অদ্ভুত যত কাণ্ড

অদ্ভুত যত কাণ্ড

গল্প আগস্ট ২০১২

বেগম রাজিয়া হোসাইন...
দুষ্টু দুষ্টু ভাবটা তার আজ একটু বেশিই ছিল। এমনিতেও সে সময়মতো খাবে না, ডাকলে আসবে না। ও বোঝে তা ভালো নয় তবু সে তা করবে। তার বুবু মানে দাদী তাকে খুব ভালোবাসেন। দুষ্টুমি করলেও বুঝিয়ে সুঝিয়ে হাত ধরে নিয়ে এসে খাবার দেন। সেও সম্ভবত এই অপেক্ষায় থাকে বুবু আসুক। বুবুর সঙ্গে খাবো। কিন্তু সব দিন সমান হয় না। বুবুর নামাজ, কুরআন, তসবিহ এই সবে কখনো দেরি হয়, কখনো আগেই খেয়ে নেন। কারণ তার প্রতিও সবারই তাড়া ঠিকমত খেয়েছেন কি না ইত্যাদি। আজ ইশতির বুবু বাইরে গিয়েছিলেন ডাক্তার দেখাতে। আসতে দেরি হয়েছে। এসেই ইশতিকে জিজ্ঞেস করেছেন খেয়েছে কি না। উত্তর পেলেন, না। এতে হঠাৎ বুবুর রাগ উঠে যায়। ভীষণ রাগÑ
কেন খাওনি? টেবিলে সব খাবার দেয়া। খালা তোমাকে খেতে বলেনি? আর বলবে কেন? নিজে সময় দেখে খোঁজ করে খাবে।
ইশতি নির্বিকার, তোমার সঙ্গে খাবো।
না, আমার দেরি হবে। সব কাজ বাকি। গোসল, নামাজ তারপর খাওয়া। তুমি এক্ষুনি খেতে যাও।
বুবু বাথরুমে ঢুকে যান। নামাজের জন্য তৈরি হয়ে আসেন।
তার আগে একটু উঁকি দিয়ে দেখেন ইশতি টিভির ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য বিছানায় চাদর গায়ে শুয়ে পড়েছে। এই দেখে তিনি ডাক দিয়ে বলেন, এই ইশতি ভলো হবে না কিন্তু। খেয়ে শোও। সময় নেই। টিচারের কাছে পড়তে যাবে।
ইশতি পাশ ফিরে বলে, তুমি নামাজ পড়ে নাও। এক সঙ্গে খাবো। আমি ঘুমাবো না।
বুবু সাবেরা বেগম তাড়াহুড়া করে জোহরের নামাজ আদায় করতে বসেন। তিনি প্রায় এক বছর থেকে চেয়ারে বসে নামাজ পড়েন। হাঁটু ভাঁজ করতে পারেন না। কষ্ট হয়। তাই ডাক্তার জোর করে ভাঁজ করতে মানা করেছেন। বয়স হলে শরীর যা হয়।
এতটুকু ইশতি তার কষ্টগুলো বোঝে। মাঝে মাঝে পায়ের গোড়ালিতে ওষুধ লাগিয়ে দেয়, হাতের আঙুল টেনে দেয়। সে তার ওষুধ চেনে। কখন কোনটা নেই চট করে গিয়ে নিয়ে আসবে। রাত হয়ে গেলেও দৌড়ে যেতে তার কুণ্ঠা নেই।
ও বুবুর কাছে এসেছে বছর পাঁচ হয়। এবার চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। দেখতে এই ছোট্টটি। বুদ্ধিতে পাকা। তার মা-বাবা, ভাই-বোন গ্রামে থাকে। ওরা বুবুদের একই পরিবারের মানুষ। বুবু তার প্রয়োজনে ডাক দেয়ায় ইশতি খুশি মনে ঢাকায় চলে এসেছে ‘বুবুর সেবা করতে’। ওর সেই মনটা অসাধারণ। অনেকটা লাগোয়া হয়ে গেছে বুবুর মনের সঙ্গে। তার দুষ্টুমি রাগ, দুঃখ অভিমানের সব কথা বুবুর সঙ্গে। ওর রাগ খুব বেশি। ঘরের অন্য কেউ তাকে খোঁচা দিলে, ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করলে এত রেগে যায়Ñ কথা না বলে শক্ত হয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে এমনভাবে সটান হয়ে থাকবে যে বোঝা যায় না সে কোথায় আছে। শেষ পর্যন্ত বুবু এ কোনায় ও কোনায়, টেবিলের নিচে সব দেখে তার খোঁজ না করলে আর খবর নেই। ইশতির জন্য এসব করতে বুবুর খুব খারাপ লাগে না। ঘরে আর কেউ নেইÑ এই একটি ছোট শিশু।
