওয়ালার চার-পাঁচ বছরের একটা ছেলে ঘরে খেলতে খেলতে হঠাৎ কিভাবে আগুন লেগে ছেলেটি মারা যায়। ছেলেটির বাবা-মা অন্য জায়গায় চলে গেলেও ছেলেটির আত্মা এই বাড়িতেই থেকে যায়। বাড়িটা ভেঙে নতুন করে গড়তে চেয়েছে কিন্তু পারেনি। কারণ ছেলেটি ভয় দেখিয়েছে। ফলে আগের মতোই রয়ে গেছে বাড়িটি। এই ঘটনা শোনার পর মেজো ভাই বাড়িটা ছেড়ে দিতে চাইলো, কিন্তু ভাবী কিছুতেই রাজি হলো না। শেষে এক রাতে বাঁচাও বাঁচাও বলে ছেলেটির সে কী চিৎকার। আমরা সবাই ঘুম থেকে জেগে ছুটে গেলাম সেই ঘরে। দেখি দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছেলেটি চিৎকার করছে। এই দেখে ভাবী জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। মেজো ভাই আর আমি তখন ভাবীকে নিয়ে ব্যস্ত। একটু পরই দেখি কোথায় আগুন, কোথায় ছেলেটি। সব আগের মতোই স্বাভাবিক। অতটুকু বাচ্চা ভূতের কাণ্ডকারখানা দেখে আমারই মাথা ঘুরতে শুরু করলো। পরদিন থেকেই মেজো ভাই নতুন বাড়ি খুঁজতে শুরু করলো। পরের মাসে নতুন বাড়িতে উঠে গেলাম আমরা। ছট্টুর গল্প শুনতে শুনতে ওর বন্ধুরা বললো, ছট্টু ভাইয়া বিদেশে গিয়ে সত্যি তুমি ভূত দেখলে। কথা না হয় নাইবা হলো। ছট্টু বললো, ভূতের সাথে কথাও হয়েছে তবে লন্ডন নয়, আমেরিকায়। ছট্টুর বন্ধুরা বললো, কালো সাদা দুই-ই আছে। তবে কালোর সংখ্যা বেশি। সে কথাই বলবো। তো পরের মাসে বড় ভাই এসে আমাকে নিয়ে গেলো আমেরিকায়। দেশ যেমনই হোক, আমার কাছে মনে হলো ওটা প্রাণহীন একটা রোবটের দেশ। কাঠখুট্টা ভাব। বড় ভাই বললো, ছট্টু গাড়ি আছে ড্রাইভারকে নিয়ে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়া। কয়েকদিন ঘুরে ঘুরে আর ভাল লাগে না। শেষে ভাইয়াকে বললাম, এভাবে আমার চলবে না। আমি পায়ে হেঁটে হেঁটে শহরের কোথায় কী আছে দেখে বেড়াবো। আমি যে ভূত দেখতে গেছি সে কথা তো আর ভাইকে বলা যায় না। ভাইয়া চিন্তাভাবনা করে একদিন বললো, ঠিক আছেÑ তবে পথ হারিয়ে ফেললে অথবা ফিরে আসার অসুবিধা হলে ড্রাইভারকে ফোন করবি। ড্রাইভার তোকে নিয়ে আসবে। অনুমতি পেয়ে একদিন পায়ে হেঁটে ইচ্ছেমতো ঘুরলাম। বেশ ভালো লাগলো। কোনটা মানুষ আর কোনটা ভূত তা ঠিকমতো বোঝা গেলো না। এভাবে এক রাতে সত্যি সত্যি আমি পথ হারিয়ে ফেললাম। শেষে জায়গাটার একটা চিত্র বর্ণনা করে ড্রাইভারকে ফোন করে দিলাম। তারপর একটি ফাঁকা জায়গা দেখে বসে থাকলাম রাস্তার পাশে। হঠাৎ কোথা থেকে একটি মেয়ে আর একটি ছেলে এসে দাঁড়ালো আমার খুব কাছাকাছি। তারপর আরো দুটো মেয়ে এলো। একটি মেয়ে বসলো আমার পাশে। বাকিরা চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেলো। মেয়েটি চুপচাপ। দূর থেকে আমাকে ফলো করে দু’জন পুলিশ এগিয়ে এলো। ওরা আমার সাথে অনেক কথা বললো, কিন্তু মেয়েটিকে কিছুই বলল না। পুলিশ চলে গেলে মেয়েটিকে বললাম। কী ব্যাপার, পুলিশ তোমাকে তো কিছুই বললো না। Ñ পুলিশ আমাকে খুঁজতে আসেনি, তাই আমাকে দেখতে পায়নি। Ñ সে কী কথা! Ñ অনেক কথা। তুমি কি বারে যেতে চাও? Ñ না, আমি পথ ভুল করে এখানে বসে আছি। ড্রাইভার এসে আমাকে নিয়ে যাবে। তুমি রাতে একা একা পথে বেরিয়েছো কেন? Ñ ভূতের আবার রাত দিন। তোমার সাথে দেখা করতে এলাম। মেয়েটির কথা শুনে একবার মনে হলো এটা বুঝি ভূত। আবার ভাবলাম ভূত কি কখনো এমন হয়! ভূত হবে ভূতের মতো, কিন্তু এ দেখছি... আমি বললাম, তোমাদের শহরে কোনটা ভূত আর কোনটা মানুষ ঠিক বুঝতে পারছি না। কথা বলতে বলতে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এলো। আমি গাড়িতে উঠলাম। তারপর মেয়েটির দিকে তাকাতেই সে হাত নাড়লো, আমিও নাড়লাম। ড্রাইভার বললো, কাকে গুড নাইট বললে? Ñ ঐ যে বসে আছে ঐ মেয়েটিকে। Ñ মেয়েটি মানে ওখানে তো কেউ নেই। Ñ তুমি কি বলছো, ওখানে আমার পাশেই মেয়েটি বসেছিলো। এখনো বসে আছে। জিন্সের প্যান্ট গায়ে শার্ট। Ñ তুমি যাকে দেখছো সে মানুষ নয় ভূত! ভূত শব্দটা শোনা মাত্রই আমি চমকে উঠলাম। তাহলে সত্যি কি মেয়েটি ভূত! ভাবলাম গণতন্ত্রের দেশ সবার সমান অধিকার। আমাদের বাংলাদেশের ভূত হলে পাশে বসা তো দূরের কথা দাঁত বের করে ফিক করে হেসে নাকি সুরে বলতো, এই ছট্টু ভাগ এখান থেকে, নইলে তোর ঘাড় মটকাবো। হা হা হা। রাতে ভাবীকে বললাম, ভাবী একটা ব্যাপার দেখে আমার খুব ভোলো লাগছে। সত্যি এখানে গণতন্ত্র আছে। ভূত আর মানুষের একত্রে বসবাস। কেউ কাকে হিংসা করে না। ভাবী খলখলিয়ে হেসে বললো, তোমার মাথার মধ্যে ভূত ছাড়া কি আর কিছু নই? আমি বললাম কেন? Ñ এটা বাংলাদেশ নয়, আমেরিকা। এখানে ভূত বলে কিছু নেই। Ñ তাহলে রাতে আমার পাশে বসে কে কথা বললো? প্রথম আমিও ভেবেছিলাম সে মানুষ কিন্তু ড্রাইভার যখন বললো, তোমার পাশে কেউ নেই তখন বুঝলাম মেয়েটি কারো অশরীরী আত্মা। ভূতরা মূর্খ নয়, মানুষ থাকাকালীন যতোটুকু জ্ঞান থাকে, ভূত হওয়ার পর জ্ঞানও বেড়ে যায়, ক্ষমতাও বেড়ে যায়। তাই ওরা সবার সাথে দেখা দেয় না। ওরা ভালো-মন্দ সবই বোঝে। আমার কথা শুনে ভাবী কি বললো জানিস? ছট্টুর বন্ধুরা বললো, ভাবী কি বললো? Ñ ভাবী বললো, আমি নাকি পাগল। রাতের ঘটনাটা বড় ভাইয়ার কানেও গেলো। বড় ভাই বললো, ভূত তোকে আর মানুষ হতে দেবে না। তোকে আমি কাল-পরশু দুবাই পাঠিয়ে দেবো। ওখানে ভালো লাগলে থাকবি। তা না হলে দেশে চলে যাবি। আমি মনে মনে বললাম, সেই ভালো। তবে ভূত মেয়েটাকে আর একবার দেখতে ইচ্ছে করছিলো। এক সপ্তাহের মধ্যে দুবাই যাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলো। এক সন্ধ্যায় এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছি। দেখি রাস্তার পাশে লাইট পোস্টের নিচে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। সেই একই শার্ট প্যান্ট তার পরনে। আমি তাকাতেই ও হাত নাড়ল, আমিও নাড়লাম। ভাবী ব্যাপারটা লক্ষ করে বললো, ছট্টু তুমি কাকে টাটা দিলে? Ñ ভাবী, সেই মেয়েটি। Ñ কোথায় সে? Ñ এই যে সামনের লাইট পোস্টের নিচে দাঁড়িয়েছে। Ñ আমি তো দেখছি না। Ñ তোমার মনে বিশ্বাস