কোন দিক দিয়ে ঈদ আসে ঈদ যায়, স্কুল বন্ধ হয় খোলেÑ কিছু আসে যায় না। বাড়ির জন্য ইশতির পেছনটান নেই।
বুবুর এখানেই তার বাড়ি। কথা হচ্ছিলো আন্টির চাকরির সুবাদে বুবুরা বছর তিনেকের জন্য দেশের বাইরে যেতে পারে। এতেও তার খুশিÑ সেও যাবে। সবসময় বলবে এটা আমাদের, ওটা আমাদের, আমরা যাবো মানে এটা তার নিজের বাড়ি। সবকিছু ‘আমাদের’। এত সহজ আন্তরিক বলেই আঙ্কেল-আন্টি তাকে নিজের মনে করে নিয়েছে। কোনো কারণে ওদের অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে সে বারবার জিজ্ঞেস করবে, দেরি হবে কেন? আর যখন ওরা ফিরে আসে তখন তার মুখে স্বস্তির আনন্দ। অদ্ভুত এক ছেলে। অন্য কারো কথায় বা ঈর্ষায় কষ্ট পেলেও এখানকার টান তাকে বেঁধে রাখে।
এইসব কারণে বুবুর স্নেহের মাত্রা তার জন্য দিনে দিনে বাড়ছে। তার মনে কষ্ট হলে বুবুর ভীষণ লাগে।
ইদানীং ইশতির মধ্যে বেয়াড়া ভাবটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। অপরাধ প্রবণতাও কিছুটা। কোনো কোনো ব্যাপারে সে নিজকে লুকাতে চায়। সহজে অন্যের দেয়া কষ্টগুলো গ্রহণ করতে পারে না। দেখায় সে-ও বড় হয়েছে, বোঝে। ইশতির রেগে যাওয়া এবং কথা কাটাকাটির জন্য বুবু তাকে অনেক মেরেছে। মারলে বুবুর হাতে ব্যথা হয়। কারণ হাতে পুরানো ভাঙাচোরা আছে। তাই ইশতি বাজার থেকে দুটো বেত এনে বুবুর ঘরে একটি তাকে রেখে দিয়েছে। বলেছে, বুবু তুমি আমাকে এই বেত দিয়ে মারবা। হাতে মারলে তোমার ভাঙা হাতে ব্যথা বাইড়্যা যায়।
বুবু চোখের পানি চেপে রাখতে পারেন না। ইশতিকে কাছে টানেনÑ ভাই তুমি কারো কথায় রাগ করো না, দুষ্টুমি করো না, বেয়াদবি করো না কেমন?
ইশতি বুবুর চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।
অপূর্ব এক মায়ার বন্ধন। অস্বাভাবিক ও স্বতন্ত্র। সামনে রোজার ঈদ আসছে। বুবু বলছিলেন, ভাই তুমি না হয় এবার বাড়িতে ঈদ করে আস। বাবা-মা সবার সঙ্গে দেখা হবে। না বুবু আমি তোমার সঙ্গে আঙ্কেল-আন্টির সঙ্গে এখানে ঈদ করবো। তুমি আমাকে বারবার চলে যেতে বল কেন? আমি এখন যাবো না। এইট পাস করে একবার যাবো। আর বাবা-মা সবাইতো এখানেই আমাকে দেখতে আসে। এখানে আমার ঈদের আনন্দ।
একদিন স্কুল থেকে এসেই বুবুর ঘরে ঢুকে সে কী চিৎকারÑ খালা, বুবুর ঘরে মগে জগে পানি কেন? ভেজা কাপড় কেন? বুবুর কী হইছে? বুবু কি ব্যথা পাইছিল?
সাকিনা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটি কথাও বলে না।
কথা বলছেন না কেন খালা? বলেন, বুবুর কী হইছিল?
তন্দ্রা ভেঙে সাবেরা বেগম আড়মোড়া দিয়ে বলেন, কিছু হয়নি ভাই। এই পায়ের গোড়ালি ব্যথা করছিল। তাই। এটাতো পুরানো ব্যথা। শরীরে কত যে ভাঙাচোড়া!
না, না নতুন কিছু, তুমি বলছ না কেন? কাছে ভিড়ে আসে।
সাকিনা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দ্রুত হেঁটে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। বিষয়টি ছিল সাকিনা ফ্রিজ থেকে বরফ হওয়া মাছের প্যাকেট নেয়ার সময় তার হাত ফসকে  সাবেরা বেগমের পায়ের পাতায় বরফ পড়ে যায়। দু’টি আঙুলে আঘাত লেগেছে। তাই বরফ পানিতে পা ভিজিয়ে রেখেছিলেন। ইশতির তীক্ষè দৃষ্টি বুবুকে বিস্মিত করে। এমনিতেও মাঝে মাঝে ইশতি জিজ্ঞেস করে, বাতের ব্যথা বেড়েছে বুবু? তোমার শ্বাসকষ্ট হইতেছে?
আগে ও প্রায়ই কাছে ঘেঁষে বসতো। এখন একটু দূরে থাকে। বলে, বুবু আমি বড় হয়েছি কত দেখ!
ড্রেসিং গ্লাসে মাথা রেখে দাগ দেবে পেন্সিলে। আগের দাগ থেকে কতটুকু বেড়েছে দেখবে। ওর এইসব কত মজার কাণ্ড!
টিভি দেখা আর খেলাধুলা তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। লেখাপড়া করতে চায় না। স্কুলে যতক্ষণ আর বাড়িতে টিচারের সঙ্গে। এটা বুবুকে কষ্ট দেয়। তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেন, পড়াশোনা একটু না করলে কেমন হবে বল?
জোরেশোরে উত্তর দেবে, আমি তো টেকনিক্যাল পড়বো। এইট পাস করলেই হবে।
এইট তো এখন বোর্ডের পরীক্ষা ভাই। ফাইভেও বোর্ডের পরীক্ষা। তুমি খাতায় না লিখলে কি করে নম্বর পাবে? স্কুল তো নয় যে প্রমোশন বা সার্টিফিকেটের জন্য বলা যাবে।
তুমি এত চিন্তা কইরো না। আমি পারবো।
কী করে পারবে সে-ই জানে।
একদিন ভাত খেতে গিয়ে সাবেরা বেগমের নাকে উঠে যায়Ñ খাবার কিছুতেই সরাতে পারছিলেন না। বসা থেকে দাঁড়িয়ে দম নেবার চেষ্টা করছিলেনÑ অসহনীয় এক আকস্মিক ব্যাপার। এই অবস্থা দেখে ইশতি ‘ও আল্লাহগো, ও আল্লাহ গো, বুবুর কষ্ট ন্যাও। ও আল্লাহগো...’ বলতে বলতে চিৎকার শুরু করে এবং মাটিতে গড়াগড়ি দেয়। সুস্থ হয়ে এলে রক্ষা। ইশতি বুবুর কাছে ভিড়ে এসে খালাকে বলে, বুবুকে কী খাইতে দিছেন? বুবুর হাতটি নিজের হাতে নিয়ে বলে, বুবু এগুলো আর খাইও না। একটু পরে খাও।
সাবেরা বেগম হাসবেন না কাঁদবেন ভেবে পাননি।
সাবেরা বেগম ভাত খাবেন। তার আগে ইশতির খোঁজ করে জানলেন সে এখনো খায়নি। সামনে এগিয়ে দেখলেন শুয়ে আছে। ডাকতেই উত্তর দিল, তোমার নামাজ হয়ে গেছে? এত তাড়াতাড়ি জোহরের নামাজ হয়? তুমি আমার খাওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি করেছ, তাই না?