নেই, তাই তুমি দেখতে পাচ্ছো না। তারপর চলে এলাম দুবাই। ছোটভাই আমাকে পেয়ে কী যে খুশি হলো তা তোদের বুঝাতে পারবো না। একদিন কথায় কথায় ভাবীকে বললাম, তুমি পরী বিশ্বাস করো? ভাবী বললো, জিন-পরীর কথা কে না বিশ্বাস করে। Ñ আমি তোমাদের এখানে কেন এসেছি জানো? Ñ বেড়াতে এসেছো। আমাদের দেখতে এসেছো। Ñ তা ঠিক। তবে এখানে আরো কাউতে দেখতে এসেছি। আমি শুনেছি দুবাই শহরে তাদের দেখতে পাওয়া যায়। Ñ কে সে? Ñ পরী। ভাবী হাসতে হাসতে বললো, যদি তাকে পাও তাহলে তার সাথেই তোমাকে বিয়ে দিয়ে দেবো। আমি বললাম, সে আমাকে একবার দেখা দিলেই আমি খুশি। অবশ্য আমি শুনেছি, অনেক আগে পরীর সাথে মানুষের বিয়েও হয়েছে। এ যুগে বিয়ে তো দূরের কথা, জিন-পরীও কতো জন বিশ্বাস করে না। যাই হোক, একদিন সমুদ্র পাড়ে ঘুরছি আর দেখছি নানা দেশের রঙবেরঙের মানুষ। যা না দেখলে বুঝানো বড় শক্ত। তারপর প্রতিদিন যাই। সন্ধ্যার পর খানিকটা হেঁটে বাসে চড়ি। ঠিক তখনই দেখতে পাই হঠাৎ কোথা থেকে যেনো অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে আসে। কোনো মেয়ের সাথেই তার মিল খায় না। গাঢ় লাল রঙের ঘাগড়া তার পরনে। চুমকি বসানোর হলুদ রঙের ওড়নার তার মাথায়। একটু নড়লেই শুরু হয়ে যায় লক্ষ তারার ঝিলিমিলি। তখন ঐ মেয়েটি ছাড়া আর কিছ্ইু চোখে পড়ে না। মনে হয় আমি যেনো স্বপ্নের দেশে দাঁড়িয়ে আছি। ছট্টুর সাথীরা গল্প শুনতে শুনতে প্রতিবাদের সুরে বললো, না ছট্টু ভাইয়া, স্বপ্নের দেশ নয় পরীর দেশে। আর ঐ সুন্দরী মেয়েটিই হচ্ছে পরী। Ñ তোরা কী করে বুঝলি? Ñ তোমার কথা শুনেই আমরা বুঝে নিয়েছি। Ñ হ্যাঁ ঐ মেয়েটিই পরী। কিন্তু প্রথম দিকে আমি বুঝতে পারিনি। Ñ বেশতো তারপর কী হলো তাই বলো। ছট্টু বললো, মেয়েটি কিন্তু কখনো আমার সাথে বাসে ওঠেনি। তবে তাকে দেখে মনে মনে ভাবি মেয়েটি কোন দেশের। একদিন রাতে কেন যেনো ঘুম আসছিলো না। শেষে চুপচুপি দশতলার ছাদে চলে গেলাম। একা একা হাঁটছি আর ভাবছি ভূতের সাথে দেখা হলো, কথাও হলো কিন্তু পরীর সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত তো দেশে ফেরা যাবে না। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। সারা শহরটাই আলোয় ভাসছে, গাড়ি ঘোড়া একেবারেই চলছে না। আকাশে সাদা সাদা মেঘের পাশ কেটে হাসতে হাসতে চাঁদ এগিয়ে চলছে পশ্চিম দ্বিগন্তে। বড় অদ্ভুত লাগছিলো সেই সময়টুকু। তখন মনে মনে বললাম, ওগো সুন্দরী পরী আমার যদি তোমাদের মতো পাখা থাকতো তা হলে আমি উড়ে যেতাম তোমাদের সেই কোকাব শহরে। তোমাদের দেখার জন্য এতো দূরে ছুটে এলাম, তুমি একবার দেখা দাও। তোমরা তো আর এখন বাংলাদেশে যাও না। বড়দের কাছে তোমাদের গল্পই শুধু শুনি, দেখতে তো আর পাই না। ঠিক তখনই দূর থেকে একটা আলো এগিয়ে আসতে দেখলাম। দেখতে অবিকল চাঁদের মতো। আমি চেয়ে আছি। হঠাৎ আলো নিবে গেলো। হঠাৎ আমার পেছন থেকে কে যেনো বলে উঠলো, ছট্টু তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছিলে? আমি পেছন ফিরে দেখি সেই মেয়েটি যে মেয়েটি সমুদ্র পাড়ে বাসস্ট্যান্ড দেখেছিলাম। আমি বললাম, তুমি কে? আগে তো কখনো দেখিনি। Ñ দেখেছো। বাসস্ট্যান্ডে দেখেছো। তিন দিন তোমার সাথে আমার দেখা হলো। Ñ তোমার শরীরে অন্য রকম পোশাক ছিলো। কথা বলতে বলতে একটু বেখেয়ালি হতেই দেখি মেয়েটি নেই। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই ঘাগড়া পরা মাথায় ওড়না দেয়া মেয়েটি। দেখেই আমার শরীরটা একটু কেঁপে উঠলো। মেয়েটি বললো, তুমি কি ভয় পাচ্ছো? আমি বললাম, এমন অবাক করা কাণ্ড দেখলে ভয় নয়, একটু চমকে তো উঠতেই হয়। তুমি কি পরী? Ñ হ্যাঁ আমি পরী। Ñ তুমি আমার নাম জানলে কী করে? Ñ তোমরা যা অসম্ভব ভাবো আমাদের কাছে তা একেবারেই সহজ। Ñ তোমার নাম কী? Ñ আমার নাম নূরী। Ñ তুমি একবার বাংলাদেশে চলো। Ñ তোমাদের দেশে মানুষ জাদুমন্ত্র জানে, পদে পদে বিপদ। Ñ এখন সেসব নেই বললেই চলে। Ñ আমি যাই, কাল রাতে ছাদে এসো। এ কথা বলেই নূরী পরী পাখা মেলে উল্কার বেগে হারিয়ে গেলো দ্বিগন্তে। আমি তখন আনন্দে অধীর। এ কথা আর বললাম না কাউকে। পরদিন রাতে আবার ছাদে যাচ্ছি, মনি ভাই বললো, রাতে আবার কোথায় যাচ্ছিস! আমি বললাম, তোমরা ঘুমাও আমি একটু ছাদে যাই। Ñ এতো রাতে একা একা ছাদে যাবি? Ñ তাতে কী হয়েছে, ছাদে তো গাড়ি চাপার ভয় নেই অথবা ছিনতাইকারীও নেই। Ñ তা না থাক তবু রাত বলে কথা। Ñ এখানে কি ভূতের ভয় আছে? Ñ এটা কি বাংলাদেশ যে ভূত থাকবে। Ñ মনি ভাই, এ দেশেও ভূত আছে বরং বাংলাদেশের চেয়ে বেশিই আছে। তবে শিক্ষিত ভূত। এদের স্বাধীনতাও আছে। মানুষের সঙ্গেই ঘুরে বেড়ায়। পরীও আছে। যে মানুষ প্রবল ইচ্ছা নিয়ে ওদের দেখতে চায় ওরা তার সাথে দেখা দেয়। আমায় কথা শুনে মনি ভাই হাসতে হাসতে বললো, ব্যস, এবার থাম। তা না হলে আমাকেই ভূতে পেয়ে বসবে। তুই যা তবে বেশি রাত করিস না। অনেকক্ষণ ছাদে বসে আছি, পরী আর আসে না। কিন্তু আমি তো জানি, পরীরা কথা দিয়ে কথা রাখে। ওরা মিথ্যাও বলে না। আমি বসে আছি। দেখি পরী আসছে। তার পরনে সাদা শাড়ি। তার চার দিকে মরীচিকার মতো ঝিলমিল ঝিলমিল করছে। মুহূর্তে মিষ্টি এক আলোয় ভরে উঠলো ছাদ। আমি আনন্দে একটা হাত বাড়িয়ে দিলাম তার দিকে। কোমল কোমল সেই হাতের ছোঁয়া এখনো আমি অনুভব করি। আমাকে বলল, তুমি কোকাব শহরে যাবে? আমি বললাম যেতে চাই, তবে আবার আমাকে এখানে রেখে যেতে হবে। Ñ তুমি একটি সুন্দর মানুষ। তোমার মন পবিত্র, তাই তোমাকে নিয়ে গেলে পরী রানী আর আসতে দেবে না। আজ তোমাকে একটা অমূল্য পাথর দেবো, গভীর রাতে নির্জনে পাথরটার দিকে চেয়ে আমাকে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলেই পাথরের মধ্যে তুমি আমাকে দেখতে পাবে। অপবিত্র অবস্থায় এই পাথর স্পর্শ করবে না। এই বলে আমার হাতে একটা পাথর দিয়ে নূরী পরী বললো, বিদায় বন্ধু! আবার দেখা হবে। পাথরটা একদিন তোদের দেখাবো। থেকে থেকে কেমন রঙ বদলায়।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