সাবেরা বেগম হাসবেন কি কাঁদবেন এবারও খুঁজে পান না। হাত ধরে টেনে বলেন, খবিশ উঠে আয়। নামাজ কি তাড়াতাড়ি পড়ার বিষয়?
ইশতি উঠে আসে, খেতেও বসে। কিন্তু অল্প ভাত নিয়ে এক গাদা ডাল নিয়ে হুড়মুড় করে খাওয়া শেষ করতে চায় Ñযা দিতে চান কিছু নেবে না।
সাবেরা বেগম বিষয়টিকে স্বাভাবিক মনে না করে তলিয়ে দেখেন কোথায় মেঘ জমেছে। হয়ত কেউ তাকে অসম্ভব কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু এতসব ভেবে দেখার ধৈর্য এখন তারও রইলো না। খাওয়ার হাতেই ইশতির গায়ে-পিঠে বেশ জোরে কিল-থাপ্পড় শুরু করলেন।
ইশতি খাচ্ছিলো। খালা তাকে অন্য খাবার তুলে দেয়Ñ
সেই কিছু খায় কিছু খায় না। অঝোরে কাঁদতে শুরু করে। হঠাৎ বলে, সরি বুবু।
সরি কেন? বুবুর শাসালো কণ্ঠ।
ইশতির ভেজা চোখÑ আমারে মারতে গিয়া তোমার ভাঙা হাতে ব্যথা পাওয়ার জন্য।
তুমি ব্যথা পাওনি?
না, তুমি মারলে আমি ব্যথা পাই না।
বুবুর কণ্ঠ মমতায় ভিজে যায়, কারও কথায় মন খারাপ করো না। নিজের কাজ নিজে ঠিকমত করবে কেমন? তুমি তো এড়ড়ফ নড়ু, বুবু, আজ থেকে আমি নিচে খেলতে যাবো না।
কেন?
আমি গরু, গাধা। গরু, গাধা কি মানুষের সঙ্গে খেলে?
এ আবার কী প্রশ্ন?
আমির ভাই আমাকে কুকুর-বিড়ালও বলে।
এবার বুবু ভালো করে বুঝতে পারেন ঘটনাটি কোথায়? খেলা ইশতির প্রাণ। সেই খেলা থেকে বিরতি বুবু ভাবতেই পারেন না। একটু রয়ে সয়ে বলেন, ঠিক আছে আমি দেখবো। সবার সব কথা ধরতে নেই।
না বুবু, আমি জানাই দিচ্ছি খেলবো না।
এতে কী হয়েছে? তুমি টিচারের কাছ থেকে পড়ে এসে খেলতে যাবে। আমি সব ঠিক করে দেব।
বুবু বারান্দা দিয়ে একজনকে ডেকে ইশতিকে খেলায় নিতে বলেন। ওদের একজন দৌড়ে ওপরে আসে।
শার্ট প্যান্ট পরে ইশতি খেলতে যাচ্ছে। যাবার আগে বুবুর আঙুল ধরে বলে, বুবু তুমি এত ভালো কেন?
বুবু হাসতে হাসতে একটু আদর করে দেন। ইশতির মুখেও সুখ-আনন্দের মিষ্টি হাসি খেলা করে যায়। এমনি তার কত ঘটনা আর অদ্ভুত সব কাণ্ড প্রতিদিন বুবুকে আন্দোলিত করে।


                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